মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩২

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩২
ইফা আমহৃদ

গুটিগুটি পায়ে হেঁটে রিকশার কাছে দাঁড়ালাম। ধ্রুব এক সমুদ্র সমপরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে সেঁটে আছে। বিরক্তিকর দম ত্যাগ করলাম। সকালের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণের নিমিত্তে এখন আমার অভিমান ধরার কথা, অথচ আমাকে উপেক্ষা করে তিনি রাগ দেখাচ্ছেন। তাজ্জব ব্যাপার! অভিমানে জর্জরিত কণ্ঠে বললাম, “ধরুন।”

হাতে রক্ষিত কাগজপত্র এগিয়ে দিলাম। রিক্সার পা দানীতে পা রাখতে পারছিনা। ধ্রুব আমার পানে দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই হাত ধরলেন। কাগজগুলো নিলেন না। রূঢ় করে ধরলেন। নির্লিপ্ত কণ্ঠে বললেন, “উঠে এসো।”
টেনে তুলেন উপরে। আমি তার পাশের ফাঁকা জায়গায় বসলাম। একটু ফাঁকা স্থান দু’জনের মধ্যে। হাতটা তার হাতের ভাঁজে আঁটক। বাহ্যিক দৃষ্টি থেকে লুকাতে ওড়নার আড়াল করে ফেললেন হাতজোড়া। রিকশা গতিশীল হল। কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করতেই ধ্রুব রূঢ় কণ্ঠে বলে, “রিকশা থাকান।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমি দ্রুত দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই ভরকে গেলাম। ধ্রুবের গালে উপর সাদা আস্তরণ লেপ্টে আছে। ধ্রুব চোখজোড়া ছোটো ছোটো করে ক্রমশ পলক ফেলছেন। দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললাম, “কী এগুলো? পান! পান খেয়ে চুন ফেলেছে কে? আমার মামারও এমন হয়েছিল। বাজারে গিয়েছিলেন তিনি। ফেরার পথে একজন পানের পিক ফেলেছে। কী বিশ্রী গন্ধ। মনে হয়, লোকটা দাঁত ব্রাশ করে না।”
চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “তুমি চুপ করবে, না-কি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিবো?”
আমারই দোষ! পাকনামি করতে কে বলেছে? দিলো তো ঝেড়ে। টান পড়ল ওড়নায়। কাঁধ হতে খসে পড়ার প্রয়াস করল। আমি দ্রুত বুকে হাত রেখে সামনে নিলাম। ধ্রুব আমার ওড়না দিয়ে গাল ঘসছে। ছিঃ! ছিঃ! কী বিশ্রী ব্যাপার। আমার ওড়নাটাই পেতে হল।

কিচিরমিচির ডাক শ্রবণ হতেই উপরের দিকে অবলোকন করলাম। উপরে ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ছে। এটা তাঁদেরই মহৎ‌ কাজ।
আমি ওড়না টানতে টানতে মিনমিনে গলায় বললাম, “আমার ওড়না।”
“হ্যাঁ তোমার ওড়না। আমি খেয়ে ফেলছি না। একটু পরিষ্কার করছি, তুমি তো করে দিবে না।”

থতমত খেয়ে গেলাম। ওড়নার এক কোণা আঙুলে পেঁচিয়ে সৌজন্য হেসে স্থির হয়ে বসে রইলাম। না! আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমার সাথে কথা বলছে না কিন্তু পরিষ্কার করার জন্য আমারই ওড়না ব্যবহার করছে। আমার অদৃশ্যতার মাঝেই ধ্রুব রিকশাচালককে তার টাকা পরিশোধ করলেন। নেমে গেলেন রিকশা থেকে। ওড়নার একপ্রান্ত তার হাতে থাকার ফলে টান পড়ল। দ্রুত তাকে অনুসরণ করে নেমে দাঁড়ালাম। পুনরায় গাড়ি গতিশীল হল। ধ্রুব আমায় রেখেই হাঁটা আরম্ভ করলেন। আমি ধ্রুবের পথ অনুসরণ করে চললাম। দোকানের কাছে গিয়ে দুইটা বোতল নিলেন। ওড়না ছেড়ে দিলেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে হাঁটা দিলেন। রুদ্র কণ্ঠে বললেন, “কিছু কিনে বাকি টাকা ফেরত নিয়ে এসো।”

অতঃপর বটগাছের তলায় খোলা হাওয়াতে দাঁড়ালেন। এতক্ষণে গালের বেশ কিছুটা স্থান রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। তবুও ক্রমাগত একই কাজের পুনরাবৃত্তি করছেন। উপরের স্ক্রিনের সরু আবরণ বিচ্ছিন্ন হয়ে এলো বলে।
কথাগুলো হারিয়ে গেল শূন্যতায়। তার কাছে রুমাল থাকার সত্বেও আমার ওড়নাটা ব্যবহারের অযোগ্য করে ফেললেন। ধ্যান ভঙ্গ হল দোকানদারের কথায়, “আর কিছু নিবেন ম্যাম?”

