ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ৫

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ৫
Suraiya Aayat

‘এই মেয়ে’ ধমকটা শুনতেই কেঁপে উঠলাম আমি, দ্রুত দাড়িয়ে পড়তেই উনি চোখ ছোট করে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমতা আমতা করা ছাড়া এখন কোন রাস্তাই খোলা নেই আমার কাছে। ওনার এমন চাহনি দেখে আমি চাপা স্বরে আধো আধো করে বললাম,

‘আপনি এখানে কি করছেন? ‘
ওনার কপালে ভাজ দেখা গেল, উনি আশেপাশে একবার তাকিয়ে বলে উঠলেন,
‘এটা তোমার বাড়ি? কোথাও নাম লেখা আছে? ‘
ওনার এমন ত্যাড়া কথা শুনতেই আমার মেজাজ স্বল্প বিগড়ে গেল।
‘আমার বাড়ি হলেই বা কি আর না হলেই বা কি। তাই বলে আপনি এতো রাতে এভাবে কাওকে না বলে এভাবে আচমকা উপস্থিত হবেন? ‘

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উনি এমন একটা ভাব নিলেন যে তিনি এভাবে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েও কোন অন্যায় করেননি বরং তিনিই সঠিক আর সত্যবাদীর যুধিষ্ঠি।
‘ইচ্ছা হয়েছে তাই না বলে এসেছি, ইচ্ছা হলে বলেই আসতাম।’
‘আপনি কবেই বা আমার কোন কথা শুনেছেন? ‘
কথাটা এতোটাই বিড়বিড় করে বললাম যে ওনার কানে যাওয়ার নয়, অবশ্য উনি শুনতেও পেলেন না।
আমার হাতটা ধরে টেনে আগের মতোই ওনার পাশে বসালেন আর ওনার দিকে আমাকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বসালেন আর আমার বাম পা ওনার পায়ের ওপর তুলে নিলেন। আমি তো অবাকের ওপর অবাক হচ্ছি তবে ওনার কাজকর্মে বেশ ঘাবড়েও গেলাম আমি। কি করতে চাইছেন টা কি উনি?
আমি না বলে থাকতে পারলাম না।

‘এই কি করছেন টা কি আপনি? এখন কি নূপুর টুপুর পারবেন নাকি? আর আপনি এতোটা ফিল্মি হলেন কবে? শুনুন আমি কিন্তু পটছি না হুহ! ‘
আমার কথায় উনি নড়বড়ে হলেন না। উনার মুখ এর ভাবভঙ্গি ও নির্বিকার, কিছু বোঝার উপায় নেই যে কি করতে চাইছেন।

তবে তারপর উনি না করলেন তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। উনি ওনার পকেট থেকে আমার ফোনটা বার করলেন আর খুবই স্বাভাবিক ভাবে আমার পায়ের সর্বকনিষ্ঠ আঙুল নিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিতে গেলেই পা সরিয়ে নিলাম আমি। বেশি ঝাপাঝাপি করে দোলনা থেকে নামতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়লাম মেঝেতে, হাতের কনুইয়ে ব্যাথা পেলাম জোর।
উনি রেগে গিয়ে আমাকে নীচ থেকে তুললেন। আমার দিকে নিশ্চয়ই উনি এখন অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কিন্তু আমি ওনার দিকে তাকাবোনা। তাকালেই যে খেলা উনি শুরু করেছেন তা শুরু হওয়ার আগেই শেষ!

উনি হাত ধরে টেনে আমাকে পুনরায় দোলনা তে বসালেন আর নিজে হাটু ভাজ করে আমার পায়ের কাছে বসে ফোনটা নিয়ে পা থেকে ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলেন আর ফোনটা খোলা মাত্রই কিছু একটা করে তা নিজের পকেটে পুরে নিয়ে আমার দুপাশে হাত রেখে আটক করলেন আমাকে।
গম্ভীর আর কঠিন স্বরে বললেন,
‘মানে তুমি কি সত্যিই স্টুপিড? পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট কে দেই? কোন স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব? এতো আনন্যাচেরাল বুদ্ধি তোমার কোথা থেকে আসে?’
আমি রাগ দেখালাম তবে ততোটাও প্রখর ভাবে নয়।
‘আমার ফোন, ইচ্ছা হয়েছে আমি দিয়েছি। ‘

কথাটা বলে আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি বলতে উনি ফোন নেবেন শুনে আমি বহু কষ্টে পায়ের ফিঙ্গারপ্রিন্ট টা দিয়েছিলাম। কিন্তু উনি তা ধরে ফেললেন কিভাবে? তবে ওনার কাছে আমি এসব আনন্যাচেরাল কাজ করলেও আমার বুদ্ধি আমার কাছে টুইটুই মার্কা চুমু টাইপের।
উনি উঠে দাঁড়ালেন এবার।
‘বাচ্চা মানুষ আর বাচ্চাদের মতোই বুদ্ধি। আমি ঠিকই বলেছিলাম যে তুমি কখনো বড়ো হবেনা। ‘
ওনার এই বাচ্চা ডাকটা আমার গায়ে লঙ্কা গুড়ো ছেটানোর মতো এফেক্ট দেই। আমি বিঞ্জানী হলে এই জ্বালার এক বিশেষ নাম দিয়ে দিতাম হয়তো।

