বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৬

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৬
ইলমা বেহরোজ

ভারতীয় বর্ডারে ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ জনপ্রতি ১০০ রুপিতে করে নেয়।দুই বর্ডারের কার্যক্রম শেষ হলো।
এবার যেতে হবে শিলিগুড়ি।রিজার্ভ ট্যাক্সিতে মোটামুটি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৫০০ রুপি। শেয়ারে গেলে জনপ্রতি ২০০ রুপি।আর ১০ সিটের জিপে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে ১৫০ রুপি।বিভোর সায়নকে জিজ্ঞাসা করলো,
——-“জিপ?না ট্যাক্সি?”
সায়ন নবাবি চালে বললো,

——-“দশ সিটের জিপ নে।টাকা আমার!”
দিশারি,বিভোর দেড় মিনিট নাগাদ সায়নের দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর ব্যপারটা গিলে নেয়।বিভোর সামনে আগায়।পাঁচ মিনিটের মধ্যে জিপ নিয়ে আসে।মেয়েরা আগে উঠে যায়।সায়ন বিভোরকে টেনে পাশে এনে ফিসফিসিয়ে বললো,
——-“কত রুপি দিতে হইবো?”
বিভোর দায়সারাভাবে বললো,
——“১ হাজার ৫০০ রুপি।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

বিভোর ড্রাইভারের পাশে বসলো।পিছনের সিটে সায়ন আর ঊর্মি।সামনের সিটে দিশারি আর ধারা।
জিপ শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো দুপুর ১১ টায়।পৌঁছাতে লাগবে মোটামুটি ৩ ঘণ্টার মতো।
আকাশ একদম পরিষ্কার।সাদা-নীলে উড়ে বেড়াচ্ছে মেঘেরা।কি মোহনীয়।দার্জিলিংয়ের শরৎকালের ফ্লেভার শিলিগুড়িতেই পাওয়া গেল।নভেম্বর মাসে দার্জিলিং শরৎকাল!
পিছন থেকে ঘষাঘষির আওয়াজ আসছে।দিশারি মাথা ঘুরিয়ে তাকায়।দেখে,সায়ন ঊর্মিকে চুমু দিচ্ছে।দিশারি ঝাঁঝালো স্বরে বললো,
——“হোটেলে গিয়া ঘষাঘষি করিস।এইখানে না কইরা।”
ঊর্মি কাঁচুমাচু হয়ে বসে।সায়ন ভ্রু কুঁচকে বললো,

——“তোর সমস্যা কি? আর ঘষাঘষি কি? ভালবাসা হচ্ছে।”
——“বালের ভালবাসা।”
——“তুই এতো বাল বাল করোস ক্যান?” সায়নের ধমক।
দিশারি আঙ্গুল শাসিয়ে বললো,
—–“তোর সমস্যা?সমস্যা হলে নেমে যা গাড়ি থেকে।”
ধারা ওদের ঝগড়া ভারী এনজয় করছে।বিভোরও মুচকি হাসছে।সায়ন,দিশারি সবসময় ঝগড়া করে।একসাথে হলেই সাপে-নেউলের সম্পর্ক হয়ে যায়।
বিভোর গাড়ির আয়নায় তাকায়।ভেসে উঠে ধারার মুখ।দিশারি-সায়নের দিকে তাকিয়ে সে হাসছে।গঁজ দাঁত ঝিলিক দিচ্ছে।চোখ দুটিও যেনো হাসছে।
অসাবধানবশত ধারার চোখও পড়ে আয়নার উপর।এক জোড়া চোখ তাকেই যেনো দেখছে।বিভোর দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়। কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে ভাবতে থাকে,

——-“ইশ!এখন নিয়ে দুইবার দেখে ফেললো।কেনোই বা তাকাচ্ছি?”
ধারার হৃদপিণ্ডে ধ্রিম ধ্রাম করে কিছু বাজতে থাকে।জানালার বাইরে তাকিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে।
শিলিগুড়ির দার্জিলিং জিপস্ট্যান্ডে পৌঁছালো ওরা দুপুর ২টার দিকে।বিভোর আরেকটা জিপ রিজার্ভ করলো।জনপ্রতি ২৫০ রুপি।পাঁচ জনের বড় তিন টা ব্যাকপ্যাক আর দুইটা লাগেজ আছে।জিপের ছাদে রেখে দেওয়া হয় ব্যাগপ্যাক আর লাগেজ।সবাই উঠে বসে।
জিপ ছুটতে শুরু করে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে।জিপ মিনিট পঞ্চাশ যাওয়ার পরই দূরে চোখে পড়ল সুউচ্চ পাহাড়।এই পাহাড়ের গাঁ বেয়েই জিপ উপরে উঠতে শুরু করলো।পাহাড়ি রাস্তা যথেষ্ট মসৃণ,আঁকাবাঁকা।

