মনের কোণে পর্ব ১৬

মনের কোণে পর্ব ১৬
আফনান লারা

নিসাদ আর সুজন টুকুস করে নেমে দরজা খুলে চলে গেছে।লিখি আর নাবিল এতক্ষণ হা করে চেয়েছিল,ওদের কথায় অপমান বোধ হলো দুজনেরই।তাই চুপচাপ হাত থেকে বালিশ বালিশের জায়গায় ফেলে দুজনে মা*রামা*রির ইতি টানলো।লিখি প্রতিযোগিতা মনে করে নাবিলের আগেই শুয়ে পড়েছে লম্বা হয়ে।শুয়ে বললো,’এবার আপনার ইচ্ছে কেমন করে শোবেন’
‘তুমি তো অর্ধেক জায়গায়ই দখল করে ফেললে।এখন যদি আমি শুই তাহলে তো গায়ের সাথে গা লাগবে ‘
‘আমি কিছু জানিনা,তবে খবরদার আমার গায়ে যেন আপনার শরীর না লাগে’
কথাটা বলে লিখি চোখ বন্ধ করে ফেললো।নাবিল আস্তে করে শুয়ে ভাবছে কি করে নড়চড় করবে।লিখিকে কেমন দ’জ্জাল মনে হয়।এত রাগী কেন এই মেয়েটা?’

রাত বারোটা অবধি নাবিল চোখ মেলে ছাদ দেখছিল,বাবু ছাদে তারা লাগিয়ে রেখেছে,অন্ধকারে জ্বলছে সেগুলো।বাসর বলতে টেবিলের উপর গোলাপ আর রজনীগন্ধা গুছিয়ে রাখা টবে,আর পরিপাটি রুম।ব্যস এই টুকুই।ফুলের তাজা ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে,ইচ্ছে করে ফুলগগুলোকে জড়িয়ে ধরতে।কি কড়া নেশার মতন সুবাস তাদের।ঘুম আসছেনা বলে নাবিল উঠে বসলো।তার সাথে কেউ ঘুমাতে আসলে সেরাত তার আর ঘুম হয়না।মা,নাহিদ কেউই শুলে ঘুম হয়না তার।আর এখন তো অচেনা একটা মেয়ে,বউ বেশে শুয়ে আছে।
বিছানা ছেড়ে নেমে খালি পায়ে টেবিল অবধি গেলো সে।টব থেকে ফুলের গুচ্ছটাকে নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখলো।জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকে গেছে।একেবারে লিখির কপাল জুড়ে জায়গা দখল করেছে।ফুলগুলো নিয়ে বিছানায় বসে লিখির উজ্জ্বল চেহারা দেখছে নাবিল।চাঁদ যেন ইচ্ছে করে তার আলো লিখিকে সপেছে।এই আলোতে লিখির ঘুম নষ্ট হচ্ছিলো না।বরং একটু আবেশে নাবিলের বালিশটাকে টেনে বুকে জড়িয়ে রাখলো।সে ভুলেই গেছে তার পাশে তার স্বামী।তার বিয়ে হয়ে গেছে।নাবিল কেমন করে যেন তাকিয়ে আছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

উদ্ভুত লাগছে অনুভূতিটা।এর আগে কখনও কোনো নারীকে এত কাছ থেকে সে দেখেনি।বিয়েটা অপ্রস্তুত ভাবে হয়ে যাওয়ায় সবকিছু অবিশ্বাস্যকর মনে হয়।এখনও বিশ্বাস হয়না বিয়েটা হয়ে গেছে।
লিখির হাতে নিজের চাপ পড়ায় জেগে গেলো সে।চোখ মেলে হঠাৎ নাবিলকে এত কাছে দেখে পিছোতে গিয়ে ধপ করে নিচে পড়ে গেলো।
নাবিল উঁকি দিয়ে বললো ‘বেঁচে আছো?’
‘না মরে গেছি।মাঝরাতে এত কাছে কি করতে এসেছিলেন আপনি?’
নাবিল হাত উপরে করে বললো,’একটুও ছুঁইনি।’
‘তবে কি করছিলেন?’
‘চাঁদের আলো তখনই সুন্দর যখন সে পৃথিবীর জীবনে এসে পড়ে।আমি সেই সৌন্দর্য্য উপভোগ করছিলাম’
লিখির চোখে ঘুম,ঠিক করে তাকাতেও পারছেনা।সব ঝাপসা মনে হয়,কোমড়ে হাত দিয়ে কোনোমতে বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লো সে।
নাবিল তার হাতের ফুলগুলোকে আগের জায়গায় রেখে কিণারায় শুয়ে পড়েছে আবার।তার নিজেরও চোখ আটকে আসছে।কাল রংপুরের ফুটপাতে তার একটুও ঘুম হয়নি।এখন সেই ঘুম দল বেঁধে আসছে মনে হয়।

