মনের কোণে পর্ব ১০

মনের কোণে পর্ব ১০
আফনান লারা

সুমনের রুমের দরজা আলতো করে লাগানো ছিল।লিখি ওয়াশরুম থেকে বের হয়েই পা টিপেটিপে ওর রুমের ভেতরে এসে হাজির।
নাবিলের খবর নেই।লিপস্টিক মুছে রাগ দমিয়ে খেতে বসে গেছে।
এদিকে লিখি আলো জ্বালিয়ে পুরো রুম সার্চ করে ড্রয়ারের ভেতর নাবিলের ফোনটা পেয়ে খুশিতে এক লাফ দিলো আর তখনই লোডশেডিং ঘটলো।অন্ধকারে হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে কোনোমতে দরজা অবধি ফিরে যাচ্ছিল সে।হঠাৎ নিজের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পেরে ভয় মনে বাসা বাঁধলো।ঢোক গিলে লিখি বললো,’সরি সুমন ভাইয়া।আমি আসলে ভুলে আপনার রুমে ঢুকে গেছি,অন্ধকার তো তাই আন্দাজ করতে পারিনি।’

অদ্ভুত!সামনের মানুষটা কিছু বলছেনা।লিখি সুযোগ বের করে চুপচাপ সরতে নিতেই মানুষটা তার হাত ধরে বললো,’আমাকে লিপস্টিক লাগিয়েছিলে না?দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা’
কথাটা বলে নাবিল লিখির মুখে তিব্বত ঘামাচি পাউডার ঘষে দিলো।লিখি মুখ ডলতে ডলতে বললো,’আপনি কি বাচ্চাদের মতন শুরু করলেন।আশ্চর্য ‘
‘লিপস্টিক লাগালে কোন সাহসে?’
‘পাউডার লাগালেন ভাল কথা,তাই বলে ঘামাচি পাউডার লাগালেন কেন?ছিঃ!এই পাউডার কেউ মুখে লাগায়?’
‘ছেলেরা কেউ লিপস্টিক লাগায়?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

‘ধরেন আপনার ফোন।অসহ্যকর একটা লোক’
নাবিল নিজের ফোন পেয়ে ফ্লোরে বসে গেলো পা ভাঁজ করে।তারপর লক খুলে নিজের ছবি সব আছে কিনা দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।লিখি অন্ধকারে দু একটা বাড়ি খেয়ে দরজার কাছে এসে দরজা হালকা ফাঁক করে দেখার চেষ্টা করছে সুমনের বোন আর মা কি করে।
তারা মোমবাতি নিয়ে ওখানেই অপেক্ষা করছে ওদের আসার।
‘শুনেন।আমরা এখব পালাবো’
‘কি করতে?’

‘এখন যদি ডাইনিংয়ে যাই ওরা আমাদের পাহারাতে রেখে দিবে সকাল পর্যন্ত,তখন সুমন ও এসে যাবে।তার চেয়ে বরং ফোন যখন পেয়েই গেছি আমরা, এই মুহুর্তে পালিয়ে যাব’
‘তা ঠিক বলেছো।কিন্তু রুম থেকে বের হবো কি করে?’
‘বারান্দা আছেনা?দালানের কাজ বাকি আছে।বারান্দায় গ্রিল-টিল কিছু লাগানো হয়নি।চলুন আমরা ওখান দিয়ে পালাই’
নাবিল উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’কিন্তু আমাদের ব্যাগ তো ড্রয়িং রুমের সোফাতেই।সেগুলো আনবে কি করে?’
‘তাই তো।আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।এখন কি হবে?’

লিখি মাথা খাটাচ্ছে।ওপাশ থেকে সুমনের মা কয়েকবার করে ডাকছেন তাদের দুজনকে।শেষে লিখি নাবিলের মুখের দিকে চেয়ে বললো,’আমার ফোন আমার হাতে।ঐ ব্যাগে দুটো জামা ছাড়া আর কিছু নেই।পরে কিনে দিতে পারবেননা?ব্যাগ আনতে গেলে ধরা পড়ে যাব”
‘আমার ব্যাগেও জামা ছাড়া কিছুই নেই।ঠিক আছে চলো যাই’
দুজনে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে পড়লো সিদ্ধান্তে এসে।এখন আবারও সেই অন্ধকার পথে হাঁটছে দুজন।অনেকটা পথ আসার পর নাবিল বললো,’আমি তো নিজের খাবারটা খেলাম,কিন্তু তুমি তো কিছুই খেলেনা’
‘বেঁচে ফিরতে পারলে অনেক খাওয়া যাবে।আচ্ছা এইবার কই যাব আমরা?’
‘আমি জুনায়েদকে ফোন করে ছাত্রাবাসের খবর নিচ্ছি,তুমি হেনাকে ফোন করে হোস্টেলের খবর নাও।পরিস্থিতি কেমন সেটা জেনে নাহয় আমরা ঢাকায় ব্যাক করবো’