তড়িগড়ি করে বললাম, “জি!”
“বলছি আর কিছু নিবেন?”
“জি-না।”
বলতেই গিয়ের বাঁধল অধরে। স্মিত হেসে বললাম, “আইসক্রিম আছে!”
“জি আছে, চকলেট আর ভ্যানিলা ফ্লেভার। কোনটা দিবো?”
“দুটোই।”
বৃষ্টির দিনে গরম খাবারের স্বাদ বেড়ে যায় আর আমার আইসক্রিমের। এজন্যই হুট করে আইসক্রিম খেতে চাওয়া।
আইসক্রিমের পাশাপাশি খুচরা টাকাগুলো ধরিয়ে দিলেন হাতে। আমি তাল সংযত করে অগোছালো। পা ফেলে ধ্রুবের নিকট ফিরিয়ে দিলাম। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে আইসক্রিম দুটির দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি সাবধানে তার শার্টের বুক পকেটে খুচরা টাকাগুলো রাখলাম। একটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, “এটা আপনার খান।”

“বৃষ্টির দিন। এমনিতেও ঠান্ডা। আইসক্রিম খেলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ততক্ষণে ধ্রুবের পানি ফুড়িয়ে এসেছে। গালটা টমেটোর ন্যায় টকটকে লাল। চশমা বিহীন চোখজোড়া একটু লালচে আভা ছড়িয়েছে।
আমি খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছি। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে এক কামড় বসালাম। উপরের অংশে লেয়ার চিবুতে চিবুতে অব্যক্ত স্বরে বললাম, “কত খেয়েছি। কখনো হয়নি। ভয় দেখাবে না।”
প্রখর চাইনি নিক্ষেপ করে বললেন, “তুমি বাচ্চা, তোমাকে কেন ভয় দেখাবো। অসুস্থ হলে আমার টাকাই যাবে।”

ধ্রুবের অকস্মাৎ এরুপ কথা শুনে হতবাক হলাম। জর্জরিত হল মুখশ্রী। টাকার কাছে আমার সামান্য আবেগগুলো তুচ্ছ।
আইসক্রিমটা হাতেই রয়ে গেল। গলে গলে স্তরে স্তরে পড়ল কাঠি খসে। মুখে দেওয়া স্পৃহা হলনা। জোরপূর্বক মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম, “স্যরি। স্যরি। আমি সত্যিই দুঃখিত। ভুল হয়ে গেছে।”
পাশের ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্ট আইসক্রিমটুকু ফেলে দিলাম। ধ্রুবের ফাঁকা প্রায় পানির বোতল নিয়ে হাত ধুয়ে নিলাম। পরিশেষে ফাঁকা পানির বোতলটাও ফেলে দিলাম। ধ্রুবকে কিছু বলতে না দিয়ে বললাম, “বাড়িতে যাবেন না?”

সন্দিহান স্বরে বললেন, “হ্যাঁ। আইসক্রিমটা কেন ফেলেছ?”
সংক্ষিপ্ত জবাব, “খেতে ইচ্ছে করছে না।”
প্রতুক্তি করার সাথে সাথে পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “তখন খেতে ইচ্ছে করছিল, এখন করছে না? ভ্যানিলা রেখেছ কেন? ওটাও ফেলে দাও।”
“এটা এঁটো করিনি। ভালো আছে। বাবুইও বৃষ্টির সময় আইসক্রিম খেতে পছন্দ করে। তাই নিয়ে নিলাম। ও অসুস্থ হলে আপনার খরচ দিতে হবে না, মামার সামর্থ্য আছে। চলুন, বাড়ি যাবো।”
ধ্রুবকে রেখেই পাজোড়া এগোলাম।