সকালে বাবুর ডাকে দুজনের একসাথে ঘুম ভাঙ্গলো।চোখ মেলে দেখলো দুজনে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।
লিখি চমকে আবারও পিছোতে গিয়ে আরও একবার পড়ে যাচ্ছিলো খাট থেকে,ঠিক সময়ে নাবিল ওর হাত ধরে টান দিয়ে কাছে নিয়ে আসলো।মাথা তুলে বললো,’আমি রাক্ষস নাকি জন্তু?নাকি ভূত?এমন ভয় পেয়ে কি বোঝাতে চাও?আর একবার পড়লে তো কোমড়ের হাঁড় এবার গুড়ো হতো তোমার’
লিখি নিজের হাত ছাড়িয়ে উঠে গেলো।হনহনিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই বাবু ওর হাতে চায়ের কাপের ট্রে ধরিয়ে দিয়ে বললো,’ভাবী সকালের নাস্তা কিন্তু আপনার হাতে খাব।সবে সাতটা বাজে।আশা করি পারবেন’
কথাগুলো বলে বাবু চলে যাবার পর লিখি ট্রে এনে নাবিলের পাশে রেখে বললো,’রুটি আর কি বানাবো?আমি তো হোস্টেলে ডিম দিয়ে খেতাম’

‘আর সবজি বানাবে।পারো না নাকি?’
‘কে বলেছে পারিনা?শাড়ী পরতে জানিনা বলে কি রান্নাও জানিনা?’
ভেংচি কেটে চোখ ডলতে ডলতে লিখি ওয়াশরুমের দিকে চলে গেছে।নাবিল উঠে আড়মোড় ভেঙ্গে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললো,’কেউ আমাকে এক কাপ কফি বানিয়ে দেয়না।বাড়ি থেকে পালানোর পর ধরে শুধু চা খেয়ে যাচ্ছি’
লিখি রান্নাঘরে এসে দেখলো রান্নাঘর ফাঁকা।বাবু ডাইনিংয়ে বসে জুস খেতে খেতে টিভি দেখছে।সে মাথা বাঁকিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলো মামা মামি কোথায়
‘তারা জগিংয়ে গেছে।দুজনের ডায়াবেটিস তো!সকাল সকাল হাঁটতে বেরোয়,তোমার কিছু লাগবে?’
‘না,তবে চা কে বানিয়েছিল?’
‘আম্মু,বানিয়ে দিয়ে চলে গেছে’

লিখি রুটি বেলছে।কতগুলো বছর পর রান্নার কাজে হাত দিয়েছে সে।ভেবেছিল সব ভুলে বসে আছে কিন্তু নাহ, ধীরে ধীরে সব মনে আসছে।
নাবিল আপেল একটা মুখে দিয়ে ওকে উঁকি দিয়ে দেখছে নিঃশব্দে।
লিখি জানেওনা।সে নিজের মত করে নাস্তা বানাচ্ছিল।
‘জানিস বাবু!আমি যাদের বাসার ফ্ল্যাট ভাঁড়া নিয়েছি তাদের মেয়ে একেবারে চিকনি চামেলি ‘
‘তাই নাকি!!’
লিখি কথা শুনে রাগে ফুলছে।নাবিল আরও বললো,’মেয়েটা আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে জানিস?’
‘সে কি জানেনা তুমি বিবাহিত? ‘
‘জানে,তাও তাকিয়ে থাকে।কি পরিমাণ ক্রাশ খেয়েছে ভেবে দেখ’

