বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৪

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৪
ইলমা বেহরোজ

ক্যাম্প – ১ থেকে ৩০০ মিটার উঁচুতে ক্যাম্প – ২। ক্যাম্প – ২ থেকে আরো উঠে গেলে লোৎসে গিরিগাত্রে যেখানে হ্যাঙ্গিং গ্লেসিয়ারগুলো আছে, সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে পাতা হয় ক্যাম্প – ৩। সেখান থেকে সোজা উঠে বাঁদিকে যেখানে এভারেস্ট ও লোৎসে গিরিশিরা মিশেছে সেটাই বিখ্যাত সাউথ কল।ওখানে পাতা হয় ক্যাম্প – ৪।বা সামিট ক্যাম্প।এরপরদিন ক্যাম্প – ১ এ জেম্বা ও রধবি আসে।ওরা ক্যাম্প – ২ এর দিকে যাচ্ছে।ক্যাম্প ঠিকঠাক করতে।বিভোর,ধারা, প্রভাস, ফজলুল, নেমে আসে বেসক্যাম্পে।তখন কারো কোনো সমস্যা হয়নি।আরো কয়টা দিনে কেটে যায় আলস্যে।

মঙ্গলবার।ভোর থেকে আবার যাত্রা শুরু হয়।লক্ষ্য ক্যাম্প ২। বেসক্যাম্প থেকে সহজ ভাবেই উঠে আসে সবাই ক্যাম্প – ১ এ।প্র‍থম দিন এগারো ঘন্টা লেগেছে।আর আজ মাত্র ছয় ঘন্টা!রাতটা ক্যাম্প – ১ এ থেকে এরপরদিন সকাল সকাল ক্যাম্প – ২ এর পথ ধরে।সোজা দক্ষিণ – পূর্ব দিক বরাবর পথ ধরে সবাই যাচ্ছে ক্যাম্প – ২ এর দিকে।ক্যাম্প – ২ এ যাওয়ার আর কিছু পথ বাকি তখন বড় একটি ক্রিভাস পথে পড়ে।ক্রিভাস পার হওয়ার জন্য দুটো মই জোড়া দিয়ে পাতা।ধারা সাবধানে পার হয়ে যায়।বিভোর যখন পার হতে নেয় জোড়ের জায়গায় জুতার ক্র‍্যাম্পন আটকে যায়।মুখ থুবড়ে মইয়ের উপর পড়ে।বিভোর তৎপরতার সঙ্গে দু’পা ও দু’হাতে মই আঁকড়ে ধরে।ধারা চিৎকার করে বসে পড়ে।জেম্বা আপ্রাণ চেষ্টা করছে বিভোরকে বাঁচানোর।সম্ভব হচ্ছেনা কিছুতে।মইয়ে যাওয়ার সুবিধা নেই। দলের সব মেম্বার সহ অন্য দলের মেম্বাররা উৎসাহিত করছে।সবাই বলছে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “ট্রাই করুন।উঠে পড়ুন।ভয় পাবেন না। কিছু হবেনা।এইটুকু পথে এসে হেরে গেলে হবেনা।”
বিভোর কিছুতেই উঠতে পারছেনা।মই দুলছে।মনে হচ্ছে ভেঙে যাবে।হারিয়ে যাবে বরফের অতলে।ধারা নিঃশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিয়ে নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।বিভোর যখন মই থেকে ছুটে যাবে।সেও লাফ দিবে এই বড় বরফের ফাটলে।হৃদপিণ্ডটা ছটফট করছে।মৃত্যু কতটা কাছাকাছি?
বিভোরের এক হাত ছুটে যায়। ধারা ভাবে বিভোর পড়ে যাচ্ছে তাই বসা থেকে উঠে দৌড়ে বিভোরের দিকে আসার জন্য পা বাড়ায়।তখনি বিভোর চিৎকার করে বলে,
— “ধারা।এটা করোনা প্লীজ।ধৈর্য্য ধরো।কিছু হবেনা আমার।”
ধারা থেমে যায়।ওর দৃষ্টি স্হির মই এবং বিভোরের দিকে।বিভোর আপ্রাণ চেষ্টার বিনিময়ে উঠে আসে মইয়ে।পার হয় বড় একটি বিপদ।সাংঘাতিক কিছু হতে পারতো।হয়নি!বিভোর আসতেই ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে বিভোরের বুকে।এতক্ষণের স্তব্ধতা জল হয়ে বেরিয়ে আসে চোখ বেয়ে।বিভোরের মৃদু হেসে ধারার পিঠে হাত বুলোয়।আর বলে,

— “কেঁদোনা।কিছু হয়নি আমার।”
আরো কিছু সময় হাঁটার পর ওরা চলে আসে ক্যাম্প – ২ এ।এরিমধ্যে দু-তিনজনের বার কয়েক ঠান্ডায় রক্ত বমি হয়েছে।নিজেদের শেরপাদের সাহায্যে এখন মোটামুটি ভালো।রাতটা কাটানো হয় ক্যাম্প- ২ এ।৭ঃ৩০ এ বেড-টি দিয়ে শুরু হয় দিন।আজ রেস্ট ডে ক্যাম্প-২এ।এরপরদিন আবার ফিরে আসা হয় বেস-ক্যাম্পে।আরো কয়টা দিন কাটাতে হবে বেস-ক্যাম্পে।বেস-ক্যাম্পে হুট করে হাওয়ার জোর বেড়ে গেছে।ঠান্ডাটা বেশ সয়ে গিয়েছিলো।কিন্তু এখন আর সয় না।ঠান্ডায় হাত – পা কাঁপে।যখন এখানে রোদে উঠে বাংলাদেশের শীতের রাতের মতো ঠান্ডা লাগে।আর রাতে উষ্ণতা -৮ থেকে -১০ ডিগ্রিতে নেমে আসে।দিনের বেলা বয়ে চলা জলধারা রাতে হয় কঠিন বরফ।তাই রাতে এর থেকে জল পাওয়া যায়না। সকালে রধবি অন্য কুকদের সঙ্গে আধ কিলোমিটার দূরে গিয়ে খাবার জল আনে।এভাবেই চলে দিনগুলো।কেটে যায় ৬-৭ সিন।এপ্রিলের ২০ তারিখ যাত্রা শুরু হয় ক্যাম্প – ৩ এ যাওয়ার।ক্যাম্প – ২ এ এসে দু’দিন বিশ্রাম নেওয়া হয়।সকাল শুরু হয় চা দিয়ে।এরপর জেম্বা মিটিংয়ে বসে চারজন অভিযাত্রী নিয়ে।জেম্বা বললো,

— “ক্যাম্প-৩ এ ও তার উপরে চলাফেরার জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন।গরজ ও রধবি তোমাদের অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আজ আসবে।কাল আমরা উপরে উঠে যাবো।আপাতত আমার কাছে তিনটি অক্সিজেন সিলিন্ডার আছে।আমি সেটি ব্যবহার কীভাবে করে তাই শিখাবো এখন।”
জেম্বা সিলিন্ডার ব্যবহার শিখিয়ে দেয়।অভিযানের পরবর্তী ধাপ নিয়েও আলোচনা হয়।এর পরের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ খুবই কঠিন।আবহাওয়া হুট করে বদলে গেলে একসাথে অনেক অভিযাত্রী এমনকি সবার মৃত্যু সম্ভাবনা রয়েছে।বিকেলে বিভোর – ধারা ক্যাম্প – ২ ঘুরে দেখতে বের হয়।বিভোর লরাকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে ধারাকে বললো,
— “ওই মেয়েটার সমস্যা কি?”
— ” মানে?!
— ” সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখি। প্রাণ নেই একদম।এভারেস্টে যে আছে সেরকম কোনো ভাব-ভঙ্গি নেই।”
— “ওর নাম লরা।মৃত ভালবাসার মানুষকে খুঁজতে এসেছে।”
বিভোর আৎকে উঠলো।
— ” কি?”
— ” হা।এভারেস্ট জয় করতে এসে ওর বয়ফ্রেন্ড ক্রিস মারা যায় এখানেই কোথাও।কথা ছিল বিয়ে হবে এভারেস্ট জয় করে ফেরার পর।হয়নি।লরা এক বছর অপেক্ষা করেছে ক্রিসের জন্য।ক্রিস ফিরেনি।তাই খুঁজতে এসেছে।”
শেষ কথাগুলোতে ধারার গলা কাঁপছিলো।বিভোর হতবিহ্বল হয়ে যায় আশ্চর্যে।একটা মানুষ এতোটা ভালবাসতে পারে কাউকে? আচমকা বিভোরের মনে হলো সে যদি মরে যায় ধারাকি এভাবেই খুঁজতে আসবে? এমন করেই সুখ হারিয়ে যাবে ধারার? পরক্ষণেই বিভোর ভাবনাটা জোর করে সরিয়ে দেয়।এসব ভাবলে বুকটা কেমন করে।মাঝে মাঝে মন বলে আরো কয়টা দিন বাঁচতে চাই।কিন্তু স্বপ্ন পূরণ হওয়ার পথে সে অবস্থায় ফেরা যায়না।