দোলনা থেকে নেমে ওনার পাশে যতোটা সম্ভব পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ওনার সমান সমান হওয়ার চেষ্টা করলাম তবুও ওনার কাধ অবধি হতে পারলাম টেনে টুনে।তারপর বেশ সাহস সঞ্চয় করে বললাম,
‘এই দেখুন আমি আপনার সমানে সমানে লম্বা তাই আমি আর মোটেও ছোট নেই। আমার কথা শুনে উনি আমার পাশ থেকে সরে এলেন, আমি এখনো ওমন পা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি বহু কষ্টে, একটা সাপোর্ট সিস্টেম থাকলে তাতে আরামে হেলান দিয়ে এভাবে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যেত।

উনি এবার আমার দিকে স্বল্প ঝুঁকে গেলেন, ওনার উষ্ণ নিশ্বাস আমি অনুভব করতে পারছি, বুকের ভিতর ও ধুকধুক করতে শুরু করে দিয়েছে, হৃদগতি দ্রুত হারে চলছে। উনি এবার আচমকাই আমার মুখ এর ওপর ফু দিতেই আমি আর নিজেকে আর আমার তাল কোনটাই সামলাতে পারলাম না, পা ছেড়ে এবার সোজা হয়ে গেলাম আর পুনরায় ওনার থেকে ছোট হয়ে ওনার কাছে বাচ্চাই হয়ে গেলাম। উনি মুখ টিপে হাসছেন আমার তা দেখে রাগ হলো। উনি এবার বললেন,

‘এবার দেখো, তোমার হাইট বোধহয় বেড়ে গেছে। ‘
আমি বুঝলাম যে উনি এটা মজা করে বললেন। আমি বিরক্ত হয়ে সরে গেলাম ওনার সামনে থেকে। ছাদের কার্নিশ বরাবর দাঁড়িয়ে রইলাম। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আমি চুলটা খোপা করে নিলাম আর খুব ভালোভাবে অনুভব করলাম যে আমার শরীরে ওড়না নেই। আমি কি এতখন ধরে এভাবেই ওনার সাথে ঝগড়া করছিলাম? ভাবতেই নিজেকে সত্যিকারের স্টুপিড মনে হচ্ছে। পিছন থেকে ডাক দিলেন উনি বেশ জোরে

‘ এই মেয়ে ওখানে কি করছো তুমি? ‘
আমি মুখ ভাঙালাম আর জোরেই বললাম,
‘আমার একটা সুন্দর নাম আছে, এই মেয়ে বলে একদম ডাকবেন না। ‘
উনিও বোধহয় এতোদূর থেকে ঝগড়া করে শান্তি পাচ্ছেন না তাই আমার কাছে এসে বললেন,
‘চলো নীচে যাও। রেডি হও।’
আমি কড়া কন্ঠে প্রশ্ন করলাম
‘কেন? কমিউনিটি সেন্টারে আপনার বিয়ে লেগেছে? ‘

এতখন ধরে যেটা মিস করছিলাম সেটা ফুলফিল হয়েছে, ওনার সাথে ঝগড়া করতে পেরেছি। কথায় কথায় এটাই ভুলে গেলাম যে আমার জন্মদিন।
‘আমি কোথাও যাবো না। আপনি যান। আমার মনে আপনার মতো অতো রঙ লাগেনি। ফারিন আপুকে নিয়ে যান। ‘
কথাটা বলতেই উনি গটগট করে বেরিয়ে গেলেন। আমি অবাক আর হতবিহ্বল হয়ে ওনার যাওয়ার পানে চেয়ে রইলাম।
বেশ জোরেই বললাম,
‘ভাইরে ভাই আপনার মতো বেয়াদপ লোক দেখিনি। প্রেমিকার নাম নিতে না নিতেই হাওয়া! আপনার প্রেমে ধ্বস লাগুক, ভূমিকম্প হোক। আপনার আর ওই রাক্ষসীর প্রেমে পৃথিবীর সব প্রাকৃতিক দূ্র্যোগ নামুক। ‘

রাগে গা তিরতির করছে আমার। যেতে বললাম বলেই কি যেতে হবে?
বেশ কিছুখন কোন সাড়া শব্দ পেলাম না আমি। তবে কিছুখন পর পায়ের আওয়াজ পেতেই চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল যে এক পা ও নড়বো না।
উনি হঠাৎ করে একটা বড়ো প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিতেই আমি কর্কশ ভাবে বললাম,
‘ কি এসব? ‘

