ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ২২

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ২২
Suraiya Aayat

বিছানার উপর আধাশোয়া হয়ে বসে আছেন উনি, ওনার থেকে একহাত দূরত্ব বজায় করে বসে আছি আমি, ঠান্ডায় গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে রাখা অবস্থায়।
উনি ওনার মোবাইলে মনোনিবেশ করেছেন আর আমি বইয়ের আড়ালে চুপিসারে মাঝে মাঝে ওনাকে লুকিয়ে দেখছি। অতঃপর একটা সময়ে ওনার কাছে ধরা খেতেই উনি ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বলে উঠলেন,
‘এভাবে লুকিয়ে দেখার কি আছে? তোমারই জামাই আমি। দেখতে হলে সরাসরি দেখো।’
আমি ওনার কথা শুনে বইটা নিজের মুখ এর সাথে একপ্রকার চেপে অকপট স্বীকারোক্তি করলাম,
‘আমি মোটেও আপনাকে দেখছি না। আর আপনাকে দেখার মতো কি ই বা আছে হু যে আমি দেখবো? ‘

উনি আমার কথা শুনে আমার মুখ এর সামনে থেকে বইটা টেনে বললেন,
‘তা মিসেস টুইটুই আপনি কি উল্টো বই ধরে উল্টোভাবে বই পড়া প্র্যাকটিস করছেন? ‘
আমি ওনার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলাম,
‘মোটেও নয়। আমি বই উল্টো ধরিনি। আপনি মিথ্যা বলছেন। ‘
উনি বইটা একপাশে রেখে আমার হাতটা টেনে ওনার কাছে টেনে আনলেন আর নেশাক্ত ধরালো কন্ঠে বললেন,
‘ টিচারকে কখনো মিথ্যা বলতে নেই, বললেই পানিশমেন্ট পেতে হয়। ‘
ওনার পানিশমেন্ট এর কথা শুনে আমার দুপুরের সব দৃশ্য চোখের সামনে শরিষার ফুলের মতো ভাসতে লাগলো। আমি চুপটি করে গুটিয়ে গেলাম নিমেষেই। আমি মুখ কাঁচুমাচু করে সরল স্বীকারোক্তি করলাম,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘আমার বারবার গোসল করতে ভালো লাগে না। প্লিজ মিস্টার অভদ্র জামাই একটু বোঝেন। ‘
উনি আমার কথা বুঝতে পেরে হো হো করে উচ্ছাসের সাথে হেসে উঠলেন। ওনার হাসির ধরন দেখে বুঝতে পারলাম উনি সেসব কিছুই মিন করতে চাননি যা আমি আমি ভেবে ইতিমধ্যে তা ওনাকে বলে ফেলেছি। উনি হাসির ঠেলায় রিতিমত গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আমি ওনাকে কখনো এতো হাসতে দেখিনি। আমি বুঝতে পারছি যে আমি ভুল কথা সঠিক মানুষের কাছে বলে ফেলেছি। আমি মুখ চেপে ধরলাম নিজের, বেফাসে অন্য কোন কথা না বার হয়ে যায় সেই ভয়ে। ওনার দৃষ্টির অগোচরে নামে নামে কেটে পড়ায় মঙ্গল। কথাটা ভেবে ধীরে ধীরে বিছানার থেকে নামতে গেলেই উনি আচমকাই আমার হাত ধরে বিছানায় টেনে শুইয়ে দিলেন। ওনার এমন হঠাৎ হঠাৎ উৎভব হওয়া রোমান্টিকতা গুলো আমার বুকের ভিতর আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট।

উনি আমার ওপর সম্পূর্ণ রুপে ঝুকে গেলেন। আমি রিতিমতো শিউরে উঠছি অজানা অনুভুতিতে। সম্ভবত শরীরে আ্যড্রিনালিনের প্রভাব বেশি ভাবে কাজ করছে, কিন্তু এ অনুভূতি তো সহজে দমে যাওয়ার নয়।
উনি বিড়বিড়িয়ে বললেন,
‘ হঠাৎ এই কথা তোমার মাথায় এলো কি করে আরু পাখি? তোমার মতো পিচ্চির ছোট্ট মস্তিষ্কে তো এসব কথা আসার কথা নয়। ‘