দুজনে দুদিকে কল করেছে।জুনায়েদ জানিয়েছে নাবিলের বাবা পাঁচ- ছয়জন লোক পাঠিয়েছেন ছাত্রাবাসে।তারা গেটের বাহিরে অপেক্ষা করছে নাবিলের ফিরে আসার।
এদিকে হেনা জানিয়েছে লিখির বড় ভাই নাকি দলবল নিয়ে চন্দ্রাঘাট সহ পুরো হোস্টেলের এরিয়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।কয়েকবার ওদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেও দেখেছে সে।
এত বড় বিপদ সামনে দেখে দুজনে দুজনের দিকে তাকালো।
এই অচেনা শহরে তাদের ঠাঁই কোথায় হবে?কি করে কয়েকটা দিন তারা গা ঢাকা দিয়ে এখানে থাকবে।বাসা ভাঁড়া করে থাকা যায় কিন্তু তাতে হতে হবে দম্পতি। কিন্তু তারা তো বিবাহিত না।তবে কি করে থাকবে?
হেঁটে হেঁটে সেই বাস স্টেশন এসে থেমেছে তারা।রাত দুইটা বাজে তখন।পথে কুকুর ছাড়া আর কেউ নেই
লিখি ফুটপাতে ফু দিয়ে জায়গা পরিষ্কার করে বসে বললো,’কতদিন থাকতে হবে এখানে?’

‘জানিনা’
‘এক কাজ করেন,আপনি আপনার বাসায় ফিরে যান’
‘আর তুমি?’
‘আমি তো ফিরবো না।ফিরলেই….’
নাবিল ও বসলো পাশে।দুজনে গালে হাত দিয়ে ভাবছে কি করা যায়।
‘চলো হোটেলে থাকি’
‘কতদিন থাকবেন?’
‘তাও ঠিক।এতদিন থাকলে পকেটের সব টাকা দুদিনেই শেষ হবে।হোটেলে যে চওড়া দাম’
‘আচ্ছা ফেইক রেজিস্ট্রি পেপার বানানো যায়?’

‘যায় তো।তবে এই দুই নাম্বারি কাজের কারখানা খুঁজে পাবো কই?এই শহরের সবই তো নতুন লাগে।
তাছাড়া তুমি আমার সাথে একই ঘরে থাকবে?কিংবা আমি থাকবো?এটা তো অসম্ভব’
‘তো এক কাজ করি।রংপুরে মেসে থাকি।আমি চুরি করে পেট চালাতে পারবো।ব্যাপার না’
‘এটা ভাল বুদ্ধি।আমিও মেসে থাকার ব্যবস্থা করে নেবো।কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা তো করতে হবে,এই রাতটা এখানে কাটানো ছাড়া আর উপায় নেই দেখছি’
লিখির পেটে গুড়গুড় করে ডেকে উঠেছে।সে জিভ বের করে বললো,’হাসবেন না বলে দিলাম।আপনার ফোন খোঁজার চক্করে আমার কিছু খাওয়া হলোনা বলে আমার পেট আমায় গা*লি দিচ্ছে এখন’
‘দোকান ও বন্ধ, নাহলে চিপস কিনে দিতাম।যাই হোক ফোন ফিরিয়ে দিয়েছো, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’

