বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৬

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৬
ইলমা বেহরোজ

দুটো শৃঙ্গের মাঝে কোন নিচু সমতল জায়গা থাকলে তাকে ‘কল’ বলে। সাউথ কল হলো এভারেস্ট আর লোৎসের মাঝের নিচু জায়গা। উচ্চতা ৭৯৫৫ মিটার।কালো পাথর আর বরফের এক ময়দান, অনেকটা সমতল। এভারেস্টের দক্ষিনে আছে বলে এর নাম সাউথ কল। দুটো পাহাড়ের মধ্যে অনেকটা নিচু খাঁজ থাকলে তাকে বলে ‘পাস’। পাস আর কলের মধ্যে ফারাক হল পাস অনেকটা নিচে যা মূলত এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলের যাতায়াতের জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন খাইবার পাস, নাথুলা পাস ইত্যাদি। আর কল সাধারণত অনেক উঁচুতে হয় যেখানে পৌঁছাতে গেলে পর্বতারোহণ জরুরী।সাউথ কলে ওরা চলে এসেছে।অনেক তাবু চারিদিকে।তবে জায়গাটা বেশ নোংরা। চারপাশে পুরনো ছেঁড়া তাবুও অন্যান্য আবর্জনা পড়ে আছে। এখানে ওখানে খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার স্তুপ করে রাখা। মনে হচ্ছে একটা নোংরা বস্তি।ধারা অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে বিভোরকে বললো,

— “এতো নোংরা কেন?”
বিভোর জবাব দিল,
— “পরিষ্কার করার জন্য এতো উপরে কেউ আসেনা তাই।”
শরীর প্রচন্ড ক্লান্ত। তাবুতে এসেই শুয়ে পড়ে সকলে।আজ এখানে থাকা হবেনা।কারণ রাতেই বেরোতে হবে শৃঙ্গারোহণের উদ্দেশ্যে। এখানকার উচ্চতা ৭৯৫৫ মিটার।প্রায় আট হাজার মিটারে আছে ওরা।আট হাজার বা তার চেয়ে উঁচু এলাকাকে বলে ডেথ জোন। মৃত্যু যেকোনো সময় এসে ছোবল মারতে পারে, তাই যতটা সম্ভব কম সময় এসব এলাকায় থাকতে হয়। জেম্বা গরজ ব্যস্ত হয়ে পড়ে খাবার তৈরিতে। প্রথমেই চা।তাঁবুর কাছে রান্নার জায়গা বানিয়ে নিল।গ্যাস জ্বালিয়ে পাত্রে আইস চাপিয়ে দিল চায়ের জল বানানোর জন্য। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট। অল্প পরে স্যুপ।গরজ বাইরে থেকে ঘুরে এসে জানালো, তাদের দল নিয়ে আরও মোট সাতটা দল এসেছে আজ সাউথ কলে। একটাই মাত্র দড়ি টাঙানো আছে আরোহনের জন্য।তাই সবাই একসঙ্গে বেরোলে চলবে না। শেরপারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে কে কখন বেরোবে তা ঠিক করে নেয়। সে কারণে দড়ি ধরে চলার সময় একই জায়গায় ভীরর হয়ে যায় না।এটাই চল।
জেম্বা কথায় কথায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— “এইটুকু পথে অনেকজন মারা পড়েছে এভারেস্টের দু’পথেই।এরকমটা হয়না অন্যবছর।এতজন এতো দ্রুত মারা যায়না।এবার যে কি হচ্ছে…”
জেম্বার কথা শুনে ধারা বিভোরের চোখের দিকে তাকায়।বিভোর বুঝে ধারা তাকিয়েছে।তবুও তাকালোনা।বিকেলে বিভোর তাঁবু থেকে বের হয়। সামনে উত্তর-পশ্চিম দিকে দেখা যায় এভারেস্ট। একদমই অন্যরকম লাগছে এখান থেকে দেখতে।
এভারেস্টের প্রতি আকর্ষণ টা দ্বিগুণ মনে হচ্ছে।কতটা কাছে এভারেস্ট!স্বপ্নের এভারেস্ট!