ধারা মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে।জানালা দিয়ে বাতাস আসছে।চুল করে দিচ্ছে এলোমেলো।ভেতরটা আনন্দে লাফাচ্ছে।বিভোর,ধারা,সায়ন,ঊর্মি,দিশারি পাঁচ জনই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে উপভোগ করছে পাহাড়ি বাতাস,পাহাড়ি সৌন্দর্য!
বিভোর দিশারির পাশে বসেছে।আরেকবার ধারাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে বিভোরের।আড়চোখে সে তাকায়।দিশারি, ধারা গল্প করছে।ধারা দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসছে।চুল উড়ছে।চোখও যেনো হাসছে।ধারা কিছু সেকেন্ডের জন্য বাইরে তাকায়।সেই মুহূর্তের ধারা পুরোপুরি মিলে যায় বিভোরের আঁকা মানবীর সাথে।বিভোরের দু’ঠোঁট নিজেদের শক্তিতে আলাদা হয়ে যায়।চোখ সরিয়ে বাইরে নিক্ষেপ করে।মনে হলো,বিভোর যেনো হালকা হাসলো।
ধারা মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছে।যখন ধারা দেখলো রাস্তার বাঁ পাশে,ডান পাশে কোনো রেলিং বা প্রাচীর নেই।ভয়ে আৎকে উঠে দিশারির হাত চেপে ধরে।মিনমিনিয়ে করুণ গলায় বললো,

——“আপু,রেলিং প্রাচীর কিছু নাই রাস্তার পাশে।গাড়ি এদিক-ওদিক হলেই ঝপাৎ করে গাড়ি সহ আমরা নিচে পড়ে মরে যাবো।”
দিশারি তাকায় বাইরে।সত্যি তাই।দিশারি ভয় পেয়ে যায়।পাহাড় বরাবরই ভয় পায় দিশারি।তার উপর পাহাড়ের উপর গাড়ি চড়ছে।পড়লেই নির্ঘাত মৃত্যু। বিভোরের হাত চেপে ধরে বলে,
—–“বিভোইরে আমি নাইমা যামু।নামায় দে….
বিভোর কপাল কুঁচকে তাকায়।ধমকে বললো,
—–“হাত ছাড়!ঘষাঘষি করবিনা।”
দিশারি হাত ছেড়ে একটু দূরে বসে।কোনো মেয়ে খামচে বা চেপে ধরুক হাত এমনটা বিভোর পছন্দ করেনা।দিশারি আবার আর্তনাদ করে বললো,

——‘পইড়া গেলে মইরা যামু।নামাই দে….
বিভোর কপট রাগ নিয়ে ড্রাইভারকে বললো,
——“ভাই নামাই দেন।”
—–“হ ভাই নামাই দেন।” দিশারি তাল মেলায়।
বিভোর অবাক হয়ে বললো,
—–“তুই সত্যি নেমে যাইতি?”
——“হ।তাইলে কইতাছি ক্যান?এই রাস্তা আমি হাঁইটা যামু।”
বিভোর বললো,
—–“বাচ্চামি করিস না দিশু।”
সায়ন ফোড়ন কাটলো,
——“ড্রাইভার ভাই নামাইয়া দেন এরে।গাড়ি থামান।”
বিভোর ধমকে বললো,

—–“কি কস শালা! এইখানে নামবো কেন?”
—–“আরে একটু নামিয়ে দে।নইলে চিল্লাইবো।নামিয়ে দে।তারপর দেখবি নিজেই উঠে আসছে।”
দিশারি দ্রুত উত্তর দেয়,
—–“জীবনেও উঠুম না।বাকি রাস্তা হাঁইটা যামু।”
—–“হ,তোর দাদা রাস্তা দেখাইয়া দিবো।” বিভোরের ঝাঁঝালো কণ্ঠ।
——“নামাইয়া দে কইতাছি।” দিশারির নাছোড়বান্দা কন্ঠ।
—–“বিভোর তুই ওরে তেল দিস না।নামিয়ে দে।ও মিয়া কি কইতাছি গাড়ি থামান।”
গাড়ি থেমে যায়।সায়ন দিশারিকে ঠেলে বললো,
—–“যা নাম….
দিশারি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠে বললো,

