মধুমাস গল্পের লিংক || জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

মধুমাস পর্ব ১
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

“এই মেয়ে!দাঁড়াও!”
শ্যামা চোখ খিঁচে থমকে দাঁড়ায়।পেছন ফিরে বুকে হাত রেখে বললো,
“আমি?”
ফিরোজ মাথা নেড়ে গম্ভীর গলায় বললো,
“হ্যাঁ।”

শ্যামার গলা শুকিয়ে যায়।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ফিরোজের দিকে কয়েক পা এগিয়ে আসে।ফিরোজ তখনো শ্যামার দিকে তেজী চোখে তাকিয়ে।তার গলায় রাগের আভাস স্পষ্ট।তেতে উঠা গলায় বললো,
“সবসময় এমন তাকিয়ে থাকো কেনো?এতো তাকিয়ে কি দেখো?আমার গায়ে কি মধু মেখে রেখেছি?”
শ্যামা কি বলবে ভেবে পায়না,লোকটার কথাগুলো এতো কর্কশ!তারপরেও কেনো জানি তার এতো ভালো লাগে।সে শুধু মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে না জানায়।শ্যামার এই নিশ্চুপতা রাগী ফিরোজের মাথা গরম করে দেয়।দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললো,
“মেয়ে মানুষ এতো নির্লজ্জ হয়!তোমাকে না দেখলে জানতাম না।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

শ্যামা কোনো কথা না বলে একপলক ফিরোজকে দেখে,সাদা শার্ট ঘামে ভিজে একাকার তারপরেও এই রোদে বসে আছে,এতো কষ্ট করার মানে কি?কি আছে এই রাজনীতিতে তা শ্যামার মাথায় ঢুকে না।
ফিরোজ বাইকের আয়না হাত দিয়ে পরিষ্কার করে শ্যামার দিকে কঠিন দৃষ্টি ফেলে তাকে দেখতে দেখতে বললো,
“এমনে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে না।আর যদি এমন বেয়াদবি করো তো স্বপন কাকার কাছে বিচার দেবো।যাও!”
শ্যামা চোখভরে ফিরোজকে দেখে, দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কলেজের দিকে এগিয়ে যায়।এই লোকটা এমন কেনো?রাগীভুত!

ফিরোজ শ্যামার যাওয়ার পথে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।প্রায় দুই বছর ধরে মেয়েটা তার চোখে পড়েছে আগেও একি গ্রামে এমনকি পাশাপাশি বাড়িতে থাকলেও কখনো কথা হয়নি কিংবা এমন করে খেয়াল করা হয়নি কিন্তু শ্যামার এই বিস্তর পরিবর্তন ফিরোজকে বাধ্য করেছে শ্যামার দিকে তাকাতে।প্রথমে একটু একটু তাকালেও দিনদিন শ্যামার চোখের দৃষ্টি গভীর থেকে গভীর হচ্ছে।

ত্রিশ বছর বয়সী ফিরোজের একটা ছোট মেয়ের এমন চোখের দৃষ্টির না বলা কথা,গোপন অনুভূতি বুঝতে মোটেই সমস্যা হয়না,সে দিব্যি বুঝতে পারে মেয়েটার কচ্ছপের গতিতে তার দিকে এগিয়ে আসা।কিন্তু ফিরোজ সতর্ক,বাচ্চার বাচ্চামিতে সায় দেয়ার মতো মন মানষিকতা তার নেই।সে মনে করে তেল যেমন জলের সাথে মিশেনা তেমনি সেও কোনো নারীর সাথে মিশতে পারবেনা।

নারীরা বেইমান হয়,স্বার্থপর হয়,নারী মানেই বি,ষাক্ত।সে বি,ষাক্ত নারীদের একদম বিশ্বাস করতে চায় না।আর এই শ্যামা কে তো কখনোই কাছে আসতে দেয়া যাবেনা,তার উপরে মেয়েটা তার ছোট বোনের বান্ধুবী,ছিহ্ ছিহ্।ফিরোজ অবাক হয়ে ভাবে,মেয়েদের স্বভাব চরিত্র এতো খা,রাপ হয় কেনো?বড়ো ভাইয়ের মতো কাউকে কি করে পছন্দ করে ফেলে।হ্যাঁ;শ্যামা তাকে এখনো এমন কিছু বলেনি কিন্তু সে জানে,এইটুকু না জানলে না বুঝলে পুরুষ জনম বৃথা।

