ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১০

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১০
Suraiya Aayat

টেবিলে সবাই নাস্তা করতে বসেছে, সকাল আটটার মধ্যে নাস্তার টেবিল রেডি। ফুপি সকাল সকাল নাস্তা না করেই বেরিয়ে গেছে। খাওয়ার টেবিলে সবাই উপস্থিত আমি বাদে। আমার মন মেজাজ কোনটাই ভালো নেই। দরজার খটখটানির আওয়াজে আমার ধ্যান ফিরতেই উঠে বসলাম আমি, সানা এসেছে। সানার দিক তাকাতেই বুঝলাম যে তার চোখে একরাশ কৌতূহল লুকিয়ে আছে। সে আমার থেকে কিছু জানতে চাই। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললাম,

‘কিছু বলবি? ‘
সানা জবাব দিলো না বরং আমার পাশে এসে বেশ আয়েশ করে বলল,
‘কিছু একটা তো হয়েছে আমাদের আরুপাখির। নাহলে সে এতো চুপচাপ। ‘
আমি বোঝার চেষ্টা করে বললাম,
‘কি আবার হবে, কিছু হয়নি।’
আমার কথা যে সানা এতো সহজে বিশ্বাস করবে না তা আমি জানতাম বেশ আর হলোও তাই। সানা আমাকে খোচা মেরে বলল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ভাইয়া কিছু বলেছে? রাগ করে আছিস ভাইয়ার ওপর? ‘
আমি রাগ দেখানোর প্রবল চেষ্টা চালিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছা আমি কি দু দন্ড চুপ করে থাকতেও পারবো না? সবকিছুতে ওনাকে কেন টানেন সবাই? ‘
আমার কথা শুনে সানা বেশ দমে গেল। ও বেশ আকুতি করে বলল,
‘সরি সরি ভাইয়ার আরুপাখি। আমি সেভাবে বলতে চাইনি। ‘
আমার কাধ থেকে সানার হাতটা সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেলাম আমি। সানা এখনো যেন মুখ গোমরা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি এতখন হাতে কা/টার মলম লাগিয়ে শুয়ে ছিলাম। আরিশ ভাইয়া নিশ্চয়ই খাওয়ার টেবিলে বসে আছেন তাই আমি খাবো না। ওনার সামনে যেতে আমার ভালো লাগছে না।

আমি ওয়াশরুম থেকে বার হলাম প্রায় দশ মিনিট পর। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই সানার অনবরত পাইচারি দেখে থমকে গেলাম যেন যদিও এটা নতুন কিছু নয়। সানা কোন কথা ভুলে গেলে যতখন না পর্যন্ত সে সেই কথাটা তার পেট থেকে ওতরাতে না পারে ততখন তার এই পাইচারি থামে না। আর এই মুহূর্তে তার সেই ভুলে যাওয়া কথাটা যে সে আমাকেই বলবে তা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমাকে দেখতেই সানা একপ্রকার হামলে পড়লো যেন। আমার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বিছানায় বসলো। আমি ওর দিক চোখ ছোট ছোট করে তাকাতেই ও ভুলসূচক একটা চাহনিতে চেয়ে বললো,
‘আমি এতোটাও ভুলোমন কি করে হতে পারি? কি করে এতো বড়ো কথাটা ভুলে যেতে পারি আমি? হাও স্টুপিড আই এম। ‘
এটা ছিল সানার সূচনা পর্ব, আর শিরোনাম আসতে যে কতো দেরি তা আমার বুঝতে বাকি নেই। তার দিকে চেয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললাম,

‘এত ভনিতা না করে আসল কথাটাও কিন্তু বলা যায়! ‘
সানা উচ্ছাসের সাথে বলল,
‘আরে ফারিন আপু আর ভাইয়াকে নিয়ে কথাটা। তোকে না বললেই নয়। কালকে সন্ধ্যায় অনেক কিছু ঘটে গেছে যা তোর কাছে এখনো অজানা। ‘
একটা অজানা ধোঁয়াশার আভাস পাচ্ছি আমি, তাই না শুনলেই নয়। আমি এবার নরম হয়ে ওকে প্রশ্ন করলাম,
‘ কি হয়েছে ওনাদের?’