বৃহস্পতিবার। সকাল সকাল চা খেয়ে ওরা রওনা দেয় ক্যাম্প – ৩ এর দিকে। মোরেন এলাকা পার হয়ে বরফের মরদান বরাবর পূর্বদিক চলতে থাকে বাঁদিকে এভারেস্টের ঢাল।সামনে সোজাসুজি লোৎসের ফেস।উপরে তাকালে দেখা যায় ক্যাম্প – ৩।বরফের ময়দান শেষ হলে সবাই ক্র‍্যাম্পন পড়ে নেয়।সামনে খাড়া প্রাচীর।উপরে উঠার জন্য দড়ির সাহায্য নিতে হচ্ছে।একটি লম্বা দড়ি ধরে প্রায় ৩-৪ টি দল উপরে উঠছে।ধারা বিভোরের চেয়ে পাঁচ-ছয় জন আগে।তিন ঘন্টা ধরে উপরেই উঠা হচ্ছে।দড়ি থেকে হাত ছুটে গেলে গড়িয়ে সোজা খাদে!মিনিট কয়েকের মধ্যে একজন ছুটে যায় দড়ি থেকে।অনেকে হাত বাড়িয়ে লোকটিকে ধরতে গিয়ে পারলোনা।আর্জেন্টিনিয়ান ছিল লোকটি।মুহূর্তে চোখের সামনে ঘটে যায় একটি মৃত্যু।সবার বুকের ভেতর কেমন করতে থাকে।এভাবে চলা যায়না।বিভোর দম নেয় জোরে।ভুলে যেতে হবে একটু আগের দেখা মৃত্যু।এগুতে হবে সামনে।বিভোর সামনে তাকায়।ধারার কষ্ট হচ্ছে খুব।চলতে পারছেনা।তার নিজেরই অনেক কষ্ট হচ্ছে।বুকের ভেতর নতুন ভয় উদয় হয়।ধারার হাত থেকে যদি দড়িটি ছুটে যায়? বিভোর গলার আওয়াজ বাড়িয়ে বললো,
— “ধারা।দড়ি ছেড়োনা কিন্তু।”

খাড়া প্রাচীর শেষে আসে ভয়ংকর ক্রিভাস।নিচে তাকালে বুক ধ্বকধ্বক করে।বরফের ধোঁয়া উঠছে।কোথায় এই ফাটলের শেষ চোখে ভাসেনা।চারদিকটা ভয়ংকর।একজন সাধারণ মানুষ এ ক্রিভাস দেখলে হার্ট অ্যাটাকের চান্স রয়েছে।এই ক্রিভাসের উপর দিয়ে পার হতে হবে!যেনো পুলসিরাত!এক এক করে পার হয় বারো জন।লরা এবং ধারা চিকন।দুজনের ওজন কম।তাই দুজনকে একসাথে পার হতে বলা হয়।লরা আগে ধারা পিছনে।আরেকটু পথ বাকি ক্রিভাস পথ শেষ হওয়ার।তখনি আচমকা লরা ছুটে যায় মই থেকে।ধারা লরার জ্যাকেট এক হাতে খামচে ধরে দ্রুত।মই নড়ে উঠে এদিক-ওদিক।ধারা ঝুঁকে দু’হাতে জ্যাকেট ধরে।এরপর চিৎকার করে সাহায্য চায়,
— “প্লীজ কেউ হেল্প করুন।বিভোর হেল্প।লরাকে বাঁচাও।”
জেম্বা সহ উপস্থিত সবাই হতভম্ব।কেউ মইয়ে উঠতে পারবেনা।সাহায্য করতে পারবেনা।কেউ মইয়ে উঠে লরাকে বাঁচাতে গেলে সেই ব্যাক্তি সহ লরা ধারা মই ভেঙে বরফের হিমালয়ে হারিয়ে যাবে।বিভোরের ইচ্ছে হচ্ছে স্বার্থপরের মতো বলতে,
— “ধারা ছেড়ে দাও লরাকে।নয়তো তুমি পড়ে যাবে।”

