মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩১

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩১
ইফা আমহৃদ

পরীক্ষার খাতার ঝড়ের গতিতে চলছে কলম। ক্রমাগত লেখার পরে ক্ষণে ক্ষণে হাতে টান পড়ছে। ব্যথায় টনটন করে উঠছে। ব্যথাকে দূর করতে মাঝে মাঝে হাত ঝাড়া দিচ্ছি। কিছুটা দূরত্বে ফ্যান থাকার ফলে ঘেমে একাকার হয়েছি। জানালার পাশে সিট পড়েছে। মাঝে মাঝে দৃষ্টি অদূরে নিবদ্ধ করছি।

হাতের সিলভার রঙের ঘড়িটার দিকে অবলোকন করলাম। ফুড়িয়ে এসেছে সময়। দশ মিনিট উচ্ছিষ্ট। শান্তি অনুভব করলাম। কলমের কেপ লাগিয়ে বেঞ্চিতে রাখলাম। শরীর টানটান করে খাতার দিকে দৃষ্টিপাত করতেই তাজ্জব বনে গেলাম। দু’চোখের পলক সেকেন্ডের ব্যবধানে থেমে গেল। দ্রুত খাতা স্পর্শ করলাম। একটু আগের লেখাগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যতায়। প্রতিটি পৃষ্ঠার একই হাল। অবিলম্বে লেখা বিহীন সাদা খাতায় পরিনত হল। এই কলমটা আসার সময় কিনে এনেছি। নিশ্চয়ই ভেনিস কলম। লোকটা তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ভেনিস কলম দিয়েছে। সময় মাত্র দশ মিনিট। এই সময়ে পুনরায় লেখা সম্ভব নয়। মাথা ধরে উঠেছে, কী করব বুঝতে পারছি না।
পেছন থেকে আঁখি মৃদু গলায় বলল, “চড়ুই কোনো সমস্যা? তোকে নার্ভাস লাগছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উপলব্ধি করলাম তরল পদার্থগুলো কপাল গড়িয়ে পড়ছে। ম্যাজিকের ন্যায় সেখানে ধ্রুব স্যার উপস্থিত হলেন। তার বিষয় পরীক্ষা দরুন জানতে এলেন ‘প্রশ্নপত্র কেমন হয়েছে।’
সবাই খুশি মনে প্রতুক্তি করতে পারলেও আমি পারলাম না। চশমার ভেতর দিয়ে কেবলমাত্র খাতার দিকে আমার নিবদ্ধ দৃষ্টি। ধ্রুব পুরো কক্ষ পর্যালোচনা করার সময় আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ক্ষিপ্র গলায় বললেন, “প্রশ্ন কেমন হয়েছে?”
কম্পিত গলায় সঙ্কিত হয়ে বললাম, “ভা-ভালো!”
“ভালো এবং ছোট একটা প্রশ্ন করেছি, এতে এত কাঁপা কাঁপি করছ কেন?
লেখা শেষ?”
মৃদু আওয়াজে, “হম!”
“কিন্তু খাতা খালি কেন?”

এবার নিজেকে সংযত করতে ব্যর্থ হলাম। বেঞ্চিতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম। এত এত কষ্ট করে লেখার পর আমি কিচ্ছু লিখিনি। আজকে সকালে ধ্রুবের কড়া হুংকার, তারপরেও কেন একটু সচেতন হইনি। খাতা হাতে পাওয়ার পর আরও ঝাড়বে।
কিয়ৎক্ষণ সরল গলায় ডাকলেন আমায়। আমি ক্রমশ কেঁদেই চলেছি। ধ্রুব আমার পাশের মেয়েকে আমায় ডাকতে বললেন। ভার্সিটিতে অবস্থানরত ছাত্রীর গায়ে হাত দেওয়া সাজে না।
আমি চোখ মুখ মুছে ধীরে ধীরে ধ্রুবের মুখশ্রীর দিকে তাকালাম। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, “কী হয়েছে, কাঁদছ কেন?”
কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, “আমার খাতা, আমার লেখা।”