সানা আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো, আর ঠিক কাটা জায়গাটার ওপর। এখন যদি আমি আ উ করি তো সে তার আসল কাজের কথায় ভুলে যাবে। আমি ব্যাথা সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম, সানা বলতে শুরু করলো।
‘ কালকে ভাইয়াকে জ্বর অবস্থায় ফারিন আপু ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ঘোরাঘুরি করতে। অতঃপর ফেরার পর ভাইয়ার জ্বরটা বেড়ে যায়। ভাইয়া ওষুধ খাইনি ততখনেও। দুপুরে খাওয়ার পর ফারিন আপু ওনাকে ওষুধ দিয়েছিল। ভাইয়াকে জ্বরের ওষুধ না দিয়ে উনি ভুল করে মাথা ব্যাথার ওষুধ দিয়েছিল। ভাইয়া নিজেও আর চেক করে দেখেনি কিসের ওষুধ। তোরা যখন চলে আসিস ততখনে ভাইয়া ঘুমিয়ে গেছিল। যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ বাজে। গায়ের জ্বরটা ততখনে অনেকটা বেড়ে গেছিল।

ভাইয়া রুম থেকে বেরিয়ে আসলো ফারিন আপুকে এটা জিজ্ঞাসা করার জন্য যে সে ওষুধের পাতাটা কোথায় রেখেছে। আপু ভাইয়ার কথায় তোয়াক্কা না করে প্রশ্ন করে উঠলো,
‘তোমার ঘরে আর একটা বেলি ফুলের মালা দেখলাম, ওটা কার জন্য? ‘
আরিশ ভাইয়া আপুর কথাটাকে এড়ানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু উনি তো নাছোড়বান্দা। উনি সমান তালে জেদ নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন,
‘ ওটা আমার জন্য কিনলে তুমি আমাকে ওটা দাওনি কেন? ‘
একটা পর্যায়ে গিয়ে ভাইয়া বুঝলো যে এতো সহজে বিষয়টা থেকে তার মুক্তি নেই তাই না পেরে বলেই উঠলেন,
‘ওটা আরুপাখির। ‘

‘আরুপাখি’ নামটা শুনতেই ফারিন আপু রেগে গেলেন আর ধমকের শুরে জোরে জোরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ ওই মেয়েটার জন্য তোমার এত কিসের দরদ? তাছাড়া তাকে তুমি এতো বছর যাবৎ পড়াচ্ছ, তোমার তো জানা উচিত যে সে ফুল পছন্দ করে না তারপরও তুমি কেন কিনেছ ওটা তার জন্য? ‘
আরিশ ভাইয়া রেগে গেল। তবুও নিজের রাগটাকে সংযত করে ফারিন আপুকে বললেন,
‘ ও বেলিফুল পছন্দ করে তাই এনেছি। এবার বলো ওষুধ টা কোথায় রেখেছো? আমার এখন কথা বলতে ভালো লাগছে না। ‘

কথাটা শুনে ফারিন আপু ভাইয়ার ঘরের দিকে ছুটে গেলেন, আর ভাইয়ার রুমে গিয়ে টেবিলের ওপর থেকে মাথায় দেওয়ার বেলিফুলটা তখন নষ্ট করতে লাগলেন। ভাইয়া ততখনে রুমে গিয়ে দেখেন উনি একটা মালা নষ্ট করেছেন। ভাইয়া ওনাকে থামতে বললেও উনি থামেননি।
ফারিন আপু হাতের মালাটা নষ্ট করার জন্য উদ্যত হওয়ার সময় বললেন,
‘আমাদের বিয়ের পর ওই মেয়ের প্রতি তোমার এতো আদিক্ষেতা আমি কখনোই সহ্য করবো না। ওর জন্য শুধু তুমি এমন রাগী এমন গম্ভীর। তুমি আগে তো এমন ছিলে না। যবে থেকে ওই মেয়েটা এলো তবে থেকে আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে। বেয়াদপ মেয়ে একটা। ‘