লিখি কিছু বললোনা,চুপচাপ ফুটপাতে বসে পা দুলাচ্ছে।নাবিল ফোনের দিকে চেয়ে ভাবছে রংপুরে মেস কোথায় পাবে।
‘রাধাবল্লভ রোডে একটা মেস থাকার কথা যতদূর জানি,এর আগে যখন রংপুর এসেছিলাম তখন বাসে থাকতে দেখেছি’
‘তাহলে ওখানে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে আমি আমার ব্যবস্থা করে নেবো’
লিখি মাথা নাড়িয়ে চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো।এখান থেকে চাঁদটাকে স্পষ্ট দেখা যায়।গাছ নেই বলে চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে আছে গোটা বাসস্ট্যান্ড।চাঁদের আলো দেখলে খিধে কমে যায়,ভয় বেড়ে যায়।
ভয়ে ঢোক গিলে লিখি পাশ ফিরে তাকালো।নাবিল তার ফিরে পাওয়া ফোন ঘেঁটে দেখছে।
লিখি ও নিজের ফোন টিপে দেখলো চার্জ নেই বলে ফোন অফ হয়ে আছে অনেক আগেই।
সময় কাটানোর জন্য নাবিলের সাথে কথা বলবে বলে ঠিক করে সে বললো,’আচ্ছা আপনি তো চাকরি করেননা।তবে সবকিছুর জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা কোথা থেকে পান?’

‘আমার মা দেয়’
‘আমায় বেলায় আমার মা বাবা দুজনেই ভিলেন ছিল এবং আছে।কেউ সাহায্য করেনি’
নাবিল ঘুরে বসে বললো,’তুমি পালালে কেন?’
‘সে বিরাট কাহিনী।যেমনটা হয় মেয়ে দের সাথে! আইএ পাশ করলেই বিয়ে দেওয়ার প্রকোপ বাড়ে লিফটের গতিতে। বিদেশগামী এক বুড়ো ব্যাটার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিল বাবা।বিশাল বড়লোক।বিয়ের পর নাকি আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে।ব্যাটার ভূড়ি দেখেই বুঝেছি বউ আরও ছটা আছে।’
‘এই জন্য পালালে?’
‘হুম,কারণ তারা আমার মতকে প্রাধান্য দিচ্ছিলো না’
‘তবে এখনও খুঁজছে কেন তোমাকে?ঐ বুড়োর তো এতদিনে তোমার বয়সের মেয়ে একটাও হয়ে যাওয়ার কথা’
‘হয়ত আরেক বুড়োর খোঁজ পেয়েছে।বুঝলাম না কোটিপতি সব কি বুড়োই হয়?সুন্দর দেখে কোটিপতি হতে পারেনা?ইয়াং’

‘টাকা কামাইতে গেলেই বুড়ো হয়।এই দেখো আমায়,আমি টাকা কামাই না।যখন কামাতে যাব তখন আমার বয়স ত্রিশে পড়বে।তখন কোনো এক যুবতীর কাছে আমিও হবো বুড়ো।ওসব বাদ দাও,আগে বলো চুরির মতন একটা কাজকে পেশা করে তুলছো কেন?’
‘সেটা আরেক কাহিনী।পরে কখনও বলবো’
নাবিল আর জিজ্ঞেস করেনি।লিখিও কথা বাড়ায়নি।তিনটা বাজার কয়েক মিনিট আগে লিখির চোখ ঝাপসা হয়ে রাজ্যের ঘুমের দেখা পেয়ে গেলো সে।ফুটপাতের সাথে থাকা দেয়ালে মাথা হেলান দিয়ে রেখে পা গুটিয়ে শুয়ে পড়ে সে।

মনের কোণে পর্ব ৯

নাবিলের মনে হলো একটা হোটেল নিলে ভাল হতো।কিন্তু হোটেল ম্যানেজমেন্ট তো হুট করে কোনো কাপলকে থাকতে দেবেনা।কাগজপত্রের ঝামেলা।রাতের ঘুম কি জিনিস তারাই বোঝে যারা রাত জাগে বাহিরে।এরকম অস্বস্তিকর পরিবেশে তাই নাবিলের চোখে ঘুম নেই।সে পাহারাদারের মতন বসে এদিক ওদিক ফিরছে।
লিখির হাতে মশা, পায়ে মশা বসেছে তাই বারবার নড়ছে এপাশ ওপাশ করে।নাবিল চুপ থেকে শুধু দেখছে।ফিল্মের নায়কদের মতন তার কাছে জ্যাকেট নেই খুলে পরিয়ে দেবে বলে।তাই হাত দিয়ে মশা তাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করেও সে অসফল।লিখি ঘুমের ঘোরে মশাকে ইচ্ছেমত ঝাড়ছিল।সাথে তাকেও ঝাড়ছে যার কারণে তার এতদূর আসা।

মনের কোণে পর্ব ১০