ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১১

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১১
লেখনিতে : মিমি মুসকান

শুভ কে কোলে করে বাড়িতে ভিতরে নিয়ে এলাম। ভিতরে এসে দেখি মামাও সাথে এসেছে। আমি তাদের দেখে খুব বড় ধরনের চমক খেলাম। চোখ বড় বড় করে তাদের দেখতে লাগলাম। এরা কারা? সত্যি’ই কি এরা আমার মামা মামী। এতো দামী পোশাক ‌এমন হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে না আমরা এতো গরিব ছিলাম। আমি হা তাকিয়ে দেখছি।
হঠাৎ করেই মামী এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে..

– ভালো আছিস?
আমি আরেকদফা অবাক হলাম। কে আমাকে কি জিঙ্গেস করছে? আজ পর্যন্ত এরকম কথা শোনার ভাগ্য আমার হয় নি। মামী এবার আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল..
– কিরে বল! সুখে আছিস তো। তোর শশুড় শাশুড়ি ভালো ব্যবহার করে তোর সাথে।
– আমি মাথা নাড়লাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এর মধ্যেই মা আসলেন। মামী মা’র সাথে ভাব জামাতে শুরু করেন। কেউ দেখলে বলবে না এই মামা মামী আমাকে দেখতে পারতেন না। আমার এতো প্রশংসা আমি নিজেই শুনে অবাক। বলতে হবে মানুষের লোভে পড়ে সব করতে পারে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে লাগলাম। তারপর শুভ কে নিয়ে উপরে চলে এলাম। রুমে এসে দেখি আহিয়ান হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে। শুভ আহিয়ান কে দেখে আমার হাত ছেড়ে উনার কোলে গিয়ে বসল। তারপর আহিয়ান এর সাথে গল্প তে মেতে উঠে। তিনি ও বেশ গল্প করছে।‌আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকি।

তারপর সবাই মিলে দুপুরে খাবার খায়। আমি নিজেই সবাইকে খাবার সার্ভ করি। বাড়ির সবাই ছিলো শুধু আপু আর বাবা বাদে। তারা অফিসেই ছিলেন। আহিয়ান নিজের হাতের শুভ কে খাইয়ে দিতে লাগলেন। আর আমার মামী! তিনি তো আমার মা’র সাথে ভাব জমাতে ব্যস্ত। কিন্তু এতে মনে হয় না আমার মা’র ওপর কোনো প্রভাব পরছে ‌কারন আমার মতে তিনি খুব বিচক্ষণ একজন মানুষ।

খাবার খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে বসার ঘরে বসে গল্প করছে। কিছুক্ষণ গল্প করার পর শুভ ক্রিকেট খেলার জেদ করে। আহিয়ান তাকে নিয়ে বাগানে চলে যায় খেলতে। আমিও তাদের পিছু পিছু আসি। দু’জনেই খেলতে থাকে। আহিয়ান বল করছে আর শুভ ব্যাট করছে। ভালোই লাগছে এভাবে তাদের দেখতে। আহিয়ান যে বাচ্চাদের এভাবে সামলাতে পারে সেটা আমার জানা ছিলো না। খুব তাড়াতাড়ি মিশে গেলেন বাচ্চাদের সাথে তিনি। হঠাৎ করেই মামী এসে আমার পাশে দাঁড়ান। আমাকে বলতে থাকেন…

– তোর শাশুড়ি’র কথাবার্তা অনেক ভালো। তা তোর সাথে কি এমন ব্যবহার করে।
আমি মুচকি হেসে বলি…
– উনি আমাকে মা’র মতোই আদর করে।
মামী বলতে থাকে..
– বাহ একদিনেই এতো। এতোদিন তো আমরা লালন পালন করলাম তোর। আর এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি আমাদের। তা বেশ টাকা হলে সবাই এমন’ই করে। কিন্তু আমি সবসময় তোর ভালোই চাই বুঝলি। তাই বলছি যত তাড়াতাড়ি পারিস তোর স্বামী কে হাত কর। নাহলে পরে বিপদে পরবি।‌
আমার আর বুঝতে বাকি রইল না মামী আমার সংসারে আগুন ধরাতে এসেছে। তাই তার কোনো কথাই আমি কানে দিলাম না। উনার কথার শেষে শুধু একটা কথাই বললাম…

