মনের কোণে পর্ব ১৫

মনের কোণে পর্ব ১৫
আফনান লারা

নাবিল মুখ থেকে শাড়ী সরিয়ে বললো,’আচ্ছা আমি নাহয় শিখিয়ে দেবো।রাগারাগির কিছু নেই’
লিখি হ্যাঁ বা না কিছুই বললোনা।মাথায় ওড়না চাপিয়ে চললো ওর সঙ্গে মামার বাড়ি।
দরজা খুলে নাবিল বের হতেই ধাক্কা খেলো বাড়িওয়ালার মেয়ের সাথে।সে নাবিলকে দেখে ঢুলছে শুধু।লিখি চোখ বড় করে বললো,’কি চাই?’
‘নাস্তার ট্রে আর বাটিগুলো ফেরত নিতে এসেছি’
লিখি নাবিলের দিকে চেয়ে বললো,’স্বামী মহাশয় গিয়ে নিয়ে আসুন’
নাবিল মিটমিট করে হাসছিল।ওর কথা মতন গিয়ে ট্রেটা নিয়ে এসে দেওয়া ধরতেই লিখি টান দিয়ে নিয়ে নিজের হাতে দিলো ঐ মেয়েটাকে।
মেয়েটার রাগ হলো লিখির এমন ব্যবহারে।চোখ দিয়ে কত কি বুঝিয়ে হনহনিয়ে চলে গেছে তাই।লিখি মেয়েটা যাবার পর বললো,’বুঝিনা!বিবাহিত ছেলে দেখে কোন দুঃখে এরা ক্রাশ খায়!’

নাবিল হাত ভাঁজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে বললো,’তুমি তো বিয়েটা মানোই না,তবে এত জ্বলছে কেন তোমার?’
‘কই জ্বলছে?বললাম তো!আপনার স্বাদ জাগলে ভেগে যান এই মেয়েটার সঙ্গে।আগে ডিভোর্স দেন তারপর নাহয়….’
নাবিল দরজায় লক করে বললো,’হুম দেবো তো।রাজকুমারীর সাথে গোটা রাজ্য ফ্রিতে পাচ্চি,এই সুযোগ কি করে হাত ছাড়া করি বলো?’
লিখি রাগে ফুলতে ফুলতে বললো,’আমি কম বড়লোক না।আমার বাবা মস্ত বড় ব্যবসায়ী।আমাদের দু- তিনটে গাড়ী আছে।’
‘এই চিকনি চামেলির বারো তলা বাড়ি আছে।সেই বাড়ির মালিকের মেয়ে সে।বুঝতে পারছো?রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাব।আর তোমার বাবা তো তোমায় মানেই না,মোট কথা তুমিই তো বিয়েটাকে মানোনা,তবে এখন এত উদাহরণ দিয়ে লাভ আছে?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখির কষ্ট লাগলো।রাগ করে তাই হনহনিয়ে আগে আগেই চলে গেছে সে।পেছন ফিরে আর তাকায়নি।ওকে এমন জেলাস হতে দেখে নাবিলের ভীষণ ভাল লাগছে।মন চায় আরও বেশি করে জেলাস ফিল করাতে।
‘যে মেয়েটা চার ঘন্টা আগেও দরজা বন্ধ করে রেগে রেগে বলছিল সে এই বিয়ে থেকে মুক্তি চায়,এখন সেই মেয়ে জ্বলে পুড়ে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে আমার সাথে অন্য মেয়েকে দেখে।বিষয়টা কেমন উদ্ভট। ‘
লিফটে নাবিল আসার আগেই লিখি উঠে চলেও গেছে।বোঝা যাচ্ছে প্রচণ্ড রেগে আছে।নাবিল অন্য লিফটে নিচে নেমে দেখলো দালানের সামনে যে সরু ফুলের বাগান করা তার টাইলস করে রাখা জায়গায় লিখি উঠে বসে চোখ মুছতেছে।নাবিল ওর কাছে এসে দাঁড়াতেই মুখ ঘুরিয়ে ফেললো সে।
‘কি হলো?কাঁদতেছো কেন?আরে ডিভোর্সের কথা তো সবার আগে তুমি বলেছিলে,তুমি বিয়েটা মানতে চাওনি তাহলে এখন কাঁদছো কেন?আমি কি বিয়ে হবার পর একবারও বলেছি যে আমি বিয়েটা মানিনা?আমি তো সাদরে গ্রহণ করেছি তোমায়।তাহলে এখন কাঁদার মানে কি?’