কথাটা বলা মাত্রই ভাইয়া ফারিন আপুর হাত ধরে ঘর থেকে বার করে দিলেন আর ফারিন আপুর হাত থেকে তোর হাতের জন্য কিনে আনা বেলিফুলের মালাটা কেড়ে দিয়ে একটা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,
‘ আমার মনে কখনো অযাচিত ভাবে ঢোকার চেষ্টা করলেও এই ভাবেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবো এই কথাটা মাথায় রেখো। আমার ওপর তোমার এসব সো কল্ড অধিকার খাটাতে আসলে নেক্টট টাইম আমি ভুলে যাবো তুমি আমার কাজিন। ‘
কথাটা বলে ভাইয়া মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিলেন।
এতো কিছুর পরও ফারিন আপু থেমে থাকলেন না। কাঁদতে কাঁদতে আম্মুর সামনে খালামনির কাছে ফোন করলেন আসার জন্য।

সে নাকি ভাইয়া ছাড়া আর কাওকে মেনে নেবে না। আম্মু ফারিন আপুর কথাতে সায় দেইনি একটিবারও। খালামনি আর খালুমনি তারাও তাদের মেয়ের কথায় তাল দিতেই ভাইয়া পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে সে কখনো ফারিন আপুকে বিয়ে করবে না।কথাটা বলেই ভাইয়া বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে।
তারপর তো ভাইয়া এলো তোদের বাসায় আর তারপর কি হলো তো তুই জানিসই।

সানার কথা শুনে আমি শিউরে উঠলাম রিতিমতো। উনি ফারিন আপুকে সত্যিই এই কথাগুলো বলেছেন? সানার এতগুলো কথা শুনে নিজেকে ভুল প্রমাণিত হতে এক মিনিট ও দেরি করলাম না আমি। কেবল সানার দিকে একবার তাকিয়ে ওড়নার নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলাম রুম থেকে। দৌড়ে নীচে গিয়ে খাবার টেবিলের সামনে যেতেই দেখলাম উনি সহ বাবা আর আম্মু বসে আছেন টেবিলে। আমার নাম ধরে আম্মু ডাকতেই উনি কেবল একটা বার আমার দিকে তাকিয়ে পুনরায় খাওয়াই মনোযোগ দিলেন। আমি ব্রেডটা কেটে কয়েক টুকরো করে ফেলেছি। ওনার দিক তাকিয়ে থাকলে নিজেকে নার্ভাস মনে হচ্ছে। উনি ওনার মতো খাচ্ছেন। সানা পাশে এসে বসলো। আমার এমন কাজে সে নিজেও বোধহয় অবাক। আমি এক টুকরো খাবার মুখ তুলিনি। ওনার দিকে তাকিয়ে একরাশ সাহস সঞ্চয় করে মিনমিন করে বললাম,

‘আরিশ ভাইয়া! ‘
উনি কেবল আমার দিকে তাকালেন, কোন উত্তর দিলেন না। আমি বুঝলাম যে উনি বাকি কথাটা বলতে বলছেন। আমি দেরি না করে বললাম,
‘আমার আপনার সাথে একটা কথা ছিল। খাওয়ার পর একটু রুমে আসবেন? ‘
উনি আমার কথায় সরাসরি নাচক করে বললেন,
‘যা বলার এখানেই বলো। ‘
আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো, আমি তবুও দমে গেলাম না। পুনরায় বললাম,
‘ আমার স্টাডি রিলেটেড।’
উনি আর কিছু বললেন না। বাবা আম্মু সহ উনি বেশ স্বাভাবিক, শুধু আমার নিজেকেই এমন অস্বাভাবিক লাগছে। আমি নিরবে খেতে লাগলাম। আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। শুধু মনে পড়ছে ওনাকে বলা শেষ কথাটা।
‘আমার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলুন। ‘
কথাটা মনে পড়তেই আমার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো। ওনার মুখের দিকে আড়চোখে মাঝে মাঝে তাকাতে লাগলাম আমি।