– মামী তোমাদের কাছে এতোদিন থেকেও যেই সম্মান টুকু পাই না আজ একদিন’র মধ্যে তার চেয়ে বেশি আদর পেয়েছি।
মামী আমার কথা শুনে মুখ কালো করে ফেললেন। আমি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম…
– অতিথি হয়ে এসেছো, এভাবেই থাকো না। অনেক সম্মান পাবে। আদর যত্নের কমতি হবে না।
বলেই চলে এলাম। কারন ওখানে থাকলে তিনি আমার মাথা খেয়ে ফেলতেন। ভাবতেও অবাক লাগে আমি তো এখন আর তাদের কোনো ক্ষতি করছি না তবুও কেন এভাবে আমার পিছনে পরে আছে তারা। মানুষ এতো টা নিচ কিভাবে হতে পারে। হঠাৎ করেই দেখি আমার হাত ধরে কেউ টানছে। তাকিয়ে দেখি শুভ! আমি শুভ’র দিকে তাকিয়ে বলি..

– কি হয়েছে ভাই!
– তুমি চলো না আমার সাথে খেলতে।
– কেন? তোমার ভাইয়া তো তোমার সাথে খেলছে।‌
– হ্যাঁ খেলছে তো কিন্তু দুজন খেলতে ভালো লাগছে না তুমিও আসো না আমাদের সাথে মজা হবে।
আমি শুভ’র গাল ধরে বলি…
– ভাই আমি তো খেলতে পারি না।
– আমি তোমাকে শিখিয়ে দেবো তুমি আসো না।

শুভ আমার কোনো কথাই শুনলো না ওর জেদের কাছেই হার মানতে হলো শেষে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো। এসে দেখি উনি মাটিতে বসে আছে। আমাকে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। শুভ বলে উঠলো..
– দেখো দেখো আহি আমি আপ্পি কে নিয়ে এসেছি।
শুভ’র কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। আমি শুভ’র গাল ধরে বলি..
– শুভ এটা ভালো না তুমি ভাইয়া’র নাম ধরে কেন ডাকছো।
আমার কথা শুনে উনি বলে উঠে…
– আমি শুভ কে বলেছি এভাবে ডাকতে তুমি কিছু বলো না।
আমি অবাক হয়ে বলি…
– কিন্তু কেন? এভাবে নাম ধরে ডাকা তো ঠিক না।
উনি দাঁড়িয়ে বলেন…

– কিন্তু আমার কাছে এটাই ভালো লাগে। আচ্ছা এই নাও ( আমার দিকে ব্যাট দিয়ে )
– এটা দিয়ে আমি কি করবো!
শুভ বলে ওঠে..
– আপ্পি তুমি জানো না এটা দিয়ে কি করে।
– হুম জানি কিন্তু আমাকে কেন দিচ্ছেন।
উনি বলে ওঠে…
– ব্যাট করতে, নাও। শুভ তুমি দূরে দাঁড়িয়ে বল করো।
শুভ বলে ওঠে..
– আচ্ছা আহি।
বলেই দৌড়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায় বল হাতে নিয়ে।
উনি আবার ও ব্যাট আমার সামনে ধরে। আমি মাথা নিচু করে আস্তে করে বলি…

– আমি পারি না ব্যাট করতে।
আমার কথা শুনে উনি আমার ধরে ঘুরিয়ে কাছে নেন। তারপর আমার হাত ব্যাট ওর উপর রেখে নিজের হাত রেখে বলে…
– দেখো কিভাবে ব্যাট করতে হয়।
আমি উনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। উনি এভাবে আমার কাছে আসা, আমার হাত ধরা কেমন একটা অনুভুতি হচ্ছে আমার। এটা আগে কখনো হয় নি। হবে কিভাবে আমি কখনো এভাবে কারো কাছে আসিই নি।একধ্যানে তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি শুভ কে বল করতে বললে আমার ধ্যান তখন ভাঙে। শুভ বল করলে উনি আমার হাত ধরে ব্যাট করে। এটা দেখে শুভ খুশিতে লাফিয়ে উঠে। সে আবারও বল নিয়ে আসে। উনি আমাকে বলে…