শ্যামা দূরে দাঁড়ানো ফারিয়ার দিকে তাকায় তারপর পিছু ফিরে আবারও একপলক ফিরোজকে দেখে।লোকটা মোবাইলে নিজের সমস্ত মনোযোগ ঢেলে দিয়েছে এই মনোযোগের ছিটেফোঁটাও যদি শ্যামাকে দিতো তাহলে শ্যামার এই পাগল মন খানিক ঠান্ডা হতো।ফারিয়া কাধের ব্যাগ টেনেটুনে ঠিক করে শ্যামার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,

“এতোক্ষণে আসার সময় হলো?”
“আসলাম তো।”
” আমার ভাই তোকে কি বললো?”
শ্যামার অনুভূতি সম্পূর্ণ নিজের,এর মাতাল বাতাস কাউকে ছুঁয়ার অনুমতি সে দেয়না।এমনকি প্রিয় বান্ধুবি ফারিয়াও শ্যামার এই অনুভূতি সম্পর্কে অজ্ঞ।ফারিয়ার ভাইয়াকে দেখলে বুকে যে মাদল তালে প্রেমের ছন্দ বাজে তা ফারিয়া জানে না,জানলে নিশ্চয়ই হাসি ঠাট্টা করতো।সে ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

“কিছু না।”
ফারিয়া মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে বললো,
“আমি তো দেখলাম কি জানো বললো।”
শ্যামা ফারিয়ার মাথায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“এটা তোর বড়োভাই!এই লোক কি বলবে বল?”
ফারিয়া ভাবুক গলায় বললো,
“কথা ঠিক। এই মানুষ কিছু বলার লোকও না।”
শ্যামা তাল মিলিয়ে বললো,

“গম্ভীর মানুষ,নিরামিষ।”
ফারিয়া প্রতিবাদ করে বললো,
“ভাইয়া মোটেই গম্ভীর না,খুবই মিষ্টি আর মিশুক।”
শ্যামা মুখ ভেঙচিয়ে বললো,
“মিশুক!কখনো কারো সাথে ভালো করে কথা বলতে দেখেছিস?”
ফারিয়া অন্যমনস্ক হয়।রাস্তার উঁচুনিচু ইটের কনায় পা রাখতে রাখতে বললো,
“ভাইয়া সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করে শুধুমাত্র মেয়েদের ছাড়া।ভাইয়া মেয়েদের প্রচন্ড ঘৃণা করে।”
ফিরোজকে জানার জন্য শ্যামা মুখিয়ে থাকে,যে যা বলে সব গোগ্রাসে গিলে।ফারিয়ার কথা শুনে তার জানার আগ্রহ বাড়ে, ফারিয়াকে জিজ্ঞেস করে,

“কেনো?”
ফারিয়া এই উত্তর দিতে ইচ্ছুক না তাইতো কথা ঘুরায়।আস্তে করে এই প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
“পরিক্ষার আর মাত্র পনেরো দিন বাকি সে খবর আছে?”
শ্যামা বুঝতে পারে ফারিয়া তাকে বলবে না তাই মন খারাপ করে বললো,
“হ্যাঁ আছে;ফাস্ট সেমিস্টার চিন্তার কি আছে?”

মুরাদনগর আগে গ্রাম হলেও বর্তমানে এটা শহর হয়ে গেছে।চারিপাশে শহুরে ছোঁয়ায় রঙিন হয়ে গ্রামের চিত্র খানিক পাল্টে গেছে।মুহাম্মদ হকের বড়ো ছেলের নাম ফিরোজ।মুরাদনগর মার্কেটে
উনার খাবারের হোটেল আছে।মুরাদনগরের কলেজ রাস্তার চৌরাস্তার মোড়ে বাগদাদ হোটেল,বেশ জনপ্রিয়।সারাদিন ভিড়বাট্টা লেগেই থাকে।

