ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ৩৩

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ৩৩
লেখনিতে : মিমি মুসকান

পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে নিতি’র সাথে কোনো কথা বলি নি। বলার ইচ্ছে ও নেই, শুধু শুধু আমাকে কটু কথা বলে। তাই ঠিক করলাম আজকের পর থেকে নিতি কে এড়িয়ে চলব। ক্যাম্পাসে বসে আছি আজ আর ক্লাস করার ইচ্ছা নেই। ইতি এসে আমার পাশে বসল। বসেই শুরু করে দিলো কাল কি হয়েছে, কি বললো, কি হলো এতো কথা। আমি সব’ই শুনছি কিন্তু কিছু বলার নেই। ইতি এতো কথা বলার পর আমি আনমনে ইতি কে জিজ্ঞেস করি…

– ইতি! তোর কি মনে হয় উনি আমাকে ভালোবাসে!
ইতি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কিঞ্চিত হেসে বলে…
– ভালোবাসা’র জন্য কি দরকার বলে মনে হয় তোর!
– আমি কিভাবে বলবো? আমি কাউকে ভালোবেসেছি নাকি? তুই বাসিস তুই বল!
– সবার ভালোবাসার ধরন এক না! আচ্ছা তোর কি মনে হয়?
– আমার কিছু মনে হলে তোকে জিজ্ঞেস করতাম কি!
– কিন্তু যাই বলিস আমার মনে হয় তোকে ভালোবাসে ভাইয়া।
– তবে উনি যে অস্বীকার করে।
– অস্বীকার মানে তুই জিজ্ঞেস করেছিলি, কবে করলি!
– গতকাল!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

– বাহ বলতে হবে নিতি আর কোন কাজ করল আর না করল গতকাল ওর কথার কারণে তুই এই কাজ টা তো করলি!
আমি ইতি’র দিকে তাকিয়ে আছি। ও মুচকি মুচকি হাসছে। অতঃপর আমাকে বলল…
– কি জিজ্ঞেস করেছিলি তুই!
– কি জিজ্ঞেস করেছি এটা জেনে লাভ নেই কি বলেছে এটা‌‌ শুনলে অবাক হবি।
– মানে…
– জানি না!
– আরে কি বলেছে এটা বল।
– আরে বইন বলেছে সে জানে না।
– কিহহ
– হুম।
– এটা কেমন উওর!
– জানি না!
– আচ্ছা তুই ভালোবাসিস তো।
– জানি না!

– কি জানি না জানি না শুরু করলি তোরা, হ্যাঁ বলতে কষ্ট লাগে নাকি।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। ইতি বলতে শুরু করে…
– ভাইয়া মুখে যত’ই বলুক জানে না, তবে সে ভালোবাসে এটা আমি জানি।
– আসছে বিজ্ঞানী!
– চুপ কর! তোর সাথে কি হয়েছে এটা কি তুই পুরোটা জানিস?
– মানে…
– যেদিন তুই মামী বাড়িতে একা ছিলি তুই জানিস সেদিন সারারাত ভাইয়া তোর বাসার বাইরে ছিলেন। এমনকি ভাইয়া কে বাসায় রেখেই আমি তোর জন্য খাবার আনতে গিয়েছিলাম।
আমি ইতি’র দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। এতো কিছু আর আমি কিছু জানি না।
ইতি আবারও বলতে শুরু করে…

– সেদিন যখন বিয়ে নিয়ে তোর সাথে ঝগড়া করে বের হলাম, কিছুদূর যেতেই হঠাৎ করেই ভাইয়ার গাড়ি থামল আমার সামনে। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। ভাইয়া এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন”কি হয়েছে”? তুই কাঁদছিস কেন? অতঃপর ভাইয়া কে আমি সব বলি কিন্তু ভাইয়া আমাকে এটা বলিনি যে ভাইয়াই তোকে বিয়ে করবে। প্রথমে ভেবেছিলাম তোর জন্য কোনো ভালো পাত্র নিয়ে আসবে কিন্তু এখানে তো..
আচ্ছা যাই হোক ভাইয়া কিন্তু কখনো তোকে দয়া করেনি আমার যা মনে হয় যা করেছে তোকে ভালোবেসে করেছে।