– ভালো আরে দেখো আমি কিভাবে শেখাই তোমাকে।
আমি সামনে তাকিয়ে বলে উঠি..
– মা আসছেন!
উনি আমার কথা শুনে বলেন..
– তো!
আমি নিচু গলায় বলি..
– এভাবে আমাকে ধরে রাখবেন নাকি মা কি ভাববে?
উনি শান্ত ভাবেই বলে…
– কিছুই ভাববে না , তুমি খেলায় মনোযোগ দাও।
বলেই আবার ব্যাট করেন।

এদিকে মা হাঁটতে হাঁটতে একপাশে এসে দাঁড়ান। মামী সেখানেই ছিলেন। তিনি মা’কে দেখে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকেন। মামা মনে হয় ভেতরে আছে। আমি মা’র দিকে তাকিয়ে দেখি উনি এভাবে আমাকে আর উনাকে দেখে একটু খুশি। মুচকি হাসলেন তিনি। তার এই হাসি দেখে আমি বেশ লজ্জায় পরে গেলাম। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। আর এদিকে উনি আমাকে শিখিয়ে’ই যাচ্ছেন।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে খেলার পর উনি আমাকে ছেড়ে দেন। পুরো আকাশ তখন লাল বর্ণ ধারন করে। আমরা সবাই মিলে ভিতরে আসি। মামা মামী’রা আজ এখানেই থাকবে। আহিয়ান শাওয়ার নিতে গেছে। আমি শুভ কে হাত পা ধুইয়ে দিয়ে ঘরে টিভি অন করে কার্টুন দেখতে দিয়ে মা’র ঘরে আসি। মা সোফায় বসে ছিলেন। মা আমাকে দেখে মুচকি হাসেন। আমি মাথা নিচু করে তার সামনে দাঁড়াই। মা আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে আমার মাথায় হাত রেখে বলেন…

– আমি জানতাম তুমি আসবে আর কেন আসবে তাও জানতাম।
আমি মাথা তুলে মা’র দিকে তাকাই। মা মুচকি হেসে আমাকে বলেন..
– ভেবো না আমি তোমার মামী’র কথাই কিছু মনে করিনি। কিন্তু একটা কথা কি জানো খুব ভালো লাগলো যে তুমি আমার কাছে আসলে।
আমি মা’র দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি’ই খুব ভালো একজন মানুষ তিনি। মা আমার মাথায় হাত রেখে বলেন…
– চৌধুরী বাড়িতে অতিথি’দের অনেক সম্মান করা হয়। দেখো তারা যেন কখনো অভিযোগ’এর সুযোগ না পায়।
আমি মুচকি হেসে মাথা নাড়লাম। তারপর বলি..
– আমি চেষ্টা করবো মা এমন যাতে কখনো না হয়।
মা ‌হেসে‌ বলেন…

– যাও তোমার মামা মামী’র খাবারের ব্যবস্থা করো। তোমার বাবা আর আপু আজ আসতে দেরি হবে। তারা বাইরে থেকে ডিনার করে আসবে।
আমি আচ্ছা বলে বাইরে এসে খাবারের ব্যবস্থা করলাম।
মামা মামী কে ডেকে , শুভ কে টেবিলে বসিয়ে দিলাম। সার্ভেন্ট কে খাবার সার্ভ করতে বলে মা কে ডাক দিলাম। মা বলেন আহিয়ান কে ডেকে আনতে। আমি নিজেই গেলাম তাকে ডাকতে।
রুমে এসে দেখি উনি মাত্র শাওয়ার নিয়ে এসেছে। একটা কালো জিন্স আর বক্সার গেঞ্জি পরা। আয়নায় দাঁড়িয়ে মাথার চুল মুছতে থাকে। আমি দাঁড়িয়ে বলি..
– মা খাবার খেতে ডাকছেন।
উনি আমার দিকে না তাকিয়ে বলেন…
– তুমি যাও আমি আসছি।

