পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩২

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩২
মম সাহা

চোখের পলকে কেটে গেলো দিন দুই। সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতি, পরিবেশেরও পরিবর্তন হচ্ছে। কেবল পরিবর্তন হয় নি তৃণার বিধ্বস্ততা, দৃষ্টান্তের অসহায়ত্ব। সেদিন পুকুর পাড়ে অনেক জোড়াজুড়ির পরও মৃত্যুঞ্জয় কিংবা দর্শিনী জানতে পারে নি দৃষ্টান্তের প্রথম ভালোবাসা কে। কিন্তু দৃষ্টান্তের শেষ ভালোবাসা আঁকড়ে রাখার আকুলতা দেখেছে। দর্শিনীর ভীষণ খারাপ লাগছে এদের ভবিষ্যতের বিচ্ছেদের কথা ভেবে।

নানান রকমের ভাবনা ভেবেই দর্শিনী হাঁটছে মাটির সরু পথটা দিয়ে। পাশে প্রতাপ সাহাও আছেন। উদ্দেশ্য হরমোহনের বাড়ি যাবে। বাবা-মেয়ে মিলে ভেবেছে ঠান্ডা মাথায় আরেকবার চেষ্টা করবে ঝামেলায় না জড়ানোর জন্য। মেঘলা আকাশ, বৈরী বাতাস পরিবেশটাকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। বাবা মেয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে ধীরে ধীরে হাঁটছে। দু’জনের মাঝেই নিস্তব্ধতা। আজ কত গুলো বছর পর বাবার হাত ধরে মেয়ে হাঁটছে! ছোট বয়সে, ছোট, ছোট হাত গুলো দিয়ে আঁকড়ে ধরতো বাবার হাত। সেখানে কোনো দ্বিধা থাকে না। কারণ ঐ বয়সে তার একমাত্র আশ্রয় তো এই জন্মদাত্রী, জন্মদাতা। কিন্তু সন্তান বড় হওয়ার সাথে সাথে ঢিলে হয়ে যায় আঁকড়ে ধরা হাতটা, তৈরী হয় কত দ্বিধা! সে দেয়াল টপকে আর বাবা-মায়ের হাতটা শক্ত করে ধরা হয় না, যার জন্য জীবনে বারবার মুখ থুবড়ে পড়তে হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মা,তোমার কী মনে হয়? হরমোহন এত সহজে সন্ধি করবে? কত ভাবেই তো তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম এ জমি আমি ছাড়বো না, সে তো মানলো না। তোমার কী মনে হয়,আবার বললে ও মানবে?”
প্রতাপ সাহার কথায় দর্শিনীদের নিস্তব্ধতার বেড়া ভাঙলো। দর্শিনী কতক্ষণ ঠোঁট উল্টে রেখে বললো,
“জানিনা বাবা,তবে আমি শুনেছি ভালোবাসা দিয়ে নাকি সব করা সম্ভব। আমরা তো রেষারেষি, হানাহানি দিয়ে এতদিন চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না। একবার ভালোবেসে চেষ্টা করে দেখি? আমি তো জানি, এটা দাদুর হাতের শেষ স্মৃতি যা তুমি হারাতে দিতে চাও না। আমরা নাহয় আরেকবার আঁকড়ে ধরবো।”
প্রতাপ সাহা হাসলেন। আবার কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলেনও। অতঃপর মেয়ের মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন,

“ভালোবাসা দিয়ে সব জয় করা যায় কথাটা কিন্তু আজকাল ভুল,মা। যদি তেমনই হতো,তাহলে তোমার এত ভালোবাসার পরও তোমার প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির মানুষ তোমাকে এত অবহেলা দিতে পারতো না। আর এখন বড়বৌমা,যে এককালে তোমারে কত ভালোবাসতো, সে এমন হুট করে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো না।”
বাবা যেন মোক্ষম সময়ে মোক্ষম কথাটা বললো। দর্শিনীর পায়ের গতি আরও কিছুটা ধীর হয়ে গেলো। বাবা তো ভুল কিছু বলে নি। সত্যিই তো,ভালোবাসা দিয়ে আদৌও সব সম্ভব! হয়তো হ্যাঁ, আবার হয়তো না।
দর্শিনী ছোট শ্বাস ফেললো। জীবনে যদি সবটার নেগেটিভ দিক বের করি তাহলে হতাশা ছাড়া কিছুই মিলবে না। তাই কিঞ্চিৎ নেগেটিভ জিনিস এড়িয়ে চলা ভালো, জীবনে খুশি থাকা যায়। দর্শিনী হাসলো। বাবার কথার উত্তরে ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