উনি এবার যেন রেগে গেলেন, তাহলে আমার বলা কথাগুলো কি উনি শুনে ফেলেছেন? আমি দমে গেলাম।
‘একটাও ফালতু কথা না। তাড়াতাড়ি পরো এগুলো। ‘
কথাটা শুনতেই প্যাকেটটা খুলতেই দেখলাম একটা নীল রঙের পশম ওয়ালা স্কাফ। একটা ব্লু জ্যাকেট। একটা ব্লু পশম ওয়ালা টুপি যার দু পাশ দিয়ে দুটো কিউট টেডিবেয়ার।
আমি দেখে খুশি হয়ে গেলাম।

‘আপনি কি কিউট আরিশ ভাইয়া। আপনার মতো ভাই ঘরে ঘরে হোক। ‘
উনি রাগী রাগী মুখ করে বললেন,
‘জলদি এগুলো পরো। বার হবো আমরা। ‘
আমি আহাম্মক বনে গেলাম, যদি খুব ভুল ধারণা না হয় এটা জুন মাস, ঠা ঠা করা গরম।
‘এগুলো এখন পরবো কেন? এখন কি শীতকাল নাকি? ‘
আবার উত্তরে উনি এমন ভাবে তাকালেন যাতে আমি বলতে বাধ্য হলাম,
‘পরছি পরছি এভাবে তাকানোর কি আছে? ‘

জ্যাকেটটা পড়তেই উনি হাত থেকে স্কাফ আর টুপি নিয়ে নিলেন,
‘ নিজেই স্কাফটা গলায় জড়িয়ে দিলেন আর টুপি টা পরিয়ে দিলেন। ‘
গরমে আমার প্রান ওষ্ঠাগত। আমার নাক ঘামছে সাথে সারা শরীরও। উনি একঝলক আমার দিকে তাকিয়ে পকেট থেকে রোমাল বার করে আমার নাকের ঘামটা মুছিয়ে দিতেই আমি মিনতির সুরে বললাম,
‘এবার এগুলো খুলে রাখি? গরম লাগছে ভীষন। ‘
‘এটা তোমার শাস্তি? ‘
অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম
‘কিসের শাস্তি? ‘

‘শুনলাম একটু আগে আমার সব গার্লফ্রেন্ড গুলো ভূমিকম্প, আর ধব্সে চাপা পড়েছে। তুমি একটু আগেই না অভিশাপ দিলে! ‘
আমি চোখ কান বুজে নিলাম। উনি আড়ালে কথা শুনেছেন?
আমি মিনমিন করে বললাম,
‘তাদের মাগফেরাত এর কামনা করি। তারা জান্নাত বাসী হোক। কিন্তু এগুলো এবার খুলি? ‘
উনি হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে বললেন,
‘ভেবে দেখছি। ‘
ওনার সাথে আমিও নামছি রকেট এর গতিতে। আশরাফ চাচা ঘুমিয়ে গেছেন। উনি দেখি বাইকের সামনে টেনে নিয়ে গেলেন।
‘হ্যাপি বার্থডে মিস টুইটুই। ‘

আমি চমকে গেলাম। এতখন মনেই ছিল না আমার। থ্যাঙ্কিউ অবধি বলতে ভুলে গেলাম।
উনি নিজেই আমার মাথা থেকে টুপি আর স্কাফটা খুলে দিলেন। আমি দম ছাড়লাম।
উনি অনেকখন আমার দিক চেয়ে রইলেন। তারপর নিজেই বললেন,
‘এগুলো চাচার ওই টেবিলের ওপর রেখে এসো। ফেরার সময় নিয়ে নিও। ‘
উনি বাইক স্টার্ট দিলেন। আমি ওনার কাজকর্মে ওবাক হই। উনি এবারো আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন নিজে এই মুহূর্তে আমার সামনে উপস্থিত হয়ে। এর থেকে বড়ো সারপ্রাইজ আর হয়তো হতো না। আমি ওনার দিক শান্ত ভাবে চেয়ে বললাম,

‘আপনি আজকেই কেন ফিরে এলেন?আপনার না আরও দুইদিন পর ফেরার কথা ছিল? ‘
উনি উত্তর দিলেন না। এমন একটা ভাব নিলেন যেন কিছুই শোনেননি। কেবল ইশারা করে পিছনে বসতে বললেন। আমি উঠে বসে ওনাকে না ধরেই বসলাম।
উনি রাগী গলায় বললেন,
‘সাইক্লোনের গতিবেগ জানো কতো? ‘
ওনার কথার ইশারা বুঝতে পেরে ওনাকে জাপটে ধরলাম আমি। এটাতে উনি হয়তো বোঝালেন,
‘নো মোর আরগিও।’

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ৪

উনি বাইক চালাচ্ছেন বেশ স্বাভাবিক গতিতে। আমার সমস্ত মন খারাপ মিলিয়ে গেছে যেন ওনার উপস্থিতিতে একনিমেশেই। তবে মাথায় খালি একটাই প্রশ্ন ঘোরে আমার,
‘আচ্ছা ওনার চোখে আমি কি কখনো বড়ো হবো না? ‘

ভালোবাসি বলে দাও পর্ব ৬