ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ২২

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ২২
লেখনিতে : মিমি মুসকান

সকাল‌ সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে নিলাম কারন আজ আমাদের এতিমখানায় যেতে হবে। উনি আরো আগে উঠে বাইরে হাঁটতে চলে গেছেন। খুব শীত লাগছে তাই একটা পশমী কাপড় পড়ে নিলাম। আমি তৈরি হয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আসলে তবে বের হবো। আজ অনেক কাজ আছে, কিন্তু সকালের মূহুর্ত গুলো ভুলা”র মতো না। চারদিক হালকা কুয়াশা চমৎকার একটা পরিবেশ। চারদিক নিস্তব্ধ, ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে সময়টা উপভোগ করতে থাকি। এর মধ্যে উনি ডাক দেন। তার দেওমা অদ্ভুত নামে মানে ভুতনি। আমি ঘুরে তাক দিকে তাকাই। দেখি দাঁত বের করে হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছু না বলেই মুখ ভেংচি দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। এখন কথা কাটা করে লাভ নেই। আমি ভেবেই রেখেছি আজ উনার সাথে লাগবোই না তাহলে কাজের গন্ডগোল হবে। বাইরে গাড়ি পার্ক করা ছিলো। আমি গাড়িতে বসে পড়লাম। খানিকবাদে উনি ও বসে পড়েন।
অতঃপর আমাকে বলে..

– ভূতনি মনব্রত রেখেছো নাকি।
– আপনি না ওই বাচ্চাদের সামনে আমাকে ভূতনি বলে একদম ডাকবেন না।
– আমি তো ডাকিও না। কিন্তু এখন ডাকবো।
– কেন?
– তুমি মানা করেছো তাই!
বলেই হেঁসে ওঠে। আমি মুখ ফুলিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। আমি জানি উনি নিশ্চিত ডাকবে তাই অনুরোধ করার প্রশ্নই উঠে না। কারন এটা তে কাজ হবে না। বাইরে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি, কতোকিছুই না বদলে গেলো। আসলেই অবাক লাগে ভাবলে এক সময় উনি আমাকে সহ্য করতে পারতেন না। কতো অপমান করেছেন আর এখন সারাটা দিন তার সাথেই থাকি। এতো বিরক্ত করি তবুও তিনি বিরক্ত হন না। আগের মতো সেই গম্ভীর ভাব টা এখন আমার সাথে দেখান না আসলেই মানুষের স্বভাব ক্ষনস্থায়ী তবে অভ্যাস না। আর আমার কাছে মনে হয় আমি উনার স্বভাব। তাই এতো তাড়াতাড়ি পাল্টে ফেলতে পেরেছে। তবে আমি উনাকে যেমন ভাবতাম তার সাথে উনার এখন মিল নেই। যাই হোক এখন যেমন আছে তেমনও অনেক ভালো তিনি। তবে একটা জিনিস পাল্টায় নি তা হলো আমাকে অপমান করা! শুধু সুযোগ খুঁজ অপমান করার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতিমখানায় পৌঁছানোর আগে রেস্টুরেন্টে আমরা সকালের নাস্তা করে নিলাম। অতঃপর সেখান থেকে এতিমখানায় গেলাম। দেখি কাজ শুরু হয়ে গেছে। বলতে হবে তারা কাজের গাফিলতি করেন না। বাচ্চারা অনেকেই এখনো ঘুমাচ্ছে। উনি তাদের সাথে হাত লাগিয়ে কাজ শুরু করতে লাগলেন। দুপুরে বাচ্চাদের খাবারের জন্য এতো আয়োজন। বাচ্চাও আছে অনেকজন কারন এতিমখানা’টা আসলে অনেক বড়, যার কারনে বাচ্চাদের সংখ্যা বেশি। হয়তো মামা মামী না থাকলে এমন একটা এতিমখানায় বড় হতাম নাহলে রাস্তায় ফুটপাতে!