“বাবা,কে বলেছে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা যায় না? তুমি নিপা বৌদিকে দেখেছ? কীভাবে বদলে গেলো? এত বছর যে মানুষটা বাঁকা কথা ছাড়া সোজা কথার উত্তর দিতো না কাউকে,সে মানুষটা আজকাল কত নরম হয়েছে দেখেছো? আর বড়বৌদির কথা বলছো! যে মানুষটার আঁচলের তলে আমি মায়ের সুঘ্রাণ পেতাম সে মানুষটার সামান্য রুক্ষতা আমার বদল মনে হয় নি। তার শ্বশুর বাড়ি,স্বামী,বাবার বাড়ি সব মিলিয়ে সে ভেঙে পড়েছে। আমরা না বুঝলে কে বুঝবে, বাবা? আমরা তো জানি মানুষটা কী ছিলো। সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা। কিছু ভেবো না।”
প্রতাপ সাহা হাসলেন। মেয়েটা আজও বদলায় নি! এই মেয়েটা একদম ভিন্ন ধাঁচের। কখনো উত্তপ্ত আগ্নি,কখনো বা শীতল বারি।

“আরে দর্শিনী যে! কেমন আছো, মেডাম?”
নিজের সামনে সামান্য পরিচিত লোকটাকে দেখে থামলো প্রতাপ আর দর্শিনী। দর্শিনী হাত জোর করে বললো,
“নমস্কার হীমাদ্রি দা। ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ ভালো আছি। কাকামশাই,ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ বাবা,ভালো আছি। তোমার কী খবর?”
“ভালো কাকা।”

হিমাদ্রী ছেলেটার বিনীত আচরণ বড় ভালো লাগে প্রতাপ সাহার। গ্রামের সবচেয়ে ভদ্র, সভ্য ছেলে বলা যায় তাকে। কোনো ঝুট ঝামেলায় তাকে পাওয়া যায় না কখনো। হিমাদ্রীর ভাইয়ের সাথেই তৃণার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
হিমাদ্রী এবার দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি দিলো। বোকা সোকা একটা হাসি দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করতে করতে বললো,
“দর্শিনী,তোমাকে যে একবার স্কুল যেতে বলেছে বড় স্যার। আমি তোমাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম। তোমার তো চাকরিটা হয়েছে। কাল থেকেই পারলে জয়েন হতে পারো।”
আকষ্মিক চাকরি হওয়ার খবরটা পেয়ে দর্শিনী অবাক হয়ে যায়। সাথে প্রচন্ড রকমের খুশিও হয়। বাবা যে স্কুলের শিক্ষক ছিলো সন্তানও সে স্কুলের শিক্ষক হলে সেটা বাবার জন্য কতটা গর্বের! নিজের মাথাটা আরেকটু উঁচু করে বাঁচার একটা অবলম্বনও পেলো দর্শিনী। কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধলো প্রতাপ সাহা। অবাক কণ্ঠে বললো,

“এখন চাকরি কীভাবে করবে? তোমার এখন বিশ্রাম প্রয়োজন, সেখানে কিনা তুমি চাকরি করার কথা ভাবছো? না মা,এটা আমি পছন্দ করছি না।”
“কাকা মশাই, আপনি চিন্তা করছেন কেনো? মা হওয়াটা আশীর্বাদ স্বরূপ। সেটার উছিলায় কিছু করতে না দিয়ে অভিশাপ করে তুলবেন না গর্ভকালীন সময়টা। আর ও এখন বাসার বাহিরে থেকে নিজের মন রিফ্রেশ রাখবে সেটা আরও ভালো ব্যাপার। তাই না?”
হিমাদ্রীর কথায় প্রতাপ সাহা কিছু বললেন না। দর্শিনী বুজেছে,চাকরিটা করতে হয়তো বাবার সাথে মন কষাকষি করা লাগবে। কিন্তু বাবা ঠিক বুঝবে আশা করা যায়। কিন্তু হিমাদ্রীর সামনে মন কষাকষি টা বিদঘুটে দেখা যাবে বলে সে ছোট্ট কন্ঠে হিমাদ্রীকে উদ্দেশ্য করে বললো,

