বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৭

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৭
ইলমা বেহরোজ

ওরা দার্জিলিংয়ে পৌঁছায় সন্ধ্যায়।ব্যাগপ্যাক, লাগেজ নিয়ে সবাই জিপ থেকে নেমে রাস্তার একপাশে দাঁড়ায়।ক্ষুধায় সবার পেটে তখন ইঁদুর দৌড়ছিলো।
সায়ন পেটে হাত রেখে বললো,
——“আগে কিছু খাওয়া লাগবো।পেট পুরো খালি মাঠ হইয়া গেছে।”
দিশারি তাল মেলায়,
——“হু আমারো।”
বিভোর এদিকওদিক তাকিয়ে কিছু খুঁজতে খুঁজতে বললো,

——“মুসলিম রেস্টুরেন্ট জানি কই!মনে পড়ছেনা ঠিক।”
একজন প্রাপ্ত বয়স্ক বাঙ্গালি পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞেস করে বিভোর,
——“ভাই মুসলিম রেস্টুরেন্ট কোনদিকে?”
লোকটি বলল,
——-” বড় মসজিদের কাছেই মুসলিম রেস্টুরেন্ট পাবেন।”
বিভোর সায়নদের উদ্দেশ্যে বললো,
—–“পিছু আয় তোরা।”
সায়ন হাঁটতে হাঁটতে বললো,
——“চিনিস বড় মসজিদ?”
——“হু।সামনেই।”
দিশারি বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

——“খাওয়ার জন্য সবচেয়ে জোস রেস্টুরেন্ট কোনটা?”
বিভোর মৃদু হেসে বললো,
—–“সিমলা রেস্টুরেন্ট।
খুশিতে টগবগ হয়ে দিশারি বললো,
—–“তো ওইখানেই চল।”
বিভোর নাকচ করে,
——“যেইটা কাছে আছে ওইখানেই ঝটপট খেয়ে নে।ছয়টা ত্রিশ বাজে।আট টায় দার্জিলিংয়ের সব দোকান-পাট বন্ধ করে দেওয়া হয়।আমাদের হোটেলে ফিরতে হবে।”
সায়ন বললো,
——“ওহ বিভোর? হোটেল বুকিং করতে বলছিলাম অনলাইনে। করেছিস তো?”
——“হু।”

চকবাজার থেকে হেঁটে প্রায় ৫-৬ মিনিটের পথ উপরে উঠতেই ওরা মসজিদটির সন্ধান পেলো।
মসজিদের কাছেই দুটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট।একটি ছোট আর আরেকটি বড়।ওরা বড়টিতে ঢুকলো।
মেনু গরুর মাংস দিয়ে ভাত।পাঁচজন গোল হয়ে টেবিলে বসে।রেস্টুরেন্টের নাম,ইসলামিয়া রেস্টেুরেন্ট।গরুর মাংস ৬৫ রুপি।অসম্ভব সুস্বাদু কিন্তু অনেক বেশি ঝাল।ধারা কখনো ঝাল খায়নি।স্বাদটা অসাধারণ হলেও ঝালটা জিভে লাগে খুব।খাওয়া শেষে মুখ দিয়ে “চুউ চুউ”র মতোন আওয়াজ করতে থাকে।চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে অবিরাম।বিভোর দ্রুত জল এগিয়ে দেয়।ধারা ৮-৯ গ্লাসের মতো জল পান করলো।বিভোর বাইরে থেকে চকলেট কিনে আনে।ধারা খেয়ে শান্ত হয়।
বিভোর অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,