সত্যি কথা বলতে কি কেউ চায় না কাউকে বসিয়ে খাওয়াতে। মা- বাবার মতো সবাই তো আর নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে না। তাই কারো অধীনে থাকলে তার কথা শুনতেই হবে। এটাই ভাগ্য। মা- বাবা’র কথা আজ খুব মনে পড়ছে। তাদের মৃত্যু বার্ষিকী কথা আমার মনেও নেই। কারন তখন খুব ছোট ছিলাম। তাদের লাশ দেখেও বুঝতে পারি নি তারা মারা গেছে। এটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে যে আমার মা বাবা আর বেঁচে নেই। আর এই বাচ্চারা। ওরা হয়তো জানেও না ওদের মা বাবা কে। বেশিরভাগ’ই অবৈধ সন্তান হিসেবে এই সমাজের কাছে পরিচিত। এটাই তাদের ভাগ্য।‌ ভাগ্য খুব বিচিত্র! কিভাবে চোখের পলকে বদলায় তা নিজেকে দেখে বুঝেছি আমি। এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম!

দুপুরে আমি আর উনি মিলে সব বাচ্চাদের খাবার দিতে লাগলাম, এর একটু আগেই মিলাদ হয়েছিল। বাচ্চাদের খাবার দেওয়ার সময় হঠাৎ একটা বাচ্চা আমাকে ডাকল..
– ভূতনি আপু একটু পানি দাও আমায়!
আমি রীতিমতো থমতম খেয়ে গেলাম। বাকি বাচ্চারা অবাক হয় নি। যে যার মতো খাচ্ছে কিন্তু কেন? আমি উনার দিকে তাকাতেই দেখি মুচকি হাসছে। বাচ্চা টা আবার বলে..
– কি হলো ভূতনি আপু দাও!
উনি এবার একটু জোরেই হাসল। খেয়াল করলাম আশপাশ কয়েকজন মানুষ আমাকে দেখে মুট টিপে হাসছে। রাগে আমার শরীল জ্বলছে। আমি বাচ্চা কে পানি দিয়ে বলি..

– আমাকে ভূতনি কেন ডাকছো!
– এটা তো তোমার নাম, আহি ভাইয়া আমাদের সবাইকে বলেছে তোমাকে এই নামে ডাকতে!
ইচ্ছে করছিলো এখন’ই গিয়ে উনার গলা টিপে দিতে। ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথা খাচ্ছে উনি। তাকিয়ে দেখি উনি বের হচ্ছে। আমি বাচ্চা টাকে বলি..
– আমাকে এই নামে ডেকো না ঠিক আছে আপু।
কিন্তু একজন কে বললে কি হবে। সবাই সেই ভূতনি নামেই ডাকতে লাগল। আমার নামটাকে উনি পুরো সবার কাছে বিলি করেছে। আরে আমার নাম বলছি কেন? আমার নাম তো নিহা।ভূতনি না! ধুর!
বাইরে বের হয়ে দেখি উনি নেই, আমি খুঁজতে থাকি। হঠাৎ উনি “এই ভূতনি” বলে ডাকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখি দেওয়ালে ঘেসে দাঁড়িয়ে বের করে হাসছে। আমি উনার সামনে কোমরে হাত বলি…

– আপনাকে না বলেছি বাচ্চাদের সামনে ভূতনি বলে ডাকতে না।
– তো আমি ডেকেছি নাকি বলো!
– তাহলে ওরা কিভাবে ডাকল!
– তুমি তো বললে ওদের সামনে এই নামে ডাকতে না এটাতে বলো নি ওদের বলতে না ‌
– তাই আপনি সবার কাছে গিয়ে বলছেন আমাকে ভূতনি বলে ডাকতে!
– খুব মানায় তোমায় এই নামে ভূতনি!
– রাখুন আপনার ভূতনি!
রেগে চলে এলাম এখান থেকে। উনাকে বলেছি ডাকতে না আর উনি সবার কাছে গিয়ে বলেছে এই নামেই যেন আমায় ডাকে। সত্যি’ই অসাধারন!
বির বির করে উনাকে বকতে লাগলাম। তখন এতিমখানার একজন এসে বলল…

– ম্যাম আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে।
– না না তো!
– আচ্ছা স্যার আপনাকে ডাকছে খাবার খেতে চলুন আমার সাথে।
– হুম।
আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে এখন। এতো অপমান করে এখন খেতে ডাকছে হুহ। যেয়ে দেখি এক প্লেট নিয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে উনার পাশে বসলাম। কিন্তু এক প্লেট কেন? আমি জিজ্ঞেস করলাম…
– আপনি খাবেন আর আমাকে কি দেখাতে এখানে ডেকেছেন।
– ঠিক বলেছো! আমি খাবো তুমি বসে বসে দেখো।গাধা একটা। তোমার হাত না কাটা ভুলে গেছো নাও হা করো!
– আপনি এখানে খাওয়াবেন। সবাই দেখবে!
– তো!
– দেখলে কি ভাববে!
– ভাববে একটা বাচ্চা কে খাওয়াচ্ছে নেও খাও।
– অপমান করতে ছাড়েন না আপনি আমায়!
– না এটা বেশ লাগে আমার কাছে। নাও!

বিকালে সব বাচ্চাদের সাথে খেলছি আমি, তারা এখনো আমায় ভূতনি বলেই ডাকে। কোন ধরনের মানুষ উনি বুঝি না আমি।অসহায় মুখ করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। দূর থেকে এসব দেখে হাসছে। মজা লাগছে তার কাছে! প্রায় অনেকক্ষণ খেলার পর মনে পড়ল ওদের জন্য উপহার এনেছি তা দিতে হবে। আমি আশপাশ তাকিয়ে দেখি উনি কোথায় নেই। উনাকে খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেলাম একটা গাছের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। উনি প্রায়’ই খায় এসব তবে আমার সামনে না। এর গন্ধ আমার সহ্য হয় না বলে হয়তো। আমাকে দেখে হাতের অর্ধেক সিগারেট টা ফেলে দিলেন।

– কি হয়েছে ভূতনি?
– ওদের উপহার গুলো দেওয়া লাগবে।
– তুমি যাও আমি নিয়ে আসছি।
বলেই গাড়ির কাছে গেলেন উনি। সব বাচ্চাদের উপহার দিলাম। তারা অনেক খুশি। অনেকে নাচছে খুশিতে! ভালোই লাগছে এসব দেখে। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। বাইরে থেকে খেয়েই বাসায় আসলাম। এর মধ্যে উনি আমাকে গাড়িতে বসিয়ে কোথাও গেলেন। জিজ্ঞেস করায় বললেন কিছু কাজ ছিলো তাই গেছে। আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।‌
সারাদিনে’র খাটাখাটনি’তে খুব ক্লান্ত লাগছিলো। খুব ঘুম পাচ্ছিল! তাই আমি আজ একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম। বেশ ঘুমও পাচ্ছিল। তখন ১০ টা বাজে আমি বিছানায় শুয়ে পড়লাম। ঘুম টা তখন মাত্র আসলো আমি ঘুমাবো তখন কেউ আমার বাহু ধরে টেনে তুলল। সে কেউ শুধু একজন’ই আহিয়ান। সে আমাকে উঠিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল..

– কি হয়েছে এতো তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লে! মাত্র ১০.৩০ টা বাজে।
– ঘুম পাচ্ছে তাই! দেখি সরুন ঘুমাতে দিন।
কপালে হাত দিয়ে…
– শরীর ঠিক আছে তোমার!
– অনেক ভালো লাগছে শুধু একটু ঘুমের দরকার আমার আর কিছু না।
বলেই বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর মনে হলো লাইট নিভে দিয়েছিন তিনি। অতঃপর আমার পাশে শুয়ে পড়ল। সবটাই আন্দাজ কারন আমি ঘুম ঘুম চোখেই সব আন্দাজ করলাম। কতোক্ষণ পর উনি লাইট জ্বালিয়ে আবার আমাকে টেনে তুলল..
– কি শুরু করলেন আপনি!
– তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো?
খানিকটা রেগেই বলি..
– ঘুম থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করছেন ঘুমিয়ে গেছি কিনা।
– আরে মাত্র ১১ টা বাজে এখন ঘুমিও না।
– মাত্র আধ ঘন্টা আগে না আপনি আমাকে উঠিয়েছিন।
– হ্যাঁ কেন?
– কিছু না।