“আমি কাল গিয়ে কথা বলবো আর পারলে কাল থেকেই শুরু করবো। ধন্যবাদ। নমস্কার।”
হিমাদ্রীও “নমস্কার” বলে হেলতে দুলতে সামনের দিকে হাঁটা ধরলো৷ দর্শিনীরাও নির্দিষ্ট গন্তব্যে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু প্রতাপ সাহা মেয়ের সাথে আর কোনো কথা বললেন না। কিন্তু মেয়ের ধরে রাখা হাতটাও ছাঁড়লেন না। বরং আরেকটু শক্ত করে ধরে রাখলো সে হাত খানা। দর্শিনী হাসলো, বাবা হয়তো একেই বলে!

প্রতাপ আর দর্শিনী হরমোহনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। হরমোহনের বাড়ির ভিতরে কেউ একজন এসেছে বোঝা যাচ্ছে। তারা ভিতরে না গিয়ে বাহির থেকেই উঁকি দিয়ে চমকে উঠলো। দর্শিনী হা হয়ে তাকিয়ে রইলো বাড়ির ভিতরে থাকা মানুষটাকে দেখে। প্রতাপ সাহাও বেশ অবাক হলো। হরমোহন এবং সে মানুষটা প্রতাপ সাহার জমি নিয়েই আলোচনা করছে। কোনো মতে সে জমি ছাড়া যাবে না বলে হরমোহনকে হুমকি দিলো সে মানুষ।
দর্শিনী বাবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালো। বাবারও প্রায় একই দশা। হঠাৎ করে দর্শিনীর মুখ চোখ কাঠিন্যতায় ছেয়ে গেলো। কঠিন কণ্ঠে বললো,

“এ জমি আমরা আর ছাড়ার কথা ভাববো না, বাবা। ভদ্রতার মুখোশের আড়ালে মানুষ কতটা খারাপ, দেখলে? জান যায় যাবে,জমি কিন্তু ছাড়বো না।”
প্রতাপ সাহা কিছু বললো না কেবল মাথা নুইয়ে নিলো। বন্ধু যখন শত্রু হয়ে যায় তার কাছে ভালো কিছু আশাকরা নিত্যান্তই বোকামি।

মোহনা বাড়ি ফিরেছে আজ দু’দিন হলো। নিজের ঘর থেকে সে খুব কম বের হয়। নিত্যান্তই প্রয়োজন ছাড়া বেরই হয় না বলা যায়। সারাদিন ঘরে থাকে। কি যে করে একমাত্র সে-ই জানে।
আজ বিপ্রতীপকে জেল থেকে ছাড়ানো হবে বলে নিলয় কুমার থানায় গিয়েছে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে মোহনা এই দু’দিন বিপ্রতীপকে ছাড়ানোে কথা বলে নি। বরং তার ভাব ভঙ্গিমা এমন যে বিপ্রতীপ জেলে থাকলেই ভালো। মোহনা নিজের স্বামীর সাথেও কথা বলা ছেড়েছে মাস খানেক আগে। প্রয়োজনে কেবল হু,হা জবাব দিতো। এই দু’দিন সে এটাও করে নি। সে বাড়িতে এমন ভাবে অবস্থান করেছে যেন তার কোনো অস্তিত্ব নেই।

মায়া নিজেকে বেশ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু যতবার মোহনার সামনে পড়ছে ততবারই ভয়ে তার শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি মোহনা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে মে*রে ফেলবে তাকে। মায়ার ভয় হয়,এ মহিলা যা ভয়ঙ্কর খুব নৃ*শংস ভাবে না আবার খু*ন হতে হয় মায়াকে।
মায়া রান্নায় মগ্ন। হঠাৎ করে বিহঙ্গিনী আর মোহনার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। তারা কোনো বিষয় নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি করছে বোধহয়। মায়ার আগ্রহ জাগলো। কি নিয়ে এত কথা কাটাকাটি হচ্ছে তা বুঝার জন্য সে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে মোহনার ঘরে উঁকি দিলো। পর্দার আড়াল থেকে দেখা গেলো বিহঙ্গিনী মোহনার সামনে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলছে,