আমি ওনার কথা বলার ভাব শুনে উপলব্ধি করলাম যে উনি অনেক কষ্টে নিজের হাসি সংযত করে কথাগুলো বলছেন যাতে আমার লজ্জার মাত্রা দ্বিগুণ বেড়ে যাচ্ছে। আমি ওনার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিলাম।
‘ আপনার জন্য আমাকে ভর দুপুরে গোসল করতে হয়েছে। আমার ঠান্ডা লেগে গেলে আপনার দোষ। ‘
কথাটা শোনা মাত্রই উনি আমার কাধে নাক ঘষতে লাগলেই আমি ওনাকে শক্ত করে ধরলাম। উনার ঠোঁটের স্পর্শ গুলোও আমার কাধে বেশ ভালো ভাবে অনুভব করতে পারছি। উনি স্পর্শ দিতে দিতে বললেন,
‘ সবকিছুর অভ্যাস করে নাও কারন আমি মানুষটা তোমাকে কখনোই ছাড়ছি না। না চাইলেও আমার সাথেই সারাজীবন থাকতে হবে। তোমাকে বলেছিলাম না যে একবার সে হাত ধরলে আর কখনোই ছাড়বো না। ‘
কথাটা বলে উনি গভীরভাবে আমার কাধে একটা স্পর্শ দিয়ে সরে এলেন। আমি এবার ওনার দিকে তাকালাম। উনি সরে গেছেন আমার উপর থেকে তবুও ওনার শরীরের ঘ্রাণ যেন আমার শরীরের সাথে মিশে আছে অতোপ্রোত ভাবে আর আমি সে ঘ্রাণ পাচ্ছি। ওনার বলা কথা গুলো কানে ক্রমাগত বাজতে লাগলেই আমি লজ্জাবতী হয়ে গেলাম। এবার এ অনুভুতির সামাল কি করে দিই?

আজ তিনদিন হয়ে গেল ও বাসা থেকে এ বাসায় এসেছি। উনি সরা দিন ওনার কলেজে থাকেন আর আমি সানা আর ফুপি বাসায় তিনজনের আসর জমিয়ে রাখি। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে কিন্তু ওনার সাথে ঝগড়াটা আর আগের মতো জমে উঠছে না। আমার তো মন চাইছে আজকে উনি বাসায় ফিরলে বলবো চলুন একটু ঝগড়া করি, কিন্তু এ কথা ওনাকে বললে যে আমার রক্ষে নেই আমি তা জানি। কথাটা ভেবে পায়ের ওপর পা তুলে বসে পা নাড়াতে লাগলাম। এটা আমার ভীষন বাজে রকমের অভ্যাস। বসে থাকলে বা বিছানায় শুয়ে থাকলেও পা আমার কখনো স্থির থাকে না। ছোটবেলায় এর দরুন আম্মুর কাছে অনেক বকা শুনেছি তবে এখন আর কেও বকা দেই না। আম্মু বলে যাদের মাঝে এই স্বভাব আছে তাদের মন নাকি খুব চঞ্চল হয়, কিন্তু আমি তো শান্তশিষ্ঠ। তাহলে আম্মুর কথা মিথ্যা?।

ফুপি ফুপার সাথে এক আত্মীয় বাসায় গেছেন। সানা আমার পাশে বসে বসে ঝিমোচ্ছে, তাকে বেবাগে ঝিমোতে দেখে আমার নিজেরই ঝিমুনি আসছে।
কথায় আছে সুখে থাকতে ভুতের কিলাই, আমি হলাম সানার এই ভূত, সানকে ঝিমোতে দেখে তাকে বেশ কয়েকটা চাপট মেরে ডাকতে লাগলাম।
‘এই মেয়ে, ঝিমাস কেন! ওঠ! ‘
আমার কথা শুনে সানা চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
‘ কি হলো ডাকিস ক্যান? ‘
আমি তার মিমিক্রি করে বললাম,
‘কি হলো ডাকিস ক্যান? ‘
সানা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কি হয়েছে বল। ‘

‘দোস্ত তোর কি মনে হয়না যে জীবনটা কেমন যেন নিরামিষ হয়ে গেছে! জীবনে ঝাকানাকা কিছু আনা দরকার।’
সানা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি ঝাকানাকা? ‘
আমি হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললাম,
‘ আরে ঝাকানাকা মানে সেই সেই ওইরকম। ‘
সানা বিরক্ত হয়ে বলল,
‘কি রকম? ‘
আমি বলে উঠলাম,
‘ আরে এই সেই সেই রকম। ‘
সানা বিরক্ত হয়ে উঠে যেতে নিলেই ওর হাত ধরে আমি পুনরায় বসিয়ে বললাম,
‘উঠছিস কেন বস! ‘

‘বুঝেছি তোর এখন সিরিয়ালের মতো বউ শাশুড়ির ঝগড়া লাগবে বা একজন ভিলেন লাগবে জীবনে যে রাতদিন একটা না একটা প্যাচাল বাধাবে আর ভাইয়া তাকে ঝাড়ি দেবে লাইক ফারিন আপু। ‘
সানার কথা শুনে আমি হেসে উঠলাম। সানা “আজাইরা” কথাটা বলে বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। আমি হাসছি। সত্যিই কি ওরকম কিছু হলে জীবনটা থ্রিল হয় বুঝি? কিন্তু আমার শাশুড়িআম্মু ঝগড়া তো দূর, আমি ব্যাথা পেলেই উনি ছুটে আসেন। জীবন অতিরিক্ত প্যারালেস।