আবার শুয়ে পড়লাম। উনি এমন কেন শুরু করেছে আমার মাথায় ঢুকছে না। আজ যা কাজ করলেন উনি আমার মতে আমার আগেই শুয়ে পড়ার কথা তার। কিন্তু উনি শুধু ঘুরাঘুরি করছে ঘুমানোর কোনো নাম নেই।
উনি আবারও লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। আমার শরীর একটা কম্বল দিয়ে আমি উনার দিকে ফিরে ঘুমিয়ে ছিলাম। আমার মতে উনি আবারও আধ ঘণ্টা পর’ই আমার মুখে ফোনের লাইট ধরে বলল..
– ভূতনি! এই ভূতনি ঘুমিয়ে গেছো!
আমি বিরক্ত হয়ে কম্বল দিয়ে মুড়ো দিয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে থাকি। উনি উঠে আবারও আমার বাহু টেনে তুলেন। অতঃপর বলেন..

– এই ঘুমিও না তুমি!
– আপনার কি ভয় করছে! বলুন তো আমাকে।
– তোমার মতো একটা ভূতনি’র সাথে থাকতে পারি দেখছো না তুমি তাহলে আবার কিসের ভয়।
– তাহলে এইভাবে পিছে লেগে আছেন কেন। ঘুমাতে দিন না আমায়।
– ঘুমানো লাগবে না তোমার, ঝগড়া করো আমার সাথে।
আমি হাই তুলতে তুলতে..
– এখন ঘুমাতে মন চাইছে ঝগড়া করতে না।

আবার শুয়ে পড়লাম। খানিকক্ষণ পর মনে হলো উনি বিছানা থেকে নেমে বাইরে গেল। যাক ভালোই হলো। এখন একটু শান্তিতে ঘুমাবো। ঘুমিয়েও গেলাম। উনি আবার ও আমার বাহু টেনে ঘুয থেকে তুললেন। এবার আমার পাশেই বসা ছিলো। এমন রাগ হচ্ছিল। কিছু বলতে যাবো তার আগেই উনি আমার মুখে হাত দিলেন আর ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কারনটা কি? উনি countdown শুরু করল। কিন্তু কেন? আমার জানামতে বিয়ের ছয় মাস পর কেউ নাকি anniversary পালন করে তবে আমাদের টা মনে হয় দেড় মাসের মতোই হবে। হঠাৎ আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে উনি আমার সামনে একটা কেক তুলে বলেন…

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ২১

– Happy birthday my dear ভুতনি!?
আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কি বললেন উনি? আমার বিশ্বাস’ই হচ্ছিল না।‌পুরো রুম অন্ধকার! কেক থাকা মোমবাতির আলোতে ‌আমরা দুইজন দুইজনকে দেখছি। উনি আবারও বলেন..
– Happy birthday! এই ভূতনি! কি হলো?
অবাক হয়ে বলি…
– আজ আমার birthday!
– না কে বললো তোমার আজ আমার birthday, দেখো না কেক এ আমার নাম লেখা।
– আমি মজা করছি না কিন্তু!
– হ্যাঁ আমি করছি রাত ১২ টা বাজে তোমার সাথে! নাহ বলো।
– তেতো তেতো কথা বলছেন কেন?
– তুমি কেন বোকা বোকা কথা বলছো! নাও কেক কাটো।
উনি উঠে লাইট জ্বালালেন। আমি আবার বলে উঠি..
– আপনি কিভাবে জানলেন আজ আমার birthday.
– That’s not important!
– কিন্তু আমার জন্য আমার important.

– আরে বিয়ের সময় দেখেছিলাম তোমার কাগজপত্রে লেখা ছিল। হয়েছে শান্তি! ( আমার হাতে ছুরি দিয়ে )
নাও কাটো!
আমি এবার কেক এর দিকে তাকালাম। চকলেট কেক, কেক”র ওপর লেখা “Happy birthday my ভূতনি বউ” আমি কিঞ্চিত হেসে উনার দিকে তাকালাম। উনি চোখের ইশারায় আমাকে কেক কাটতে বললেন.. অতঃপর আমি কেক কাটলাম! উনা কেই খাইয়ে দিলাম। উনিও আমাকে খাইয়ে দিলেন। হঠাৎ উনি একটা প্যাকেট আমার সামনে রাখলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম..
– কি এটা?
– নিজেই দেখো!

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ২৩