লিখি কথা শুনতে গিয়ে তাওয়াতে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে।তার হুশ নেই।যখন হুশ আসলো তখন হাত পানিতে চুবালো।কিন্তু ততক্ষণে হাত পুড়ে দাগ বসে গেছে।নাবিল আওয়াজ পেয়ে দেখতে এসে এই অবস্থা দেখে ওর হাত ধরলো তখনই লিখি হাত সরিয়ে নিয়ে বললো,’ছুঁবেননা।যারে নিয়ে আলোচনা করছিলেন করেন।আমাকে আমার মতন থাকতে দেন’
‘তোমার হাতে মলম লাগাতে হবে নাহলে এই ব্যাথা সহজে সারবেনা’
‘লাগবেও না ‘
লিখি হাত ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ালো।বাবু ও এসে গেছে।ওদিকে মামা মামি এসে লিখিকে রান্নাঘরে দেখে বাবুকে বকলেন,তারা জানতেনও না বাবু লিখিকে নাস্তা বানাতে বলেছে।
মামি রেগে মেগে বাবুকে বকা দিলেন অনেক।লিখি চট করে সবার থেকে সরে রুমে চলে আসলো।নাবিল চুপ করে আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে এখনও।সে হয়ত এখন মজা না করলে লিখির হাত পুড়তোনা।তাই নিজেই নিজেকে বকছে মনে মনে।

লিখি গাল ফুলিয়ে বসে ছিল বিছানার এক কোণে।নাবিল ধীরে ধীরে রুমে প্রবেশ করেছে।কারোর কোনো সাড়া শব্দ নাই।নাবিলের হাতে মলম।আস্তে করে লিখির পাশে বসে ওর হাতটা ধরতে নিতেই লিখি হাত সরিয়ে বললো,’ঢং করতে হবেনা’
‘তোমার নিজের ভুল হলেও দোষটা আমার উপর চাপাতে হবে?’
‘হ্যাঁ আমার দোষে আমার হাত পুড়েছে।আপনাকে তো বলিনি মলমপট্টি লাগাতে!
যান এখান থেকে।আমাকে একা থাকতে দেন’
নাবিল জোর করে লিখির হাত টেনে মলম লাগাচ্ছে এভার।লিখি হাজার চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারেনি ওর হাত থেকে।
জোর করে মলম লাগিয়ে নাবিল উঠে চলে গেছে।এর মাঝে একটাও কথা বলেনি।
লিখি হাতের দিকে চেয়ে চুপ করে ছিল।ঐ মেয়েটূর কথা নাবিল বললে তার একটুও সহ্য হয়না।কিন্তু নাবিলের সাথে হওয়া বিয়েটা তো সে মেনে নেয়নি তবে এত খারাপ কেন লাগে!কেন আগের মতন স্বাভাবিক ভাবে সব নিতে পারিনা!
তার জীবন,তার ইচ্ছা।কাল যদি ডিভোর্স পেপার নিয়ে এসে বলে ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করতে চায়,তবে আমার তো কিছু করার থাকবেনা।আমাকে এখন থেকে শক্ত হতে হবে।’

মনের কোণে পর্ব ১৫

মামিদের বাগানে ঢুকে একটা শুকনো জায়গায় বসে আছে নাবিল।মামি তখন ওর পাশে এসে বসলেন।ওর মন খারাপ দেখে বললেন,’বাবুর থেকে শুনলাম তুই নাকি কোন মেয়েকে সুন্দর বলেছিলি?সেটা শুনেই লিখি হাত পুড়ে ফেললো।কেন করিস এমন?মেয়েটা কি দোষ করেছে?ও তোর স্ত্রী।
একটু খেয়াল তো রাখবি।দুষ্টুমি করতি যখন সে তোর গার্লফ্রেন্ড ছিল তখন,এখন তো সে তোর বউ, এখন তার সামনে অন্য একটা মেয়েকে সুন্দর বললে তার তো কলিজা ফেটে যাবার মতন অবস্থা হবার কথা।আর কোনোদিন এমন করবিনা’
‘মামি তুমি সবটা জানোনা।ও বিয়েটা মানেনা।আম্মুকেও জানাতে মানা করছে তাহলে কেন সে কষ্ট পায় আমি অন্য কারোর কথা বললে?’
‘সে নিজের চোখে দেখেছে তোদের বিয়েটা লিগালি হয়েছে আর তাই তার অধিকার বোধটা বেড়ে গেছে।নকল হলে এতটাও জ্বলতো না’

মনের কোণে পর্ব ১৭