—–“তোর বাপের গাড়ি এইটা? আমি কি ফইন্নি? এমনে নামতে কস ক্যান?”
সায়ন বললো,
——“আমিতো জানি তুই এখন নামবিনা।এতক্ষণ হুদাই ক্যাচাল করছোস।তাই ঠেলে নামাচ্ছি।”
দিশারি সত্যিই বেহুদা এসব করছে।সত্যি সে নামতে চায়না।একটু ভয় পেয়েছে এই আর কি।কিন্তু সায়নের কথায় জিদ উঠে।সত্যি নেমে যায় ধারাকে ঠেলে।ধারা বললো,
——“আরে কি করছিস আপু।নেমে গেলি কেন?”
—–“তোরা যা।আমি অন্য গাড়ি দিয়া আসুম।সায়উইন্নের লগে এক গাড়ি দিয়া আমি আর যামুনা।”
—–“হ যাইস না।তোরে নিতামও না।ও মিয়া গাড়ি ছাড়ো।” বললো সায়ন।
দিশারি মাছি তাড়ানোর মতো হাত নাড়িয়ে বললো,
—–“হ যা যা।”
বিভোর রাগে কটমট করে বললো,
—–“তোরা কি নাটক শুরু করেছিস রাস্তার মাঝে।দুইটার কানের নিচে কখন লাগাই ঠিক নাই।”
সায়ন চুপসে যায়।বিভোর সত্যি মেরে দিতে পারে।গার্লফ্রেন্ডের সামনে মার খাওয়া ভালো না।বিভোর দিশারিকে হুংকার দেয়,
——“তুই গাড়িতে উঠবি?”

দিশারি ত্যাড়াচোখে বিভোরকে দেখে।পোলায় ক্ষেপেছে খুব।বিভোর ক্ষেপে গেলে মার একটাও মাটিতে পড়েনা।এই পোলা যে বউ পিটাবে রাগ দেখেই বুঝা যায়।এমনকি সবাই তাই বলে।বাধ্য মেয়ের মতোন গাড়িতে উঠে বসে দিশারি।ধারা বিড়বিড় করে,
——“বাব্বাহ!”
জিপ আবার চলতে শুরু করে।ধারা সোজাসুজি বিভোরের দিকে তাকায়।পরনে ব্ল্যাক জ্যাকেটটা নেই।এখন ব্লু শার্ট পরা।৫-৬ টা চুল কপালে ছড়িয়ে আছে।হালকা গোঁফ।গাল ভর্তি ঘন ছোট ছোট দাঁড়ি।
ধারা শুনতে পায় গায়েবি কেউ বলছে,
——-“হে রে ধারা?কেমনে পারলি ওমন ড্যাশিং বর রেখে পালাতে?”
ধারা মুখ ফসকে জোরে জবাব দেয়,
—–“আমি তো আগে তাকে ভালো করে দেখিনি।”
দিশারি,বিভোর,সায়ন সবাই অবাক হয়ে তাকায়।দিশারি ধাক্কা দিয়ে বললো,

——“কার লগে কথা কস?”
ধারা বাংলার পাঁচের মতো করে মুখ।বলে,
—–“কই কেউ না।”
——“তো একলা বলস?”
ধাড়া মাথা নাড়ায়।বিভোর আনমনা হয়ে ভাবে,
——“জিনের আছড় আছে নাকি?”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৫

প্রায় আধাঘণ্টা পর ধারা আবিষ্কার করলো নিচের দিকে তাকালে ভয়ে গায়ে কাটা দিচ্ছে।তাঁদের জিপ মোটামুটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৫০০ ফুট উপর দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছে।শত শত বাঁক এই পাহাড়গুলোতে।জিপ উপরে উঠছে তো উঠছেই, ছুটছে তো ছুটছেই।যেন কোনো বিরাম নেই।
একসময় জিপে থাকা সবার মনে হলো,তাঁরা সমতল কোনো একটি শহরে পৌঁছে যাচ্ছে।আর তখনই সবার মন বলে,এটাই বুঝি সেই স্বপ্নের দার্জিলিং।কিন্তু না,আশা ভঙ্গ হয় তখনই, যখন সেই শহরগুলোকেও পিছু ফেলে জিপ ছুটে যায় সামনের দিকে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৭