কিন্তু পারছেনা বলতে।একটা অসহায় মেয়ে ওরকম ঝুলে আছে মৃত্যুর মুখে।কীভাবে বলবে ছেড়ে দিতে?এদিকে মই নড়বড়ে।ধারাকে না হারাতে হয়!বিভোর কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।ধারা চেঁচিয়ে যাচ্ছে,
— “প্লীজ সাহায্য করো কেউ।লরাকে বাঁচাও।”
ধারার কন্ঠে কান্না!লরার মধ্যে নেই কোনো ছটফটানি।চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছে ধারার হাত থেকে কখন ছুটে গিয়ে ক্রিসের বুকে পড়বে।ধারা মাকড়সার মতো শক্ত করে ধরে রেখেছে লরার জ্যাকেট।হাত ব্যাথায় বিষে পরিণত হচ্ছে।কতক্ষণ আর পারবে?ছাড়তে তো হবেই।লরা বলে,
— “ধারা ছেড়ে দাও।তোমার জন্য একজন আছে।তাকে একা করে দিওনা।পড়ে যাবে তুমি।”
— “প্লীজ লরা চেষ্টা করো উপরে উঠার।আমি পারছিনা আর…..
লরা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো,
— ” ধারা আমাকে ছেড়ে দাও।প্লীজ ধারা। ”

ধারা পড়ে দো’টানায়।লরার শেরপা একটি দড়ি ছুঁড়ে দেয় ধারার দিকে।ধারা লরাকে ধরে রাখবে নাকি দড়িটি ধরবে?ধারা কাঁদতে কাঁদতে বলে,
— “আমি আর পারছিনা প্লীজ বাঁচাও কেউ।”
এদিকে সবাই ভাবছে কীভাবে বাঁচানো যায়।কুল কিনারা পাচ্ছেনা।ধারা দড়িটা যদি লরার হাতে ধরিয়ে দিতে পারতো তবে সুযোগ ছিল।কিন্তু সেটাও সম্ভব হচ্ছে।লরা আবার বলে,
— “ধারা ছাড়ো।পড়ে যাবে।”
— “লরা আমার কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়তে।বিভোর কই তুমি আমি পারছিনা ধরে রাখতে।ছাড়তেও পারছিনা।প্লীজ বাঁচাও।”
বিভোরের বুকটা খানখান হয়ে যাচ্ছে ধারার কান্না শুনে।লরা আবার বলে,
— “পাগলি মেয়ে ছাড়ো আমায়।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৩

— “লরা তুমি চেষ্টা করো প্লীজ।পারবে তুমি।আমার হাত দুটি অবশ হয়ে আসছে।প্লীজ।”
মইয়ের গোড়া গরগর আওয়াজ তুলে।বিভোর সহ অনেকে চেঁচিয়ে উঠে,
— “মই ভেঙে যাবে।”
বিভোর দিশাহারা হয়ে পড়ে।মুখ ফুটে বলতে পারছেনা কিছুতেই,
— “ধারা লরাকে ছেড়ে দাও।”
শুধু অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলে,
— “ধারা আমি তোমাকে ভালবাসি।”
ধারার বুকটা কেঁপে উঠে।এরকম সিচুয়েশন কেনো এলো তাঁর জীবনে?

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৫