কথাটা ভেবে আমি বেরিয়ে এলাম বাসার বাইরে। আরিশ ভাইয়ার বাসায় আমাদের বাসার মতো অতো বাগান নেই ঠিকই কিন্তু আমার পছন্দের ফুলগুলো আছে। এ বাসায় কোন সিকিউরিটি গার্ড নেই তাই আমি হুঠহাঠ বেরিয়ে গেলেও কেও কিছু বলার নেই। বাইরে বের হতেই দেখলাম লাল কাঠগোলাপটা ফুটে আছে সেটা দেখতেই আমি থমকে গেলাম আর সেদিকে অপলক চেয়ে রইলাম বেশ কিছুখন। এতো সুন্দর ফুলটা ছিঁড়বো কি ভাবছি, ছিঁড়লেও আরিশ ভাইয়া কিছু বলবেন না তা আমি জানি। কথাটা ভেবে আমি ফুলটা এক সেকেন্ডে ছিঁড়ে দুই সেকেন্ড এ কানে গুজলাম। আমি খিলখিলিয়ে হাসছি একা একাই। নিশ্চয়ই আমাকে দেখতে টুইটুই লাগছে ভেবে খুশি হলাম। পিছন ঘুরে তাকাতেই একটা ধাক্কা খেলাম ওনার বুকের সাথে। সর্বপ্রথম আমার নাকটা ওনার বুক লাগতেই আমি আমার নাকটা চেপে ধরে ওনার দিকে মুখ চুন করে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই উনি পকেট থেকে ওনার ফোন বার করে একঝটকাই একটা ছবি তুলে নিলেন আমার কিছু ভাবার আগেই। আমি ওনার হাতে ঝাড়ি মেরে বললাম,

‘ এভাব খাম্বা পিলারের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন কেন পিছে? আমার নাকটা যদি ভেঙে যেত তাহলে তার দায় আপনি নিতেন? আর ছবি তুললেন কেন হম? ‘
কথাটা বলে আমি নাক ছাড়লাম, নাকটা লাল হয়ে আছে নিশ্চয়ই। উনি কিছু বলছেন না চুপচাপ আমার মুখ এর দিকে তাকিয়ে আছেন। উনি চুপ করে আছেন দেখে বললাম,
‘ এভাবে তাকিয়ে আছেন যে! সে সরি। ‘
উনি সরি বললেন না বরং উল্টে বললেন,
‘ ইউ সে সরি। আমার গাছ থেকে ফুল ছিঁড়েছ কেন? ‘
‘মোটেও ওটা আপনার একার গাছ না। আমারো গাছ। আর নিজের গাছ থেকে ফুল ছেড়া অন্যায় না। ‘
উনি ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘ওহহ রিয়েলি? ‘
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
‘হমম হমম হমম। চাইলে আপনিও আমার গাছটা থেকে একটা ফুল নিয়ে কানে গুজতে পারেন, আফটার অল আমি আপনার মতো অতো হিংসুটে নয়। ‘
উনি নাকটা টেনে বললেন,
‘হিংসুটে না হলেও ঝগড়াটে বটে। তোমার সাথে ঝগড়া করার জন্য হলেও আমার ডাক্তারি না পড়ে ল নিয়ে পড়া উচিত ছিলো বাট আই মিসড দা অপরচুনিটি। ‘
আমি চোখ ছোট ছোট করে ওনার দিকে তাকালাম।
‘এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আমার জন্য কফি বানাও। আর ভুলেও চিনি দিলে খবর আছে। আগের দিনের মতো চিনি দিলে আবার তোমাকে দিয়ে বানাবো। ‘

কথাটা বলে উনি আমার হাত ধরে বাসার দিকে যেতে লাগলেই আমি বললাম,
‘ আপনার কফির মতো আপনিও তেঁতো। কোন মিষ্টতা নেই। নিমপাতা। ‘
উনি ওনার পাশে আমাকে টেনে এনে ওনার গলার স্টেথোস্কোপটা আমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘ প্রবলেম নেই, তুমি তো আছো আমার জন্য এজ আ সুইট। ‘
আমি ওনার দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললাম,
‘ দেশের একজন ভালো মানুষ হয়ে আমার মতো মেয়েটার জীবনযাত্রা আসান করে দিন।’
উনি হেসে বললেন,
‘ কাভি নাহি! ‘

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ২১

আমি ওনাকে ছাড়িয়ে কিচেনে গেলাম। উনি ুমে ঢুকে গেলেন উনি বিনা বাক্য ব্যায় করে।
কফি বানাতে বানাতে লক্ষ করলাম এখনো আমার গলায় ওনার স্টেথোস্কোপটা ঝুলে আছে, উনি বোধহয় নিতে ভুলে গেছেন। পরক্ষনেই মনে পড়ে গেল যে এটা তো আমারও উদ্দেশ্যে, তাহলে উনি কি ওনার হাজার ব্যা্স্ততার মাঝে এটাই আমাকে মনে করিয়ে দিতে চাইলেন?
কথাটা ভাবতেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। আচ্ছা উনি এতো দিক সামলে কি করে চলেন?

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ২৩