“সেটাই তো জানতে চাইছি, কী হয়েছে?”
সংক্ষেপে বললাম, “ভেনিস।”
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। খাতাটা হাতে নিয়ে পুরো খাতায় নজর বন্দি করলেন। পুনরায় খাতাটা বেঞ্চিতে রাখলেন। লিপ্ত হলেন গভীর মানসিক উদ্‌বেগে। আশে পাশে সন্দিহান চোখে চেয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, “লেখার সময় দেখে লিখবে না? আশ্চর্য!”
বিরক্তিকর নজরে ব্যাপারটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন সামনের দিকে। তৃতীয় সারির কর্ণারে থাকা মেয়েটা কিছু একটা বললেন। আমি নিজের চিন্তায় মশগুল থাকায় শ্রবণ হলনা সেই কথন। মেয়েটার থেকে কমলা পানীয়ের বোতল নিয়ে সামনাসামনি এসে দাঁড়ালেন। ছিপি খুলে এক ঢোক পান করলেন। অতঃপর হাতে নিয়ে খাতার উপর ছিটিয়ে দিলেন। বিষয়টা বোধগম্য হতেই খাতা টেনে সরিয়ে ফেললাম। অশ্রুসিক্ত চোখে পলক ফেলে বললাম, “কী করছেন আপনি? ভিজে যাচ্ছে তো!”
“আমি বুঝে নিবো, রাখো এখানে..

প্রথম শব্দগুলোতে মার্জিত শব্দ ব্যবহার করলেও পরবর্তী শব্দে দ্বিগুণ তেজ প্রকাশ করলেন।‌ আমি কাঁপা কাঁপা হাত বেঞ্চিতে রেখে মাথানত করে রইলাম। তিনি তার মর্জিমত ঢেলে অসন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “দেখো, এবার ঠিক আছে কি-না!”
পানির সংস্পর্শে এসে লেখাগুলো জীবন্ত হয়ে উঠল। ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত হল। অপ্রত্যাশিত হাসির রেখা ফুটল। দু’গালে হাত স্থাপন করে মৃদু হেসে বললাম, “থ্যাংক ইউ!”
“ওয়েল কাম” তো বললেনই না, বিনিময়ে বাজখাঁই ভীষণ দিলেন, “ফ্যাচ ফ্যাচ কাদা কোথায় শিখেছ বলো তো? আগে তো দেখিনি। তখন স্ট্রং ছিলে। মানুষের ধীরে ধীরে উন্নতি হয় আর তোমার অবনতি হচ্ছে।

নেগেটিভ কোনো পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে সর্বপ্রথম মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়, অতঃপর বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজতে হবে। নাকের জলে চোখের জলে ভাসিয়ে দিলে সমস্যা থেকে বের হওয়া তো যাবেই না, বরং সে জল দিয়ে দেশ তলিয়ে যাবে।”
কথন থামার পূর্বেই স্থির পাজোড়া গতিশীল করে দ্রুত বেগে অগ্ৰসর হলেন। আর পাঁচটা সময়ের মত এক কর্ণপথ দিয়ে ঢুকল অন্য কর্ণপথ দিয়ে বেরিয়ে এলো। তার গমনপথের দিয়ে চেয়ে কিস্ ছুঁড়ে দিলাম। গালে হাত দিয়ে অপ্রকাশিত স্বরে বললাম, “মাই বেস্ট হাজবেন্ড।”
“এই মেয়ে কী হচ্ছে এইসব?” পাশের সিটে বসা মেয়েটার এমন প্রশ্ন শ্রবণ হতেই ফিরে দেখলাম। অধর চেপে বললাম,”সমস্যা কী?”

“স্যারকে তুমি কিস্ ছুঁড়লে কেন? তুমি একদম স্যারের আশেপাশে যাবেনা। তোমার জন্য স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, লাঠিচার্জ করেছে। তুমি স্যারের আশেপাশে গেলে আমরা বিক্ষোভ করব। বুঝেছ?”
“কচু করবে।”
[আমার বিড়াল আমাকে বলে ম্যাও, যত্তসব। আমার সাতবছর আগের বিয়ে করা বর, আমাকে বলে দূরে থাকতে] ঈর্ষা জাগল ঈষৎ। কে ধ্রুবকে এত পারফেক্ট হতে বলেছে। পারফেক্ট না হলে মেয়েরা এভাবে লাইন দিতো না। অসহ্যকর, বিরক্তিকর।
মুখ ভেংচি দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে এলাম।
পরীক্ষা শেষ। বেল বেজেছে মিনিট খানেক পূর্বে। ভারাক্রান্ত মন সমেত ক্যাম্পাসে বসে আছি। আমাকে গোল করে বসেছে বন্ধুমহল। আজকের ব্যাপার নিয়ে বড়সড় গন্ডগোল ঠেকছে তাদের কাছে। আঁখি জোর গলায় বলে, “তোর আর ধ্রুব স্যারের ভেতরে কী হয়েছে বলত?”

