বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৫

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৫
ইলমা বেহরোজ

কানাডিয়ান একজন লোক এগিয়ে আসেন।লোকটির মুখের চামড়া কুঁচকানো।বয়স নিশ্চয়ই অনেক।তিনি লরার উদ্দেশ্যে বলেন,
— “সুইটি তুমি চেষ্টা করো।নয়তো তোমার জন্য ওই মেয়েটার ক্ষতি হবে।”
লরা চোখ ঘুরিয়ে ধারার দিকে তাকায়।ধারার চোখে জল।ঠোঁট ভেঙে কাঁদছে।লরা দু’হাত উঁচিয়ে মই ধরার চেষ্টা করে।ধারা শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে লরাকে আরেকটু উপরে তোলে।বিভোরের বুক ধুকপুক করছে।কখন না অঘটন ঘটে যায়!লরা মই ধরতে সক্ষম হয়।ধারাকে বলে,

— “এবার ছেড়ে দাও। ”
ধারার হাত কাঁপছে ছাড়তে।লরা আবার বলে,
— “ছেড়ে দাও।একটু সরো।আমি উঠার চেষ্টা করছি।”
ধারা ছেড়ে দিতে গিয়েও পারছেনা।মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই লরা পড়ে যাবে।মনে মনে,আল্লাহর নাম স্বরণ করে চোখ বুজে লরার জ্যাকেট ছাড়ে।চোখ খুলে দেখে লরা পড়েনি।ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে।কিন্তু ঝুঁকি তো রয়ে গেছে।লরা এখনো ঝুলে আছে।ধারা উৎসাহিত করে,
— “লরা চেষ্টা করো।আমার হাত ধরো।”
লরা দু’হাতে মইয়ে চাপ দেয় উপরে উঠার জন্য।সাথে সাথে মই আওয়াজ করে দুলতে থাকে।বিভোর চিৎকার করে বলে,
— “ধারা সাবধানে থাকো।প্লীজ।”
লরার এক হাত ছুটে যায় মই থেকে।ধারা চিৎকার করে ঝুঁকে সামনে এগোতে চায় লরাকে ধরতে।লরা চিৎকার করে বলে,
— “প্লীজ নিজেকে সামলাও।”
এরপর অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না ধারা।হাত ভেঙে যাচ্ছে।আমার মৃত্যু এখানেই লিখা ছিল।”
—- “এভাবে বলোনা।চেষ্টা করো প্লীজ।”
লরা ধীরে ধীরে বলে,
—- “তুমি খুব ভালো মেয়ে ধারা।বিউটিফুল গার্ল।”
কথা শেষ করেই লরা মই ছেড়ে দেয়।ধারা চিৎকার করে কেঁদে উঠে,
— “লরা।বিভোর লরা পড়ে গেছে।বিভোর….লরা….
বিভোর সহ উপস্থিত সবার বুক ভারী হয়ে আসে।ছয় মিনিট বাঁচার যুদ্ধ করে অবশেষে হেরে গেলো আরো একজন!বিভোর এখনো আতংকে আছে।ধারাকে বলে,
— “ধারা প্লীজ কেঁদোনা।ক্রিভাস পার হও।প্লীজ রিকুয়েষ্ট।ধারা প্লীজ।”
ধারা নীচে তাকিয়ে আছে।লরাকে দেখা যাচ্ছেনা।কই হারিয়ে গেছে লরা?পড়ে গিয়ে কি মাথা শরীর ফেটে গেলো?ধারা চোখ বুজে নিঃশব্দে কাঁদে।এরপর চোখের জল মুছে ধীরে ধীরে পার হয় ক্রিভাস।বিভোর আসতেই বিভোরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।বিভোর অনুভব করে ধারার শরীর কাঁপছে।কাঁদছে ধারা!কিছুতো করার নেই।লরা চেষ্টা করেছে পারেনি।ধারাও চেষ্টা করলো পারলোনা।লরার মৃত্যু যে এখানেই লিখা ছিল!কানাডিয়ান লোকটি ধারার মাথায় হাত রাখে।ধারা তাকায়।তিনি হেসে বলেন,

— “হানি কেঁদোনা।এখন নিয়ে তৃতীয় বারের মতো শৃঙ্গে এসেছি আমি।চোখের সামনে এমন কাহিনি অনেক ঘটেছে।এমন হবেই।নিজের ইমোশনাল সামলিয়ে সামনে এগুতে হবে।লক্ষ্যের দিকে হাঁটতে হবে।জল মুছো।”
ধারা জল মুছে।লোকটি বিভোরের দিকে ইশারা করে বলেন,
— “সে তোমাকে চোখে হারায়।তাঁর জন্য নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করো।ভুলে যাও কিছু সময় আগের ঘটনা।”
ধারা বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর মৃদু হেসে ধারার চোখের জল মুছে দেয়।লোকটি বিভোরের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
— “আমি ডেমরার।তুমি আমাকে শুধু ডেম ডাকতে পারো।”
— “আমি বিভোর।”
— “বিইভর?”
— “চলবে।”
তারপর ধারার দিকে তাকিয়ে ডেমারার বললো,
— “আর তুমি?”
— “ধারা।”
— “ধেরা?”
— “ধারা।”
— “দারা?”
— “হা।”

জেম্বা তাড়া দেয়।আবার যাত্রা শুরু হয়।ধারা একবার পিছন ফিরে তাকায়।হারিয়ে গিয়েছে লরা।বুকটা হুহু করে উঠে।চোখের কার্ণিশে জল জমে।দ্রুত বিভোরের আড়ালে জল মুছে হাতের উল্টো পাশ দিয়ে।শক্ত বরফ নীলচে-সবুজ কাচের মতো হয়ে আছে চারিদিকে।আবারো পাথরের মতো শক্ত খাড়া বরফের দেয়াল।জুতোর তলায় লাগানো শক্ত ক্র‍্যাম্পনের কাঁটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরেও দেয়ালে পা আটকাচ্ছেনা।দু’তিন পা ওঠার পরেই বুক ভরে দম নিতে হচ্ছে।তাঁর উপর মাথার উপড় চড়া রোদও রয়েছে।গলা শুকিয়ে কাঠ।কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে ওরা ক্যাম্প – ৩ এ।হ্যাঙ্গিং গ্লেসিয়ারের মতো অনেকগুলো বরফের ঢিবির আশে-পাশে, উপরে-নীচে লাগানো হয়েছে ক্যাম্প-৩ এর তাঁবুগুলো।তাঁবুতে পৌছানো মাত্র জেম্বা চা বানিয়ে নিলো।ধারার বুকটা এখনো ভারী।কিছুতেই লরার ফ্যাকাসে, রক্তহীন মুখটা চোখের সামনে থেকে সরছেনা।চা খেয়ে শুয়ে পড়ে।কিছু ভালো লাগছেনা।কিছুনা!ক্যাম্প – ৩ এর উচ্চতা ৭৩০০।বাকি দিনটা বিভোর প্রভাসদের সাথে কাটায়।ধারাকে একা থাকতে দেয়।শোকটা কাটিয়ে উঠতে।রাতে ডিনার করে শুয়ে পড়ে।মাঝরাতে বিভোরের ঘুম ভাঙে প্রভাসের ডাকে।প্রভাসের অসহ্য রকম শ্বাসকষ্ট হচ্ছে হুট করে।বিভোর জেম্বাকে ডেকে তুলে।জেম্বা প্রভাসকে অক্সিজেন লাগিয়ে দেয়।এতে কিছুটা আরাম হয় প্রভাসের।

এরপরদিন সকাল সাতটায় সবাই বেরিয়ে পড়ে।ক্যাম্প – ২ এ নেমে যাওয়ার জন্য।তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।কিন্তু সেই ভয়ংকর ক্রিভাসটি পার হওয়ার পথে ধারার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থাকে।যদি লরার দেখা মিলে!মিললো না দেখা।ক্যাম্প-২ এ ছিল রধবি।সে জুস করে দেয়।জুস খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ক্যাম্প ১ এ আসে।এরপর আবার ক্যাম্প-১ থেকে হাঁটা।কোনো বিশ্রাম নেই।খুম্বু আইস ফল জোনের কাছে এসে দেখলো তুষারস্তূপ ভেঙে ভেঙে পড়েছে,তার ফলে পালটে গেছে পথ।এস পি সি সি নতুন পথ তৈরি করেছে।বেসক্যাম্পে পৌছানো হয় বিপদ ছাড়াই।বেসক্যাম্পে সব ঠিক আছে।হারিয়েছে তিনজন মানুষ।অসুস্থ হয়েছে চারজন।এছাড়া সবাই সুস্থ আছে।রাতে শুরু হয় ভীষণ তুষারপাত। বিভোর ধারাকে বুকের সাথে চেপে রেখেছে।ধারা কথা বলছেনা।এখনো ভুলতে পারছেনা লরাকে।বিভোর কৌতুক বলা শুরু করে।একসময় ধারা হাসে।বিভোরের বুকটা হালকা হয়। কেটে যায় আরো অনেকগুলি দিন।এর মধ্যে খবর আসে নর্থ কল দিয়ে যাওয়া অভিযাত্রী পাঁচপজন মারা গিয়েছে।৬-৭ জন অসুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে।

৮ মে শুরু হয় চূড়ায় পৌঁছানোর যাত্রা।যাত্রার শুরুতে যে যার মতো পূজো করে,নামায পড়ে।আবার বেসক্যাম্পে আসা হবে নাকি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা।ক্যাম্প ১-২ পার হয় সুস্থ ভাবে।ক্যাম্প -৩ এ উঠতে কষ্ট হয়।শক্ত দেয়ালের জন্য।রাতটা ক্যাম্প – ৩ এ থেকে এরপরদিন হাঁটা শুরু হয় ক্যাম্প – ৪ এর দিকে।ক্যাম্প তিনের বাঁদিকে দড়ি লাগানো হয়েছে। সেই দড়ি ধরে একের পর এক অভিযাত্রী চলেছে স্বপ্নের লক্ষ্যে। এরমধ্যে প্রভাস এসে বিভোরকে বললো,
— “ভাই পেট গুড়গুড় করছে।”
বিভোর হেসে এদিক-ওদিক তাকায়।আশেপাশে বসার জায়গা বলে কিছু নেই।একদম খোলামেলা এলাকা। চারপাশের লোকজন। এক পাশে নিচু ঢাল দেখে বিভোর বললো,
— “ওই দিকে যাও।”
প্রভাসস ঢাল দিয়ে নামতে গিয়ে দেখে অতলান্ত ক্রিভাস। ভয়ে পেট আবার গুড়গুড় করে উঠে।চলে আসে।বিভোর বলে,
—- “শেষ এত জলদি?”
প্রভাস মুখ গুমোট করে বলে,
— “ক্রিভাস ওদিকে।ভয়ে আত্মা কেঁপে উঠছে।প্রকৃতির ডাক আর শুনতে পাচ্ছি না। ”
বিভোর হেসে বলে,
— “ভয়ে আপনা-আপনি চাপ হালকা হয়ে গেলো?”
প্রভাস হাসে, সাথে বিভোর।কথাগুলো ধারার কানেও আসে।

সবাই অক্সিজেন ব্যবহার করে সামনে এগোচ্ছে।অক্সিজেন ছাড়া নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছেনা।বাঁ পাশে সরে রোপে জুমার লাগিয়ে অন্যান্য অভিযাত্রীদের সঙ্গে শামিল হয় আরোহণে। টানা চড়াই। এরপর বাঁদিকে আড়াআড়ি চলা।পাহাড়ি ভাসায় একে বলে ট্রাভার্স করা। অনেকটা আড়াআড়ি চলার পর একটা হলুদ পাথরের দেয়াল আসে। এর নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সবাই।এটার নাম ইয়েলো ব্যান্ড।আজ আর আলাদা করে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে না। একই দড়িতে আগে পরে অনেক ক্লাইম্বার।মাঝেমধ্যেই বেশি কষ্টকর জায়গায় কেউ না কেউ দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। স্বভাবতই পিছনে লোকেরাও দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হচ্ছে বিশ্রাম নিতে হচ্ছে। তবে কেউ অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছে না। তাড়া দিচ্ছেনা জোরে চলার জন্য বা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইছে না। ধৈর্যের পরীক্ষা চলছে।এ পথে চলতে গেলে এরকম হওয়া খুব স্বাভাবিক। এর নাম হিউম্যান ট্র্যাফিক জ্যাম।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৪

কিছুটা এগোনোর পর দেখা মিলে মন খারাপ এক দৃশ্যের।একজন শেরপা মৃত দেহ নামাচ্ছে। যে দড়ি ধরে উঠা হচ্ছে সেই দড়ি দিয়েই নামানো হচ্ছে।জিজ্ঞাসা করে জানা গেলো লোকটির অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিল।এ পথে কেউ মারা গেলে তার মৃতদেহটা আবর্জনা হিসেবে ধরা হয়।আর সেটা নামিয়ে আনতে হয়।সেই আবর্জনা পরিষ্কার করার চার্জ আছে।চার্জ ২০০০ মার্কিন ডলার।ধারার মনটা খারাপ হয় খুব বাজে ভাবে।তার মতোই এক অভিযাত্রী।ভালবেসে এসেছিল এভারেস্ট জয়ের জন্য।কিন্তু আর বাড়ি ফিরলোনা।ভাবতেই,চোখে ভেসে উঠে, মা,বাবা,তিন ভাই, ফুফি,দিশারি সবাইকে।আর কি দেখা হবে?
সাউথ কল পৌঁছাতে আর পনেরো মিনিট বাকি। বিভোরের অক্সিজেন শেষ হয়ে আসে।সিলিন্ডার চেঞ্জ করে দেয় গরজ।তখন বিভোরের হুট করে খেয়াল হয় ,তার অক্সিজেন অন্যদের তুলনায় খুব দ্রুত শেষ হচ্ছে।কিন্তু কেনো?চলবে তো ফেরা অবধি?আতংকে চোখ-মুখের রং পাল্টে যায়।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৬