আকাশে থালার ন্যায় চাঁদ ঝুলছে। পূর্ণিমার আলো ছড়াচ্ছে চারিদিকে। চাঁদের থেকে দূরত্ব বজায় রেখে কয়েকটা তারা জ্বলছে। নিভু নিভু প্রকট। আমার আর ধ্রুবের মাঝে চাঁদ তারার ব্যবধান। চায়ের কাপ সমেত প্রবেশ করলাম রমিলা আন্টির কক্ষে। বাবুই বসে বসে গেমস খেলছে। দুই তারিখ থেকে তার পরীক্ষা শুরু, অথচ আমার জন্য এই বাড়িতে পড়ে আছে। বই-খাতা ব্যতীত এসেছে।
রমিলা আন্টি পান বানাচ্ছেন। আমি কাপটা হাতে দিতেই মুচকি হাসলেন তিনি। বানানো পানটা মুখে না পুড়ে রেখে দিলেন সাজিয়ে। তৃপ্তিকর হাসি ফুটল তাঁর মুখে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “বাহ্। খুব ভালো হয়েছে। প্রতিদিন এককাপ করে খাওয়াবে। তবে এখন না, পরে। তোমার না পরীক্ষা, পড়তে বসো গিয়ে। আমার কিছু লাগলে সার্ভেন্টদের বলব।”

তিনি চা খাওয়াতে মগ্ন হলেন। ইতস্তত বোধ নিয়ে নম্র গলায় বললাম, “বাবুইয়ের পরীক্ষা, আমারো পরীক্ষা। পড়ার পাশাপাশি ওকে সাহায্য করতে হবে, আমরা বরং বাড়িতে চলে যাই।”
চিন্তিত হয়ে বললেন, “বাবুইকে আমি পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, তবে তোমাকে..
তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করে, “কিন্তু কী আন্টি?”
“তোমাকে যাওয়ার অনুমতি আমি দিতে পারছিনা। তোমাকে ধ্রুব এনেছে।”
“আপনি তার মা, আপনার কথা কীভাবে ফেলবে? প্লীজ।!”
“তা ঠিক, তবুও। আমার ছেলে যেমন আমার মতামতকে প্রাধান্য দেয়, আমারও তো উচিত তার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া।”

আমি দীর্ঘশ্বাস নিলাম। ধ্রুব বাড়িতে নেই। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম ছাড়াই বেরিয়েছেন অজানায়। চাপা অভিমানে তার মুখোমুখি হওয়ার স্পৃহা ছিলনা। সরল
ভাষায় বললাম, “আন্টি, আমি আপনার সাথে আজ রাতে ঘুমাতে পারি?”
আন্টি মৃদু হাসলেন। তাঁর অভিজ্ঞ, জ্ঞানীগুণী চোখজোড়া অন্যকিছুর আভাস দিচ্ছে। চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে ক্ষিপ্র গলায় বললেন, “কেন নয়। বড় একটা বিছানা। আমি আর বাবুই থাকছি। অনেকটা ফাঁকা পড়ে আছে। তুমি নিশ্চিতে শুতে পারো।

তবে কী জানো? অভিমান ভালো, দূরত্ব কিংবা অভিযোগ নয়। মিটিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা করতে হয়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অতিদ্রুত সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আন্টি এবার পান মুখে দিতে গিয়েও দিলেন না। আঁচলে প্যাঁচ দিয়ে রাখলেন। ঘরের ভেতরকার আলো নিভিয়ে দিলেন। আমাদের শুতে বলে ওয়াশরুমের দিকে অগ্ৰসর হলেন। আমি সময় খরচ করলাম না। বিছানায় বালিশ আর কাঁথা ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। মাঝে বাবুই এবং দু’কিনারায় আমি আর আন্টি। এখন একটা ভারী ঘুমের প্রয়োজন। একবুক হাহাকার নিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস দিলাম। ধ্রুবের তিক্ত কথার ইতি টানতে হলেও ঘুম প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করতেই ভারী হয়ে এলো পাতা। আমি হাই তুলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম নিদ্রায় মগ্ন হতে। মনে মনে তখন ধ্রুবকে গভীরতর অভিযোগ করছি।

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩১

“আপনি পাষাণ ধ্রুব, বড্ড পাষাণ। আপনি আমার মন পড়তে পারেন না। আমার ছোট ছোট ইচ্ছেগুলোর দাম দিতে পারেন না। বড্ড নিষ্ঠুর। বড্ড..

মেঘমিশ্রিত পূর্ণিমা পর্ব ৩৩