‘আমি কি জানতাম চরিত্রহীন একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে আমার’
নাবিলের মেজাজ গেলো খারাপ হয়ে।চেঁচিয়ে বললো,’কি বললে?আমি ক্যারেক্টার লেস?তোমার মনে হয় সেটা?আজ কদিন ধরে যে আমার সাথে আছো,বিয়ের আগে এবং পরে,একবারও তোমায় খারাপ স্পর্শ করেছি?’
‘ওটাই তো সমস্যা! আমি বাদে অন্য মেয়ের প্রতি আকর্ষণ আপনার’
নাবিল কোমড়ে হাত রেখে বললো ‘বিয়ে হয়েছে গোটা একটা দিনও কমপ্লিট হয়নি আর তুমি এখনই এটা বলতেছো?তুমি আসলে কি চাও বলোতো?একবার বলো বিয়ে মানো না, আবার আমার সাথে অন্য মেয়েকে তোমার সহ্য হয়না,আবার ডিভোর্সের কথা বললে তোমার কান্না পায়।তুমি কি চাও খোলসা করে বলো।আমাকে চাও?আমার ভালবাসা চাও?’
ধুরুম করে কিল বসিয়ে দিয়েছে লিখি।
নাবিলের মাথার মাঝ বরাবর। সে মাথায় হাত দিয়ে ব্যাথায় এখন চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
‘আমি কচি খুকি না যে আহ্লাদ করবো,ঢং করবো।আমি সোজাসাপটা কথা বলি, নিকুচি করেছে আপনার ভালবাসার!!’
লিখি হনহনিয়ে চললো মামার বাসার দিকে।নাবিল ও মাথা ধরে ওর পিছু পিছু চললো।
‘এই মেয়েটা কি চায় সে নিজেই জানেনা।কি চায় সেটার তথ্য বের করতে ঐ চিকনি চামেলিকে কাজে লাগাতে হবে।একদিন ওরে জড়িয়ে ধরলেই ভালবাসার সবগুলো স্বরবর্ণ সুরসুর করে বেরিয়ে আসবে’

লিখি মামাদের বাসায় ঢুকে সোজা মামির রুমে গিয়ে বসে আছে।ড্রয়িং রুমে মামা নাবিলের সাথে কথা বলছিলেন।মামি লিখির কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন ওর মন খারাপ কেন।
‘আচ্ছা উনি কি কখনও প্রেম করেছিলেন?জানেন কিছু?’
‘নাবিল অনেক সিধেসাধা একটা ছেলে।গেমস আর পড়াশুনার বাহিরে ওর কোনো জগৎ ছিলনা।এর জের ধরেই তো অনাবিল ভাই ওকে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিলেন যাতে করে পড়াশুনা শেষ করে, একটা ভাল পজিশনে আসে।নাবিলের সেটা পছন্দ না বলেই পালিয়ে এতদূর এসেছে।আমি কখনও ওর প্রেম নিয়ে কিছু শুনিনি।তবে তোমার জানার হলে ওর থেকেই জানতে চেও।সে যদি তোমায় ভালবাসে নিশ্চয় সত্যিটা বলবে’
লিখি মনে মনে ভাবলো তার এর দরকার নেই।
‘তাছাড়া নাবিল কত ভাল একটা ছেলে তার প্রমাণ আর তোমায় কি দিব।তুমি হয়ত এতদিনে বুঝেও গেছো।সে তোমার জীবন বাঁচাতে তোমায় একা পথে ফেলে যায়নি।ভুল করে হয়ে যাওয়া বিয়েটাকে সে ভুল বলেনি।সে মেনে নিয়েছে বিয়েটা।তোমার উচিত ওকে শ্রদ্ধা করা।অতীত সবারই থাকে।তোমার বুঝতে হবে এখন তুমি ওর স্ত্রী ‘
‘মামানি উনি খুব খারাপ।উনি অন্য মেয়ে নিয়ে মশকরা করে আমার সাথে’

‘তুমি জ্বলো তাই করে।জ্বলা বন্ধ করে দাও।দেখবে তার এই হাসিঠাট্টার স্বভাব বাপ বাপ করে পালাবে’
লিখির মুখে মূহুর্তেই হাসি ফুটে গেলো।মাথা নাড়িয়ে বললো,’আমি অবশ্যই চেষ্টা করবো এটা’
নাবিল অনেকক্ষণ লিখিকে না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে।মামা মামির সামনে লজ্জায় না পারছে ওকে ডাকতে আর না পারছে গিয়ে দেখতে।বাবু আর ওর কিছু বন্ধু মিলে গেস্ট রুমে কিসব করছিল।দরজা বন্ধ।নাবিল কয়েকবার ধাক্কাধাক্কি করেও দরজা খুলতে পারেনি।মামি এসে বললো ওরা নাকি কি সারপ্রাইজ দিবে।
রাতে খাবার গুছিয়ে মামি লিখিকে বললেন আসতে।সে মামির বিছানায় ঘুমিয়েই পড়েছিল।মামির ডাক শুনে ঘুম ভাঙ্গলো।মাথা তুলে আসি বলে নামলো বিছানা থেকে।মামা তখন রান্নাঘরে গেছেন মামির হাতে হাতে হেল্প করার জন্য।
নাবিল এই সুযোগে ছুটে আসলো লিখি কি করছে দেখার জন্য।লিখি ও তখন বের হচ্ছিল।দুজন দুদিক থেকে এসে জোরেশোরে এক ধাক্কা খেয়ে গেছে।নাবিল কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,’আজ শুধু মেয়েদের সাথে ধাক্কা খাচ্ছি।’
লিখি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেছে।নাবিলের কথায় বাড়িওয়ালার মেয়েকেও টেনে এনেছিল সে।লিখির তাই মেজাজ খারাপ হলো।কিছু না বলেই চলে গেলো সে।নাবিল বুঝতে পেরে ওর পাশে বসতে যেতেই লিখি উঠে অন্য চেয়ারে গিয়ে বসেছে।

