মধুমাস পর্ব ১৬

মধুমাস পর্ব ১৬
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

ফারিয়ার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে,ফারিয়ার বান্ধুবী হয়ে শ্যামার এখনো বিয়ে ঠিক হলোনা এই ব্যাপারটা যেনো খুবই গুরুতর এক অপরাধ।ফারিয়ার বিয়ের আর চারদিন বাকি,যতোই ফারিয়ার বিয়ে ঘনিয়ে আসছে ফাতেমা বেগম শ্যামার চিন্তায় চিন্তিত্ব হয়ে যাচ্ছে।শ্যামার জন্য তখন ভালো ভালো সমন্ধ আসছে,স্বপন ইসলাম মেয়ের কান্নাকাটি দেখে বিয়ে নিয়ে না ভাবলেও ফাতেমা বেগমের খুচানোর জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পাত্র পক্ষকে হ্যাঁ বলে দেয়।

ছেলে কানাডার প্রবাসী।বিয়ে করে স্ত্রী সাথে নিয়ে যাবে।মেয়ে হয়তো দূরে থাকবে কিন্তু এমন সোনায় সোহাগা পাত্র আর কই পাওয়া যাবে।পাত্রের নাম আদনান।আদনানের ছুটি কম বিধায় খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে চায়।সে জন্যই হুট করে এক সন্ধায় শ্যামাকে দেখতে চলে আসে।আদনানের মা মুরাদনগর মাস্টার পাড়ায় ভাড়া থাকে উনিই শ্যামাকে কলেজে যেতে দেখেছে,একমাত্র ছেলের জন্য এই মেয়েকেই মনে ধরেছে।আজকে মেয়ে দেখে যদি আদনান পছন্দ করে তাহলে আগামীকাল বিয়ে হবে বলে এমনটাই আশা।উনার।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাত্র পক্ষ বসার ঘরে বসে আছে।শ্যামা মাত্র বাহির থেকে এসেছে বসার ঘরে দামী পারফিউমের ঘ্রাণে সেদিন উঁকি দিয়ে দেখে অচেনা লোকজন বসে আছে।অচেনা লোক দেখেই শ্যামার বুকটা কেঁপে উঠে।শান্তা পেছন থেকে শ্যামাকে টেনে রুমে নিয়ে যায়।সে বিরক্ত স্বরে বললো,
“কি হয়েছে?টানাটানি করছো কেনো?”
শান্তা ফিসফিস করে বললো,

“আস্তে কথা বল।”
“কেনো?আর উনারা কে?”
“তোকে দেখতে এসেছে,এমন জোরে জোরে চেচালে খারাপ ভাববে।”
শ্যামা শক খাওয়া মানুষের মতো ছিটকে দূরে গিয়ে বললো,
“কি!”

“কি মানে তোর তো খুশী হওয়ার কথা এমন ভালো পাত্র এসেছে।খুব পয়সা ওয়ালা,তোকেও বিদেশ নিয়ে যাবে। বিয়ের পরে বিদেশ যাবি।বুঝলি?”
মূহুর্তেই শ্যামার চোখ জলে ভরে উঠে।সে তো ভালো পাত্র চায় না,সে টাকা চায় না,আর না চায় বিদেশ যেতে।সে তার ফিরোজকে চায়,ফিরোজকে হারানোর ভ য়ে সে কুকড়ে যায়,হুট করে বুকে একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয় যা চিনচিন করে ব্যাথা বাড়াচ্ছে।সে মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে বললো,

“না না। ”
শান্তা মনে মনে কুটিলভাবে হাসে।
“না মানে কি?তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে রেডি হ,আব্বা আবার রেগে যাবে।”
শ্যামা গো ধরে বিছানায় বসে পড়ে।ইতোমধ্যেই চোখ দিয়ে পানি পরা শুরু হয়ে গেছে।
“উনাদের চলে যেতে বলো।আমি বিয়ে করবোনা।”
শান্তা কিছু বলার আগে ফাতেমা বেগম রুমে আসে।

“কি হলো শান্তা ওকে এখনো রেডি করাওনি কেনো?”
শান্তা বললো,
“আম্মা ও রেডি হচ্ছে না।”
ফাতেমা বেগম মেয়ের দিকে তাকায়।পান পাতার মতো চেহারায় দীঘির মতো গভীর কালো চোখে পানির বন্যা দেখে উনার বুক কামড়ে উঠে।কাঁদছে কেনো মেয়েটা?সাধারনত পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে আসলে মেয়েরা লজ্জায় মুখ লুকায়,চেহারায় আলাদা লজ্জা ভর করে কিন্তু শ্যামা যে কাঁদছে।উনি মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,

“কি হয়েছে শ্যামা?রেডি হয়ে যা।”
শ্যামা অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকায়।না বলতে পারা কথার জন্য বুক ফেটে যায়।
“আম্মা…!”
ফাতেমা বেগম তীর্যক দৃষ্টি মেলে তাকায়।
“এতো ভালো সমন্ধ আর পাওয়া যাবে?কোনো কথা না বলে রেডি হয়ে যা।”
শ্যামা ফুপিয়ে বলে,

“আমি বিয়ে করবো না,লেখাপড়া করবো।দয়া করে আমার কথা বুঝার চেষ্টা করো।”
ফাতেমা বেগম রেগে যায়।
“লেখাপড়ার দোহাই দিবি না।বিয়ের পরেও পড়া যায়।”
শ্যামা তার মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললো,
“না।”

স্বপন ইসলাম শ্যামার রুমে আসে।উনারা এক ঘন্টা যাবত বসে আছে।মেয়েকে কোনোভাবে রাজী করানো যাচ্ছে না অগ্যতা উনারই আসতে হলো।শ্যামার মাথায় হাত ভুলিয়ে বললো,
“আম্মা!কি সমস্যা?”
শ্যামা বাবার আহ্লাদী কথা শুনে আরো ফুপিয়ে উঠে।কাঁপা কাঁপা গলায় ফিসফিস করে বললো,
“আমি বিয়ে করবোনা আব্বা।উনাদের না করে দাও।”
স্বপন ইসলাম একদৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন।উনাকে সবাই রাগী মানুষ হিসেবে জানলেও এই মেয়েটার কাছে উনি নরম মনের মানুষ হিসেবেই নিজেকে জাহির করেন।এই মূহুর্তে মেয়ের কান্না উনার ভালো লাগছে না।শান্ত গলায় শ্যামাকে বললো,

“শ্যামা।”
শ্যামা তার আব্বার কথায় মাথা তুলে তাকায়।স্বপন ইসলাম বললো,
“তোর কি কোনো পছন্দ আছে?”
শ্যামার শ্বাস গভীর হয়।বুকফেটে কান্না আসে।এই মূহুর্তে ফিরোজের নাম বললে ঝামেলা কমার বদলে আরো বাড়বে।প্রিয় মানুষ থাকার পরেও তার নাম প্রকাশ না করতে পারার যন্ত্রণায় শ্যামা মাথা নিচু করে রাখে।স্বপন ইসলাম আবারো
জিজ্ঞেস করে বললো,
“শ্যামা।”

শ্যামা মাথা নেড়ে না করে।ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।মেয়ের কান্না দেখে স্বপন ইসলামও ভ,য় পেয়ে গেছেন,ভেবেছিলেন মেয়ে বুঝি বে-পথে চলে গিয়েছে।উনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।শ্যামা আস্তে করে বললো,
“না।পছন্দ নেই।”
স্বপন ইসলাম বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললো,
“তাহলে কান্নাকাটি কেনো?”
“আমি পড়তে চাই।”
“উনারা বিয়ের পর পড়াবে।”
“আমি এখনি বিয়ে করতে চাই না।”
“ভালো পাত্র,সবসময় পাওয়া দুষ্কর।”

“আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের দায়িত্ব নিতে চাই।”
“তেমন ইচ্ছা থাকলে বিয়ের পরেও আমাদের জন্য কিছু করা যাবে। ”
শ্যামার ছোট্ট মস্তিষ্কে আর কোনো যুক্তি খুঁজে পায় না।সে অসহায় গলায় তার আব্বাকে ডাকে,
“আব্বা….”
স্বপন ইসলাম মেয়েকে বললেন,

“দেখলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না।”
শান্তা তাল মিলিয়ে বললো,
“হ্যাঁ;সেটাই।দেখলেই কি বিয়ে হয়ে যাবে নাকি।”
স্বপন ইসলাম বললেন,
“তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।উনারা এসেছে এখন মেয়ে না দেখালে ব্যাপারটা খারাপ হবে।আমি চাই না আমার মেয়ে আমার নাম খারাপ করুক।”
শ্যামার নিজেকে খুব অসহায় লাগে।সে মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”

স্বপন ইসলাম স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“দেখেছো আমার আম্মা আমার সব কথা শুনে।”
ফাতেমা বেগম বুদ্ধি করে ফারিয়াকে ডেকে আনে।ফারিয়া এসে শ্যামার কান্নামাখা চেহারা দেখে থমথমে খেয়ে যায়।এই মেয়ে কাঁদে কেনো?সে তো কাঁদেনি বরং আরো লজ্জা পেয়েছে,মুচকি হেসেছে।সে শ্যামার হাত ধরে বললো,
“কাঁদিস কেনো?আমাকে বল।”

ফারিয়াকে দেখে শ্যামার দুনিয়া উলটে যায়।নাকের পাটাতন কেঁপে কেঁপে কান্নার দমক বাড়ে।সে বলতে পারেনা তার ভাইয়ের জন্য কাঁদে।বিয়ে করলে ফিরোজকেই
করবে।ফারিয়া ভাবে শ্যামা বুঝি ভয়ে কাঁদছে।সে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
“কাঁদিস না।দেখবি সব ভালো হবে।”

বিয়ে ঠিক হবেনা হবেনা বললেও সবার জানা ছিলো বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।শ্যামার ধারনা ছিলো বিয়ে হবেনা,তাকে মোটেই পছন্দ হবে না কিন্তু তার ধারনাকে ভুল প্রমানিত করে মাহিন তাকে ভিষণ পছন্দ করলো এমনকি বিয়েও ঠিক হয়ে গেলো।স্বপন ইসলামের একমাত্র মেয়ে বিধায় উনি দুইদিন পরেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন।উনারা চলে গেলে ফারিয়াও চলে যায়।শ্যামা স্তব্ধ হয়ে বিছানায় বসে থাকে।

তার মনে হলো আশেপাশের সবকিছু ভনভন করে ঘুরছে।বিয়ে!এতো সোজা?সে যে ফিরোজকে ভালোবাসে তার কি হবে?ফিরোজকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবে কি করে?রাতেও তো ফিরোজের সাথে কথা হলো।শ্যামার ধারনা ছিলো ফিরোজ গম্ভীর মানুষ কিন্তু সম্পর্কে জড়ানোর পরে দেখে ফিরোজ তার সাথে সারাদিন লেগে থাকতে চায়,ভিষণ ভালোবাসে,আদুরে কথায়,আদুরে ডাকে তাকে সুখের সাগরে ভাসাতে কৃপণতা করে না।

এই এতো সুখ ছেড়ে শ্যামা আরেকজনকে আপন করে নেবে?অসম্ভব।শ্যামা হাতের চুড়ি খুলে ছুড়ে মারে।হাটুতে মুখ গুজে কাঁদে।মোবাইল হাতরে বের করে ফিরোজকে ফোন দেয়।কিন্তু ফোন রিসিভ হয় না,সে থামে না একের পর এক ফোন দিতেই থাকে ।শ্যামা ঘড়িতে সময় দেখে রাত এগারোটা।এতোক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়িতে এসে গেছে তাহলে ফোন কেনো ধরছেনা?

ফিরোজ রাত এগারোটার দিকে বাড়িতে আসে।গোসল করে মোবাইল হাতে নেয় না।আজকে দুপুরে খাওয়া হয়নি,পেটে প্রচন্ড খুদা;তাই সে সোজা খেতে চলে যায়।গিয়ে দেখে ফারিয়া একা একা ভাত খাচ্ছে।ফিরোজ অবাক হয়ে বললো,
“কি রে এতোক্ষণে কেনো?”
ফারিয়া টিভি দেখতে দেখতে খাচ্ছে।ভাইয়ের কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়।
“শ্যামাদের বাড়িতে ছিলাম।ওকে দেখতে এসেছে তাই আন্টি থাকতে বলেছিলো।”
ফিরোজের মাথায় মনে হলো কেউ একশো মন ওজনের মাথর দিয়ে ভারি মারলো।
“পছন্দ হয়েছে?”

ফারিয়া আপনমনে খাচ্ছে।ফিরোজের পাথরকঠিন চেহারা লক্ষ করে না।সে খেতে খেতে বললো,
“পছন্দ হবেনা আবার?শুক্রবারে বিয়ে।ছেলে কানাডার প্রবাসী।ভিষণ সুন্দর দেখতে।”
ফিরোজের প্রচন্ড খিদে হঠাৎ করেই কমে যায়।মুখের ভাতগুলো চিবোনোর শক্তিও জোগাতে পারে না।হাত পা অবশ হয়ে আসে।অনেক কষ্টে কয়েক লোকমা ভাত মুখে পুরে নেয়।

রুমে গিয়ে সর্বপ্রথম মোবাইল ফোন হাতে নেয়।শ্যামার অসংখ্য ফোন।সে আর দেরী না করে শ্যামাকে ফোন দেয়।রিং হওয়ার সাথে সাথেই রিসিভ করে নেয়,যেনো তার ফোন কলের অপেক্ষাই বসে ছিলো।ফোন রিসিভ করেই শ্যামার ফুপানোর শব্দ শুনতে পায়।কান্না জড়ানো কন্ঠে তার চড়ুই পাখি বিরবির করে বলছে,

“ফিরোজ;শুনতে পাচ্ছো?আমি কিন্তু বিয়ে করবোনা,তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনা, একদম ম,রে যাবো।”
শ্যামার কান্নারত কন্ঠ শুনে ফিরোজের বুক হাপড়ের মতো উঠানামা করতে থাকে।সে আস্তে করে বললো,
“আমাকে নিয়েই বাঁচবে।”

মধুমাস পর্ব ১৫

“সব বোধহয় শেষ করার সময় এসে গেছে।”
শ্যামার কথা শুনে ফিরোজ স্তব্ধ হয়ে যায়।মূহুর্তেই পায়ের রক্ত তরাক করে মাথায় উঠে যায়।

মধুমাস পর্ব ১৭