ফিরোজ উনার প্রথম পক্ষের সন্তান।যখন প্রথম বউয়ের সাথে ছাড়াছাড়ি হয় তখন ফিরোজের বয়স তিন বছর বয়স ;দ্বিতীয় বিয়ে করে এই আশায় যে ছেলে বুঝি মা পাবে কিন্তু উনার খাতায় যোগ অংক মিলে না,বরং জীবন আরো বি,ষিয়ে যায়।দ্বিতীয় স্ত্রী;রোজিনা তার গর্ভে মোহাম্মদ হকের এক ছেলে ও এক মেয়ের জন্ম হয়।হোটেল থেকে ভালো পয়সা উপার্জন হয়,সচ্ছল পরিবার।

কিন্তু উনার যতো চিন্তা সব ফিরোজকে নিয়ে,ছেলেটা বেখেয়ালি ,রাগী,গম্ভীর,রাজনৈতিক পথে চলে গিয়েছে।বাসায় থাকে কম,নিজের জীবন নিয়ে;ভবিষ্যত নিয়ে কোনো ভাবনা নেই কিন্তু মুহাম্মদ হক চান যে তিনি বেঁচে থাকতে থাকতেই ফিরোজের একটা ব্যবস্থা করতে কিন্তু এই ব্যাপারে ফিরোজের কোনো হেলদোল নেই।যদিও তিনি কয়েকবার এই প্রসঙ্গে কথা তুলেছেন কিন্তু ফিরোজ হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।

মুহাম্মদ আলীও ফিরোজের সাথে কঠিন হতে পারেননা।ফিরোজ জন্মানোর পরেই তিনি বাবা হওয়ার স্বাদ পান,এই ছেলেটা তার প্রথম সন্তান,সব আবেগ অনুভূতি,মায়া ফিরোজকে ঘিরেই বেশি।মা-হীন ছেলেটাকে তিনি নতুন মায়ের আদর না দিতে পারলেও নিজের ভালোবাসার কমতি রাখেননি।উনি লক্ষ করেছেন যে ফিরোজ সবার সাথে রাগী আর গম্ভীর গলায় কথা বললেও উনার সাথে অন্যরকম, নরম,হাসিখুশি।

মুহাম্মদ আলী দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায় রাত এগারোটা বাজতে চললো কিন্তু এখনো ফিরোজ বাসায় আসেনি।সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও উনি ঘুমাননি।উপজেলার সামনে আজকে ঝামেলা হয়েছে সেখানের প্রধান উপদেষ্টা ছিলো ফিরোজ।ছেলেটা কেনো বুঝেনা রাজনীতি সবার জন্য নয়,রাজনীতি মানেই জীবনের রঙ ভিন্ন,মাজগে মাঝে জীবন শেষও হবার ঝুকি থাকে।উনি চান না ফিরোজের জীবনটাও চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যাক।আজকে একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে হবেই।
ফিরোজ রাত বারোটা নাগাদ বাড়ি ফেরে।কেচি গেইট খুলে,বাইকটা সিড়ির পাশে রেকগে ভেতরে ঢুকে। তার আব্বাকে সোফায় বসে থাকতে দেখে হেসে বললো,

“আব্বা এখনো ঘুমাননি?”
মুহাম্মদ আলী গলায় রাগ এনে বললো,
“জোয়ান ছেলে রাত বিরাতে বাহিরে থাকলে কোনো বাবা ঘুমাতে পারে?”
ফিরোজ হাসে।মুহাম্মদ আলী সেই হাসি মন ভরে দেখে।ছেলেটা এতো সুন্দর,একদম উনার আব্বার মতো হয়েছে,আব্বা মারা গেছে ত্রিশ বছর হলো,যেদিন ফিরোজ জন্ম নিলো তার ঠিক দশদিন আগে উনার আব্বা পরলোকে গমন করেন।