মামা মামিও এসে গেছেন ততক্ষণে, তাই নাবিল গিয়ে ওর পাশে আবার বসার সুযোগ পায়নি আর।মামি এখনও ওদের আলাদা বসতে দেখে ব্যাপারটা বুঝে বললেন,’নাবিল?যা ঐ চেয়ারে গিয়ে বোস’
নাবিল বাধ্য ছেলের মতন গিয়ে বসলো লিখির পাশে।মামা মুখে খাবার তুলে হেসে হেসে বলে ফেললেন আজ আর ওদের বাড়ি ফেরা হবেনা।বাবু আর তার কিছু বন্ধু মিলে গেস্ট রুমটা সাজিয়েছে।আজ তারা ওখানেই থাকবে।নাবিল শুরুতেই না করে দিলো কিন্তু মামির ধমকে তার না আর না তে রইলোনা।
লিখি ভাবলো বাসায় ফিরে নাবিলকে ইচ্ছামত ঝাড়বে এখন মনে হচ্ছে সেটা আজ আর পূরণ হবেনা।
খাবার শেষে বাবু দুজনকে টেনে হিঁচড়ে রুমটার কাছে এনে বললো,’পুরো ক্রেডিট আমার।রুম সাজানোর পুরো প্ল্যান আমি করেছি।টিপ দিতে হলে আমায় দেবে’
নাবিল বাবুর ঘাঁড়ে হাত রেখে চেপে ধরে বললো,’এত রঙঢংয়ের কি দরকার ছিল?বিয়েটা কিসের মধ্যে হয়েছে, এখনও সেই ট্রমা থেকে বের হতে পারিনি আর তোমরা সবাই মিলে আনুষ্ঠানিকতা সারছো?
বাবা যদি এই মূহুর্তে এসে যায় কি হবে জানিস?’

‘তোমার বাবা রুম চেক করার আগেই পেছনের দরজা দিয়ে তোমাদের লুকিয়ে নিয়ে যাব অন্য জায়গায়।কোনো চিন্তা নাই।দুজনে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করো এখন।টাটা’
বাবু দুজনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
লিখি মাথার ঘোমটা ফেলে খাটের দিকে চেয়ে আছে।জীবনে এ প্রথম অচেনা একটা ছেলের সাথে বদ্ধ রুমে।গা শিনশিন করছে।ভয় লাগছে।ওকে খাটের দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নাবিল বললো,’ওমন করে দেখার কি আছে?সোফা নেই।শুলে একসাথেই শুতে হবে’
‘একদম না।অসম্ভব। আমার সারারাত ঘুম হবেনা’
‘আমার হবে?আগে শুয়েছি?’
‘আমি শুয়েছি?’
‘তুমি মাঝে বালিশ একটা দিয়ে রাখো।’

‘বালিশ মাত্র দুইটা,একটা মাঝে দিলে মাথা রাখবো কিসে?’
নাবিল দুষ্টু করে একটা হাসি দিয়ে বললো,’চাইলে আমার ডান হাতে মাথা পেতে শুতে পারো’
‘যান তো এখান থেকে।আপনার গায়ের সাথে যেন আমার গা না লাগে সেটার জন্য বালিশ দেবো ভাবছি আর আপনি বলতেছেন আপনার হাতে মাথা রেখে শুতে?মজা করছেন আমার সাথে?’
‘একদম’
লিখি বালিশ নিয়ে একটা বাড়ি মে*রে দিলো হঠাৎ করে।নাবিল নাকে হাত দিয়ে বললো,’সন্ধ্যাবেলায় ঠুস করে একটা বাড়ি দিয়েছিলে মাথায়,আমি কিচ্ছু বলিনি,এখন আবার বালিশ দিয়ে নাকে বাড়ি মেরেছো তাও বলছিনা কিন্তু আর একবার যদি বাড়ি দিয়েছো তো আমিও সমান সমান দিব’

মনের কোণে পর্ব ১৪

লিখি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’আপনি মা*রবেন?দেখি মা*রেন তো দেখি কত পারেন’
নাবিল ও বালিশ নিলো।দুজনে মা*রা-মা*রি লেগে গেছে।
ঠিক কিছুক্ষণ পর আলমারির উপরে বসে থাকা বাবুর বন্ধু নিসাদ আর সুজন বললো,’ভাইয়া-আপু,আমাদের মাফ করে দেন।আমরা মনে করেছিলাম রোমান্টিক কাপলের রোমান্স দেখবো।এখন মনে হচ্ছে ভুল করে চিড়িয়াখানায় ঢুকে পড়েছি।আমাদের একটু সাইড দেন, আমরা চলে যাই নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে’

মনের কোণে পর্ব ১৬