“ভাইয়া,মারা যায় নি। তাই না মা? তুমি আমাদের মিথ্যা বলেছো। তুমি পাষাণ, মা। বড্ড পাষাণ। ভাইয়া কোথায় সেটা বলো।”
মোহনার চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ। ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে তাকে। সে কোনো রকম নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এসব উদ্ভট কথা কেনো বলছো একটা মৃত ছেলের নামে? যে মা*রা গেছে সে তো শেষই। তাকে নিয়ে এসব বলার মানে নেই।”
মায়া অবাকের পাশাপাশি বিষ্মিতও হলো। কার কথা বলছে মোহনা আর বিহঙ্গিনী? যাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ছোট্ট মায়া এত কিছু ঘটিয়েছে, তার কথা? সে মানুষটা মা*রা গেছে! এ জন্যই বিয়ের এতদিন পরেও মায়া সে মানুষটার ছায়াও এ বাড়িতে দেখে নি!

মায়ার কথার মাঝে বিহঙ্গিনীর রাগান্বিত কথা ভেসে এলো,
“তুমি কী করেছো মা ভাইয়ার সাথে? ভাইয়া মারা যায় নি আমি জানি। তুমি ভাইয়াকে পা*গল বানিয়ে রাস্তায় ছেঁড়ে দিয়েছো তাই না? ভাইয়া না তোমার ছেলে ছিলো, মা? কীভাবে পারলে তাহলে এমন করতে? ভাইয়া তোমার ব্যাপারে কিছু জেনে গিয়েছিল তাই না, মা? আমি ছোট ছিলাম, কিন্তু এখনো আমার মনে আছে, মাভক্ত ছেলেটা হুট করে কেমন বদলে গেলো। কাউকে সহ্য করতে পারতো না। তোমাকে,বাবাকে। কি করেছিলে মা বলো?”
মায়ার হাত পা অসার হয়ে আসে। এ মহিলা নিজের ছেলেকেও ছাঁড় দেয় নি! এ কেমন মানুষ! মায়া কাঁপতে কাঁপতে নিজের ঘরে গিয়ে বসলো। এ বাড়িতে তার থাকার দুঃসাহস আর হচ্ছে না।

“তুমি তো বোন, বড়বৌদি। তুমি তো একটু তৃণার পাশে দাঁড়াতে পারো। এমন করছো কেনো তুমি? হঠাৎ বদলে গেলে কেনো?”
দর্শিনীর প্রশ্নে নিধির কোনো হেলদোল নেই। সে নিজের মতন কাজ করছে। দর্শিনী অধৈর্য্য হলো। অধৈর্য্য কণ্ঠে বললো,
“এমন কেনো করছো, বৌদি?”
“যদি বলি তোমার জন্য!”
দর্শিনী অবাক হলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার জন্য! আমার জন্য করলে আমার সাথে করো। তবুও তৃণার পাশে দাড়াও প্লিজ।”
“পাশে দাঁড়াবো একটা শর্তে। সব আগের মতন করে দিবো। যদি তুমি রাজি হও।”
দর্শিনী ভ্রু কুঁচকালো। বড়বৌদির কথার ধরণ কেমন বদলে গিয়েছে আগে থেকে। এখন কেবল কর্কশ স্বর ভেসে আসে। দর্শিনী মাথা দুলালো,নিবিড় স্বরে বললো,

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩১

“কী শর্ত?”
“আমার বড়দাকে তোমার বিয়ে করতে হবে। বলো,রাজি?”
দর্শিনী কেঁপে উঠলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“তোমার বড়দা সারাদিন মদের আড্ডায় পড়ে থাকে না? ছিঃ বৌদি, তুমি এতটা নিচ?”

পথান্তরে প্রিয়দর্শিনী পর্ব ৩৩