পরিকল্পনামাফিক রাত সাড়ে সাতটায় সবাই তৈরি হয়।আর দশ – বারো ঘন্টা তারপরই গন্তব্য!এভারেস্টের চূড়া!ভাবতেই গায়ে শিরশিরি অনুভব হচ্ছে।বিভোর ধারার দিকে একবার তাকায়।ধারার মাথায় হেড-টর্চ,কোমরে হারসেন,স্লিং,ক্যারাবিনার এবং হাতে জুমার।কি দারুণ লাগছে দেখতে।ধারার চোখে পড়ে বিভোরের চাহনি।ধারা হাসে।গেঁজ দাঁতগুলো ঝিলিক দেয় অন্ধকারেও।বিভোর ও হাসলো।এরপর বেরিয়ে পড়ে।কিছুটা এগিয়ে এসে পেল দড়ি। এই দড়ি পর্বতগাত্র সংরক্ষিত অবস্থায় বাঁধা আছে শীর্ষ পর্যন্ত। যাকে বলে ফিক্সড রোপ।হারনেসে লাগানো ক্যারাবিনার এই ফিক্সড রোপের সঙ্গে জুড়ে নেয় সবাই। হাতের জুমার লাগিয়ে নেয় দড়ির গায়ে। এবার সবাই সুরক্ষিত। সামনে পিছনে তাকালে অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ছে। শুধু ছোট ছোট টর্চের আলো। আর বাকি সব ঘুটঘুটে কালো।যেন গ্রামে ডাকাত পড়েছে আর সবাই টর্চ জ্বালিয়ে ডাকাত খুঁজতে বেরিয়েছে।
উঠতে উঠতে একসময় ওরা দেখে দড়িটা শক্ত বরফ প্রাচীরের গভীরে হারিয়ে গিয়েছে। টেনে হিঁচড়ে যতটা বার করা সম্ভব বের করে ওই দড়ি বেয়ে আরো কিছুটা উঠে বুঝতে পারলো মারাত্মক ভুল হয়ে গিয়েছে। এটি নিশ্চয়ই আগে কোন বছরের লাগানো দড়ি।দড়ির বাকি অংশের উপর প্রচুর বড় চাপা পড়ে গেছে।কঠিন আইসের নিচে হারিয়ে গেছে তা।টেনশন হতে লাগলো।এখান থেকে নামার ও সুযোগ নেই।উঠারও সুযোগ নেই!কি হবে?না ফেরা যাবে বাড়ি না চড়া যাবে এভারেস্ট চূড়া।জেম্বা বললো,

— “সাবধানে দাঁড়াও আমি দেখছি। ”
জেম্বা সাবধানে চলে যায় আসল দড়ি খুঁজতে।বিভোর এক হাতে ধারাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।চোখে ভেসে উঠে মায়ের মুখ।ঢাকা থেকে বাড়ি যাওয়া হবে শুনেই মা নামক মমতাময়ী মানুষটা দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন। কখন আসবে তাঁর বিভোর।বিভোর দরজার সামনে যেতেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন বুকে।গাল ভরিয়ে দিতেন চুমুতে চুমুতে।মায়ের মুখটা আবার দেখা হবে!বিভোর দ্রুত মাথা ঝাঁকায়।কিসব ভাবছে সে!কিছুক্ষণ পরে জেম্বা ফিরে আসে।আসল দড়ি পাওয়া গেছে।কিন্তু এই দড়ি ছেড়ে কীভাবে ওই দড়ির সঙ্গে যুক্ত হবে ওরা?বেশ কিছুটা পথ রোপহীন ট্রাভার্স করতে হবে। আর এটা ঝুঁকি। পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।পড়ে গেলে একদম খাদে।খাদ মানে নিশ্চিত মৃত্যু।৩-৪ জন শেরপা মিলে দড়িটি টেনে কাছাকাছি নিয়ে আসে।এরপর এক করে সবাই ওই দড়িতে পার হয়।শুরু হয় যাত্রা।খাড়া পথ, এই পথের শেষ ঘটবে স্বপ্নের চূড়ায়।অনেক পর্বতারোহী জীবনের শ্রেষ্ঠ বাসনা পূরণের জন্য এই পথে চলেছে।হাওয়া নেই, তবে কনকনে ঠান্ডা।তাপমাত্রা মাইনাস তিরিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। একটু দাঁড়ালেই ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে।শক্ত বরফের দেয়ালে পায়ের জুতার ক্র‍্যাম্পন সজোরে মেরে ধীরে ধীরে উঠছে সবাই।একই দড়ির বন্ধনে সম্পর্কিত দু’টি দলের পর্বতারোহী।