উনার কথায় আমি এসে পরি, কিছুক্ষণ পর উনি ও আসেন। সবাই মিলে একসাথে খাবার খাই। খাবার খাওয়া শেষে শুভ কে রুমে যাই ঘুম পারাবো বলে কিন্তু সে আহিয়ান এর সাথে গল্প করা ছাড়া ঘুমাবে না বলে জেদ করে বসে থাকে।আমি পরলাম মুশকিল এ। এখন উনাকে কিভাবে ডাকবো আমি। হঠাৎ করেই দরজার থেকে আওয়াজ আসে তার। শুভ তাকে দেখে আহি বলে ওঠে। উনি শুভ’র কাছে এসে বসে পরে। তারপর শুভ কে কোলে নিয়ে বসে গল্প করতে থাকে। শুভ র কথায় হুট করেই হেসে দেয় উনি। আমি মুগ্ধ চোখে তার হাসি দেখতে থাকি। এই প্রথম বার তাকে হাসতে দেখলাম। কতোটা মুগ্ধকর এই হাসি বলে বোঝাতে পারবো না।

গল্প করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে শুভ, আমি উনার কোল থেকে শুভ কে বিছানায় শুইয়ে দেই। উনি উঠে দাঁড়ান। আমি তাকিয়ে আছি উনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বাইরে চলে যান। আমিও তার পিছু পিছু হাঁটতে থাকি। নিচের দিকে তাকিয়ে তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে একসময় রুমে এসে পরি। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই আমি ভাবছি অন্য কথা। ইতি’র সাথে খুব কথা বলতে মন চাইছে কিন্তু কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। উনাকে কি বলবো উনার ফোন থেকে ওকে একটা ফোন দিতে।

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১০

এসব ভাবতে ভাবতে হুট করেই কারো সাথে ধাক্কা খাই। কপালে হাত দিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখি আহিয়ান কোমরে হাত দিয়ে কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উনার কাঁধ বরাবর পরি। উনার বুকের সাথে’ই ধাক্কা খাই। উনাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে এক পা পিছনে গেলাম। উনি আমাকে জিজ্ঞেস করেন…
– কি ভাবছো?
উনার কথায় ধতমত খেয়ে গেলাম। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি আবার বলেন…
– কি হলো কিছু বলবে? অনেকক্ষণ ধরে দেখছি কি জানি ভাবছো কারন কি কিছু হয়েছে।
এতোক্ষণ যাও ভাবছিলাম ইতি’র কথা বলবো কিন্তু উনার এমন কথায় সেই সাহস আর হলো না। আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম না।

আমার কথায় উনি আমার থেকে সরে হাঁটতে হাঁটতে খাটে গিয়ে বসলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন…
– আজকের মতো এই খাটে ঘুমিয়ে নাও। সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিলাম ডাবল খাটের ব্যবস্থা করতে পারি নি।
উনার কথা শুনছি, কিছু বলছি না। কেন জানি উনি শান্ত ভাবে কিছু বললে আমি কিছু বলতে পারি না। উনি খাটের মাঝে একটা কোলবালিশ রেখে বলল..
– চাইলে গেস্ট রুম’এ ঘুমাতে পারো। কেউ কিছু বলবে না তোমায়।
আমি মনে মনে ভাবলাম আজ মামী এখানে, ভুলে ও ওখানে ঘুমাতে যাওয়া যাবে না। মামী দেখলেই নতুন কাহিনি করবে। চট করে বলে উঠি…

– আমি এখানেই ঘুমাবো।
উনি খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে…
– তাহলে ঘুমিয়ে পড়ো, আর হ্যাঁ তোমাকে একটা কথা বলতে মনে ছিলো। ঘরে লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম আসে না তাই তুমি লাইট নিভিয়ে দিও ওকে। গুড নাইট।
বলেই ঘুমিয়ে পরলেনা। আমি খাটের একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরি। তার আগে ‌লাইট নিভিয়ে দেই। সেদিন রাতে তেমন কিছু হলো না। বুঝতে পারলাম আগের রাতের জন্য উনি আজ খুব সচেতন। তার মানে গত রাতে উনি ইচ্ছে করে কিছু করেনি।

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ১২