—–“ঝাল খেতে পারেন না।তো খেলেন কেনো।”
ধারা উত্তরে কিছু বললোনা।
ওরা পাঁচজন বুকিং করা হোটেলে আসে।লাডেন লা রোডে হোটেল সাগরিকাতে পাঁচ রাতের জন্য তিন রুম নেওয়া হয়েছে।সুন্দর বড়-সড় রুম।একপাশে একসেট সোফা রুমে।ওয়াইফাই,গরম জল,টিভিসহ যাবতীয় সুযোগ সুবিধা আছে।দিশারি আর ধারা এক রুমে ঢুকলো।ধারা গোমড়া মুখ করে বললো,
——“আমার একটা একা রুম চাই!”
দিশারি বললো,
——“জানতাম বলবি।কারো সাথে রুম,বেড শেয়ার করতে পারিস না সেটা কি আমার ওজানা।দাঁড়া,বিভোররে বলছি আরেকটা রুমের ব্যবস্থা করতে পারবে নাকি।”

—–“উনি কেনো? আমি দেখি।”
—–“না না তুই না।ওরে বলছি।দাঁড়া তুই।”
দিশারি বিভোরকে কল করে।অথচ বিভোরে দুই রুমের পরেই আছে।
——“কি রে?” বিভোরের ক্লান্ত গলা।
——“ধারা রুম শেয়ার করতে পারেনা।দেখতো আরেকটা রুম ব্যবস্থা করতে পারিস নাকি।”
——“তো গতকাল রাইতে না তোর লগে আছিলো।তখন থাকলো কেমনে?”
—–“শেষ রাতে আম্মার ঘরে ঘুমাইছে।”
—–“আচ্ছা রাখ,দেখছি।”
—–“উম্মাহ দোস্ত।”
বিভোর ভ্রু কুঁচকে বললো,
—–“ছিহ!”
তারপর কল কেটে দেয়।দিশারি হাসে।বিভোর ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিয়েছিলো বিছানায়।লম্বা জার্নিতে ঘুম দু’চোখে ঠেলাঠেলি করছে।বাধ্য হয়ে শরীর আবার তুলে নেয়।

ধারা ফ্রেশ হয়ে লেডিস ট্রাউজার আর ব্লু ফতুয়া পরেছে।দিশারি কাপড় চেঞ্জ করতে নিবে, তখন রুমের দরজায় কেউ করাঘাত করে।।কাপড় রেখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে।বিভোর দাঁড়িয়ে ছিলো।দিশারি হেসে বললো,
——-“আয়।”
—–“তোর বোনের রুম বুকিং শেষ।একটাই খালি ছিলো।ভাগ্য ভালো তাই পেয়ে গেছি।এই যে চাবি!”
——“তোর কাছে রাখ।আমি কাপড় পাল্টাবো।প্লীজ ওর রুমটা দেখিয়ে দে ওরে।”
বলেই দিশারি ওয়াশরুমে ঢুকে।দরজা লাগানোর আগে ধারাকে বললো,
——-“বিভোরের সাথে যা।দরজাডা লাগায় যাইস।”
ধারা বিব্রত হয়ে পড়ে।বিভোরও বাতাসে অস্বস্থির স্বাদ পাচ্ছে।নিজেকে সামলিয়ে ধারাকে বললো,
——“আসুন।”
ধারা নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিভোরের পিছন হাঁটে।বিভোরের পাশের রুমটাই ধারার!বিভোর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে সুইচ টিপে বাতি জ্বালায়।ধারাকে বললো,

——“এই নিন চাবি।”
দুজনের দূরত্ব তখন দু’হাত দূরে।বিভোর চাবি বাড়িয়ে দেয়।ধারা কাঁপা হাতে চাবি নেয়।বিভোর “আসি’ বলে বেরিয়ে যায়।ধারা ডেকে উঠলো,
——“একটু দাঁড়ান? ”
বিভোর ধারার ডাক শুনে দু’কদম পিছিয়ে আসে।উঁকি দিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে বললো,
——-“কি?”
ধারা মিইয়ে যাওয়া গলায় বললো,
——“বলছিলেন দেখা করতে হোটেলে ফিরে।এখন তো দেখা হ…….
বিভোরের মনে পড়ে যায়।ধারার কথার মাঝে বাধা দিয়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
——“হুম মনে পড়ছে।বসুন বলছি।”
ধারা বিছানায় বসে।বিভোর সোফায়।বিভোর কথা বলতে গিয়ে দেখে কথা আসছেনা।খ্যাঁক করে গলা পরিষ্কার করে।তারপর প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,