– তবে উনি যে মানতে নারাজ‌
– মানতে নারাজ কোথায়? তোর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে কি তোকে ধমকেছে নাকি মেরেছে। শান্ত গলায় বলেছে সে জানে না হয়তো সে এটা বুঝতেই পারি নি, কখন তার মনে তোর জন্য একটা জায়গা হয়ে গেছে।
– এখন এটা বোঝার উপায় কি?
– তুই নিজে..
– আমি নিজে মানে..
– তুই নিজে গিয়ে ভাইয়া কে বলবি তুই তাকে ভালোবাসিস।
– আমি!
– একটা দেবো এখন, ভালোবাসিস আর বলতে পারবি না।
– আমি কখন বললাম ভালোবাসি!
ইতি দাঁড়িয়ে যায়, অতঃপর বলে..

– ওহ্ আচ্ছা তাহলে তুই ভালোবাসিস না, ঠিক আছে আমি এখন গিয়ে নিতি’র সাথে ফ্রেন্ডশিপ করবো, তার সাথে ভাইয়ার সেটিং করে দেবো, নিতি না থাকলে নতুন মেয়ে ধরবো! তারপরও ভাইয়ার সেটিং আমি করিয়েই ছাড়বো তখন কাদিস বসে।
– তুই এমনটা কেন করবি।
– কেন করবো মানে, আচ্ছা আমাকে তুই বল ভাইয়া কেমন?
– ভালো, কেয়ারিং,‌‌খুব হেল্প করে আমার, বিশ্বাস ও করে।

– তো এখানে আর বাকি কি,‌সব মেয়েরা তো এমন একজন কেই চায় তাই নয় কি। আর তোর মনে আছে আনিকার বিয়ের কথা, সবাই তোকে খারাপ ভাবলেও ভাইয়া কিন্তু সেদিন তোর পাশে ছিল আবার এই প্রেগনেন্সি নিয়ে ঝামেলা তখনও ভাইয়া’ই ছিল তোর সাথে। সে কি তোর হাত ছেড়ে দিয়েছিল না তো বরং আরো শক্ত করে ধরেছিল যেনো তোর হাত ছুটে না যায়। দেখ মান আর না মান ভাইয়া কে তুই ভালোবাসিস আর এটাই সত্যি। এখন শুধু তার মুখ থেকে ভালোবাসি কথাটা বের কর। তাহলেই বুঝবি ভালোবাসার আসল মানে। তোদের #ভালোবাসার_ফোড়ন কিন্তু অনেক আগেই ফুটে গেছে। এখন শুধু বোঝবার অপেক্ষা।

গাড়িতে বসে আছি, উনি ড্রাইভ করছেন। আমি ইতি’র কথা ভাবছি আর উনাকে দেখছি সত্যি”ই কী আমি ভালোবাসি উনাকে। ইতি শেষে একটা কথা বলেছিল..
“ভালোবাসা নাকি সুপ্ত ফুলের মতো, এটা সকল মানুষের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে এটার ‌ সৌন্দর্য নাকি অপূর্ব। মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে একটু ভালোবাসার জন্য কুঁকড়াতে থাকে। সবার ভাগ্যে এমন ভালোবাসা থাকে না। এটা সত্যি’ই ফুলের মতো স্নিগ্ধতায় ভরপুর আবার গোলাপের পাপড়ি মতোই নরম”

কথা গুলো ভালোই লেগেছিল, তবে একটু বেশি কবি টাইপ লাগলো। আসলে প্রেমে পড়লে নাকি মানুষ কবিতা লেখে মনে হচ্ছে ইতি কে সেটাই পয়েছে। প্রেম, ভালোবাসায় একাকার। আমি আড় চোখে উনাকে দেখছি। উনি শান্ত ভাবেই গাড়ি চালাচ্ছে। হুট করেই বলে উঠে…
– নিতি আর কিছু বলেছে তোমায়?
আমি খানিকটা অবাক হই, তার মানে উনি জানে নিতি আমাকে এসব বলেছে। আমি বলে উঠি…