আল্লাহ ফিরোজের মাঝে কি আবার উনার আব্বার প্রতিচ্ছবি পাঠালেন?না হলে দেখতে এতো মিল মনে হয় ফিরোজ না উনার আব্বা স্বয়ং দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে উনার মনে হয় ফিরোজকে একটা তাবিজ কিনে দেওয়া দরকার,কারো নজর লেগে যায় কিনা,পরক্ষণেই নিজের ছেলেমানুষী চিন্তায় নিজেই হাসে।একমাত্র ছেলেমেয়ের মঙ্গল কামনা করেই বাবা মা যতো আজগুবি চিন্তা মাথায় আনতে পারে।
ফিরোজ তার আব্বার পাশে বসে বললো,

“এমপি সাহেব এসেছিলো তাই দেরী হলো।”
“এসব নেতাগিরি করে কি হবে?এমপির পিছনে ঘুরে কি জীবন চলবে?”
ফিরোজের গলা খানিক নিভে আসে।
“এসব আমার ভালো লাগে তাছাড়া এসব তো নেরাগিরি না আমি ছাত্রলীগের সভাপতি।এই পদের আলাদা সম্মান আছে।”
মোহাম্মদ আলী নাক সিটকে বললো,

“কিসের সম্মান?এসব বাদ দেও আব্বা,আমার হোটেলে বসো,রোজগার করো।”
ফিরোজ তার চুলে হাত ভুলিয়ে বললো,
“হোটেলে তো বসিই।”
“এমন বসা না।আমার মতো বসবি।আমার বয়স হচ্ছে না বলো?এবার আমি একটু বিশ্রাম নিতে চাই।”
ফিরোজ উনার কথা পাত্তা দিলোনা।আস্তে করে বললো,
“আচ্ছা।”
মোহাম্মদ আলী ফিরোজের বাহুতে হাত রেখে বললো,

“বয়স তো কম হলোনা এবার একটা বিয়ে করে নে দেখবি এসব রাজনীতি থেকে ভালোলাগা অন্যদিকে চলে যাবে।”
বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই ফিরোজের মুখের ভাব শক্ত হয়।সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আমি এসব বিয়ে টিয়েতে নেই আব্বা।তারচেয়ে ভালো তামিমকেই বরং বিয়ে করান নয়তো ফারিয়াকে বিয়ে দেন।”
তামিম মোহাম্মদ আলীর ছোট ছেলে যে কিনা এবার মাস্টার্সে ভর্তি হলো,আর ফারিয়া এবার ইন্টার প্রথম বর্ষে পড়ে।মোহাম্মদ আলী হেরে যাওয়া চোখে ছেলের যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকেন।পিছন থেকে বলেন,

“রাতের খাবার খেয়ে যা।”
ফিরোজ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
“বললাম না এমপি সাহেব এসেছিলো উনার পক্ষ থেকেই রাতের খাবার হয়েছে।”
শ্যামা বালিশে মাথা রেখে কাত হয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে।চোখের দৃষ্টি মোবাইলের স্কিনে স্থির।ফোনের গ্যালারিতে ফিরোজের শতাধিক ছবি।সে হাতের আঙুল দিয়ে ফিরোজকে ছুঁয়ে দেয়,জুম করে ফিরোজের প্রতিটা অঙ্গ ভিষণ মায়া নিয়ে পর্যবেক্ষণ করে।ছবি দেখতে দেখতে শ্যামার শ্বাস ঘন হয়।কানে বাজে ফিরোজের আজকের বলা কথাটা,”আমার গায়ে কি মধু মেখে রেখেছি?”শ্যামা ফিক করে হেসে দেয়।মোবাইলে ফিরোজের ছবির দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললো,

“আপনার গায়ে মধু মাখা কিনা জানা নেই কিন্তু আপনি কাছে থাকলে চারদিকে মধুমাস মনে হয়।চারিদিকে বসন্তের হাওয়া আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় কিন্তু যাকে ঘিরে মধুমাসের উত্তাল বাতাস বয় সে কখনো টের পায়নি বরং চোখের বি,ষ দিয়ে আজন্ম মে,রে ফেলে।শ্যামা ছবির কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” আপনি আমাকে এভাবে বিষ পান করালেন কিন্তু নিরাময়ের ওষুধ দিলেন না কেনো?আমি যদি মা,রা যাই মধুমাসের মধুরানী হবে কে?”

মধুমাস পর্ব ২