‘আচ্ছা উনি কোনভাবেই আমার থেকে ডিসটেন্স মেইনটেইন করে চলছেন না তো! ‘
কথাটা ভাবতেই খাবার টেবিলে উঠে দাঁড়ালাম আমি। আমি উঠে দাঁড়াতেই বাবা আম্মু সানা সকলেই চমকে গেল কিন্তু উনি আমার দিকে তাকালেন না বিন্দুমাত্র।
আমি কাওকে তোয়াক্কা না করে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া আপনার সাথে আমার কথা আছে। আমি কাঠগোলাপ গাছে জল দিতে যাচ্ছি। আপনি ওখানে চলে আসুন। ‘
কথাটা বলে না খেয়ে উঠে পড়তেই বাবা অবাক হয়ে বললেন,
‘ মাঝে মাঝে যে কি পাগলামো করে মেয়েটা। ‘
আরিশ ভাইয়া নিজেও আর কিছু মুখে তুললেন না, খাবার ছেড়ে উঠে শুধু বললেন,
‘মাঝে মাঝে না সবসময় পাগলামো করে। ‘
কথাটা আমার কান অবধি পৌছালো না।
কাঠগোলাপ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। গাছটায় সাদা ফুলে ফুলে ভর্তি। আমি চঞ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ওনাকে অনেক কিছু বলার আছে।
হঠাৎ পিছনে কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘আরিশ ভাইয়া, আই এম সরি। ‘

উনি গম্ভীরতার মাঝেও একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
‘আমাকে সরি বলার মতো কিছু নেই। আমি কারোর কেও নই। যাই হোক। কালকে থেকে আমার ডিউটি আছে। আমি আর পড়াতে আসতে পারছি না। আর ফুপাকেও বলে দিয়েছি তোমার জন্য নতুন টিচার দেখতে। তোমার আপত্তি থাকার কথাও না। যাই হোক তোমার এইচএসসি র জন্য অগ্ৰিম অল দা বেস্ট। ‘

ওনার এমন কথা শুনে আমার বুক এর ভিতর ধুকধুক করতে লাগলো, সব কথা তালগোল পাকিয়ে গেল আর চোখ ছাপিয়ে চোখ থেকে অনবরত টপটপ করে জল গড়াতে লাগলো। উনি আমার দিক একবার তাকিয়ে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। অন্য সময় ওনার সামনে কখনো কাঁদলে উনি ধমক দিয়ে কান্না থামিয়ে নিজেই চোখ মুছিয়ে দেন, আজ তার ব্যাতিক্রম। উনি দেখেও না দেখার ভান করতে লাগলেন।
উনি নিরবে চলে যেতে নিলেই আমি ওনার হাত ধারলাম আঁকড়ে। উনি পিছু ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু উচিয়ে ইশারায় প্রশ্ন করলেন যে কি হয়েছে।
আমার চোখ থেকে এখনো জল গড়াচ্ছে। আমি ওনার হাতটা শক্ত করে ধরে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম,

‘ আমার আপনাকেই লাগবে। আমার জীবনের শেষ সময় অবধিই আরিশ খান নামক টিচারটাই লাগবে। ‘
উনি হাত ছাড়িয়ে নিলেন কিছু বললেন না। আমি ওনার পাশে গিয়ে ওনার দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে ভাঙা কন্ঠে বললাম,
‘ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে বলেছি বলেই ডিসটেন্স মেইনটেইন করতে হবে? এতোটা ভালো মানুষ ও আপনাকে হতে বলিনি তে আমার অন্যায় আবদার গুলোও আপনাকে মানতে হবে। আর হ্যা কালকে সকালে আমার মক টেস্ট আছে আপনার কাছে। সকাল সকাল যেন আমার বাসায় আপনাকে দেখি না হলে আপনার খবর আছে। ‘
কথাটা বলে চলে যেতে লাগলাম। আর কিছু একটা মনে পড়তেই দাঁড়িয়ে গেলাম আর ওনার দিকে ঘুরে চোখ পিটপিটিয়ে বললাম,

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ৯

‘আর হ্যাঁ নো মোর ওয়ার্ডস।’
কথাটা শুনে উনি কোন পতিক্রিয়া দিলেন না। আমিও চেয়ে থাকবো গোটা একটা দিন ওনার অপেক্ষায়। উনি কি সত্যিই আমাকে ফিরিয়ে দেবেন?

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ১১