কেটে যায় চার ঘন্টা।শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে।এভারেস্ট চূড়া পৌঁছানোর আর মাত্র কয়েক ঘন্টা।এই রাত জীবনের ১৮০ ডিগ্রি মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।কিন্তু,কিছুক্ষণ যাবৎ হাওয়া হচ্ছে খুব।জেম্বার মুখটা শুকনো।এতোটা এসে নেমে যাওয়াটা কষ্টকর।হাওয়া বেড়েই চলেছে।জেম্বা বলে,
— “আমাদের নেমে যেতে হবে।”
ফজলুল চিৎকার করে উঠে,
— “কি বলছো?আর কয়টা ঘন্টার পথ।আর নেমে যাবো?”
জেম্বা বলে,
— “আর এ’ঘন্টা উঠারও অবস্থা নেই।আবহাওয়া উল্টে গেছে।”
— “এই আবহাওয়ায় যেতে পারবো।”

জেম্বা কি বলবে বুঝতে পারছেনা।আতংকে কলিজা কাঁপছে।আবহাওয়ার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সর্বনাশা কিছু হতে চলেছে।এমন আবহাওয়া তো মে মাসে হওয়ার কথা নয়।এমনকি সাউথ কল থেকে যাত্রার শুরুতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে আজকের আবহাওয়া ভালো।হুট করে কি হলো?এরি মধ্যে স্যাটেলাইট ফোনে কল আসে।গরজ দ্রুত রিসিভড করে।ওপাশ থেকে স্পষ্ট ইংলিশে ভেসে আসে,
— “শুনতে পাচ্ছেন?শুনতে পাচ্ছেন? আবহাওয়ার অবস্থা খুবই খারাপ।নেমে আসুন।দ্রুত নেমে আসুন।খুব দ্রুত খারাপ কিছু হতে চলেছে।নেমে আসুন।দ্রুত, দ্রুত।”
জেম্বা ঘুরে যায়।বাকি শেরপারাও।দ্রুত নেমে যেতে হবে।বিভোর হতবাক!নামতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।বিভোর জেম্বাকে বলে,
— “ধারাকে নিয়ে যাও জেম্বা।”
ধারা চোখ বড় বড় করে তাকায়।বলে,
— “আমি তোমাকে ছাড়া কিছুতেই নামবোনা।”
জেম্বা বলে,

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৫

— “বেভোর চলো।এমনটা হওয়ার কথা ছিলনা।হুট করে আবহাওয়া যখন উলটে গিয়েছে আমাদের ফিরতে হবে।জানিও না ফিরতে পারব কিনা।কিন্তু বাঁচলে আবার আসা যাবে।”
অগত্যা বিভোরকেও নামার জন্য ঘুরে দাঁড়াতে হয়।পাশে কোথাও আওয়াজ হয় জোরসে।বরফ ধসে পড়েছে!পায়ের নীচের বরফেও কাঁপুনি।কি হতে চলেছে?আবারো স্যাটেলাইট ফোনে কল আসে।ফোন থেকে ভেসে আসছে আতংকিত কন্ঠস্বর,
— “যত দ্রুত সম্ভব নেমে পড়ুন।আবহাওয়ার বলছে,ঘন্টায় হাওয়ার গতিবেগ ২৮০-৩৮৫ কিমি পর্যন্ত যেতে পারে।খারাপ কিছু হতে চলেছে।দ্রুত।দ্রুত…..
বুকে হাতুড়ি পেটা চলছে সবার।অসহায় মনে হচ্ছে।বরফের হিমালয় একি তাণ্ডব শুরু করেছে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৪৭