“কী হবে, কিছু হয়নি।” একরোখা জবাব আমার।
প্রিয়া হা হুতাশ করতে করতে বলল, “আমি সিউর তোদের ভেতরে কিছু একটা চলছে।”
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বললাম, “কে বলেছে তোদের?”
“কে আবার বলবে? ভার্সিটির মেয়েদের দেখেছিস। কী সাংঘাতিক মাইরি। স্যারকে পুলিশে ধরায় ভার্সিটিতে কী বিক্ষোভ। তারপরে থানায় চলে গেল। ওদের জন্যই তো ধ্রুব স্যারকে ছাড়তে হয়েছিল।”
তারিফের কথায় সম্মতি দিয়ে নিরব বলে, “একদম। কী গলা মাইরি, একদম বাঁশ। তোকেও খুঁজেছিল।”
বিগত দিনগুলোতে ঘটে যাওয়া প্রতিটা ঘটনা বোধগম্য হল। অথচ আমি জানতামই না। সকালের অগোচরে নিজেকে প্রচুর রকম কটুক্তি করলাম।

প্রিয়া আলতো হেসে বলে, “তোর কি ধ্রুব স্যারকে ভালোলাগে?”
সকলে চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে আমার মুখশ্রীর দিকে চেয়ে আছে। তা দেখে টেনে টেনে বললাম, “চুপ করবি। উনি আমার স্যার হয়।”
“আচ্ছা উনি।”
“চুপ করবি তোরা, সবসময় মজা। আমি চললাম..
আমি উঠতেই হাত ধরে ফেলল প্রিয়া। ফোড়ন দিয়ে বলে, “ধ্রুব স্যারের আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, চড়ুইকে ভালোবাসবে। তাহলেও হয়েছে।”
কথাটা আমাকে বিদ্রুপ করে বলা হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। রাগান্বিত স্বরে বললাম, “কেন আমাকে ভালোবাসা যায়না?”
আঁখি ছোট করে বলে, “যায়, কিন্তু ধ্রুব স্যার নয়। অন্য কেউ।”
রাগে গজগজ করতে করতে বললাম, “চ্যালেঞ্জ করছিস আমায়। ঠিক আছে। ঐ ধ্রুব যদি ‘ভালোবাসি’ বলে, তাহলে মেনে নিবি তো। বাই..
কাউকে বাক্য উচ্চারণ করতে না দিয়ে ধপাধপ পা ফেলে বেরিয়ে এলাম। সবকিছু বিষাদময় ঠেকছে। ইচ্ছে করছে সবাইকে জানিয়ে দেই, “ধ্রুব আমার হাজবেন্ড।”

ভার্সিটির বাইরের রাস্তাটা অন্যসব রাস্তার থেকে তুলনামূলক নিচু। গতরাতের বৃষ্টির পানি জমে আছে রাস্তায়। এদিকে গাড়ি নেই বললেই চলে। আসার সময় ভার্সিটি থেকে অনেকটা দূরে গাড়ি থেকে নামতে হয়েছিল। আর ধ্রুব! সে তো আমাকে রেখেই চলে এসেছে। এখন আবার বাড়ি ফিরতে হবে। সূর্য নেই। বৃষ্টিহীন পরিচ্ছন্ন আকাশ। হাতের সহায়তায় প্ল্যাজু একটু উঁচু করে হাঁটা দিলাম। প্যাঁক প্যাঁক শব্দ হচ্ছে। শব্দটা একটু তীক্ষ্ণ হতেই পাশে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। ধ্রুব গভীর ভাবে পানির ভেতরে হেঁটে আসছে। মনে হচ্ছে, পানি নেই, শুষ্ক মাটি। কিছুক্ষণের মাঝেই আমাকে অতিক্রম করে চলে গেলেন। আমিও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলাম। ধ্রুবের কাছাকাছি যেতেই দেখলাম তিনি রিক্সা ভাড়া করে দাঁড়িয়ে আছেন। ফট করে রিক্সায় উঠে একপাশে সেঁটে গেলেন। তার ব্যবহারে আমাকে বসার আহ্বান করেন। আমি এড়িয়ে গেলাম। তিনি সত্বর কণ্ঠে বললেন, “কী হলো, এদিকে কোথায় যাচ্ছো?”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩০

“বাড়িতে যাচ্ছি।” রিনরিনে জবাব।
“সামনে আমি সমান গর্ত। পানিতে ভরে আছে। জামা কাপড় নোংরা হলে আমি কিন্তু একটা টাকাও নষ্ট করব না।”
লাগবে না, আমি ধুয়ে নিবো।
“ডিটারজেন্ট কিনতে টাকা লাগবে। একই হলো তো!”

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩২