মধুমাস পর্ব ২৬

মধুমাস পর্ব ২৬
জাকিয়া সুলতানা ঝুমুর

“কোথায় গিয়েছিলি?”
শ্যামার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়,কণ্ঠনালি শুকিয়ে মরুভূমির ন্যায় খটখটে হয়ে যায়।শান্তিপূর্ণ মুচকি হাসি মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে সেখানে ভর করে ভ,য়।শ্যামা দরজায় দাঁড়িয়ে হাত পায়ের মৃদু কাঁপন স্পষ্ট টের পায়।
অন্ধকার রুমের মধ্যে থেকে ফাতেমা বেগমের রুক্ষ কন্ঠ আবারো ফিরে আসে।

“ভেতরে আয়।”
শ্যামার প্রাণপাখি ছটফট করে উঠে।দুর্বল পা বাড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে।ফাতেমা বেগম দরজা বন্ধ করে লাইট জ্বালায়।শ্যামা টিনের বেড়ার সাথে সিঠিয়ে দাঁড়ায়।ঘরের আরেক পাশে শান্তা দাঁড়িয়ে আছে।শান্তাকে দেখে শ্যামা বুঝতে পারে শান্তাই ফাতেমা বেগমকে জাগিয়েছে।শান্তার মুখের ঠোঁট টিপা হাসি দেখে শ্যামার খুব খা,রাপ লাগলো,মানুষের ভাবী নাকি বোনের মতো হয় কিন্তু তার ভাবী এমন কেনো?শান্তাকে দেখে তার ঘৃণা লাগলো। ফাতেমা বেগমের চোখ দিয়ে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে,জোড়ে জোড়ে শ্বাস ফেলে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“কথার উত্তর দে শ্যামা।”
শ্যামা জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।কথা বলতে গিয়ে টের পায় তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না।সে বহুকষ্টে বললো,
“আম্মা আমি… ”
শ্যামা তার কথা শেষ করার আগে ফাতেমা বেগম বললো,
“টয়লেটে তো যাসনি।তাহলে কোথায় গিয়েছিলি?”

শ্যামা অপলক তার আম্মার দিকে তাকিয়ে আছে।মনে মনে যুতসই উত্তর মিলাতে পারছেনা।শ্যামাকে চুপ করে থাকতে দেখে ফাতেমা বেগম এগিয়ে আসে।হাত দিয়ে শ্যামার মুখ চেপে ধরে।
“কথা বল।”
গাল চেপে ধরাতে শ্যামার কথা বলতে সমস্যা হয়।সে বললো,
“আম্মা।”

“ফিরোজের কাছে গিয়েছিলি?”
শ্যামা চুপচাপ ব্যাথা সহ্য করে কিন্তু কোনো কথা বলেনা।শ্যামকে চুপ থাকতে দেখে ফাতেমা বেগম হাতের শক্তি বাড়িয়ে আরো জোড়ে চেপে ধরে বললো,
“বল।”
শ্যামা মুখে র,ক্তের নোনতা স্বাধ পায়।ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বললো,
“হ্যাঁ।”

শ্যামার কথা শুনে ফাতেমা বেগম তার মুখ ছেড়ে টেবিলের কাছে হেলান দিয়ে রাখা বিছানার ঝাড়ু হাতে নেয়।শ্যামা ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দেয়।
“আম্মা আমাকে কিছু বলতে দাও।”
ফাতেমা বেগম গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে শ্যামাকে কয়েকটা বারি দিয়ে ফেলে।শ্যামা আ,ঘাতের চোটে ঘরের মধ্যে ছুটতে থাকে।ফাতেমা বেগম চুল টেনে ধরে বললো,

“এতো রাতে কি করেছিস বল।অ,সভ্য।শেষ পর্যন্ত তুই এতো খারাপ হলি?বিয়ের দরকার হলে বলতি আমরা বিয়ে দিতাম কিন্তু এই নোংরা কাজ করলি কি করে?”
শ্যামা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।তার আম্মা কি ভাবছে এসব?সে আর ফিরোজ কি এতো খারাপ?প্রেম করলে কি শারীরিক সম্পর্কই মূখ্য ব্যাপার?মায়ের মুখে এমন তর কথা শুনে শ্যামার খুব খারাপ লাগে।মাথা নেড়ে প্রতিবাদ করে বললো,
“না না আম্মা।তুমি যা ভাবছো তা না।আমি আর ফিরোজ কেউই এতো নিচু মনের না।”

শান্তা পাশ থেকে বললো,
“বললেই হলো?এতো ভালো মনের হলে রাতে কেন দেখা করতে গেলি?”
ফাতেমা বেগম শ্যামার দিকে তাকিয়ে আছে।শ্যামা বললো,
“আম্মা তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?”
“করি না।তুমি আমাকে ঘুমে রেখে ওই ছেলের সাথে দেখা করতে চলে গিয়েছিস,কিভাবে বিশ্বাস করবো।”
“আমি শুধু একটু দেখতে গিয়েছি আর কিছু না।তুমি যা ভাবছো তা ভুল।”

ফাতেমা বেগম বললো,
“এতো কথা না বলে ফিরোজকে ভুলে যা।”
শ্যামার সারা শরীরে পুরোনো ব্যাথাগুলো আবারো তরতাজা হয়ে উঠে।সে দাতে দাত চেপে বললো,
“কখনো না।”

ফাতেমা বেগম রেগে যায়।ঝাড়ু দিয়ে আরো কয়েকটা বারি দিয়ে বললো,
“তোর আব্বাকে ভালো করে বললে না হয় বুঝতাম কিন্তু এতো অপমানের পরেও তুই এই কথা কিভাবে বলিস?এই জন্য তোকে জন্ম দিয়েছিলাম?”
শ্যামা মাটিতে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।শান্তা বললো,

“থাক আম্মা আর মা,ইরেন না।”
ফাতেমা বেগম ঝাড়ু ছুড়ে ফেলে চলে যায়।শান্তা শ্যামার কাছে এসে বললো,
“ইমার্জেন্সি পিল এনে দেবো নাকি?”
শ্যামা রাগ্বত চোখে শান্তার দিকে তাকায়।
“এতো নিচু মনের কেনো তুমি?”

“আমাকে বল।পরে বাচ্চা টাচ্চা হয়ে গেলে আমাদেরই ঝামেলায় পরতে হবে।”
শ্যামার সারা শরীর ঘৃণায় রি রি করে উঠে।শান্তার দিকে তাকিয়ে রেগে বললো,
“বেরিয়ে যাও আমার রুম থেকে।”
শান্তা বললো,

“কেন?আমি চলে গেলে নাগরকে রুমে এনে ঢোকাবি নাকি?”
“হ্যাঁ তাতে তোমার কি?”
শান্তা হেসে বললো,
“কি আবার আম্মাকে আবারো ডেকে আনবো।”
“তুমিই মাকে ডেকেছিলে তাই না?”
“ডাকবোনা,নাগরের সাথে দেখা করতে গিয়েছো।”

শ্যামা সারা শরীর ব্যাথায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।শ্যামা আর কথা বাড়াতে চায় না।সে হাত বাড়িয়ে দরজা দেখিয়ে বললো,
“বেরিয়ে যাও অ,সভ্য মহিলা।”
শান্তা চোখ পাকিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
“কে অ,সভ্য তা তো বুঝাই যায় রাতের বেলা বেরিয়ে যায়।”
শান্তা যাওয়ার আগে বাহির থেকে দরজা আটকে চলে যায়।বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে শ্যামার নাকের পাটাতন ফুলে উঠে,ঠোঁট ফুলিয়ে মুখে হাত ঢেকে কেঁদে ফেলে।সে আর ফিরে আসতে চায়নি কিন্তু ফিরোজ তাকে জোড় করে পাঠিয়েছে এবার কি হবে?

শরীরের যন্ত্রণায় তার খুব কষ্ট হচ্ছে।মুখটা নোনতা নোনতা লাগাতে থু থু ফেলে দেখে থু থু এর পরিবর্তে টাটকা র,ক্ত এসেছে।গালে হাত দিয়ে তখন ফাতেমা বেগম চেপে ধরাতে যে ব্যাথা হয়েছিলো তা তীব্র আকাড়ে অনুভূত হয়।
ফিরোজ সকালে নাস্তা করতে যায়।মোহাম্মদ আলী তার সাথে কথা বলেনা নাস্তাও খায় না।ফিরোজও রাগ করে আগ বাড়িয়ে কথা বলেবা।উনি আজকে টেবিলে বসে আছে ফিরোজ গম্ভীর মুখে নাস্তা না খেয়েই বেরিয়ে যেতে চায়।মোহাম্মদ আলী দারাজ গলায় বললো,

“ফিরোজ।দাড়া।”
ফিরোজ দাঁড়ায়।মোহাম্মদ আলী বলে,
“নাস্তা করে যা।”
“আমি নাস্তা করবো না।”
রোজিনা বেগম বললো,
“তা করবে কেনো ঘরে দাসী আছিনা কোমড়ের হাড় ক্ষয় করে নাস্তা বানাবো ইচ্ছা হলে খাবে না হলে নাই।মাইয়াদের পিছে ঠিকি ঘুরতে পারে,মায়ের মতো হইছে একদম,বদ,মাইশ।”

ফিরোজের মাথা গরম হয়ে যায়।
“এই মহিলা চুপ।একদম চুপ।”
“চুপ না হলে কি করবে?”
ফিরোজের হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগে।মা থাকলে কি আজকে এমন করে বলতে পারতো?তার পছন্দকে এমন অবজ্ঞার চোখে দেখতো?ফিরোজ শক্ত চোখে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

“আব্বার উনাকে চুপ করতে বলেন।”
রোজিনা বেগম বললো,
“হুকুম দেয়,বেয়াদব।”
মোহাম্মদ আলী বিরক্ত কন্ঠে বললো,
“তুমি চুপ থাকো।আমি কথা বলছি।ফিরোজ তুই কাল রাতে কেনো শ্যামার সাথে দেখা করতে গেলি?”
ফিরোজ বিস্মিত হয়।সে যে শ্যামার সাথে দেখা করেছে তা উনি জানলো কি করে?উনি কি তার পিছনে খোঁচর লাগিয়েছে?হয়তো;না হলে কি করে জানবে?সে বললো,

“কে বলেছে?”
“যাসনি?মিথ্যা কথা?”
“গিয়েছি তাতে আপনার কি?”
“কেন যাবি?তোকে মানা করেছি না।”
“বউয়ের সাথে দেখা করবো না?”
“কিসের বউ?”

“আমি তো শ্যামাকেই বিয়ে করবো।”
মোহাম্মদ আলী ছেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিয়ে করবে?”
“হ্যাঁ।”
মোহাম্মদ আলী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আচ্ছা ভালো কথা।”
ফিরোজ বললো,
“আব্বা ভালোয় ভালোয় মেনে নেন।”
“হ্যাঁ তাই ভাবছি।”

ফিরোজ চলে গেলে রোজিনা বেগম মোহাম্মদ আলীকে বললো,
“তুমি মেনে নিলে?এমন ফকিন্নি মার্কা বাড়িতে বিয়ে করাবে!”
মোহাম্মদ আলী হাসে।রোজিনা চোখ পাকিয়ে বললো,
“হাসি আসে তোমার?”
“আসলো তো।”

রাত নয়টা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে।স্বপন ইসলাম বাড়িতেই ছিলো।আকস্মিক মোহাম্মদ আলী স্বপন ইসলামের বাড়িতে আসেন।উনার উপস্থিতিতে সবাই অবাক হয়।স্বপন ইসলাম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।মোহাম্মদ আলী ঘরে যায়না।বাহির থেকে বললো,
“আপনি কথা রাখতে পারেননি।”
স্বপন ইসলাম নিজের মেয়ের বন্ধ রুমের দিকে তাকায়।মেয়ে তো বাড়ি থেকে বেরোয়নি; তাহলে!
মোহাম্মদ আলী বললেন,

“আপনার মেয়েকে আটকে রাখতে পারেন না কেনো?বাবা ভাই ঘরে থাকতে রাত একটায় একটা মেয়ে কি করে বাড়ির বাহিরে চলে যায়?নাকি আপনারাই বাহিরে যেতে দিলেন।”
স্বপন ইসলাম নিজের স্ত্রীর দিকে তাকায়।ফাতেমা বেগম অপরাধী চোখে তাকিয়ে আছে।স্বপন ইসলাম কিছু বলার আগে মোহাম্মদ আলী বললো,
“মেয়েকে সামলান।আর না পারলে হাত পা ভেঙ্গে বাসায় বসিয়ে রাখেন,আল্লাহর উয়াস্তে আমার ছেলেকে মুক্তি দেন।আসি।”

মোহাম্মদ আলী যেমন তু,ফানের বেগে এসেছিলো তেমন চলেও গেলো মাঝখান দিয়ে শ্যামাদের টিনের চালের ঘরটায় তুফানে সব লন্ডবন্ড করে গেলো।শ্যামা রুম থেকে সব কথা শুনতে পেলো শুনে ভ,য়ে কুঁকড়ে যায়।স্বপন ইসলাম স্ত্রীর দিকে তাকায়।

“ও কি বেরিয়ে গিয়েছিলো?”
ফাতেমা বেগম চুপ হয়ে থাকে।স্বপন ইসলাম মেয়ের রুমের দিকে যায়।উনার ক্ষিপ্ত রুপ দেখে সবাই ভ,য় পেয়ে যায়।যে তুফান এসেছিলো তার সবটা আ,ঘাত শ্যামার উপরে আছড়ে পরে,কাতর শ্যামা আর সইতে পারে না।চোখের পানি অঝোরে ঝড়ছে আর শরীর কাঁপছে।সবাই স্বপন ইসলামকে শ্যামার থেকে ছাড়িয়ে নেয়।উনি
কাঁপা কন্ঠে বললো,

“রিপন ঘটককে বলবি তাড়াতাড়ি সমন্ধ আনতে।এই জঞ্জাল যতো তাড়াতাড়ি পারি দূর করে দেবো।”
ফিরোজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো।শ্যামাদের বাড়ি থেকে তার আব্বাকে বেরোতে দেখে সে চিন্তিত্ব হয়।
“আপনি ওদের বাড়িতে গিয়েছিলেন কেনো?”
স্বপন ইসলাম কুটিল হাসে কিন্তু কোনো কথা না বলে চলে যায়।ফিরোজের বুকটা কেঁপে উঠে।এক দৌড়ে শ্যামাদের বাড়িতে চলে আসে।বাড়ির ভেতরে সবার হইচই শুনে কোনোদিকে না তাকিয়ে ভেতরে চলে যায়।শ্যামাকে এমন অবস্থায় দেখে ফিরোজ বললো,

“আপনারা ওকে কি করেছেন?”
ফিরোজকে দেখে রিপন রে,গে যায়।এগিয়ে এসে সে ফিরোজকে আ,ঘাত করে,একে একে কয়েকবার আ,ঘাত করে।ফিরোজ শূন্য দৃষ্টি মেলে শ্যামার দিকে তাকিয়ে আছে।রিপন তাকে ধাক্কা দিয়ে বারান্দা থেকে উঠোনে ফেলে দেয়।বলিষ্ঠ দেহের ফিরোজ ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ে।ঝিরিঝিরি বৃষ্টির কারণে।গায়ে কাদা লেগে যায়।স্বপন ইসলাম বললেন,
“রিপন থামো।আর এই ছেলেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো।”

শ্যামা পা হেচড়ে হেচড়ে বারান্দায় আসে।অস্পষ্ট গলায় বললো,
“ভাইয়া আর মা,ইরো না ভাইয়া।”
ফিরোজের চোখে পানি টলমল করছে।সে চাইলে রিপনের সাথে মা,রা,মা,রি করতে পারতো কিন্তু তার শ্যামাকে পেতে হবে তাই এখন বাড়াবাড়ি করা ঠিক না।সে শ্যামার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি আসবো,তুমি কেঁদোনা শ্যামা।”

রিপন ফিরোজকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“আরেকবার আসলে পা ভেঙ্গে দেবো,বেরিয়ে যা।”
শ্যামা কেঁদে দেয়।
“ভাইয়া আর মে,রো না।”

মধুমাস পর্ব ২৫

রিপন হুংকার দিয়ে উঠে।
“তুই ভেতরে যা।”
ফিরোজ আর শ্যামা অসহায় চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।দুজনের চোখে না পাওয়ার আকুতি,ব্যাথা ভুলে নিজেদের কাছে টানার ব্যাকুলতা।
কি হবে এই অসম প্রেমের?আদো কি মিলন হবে?

মধুমাস পর্ব ২৭