– না!
– ভালো তার তোমাদের ব্যাপার তাই আমি আর মাঝে ঢুকি নিই। তোমার যদি ভালো লাগে এভাবে মানুষের কথা শুনতে শোন তুমি। আমি কিছু বলবো না। যেদিন তুমি পারবে সেদিন তুমি নিজেই বলবে।
উনার কথা শুনে মন’টা খুব খারাপ হয়ে গেল। আমাকে একা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। যাই হোক আমি উনাকে আর কিছু বলবো না।

টেবিলে বসে ‌বই খোলা রেখে গালে হাত দিয়ে ভাবছি ইতি’র কথা মতো কি সত্যি আমি উনাকে ভালোবাসি! ভালোবাসি না বাসতে পারি। ইশ্ কি দ্বিধা এই ভালোবাসায়। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছি আমি। না পারছি অন্য কিছু ভাবতে, না পাড়ছি কিছু করতে। ধুর!
হঠাৎ কেউ মাথায় বাড়ি মারল, আমি লাফিয়ে উঠি। পেছনে তাকিয়ে দেখি উনি স্কেল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আবার আমার হাতে বাড়ি মেরে বলল..

– বই খুলে কার কথা এতো মনোযোগ দিয়ে ভাবছো। সামনে পরীক্ষা! মনে আছে সেই কথা! আমার বউ হয়ে শেষে ফেল করলে আমার মান সম্মান খাবে তুমি।
– ইশ কি জ্ঞান দিচ্ছে। আমি বুঝতেই পারি না আপনি ফার্স্ট বয় কিভাবে হন, সারাদিন তো ফোন নিয়ে বসে থাকেন আপনি কি পরীক্ষা দেবেন।
– আমার কথা ভাবতে হবে না তোমার? আগে বলো কি ভাবছিলে এতো মনোযোগ দিয়ে?
– কিছু না!
– বিশ্বাস হচ্ছে না, আসলে তোমাদের মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না বুঝলে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ আপনারা ছেলেরা তো সাধু নাহ!
– আচ্ছা ঘুরতে যাবে!
– এই সন্ধায়, এখন কোথায় যাবো।
– চা খেতে!

– সেটা তো ঘরেই বানানো যায়, দাঁড়ান আমি বানিয়ে আনছি।
– না আজ বাইরে চা খাবো, চলো।
– আরে হুটহাট করেই আপনার এমন ইচ্ছে হয় কেন বলুন তো।
– আপনার মন আমার ইচ্ছা তোমার সমস্যা।
– আপনিই একটা বড় সমস্যা!
– হ্যাঁ হয়েছে এই সমস্যার সাথে আজীবন থাকতে হবে তোমার চলো এখন..

বলেই আমার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলেন। উনার এমন আজব কাজে মাঝে মাঝে আমি সত্যি হতবাক হয়ে যাই।
উনি গিয়ে বাইকে বসলেন, আমাকে বললেন উনার পিছনে বসতে। আমি জিজ্ঞেস করি”বাইকে করে যাবো”?
উনি মাথা নাড়ান। অতঃপর আমার আমি উনার পিছনে বসে উনার দুই কাঁধে হাত রাখি। উনি ধীর গতিতে’ই বাইক চালাচ্ছে। ভালোই লাগছে এই ভোর সন্ধ্যায় দুইজনেই বাইকে ঘোরার মজা আলাদা। উনি আমাকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানের সামনে নামলেন। আমাকে বাইকে বসতে বলে উনি চা আনতে গেলেন। দু’কাপ চা এনে একটা আমার হাতে দিলেন, অতঃপর উনি দাঁড়িয়ে চা খেতে থাকে আর আমি বাইকে বসে। দুজনের মাঝেই নিরবতা। চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর দ্রুত গতিতে চলে যাওয়া গাড়ি গুলোকে দেখছি। সবার’ই তাড়া আছে কোথাও না কোথাও যেতে। আসলেই জীবন কখনো থমকে থাকে না।‌ সবসময় আপন গতিতে চলতে থাকে ঠিক এই গাড়ির মতো। কখনো সোজা চলে তো কখনো বা আঁকাবাঁকা। আর সেই আঁকাবাঁকা পথে কতো বাঁধা’ই না থাকে।

পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে পরলাম মহা বিপদে। নিতি আমার পিছনে লেগে আছে কথা বলার জন্য, আমি কি ভাবলাম ওসব নিয়ে। কিন্তু আমি কিছুক্ষণ ধরেই ওকে এড়িয়ে চলছি। আর মেয়েটা বুঝতেই চাইছে না তবুও আমার পিছনে লেগে আছে।
আমি ক্লাসে হঠাৎ নিতি আমার বাহু ধরে টেনে বলে..
– ইগনোর করছো তুমি আমায়!
আমি শান্ত গলায় বলি..
– যখন বুঝতেই পারছো তখন কেন পিছনে পড়ে আছে।
– ওহ্ আচ্ছা মুখে বলি ফুটেছে দেখছি।
– আমার কোনো কথা বলার নেই তোমার সাথে। ছাড়ো আমাকে।
– কিন্তু আমার আছে অনেক..

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ৩২

– আমি বললাম তো আপু আমার কোনো কথা নেই তোমার সাথে আমাকে যেতে দাও তুমি।
– আরে এতো তাড়া কিসের তোমার? আমি তো তোমাকে কিছু করছি না তাহলে…
আমি আশপাশ তাকিয়ে দেখি সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি শান্ত ভাবে নিতি কে বলি..
– আমার ক্লাস আছে আপু, দেরি হচ্ছে যেতে দাও।
– তো আটকাচ্ছে কে? যাও কিন্তু আমার কিছু কথার উওর দিয়ে…
– মানে?
– মানেটা খুব সহজ, কি করেছো তুমি আমার আহি’র। ওর মাথা টা চিবিয়ে খেয়েছো নাকি? তোমাকে ছাড়া যে কিছু বোঝতে চায় না।

নিতি কথায় অনেক রাগ হলো। প্রথমে বলছে আমার আহি, যেনো তার’ই সবকিছু। আরে বইন বর তো আমার, তারপর আবার আমাকেই কথা শুনাচ্ছিস। আমি শান্ত ভাবে বলি উঠি..
– আপু সেটা তুমি তোমার আহি কে জিজ্ঞেস করো কেমন।
– মুখে মুখে তর্ক করছো আমার।
মুচকি হেসে বলি..
– আল্লাহ আপু কি বলো! মুখে তর্ক করবো কেন? শুধু উওর দিচ্ছিলাম।
– তুমি ভাবতেও পারছো না আমি তোমার কি হাল করতে পারি।
– বিশ্বাস করো ভাবার ইচ্ছে ও নেই।
– নিহা!
– চেচিও না আপু সবাই দেখছে।

– দেখুক, সবারও জানা উচিত তুমি কি করেছো আহি’র সাথে।
পিছনে তাকিয়ে দেখি উনি দাঁড়িয়ে আছেন। দেখছেন আমাদের কে, আমি উনার দিকে কালকের কথা গুলো মনে করি। অতঃপর বলে উঠি…
– আজ বলছো আমি করেছি কিন্তু সেদিন তো বলেছিলে যা করার সব উনি করেছে আমার সাথে। সাপের মতো মানুষের দু’মুখ আছে শুনেছিলাম আজ বরং তা দেখেও নিলাম।
নিতি রেগে বলে উঠে..
– তোমার এতো সাহস, তোমাকে তো আমি!
বলেই আমাকে চড় দেওয়ার জন্য হাত তুলে…

ভালোবাসার ফোড়ন পর্ব ৩৪