——“আমি জানি আমার উপস্থিতি আপনাকে বিব্রত করছে।ঘুরতে এসে আনন্দ করতে পারছেন না। উপভোগ করতে পারছেন না।সেইম আমারো হচ্ছে।দেখুন,আমাদের অতীত আছে এইটা ঠিক।কিন্তু সেই অতীতের প্রতি টান আপনার ও নাই আমারো নাই।আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে। হয়তো বিয়েও করে নিয়েছেন।আর এটা আমি খুব সহজ ভাবে এক বছর আগেই মেনে নিয়েছি।তো,সেই দিনটার জন্য, সময়টার জন্য এখন এতো বিব্রত,আড়ষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই।আমরা দুজন এখন শুধুমাত্র ট্রাভেল সহযাত্রী।ট্যুরে এসেছি।”
কথা শেষ করে বিভোর ধারার দিকে তাকায়।ধারা বিভোরের দিকে একদৃষ্টি তাকিয়ে আছে।পলক পড়ছেনা।বিভোর কেশে বললো,
——-“বুঝেছেন ধারা?”
ধারা চোখ সরিয়ে মেঝেতে নিবদ্ধ করে।আমতা আমতা করে বললো,
—–“জ্বি…জ্বি বুঝেছি।”
—–“তাহলে আর বিব্রতবোধ করবেন না।খুব সহজভাবে,আনন্দ নিয়ে দার্জিলিং উপভোগ করুন।”
——“আপনিও।”
বিভোর হেসে উঠে দাঁড়ায়।ধারাও দাঁড়ায়।বিভোর বললো,
——“আসি?”
ধারা দীর্ঘ হেসে বললো,
—–“আসুন।”

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৬

বিভোর সেই হাসিতে থেমে যায়।গঁজ দাঁত সেই সাথে ধারার বড় চোখ ছোট হয়ে যাওয়া।চোখ দু’টিতে জল চিকচিক করে।মনে হয় চোখ হাসছে।বিভোরের ইচ্ছে হয় জিজ্ঞাসা করতে,
——“ধারা আপনার কি বিয়ে হয়েছে?”
কিন্তু করেনি।রুম থেকে বেরিয়ে যেতে উপক্রম হয় বিভোর।তখনি ধারা পিছন থেকে বলে উঠে,
——-“বিবাহিত মেয়েদের হাতে চুড়ি থাকে।নাকে নাকফুল থাকে।আমার নেই…….
বিভোর খানিকটা অবাক হয়। ঘুরে তাকায়।স্বাভাবিকভাবে বললো,
——“বর্তমানে জেনারেশনে অনেক মেয়েরা বিয়ের পরেও নাকফুল,চুড়ি ইউজ করেনা।”
কথা শেষ করে আর দাঁড়ায়নি সে।দরজার বাইরে চলে আসে।ধারা গলার জোর বাড়িয়ে বলে উঠলো,

——“বিভোর সাহেব,আমার বিয়ে হয়নি।”
কথাটি বার বার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বিভোরের কানে।কি যেনো একটা ছিলো কথাটিতে।আরেকবার ধারার রুমে সে কি ঢুকবে? কিন্তু কি কথা বলবে?বেমানান না ব্যপারটা?সাত-পাঁচ ভেবে নিজের রুমে স্থান নেয়।
ধারা নিজের মাথায় নিজে গাট্টা মারে।দরজা লাগিয়ে লাফিয়ে বিছানায় উঠে।তারপর শুয়ে পড়ে।পৃথিবীটা অন্যরকম লাগছে!একদম…..অন্যরকম। অজানা,অচেনা,অদ্ভুত অনুভূতিতে সে শিহরিত হচ্ছে।

বৃষ্টি হয়ে নামো পর্ব ৮