মনের কোণে পর্ব ২০

মনের কোণে পর্ব ২০
আফনান লারা

লিখির থেকে ফের ঘড়িটা কেড়ে নাবিল চলে গেছে বাবুর কাছে।নয়টা বাজেনি বলে ওর স্যার এখনও যাননি।প্রতি দশ মিনিট পর স্কেলের বাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায় ঐ রুম থেকে।নাবিল অনার্সে পড়েও স্যারের হাতে মা*র খায়।এটা আসলেও অবাক করার বিষয়।এটা কেমন স্যার তাও বলিহারি! এত বড় একটা ছেলেকে মা*রতে কি তার হাতে বাঁধেনা?
মামা মামিও কিছু বলেননা।

‘নাহ!আমাকেই গিয়ে দেখতে হবে,আর যাই হোক ও তো আমার ভাইয়ের মতন!’
পর্দা সরিয়ে ভেতরে আগে থেকে না বলেই ঢুকে পড়েছে নাবিল।
ওমা! যেটা ভেবেছিল তার কিছুই এখানে ঘটছিল না।
ঠাস ঠাস করে স্কেল দিয়ে মশা তাড়াচ্ছিলেন বাবুর টিচার।
নাবিলকে দেখে সালাম দিলেন প্রথমে।কারণ ছেলেটা নাবিলের জুনিয়র হবে।সালাম ছোট বড় সবাইকে দেওয়া যায়।দেওয়ার আগে ভাবতে হবেনা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ছেলেটি একেবারে রোগাপটকা। শরীরে কিঞ্চিত মাংস নেই।অথচ সে নাকি বড়লোকের ছেলে।বাবার থেকে হাত খরচ নিতে চায়না বলে অনেক টিউশন করায়।বুয়েটের ছাত্র।মাথা ভর্তি জ্ঞান।মামাকে চেনে বলে ইজিলি ছেলেটা মেনে গেছে বাবুকে পড়াতে।
ছেলেটা আবার বিবাহিত। তার ধারণা কম বয়সে বিয়ে করলেই বিয়ের মর্ম বোঝা যায়।টিউশন করে মাসে ৩০এর উপরে আয় করে বলে মেয়ের বাবা খুশি খুশি ওর হাতে মেয়ের হাত দিয়ে দিলেন।এমন বাপ কয়টা পাওয়া যায় বলুন তো?টিউশনিকে কজনে চাকরি হিসেবে ধরে?দেশে তো সরকারি ছাড়া বাকি চাকরিগুলো মেয়ের বাপেদের কাছে দুধে মাছি।”

সালাম নিয়ে নাবিল ওদের পড়তে বলে চুপচাপ ওখান থেকে চলে এসেছে।পড়ানোর সময় কাউকে ডিস্টার্ব করা সে পছন্দ করেনা।
আর পনেরো মিনিট পর নয়টা বাজবে।মানিক নাকি জাস্ট নয়টা অবধি পড়ায়।তার হাতের ঘড়িতে নয়টা বাজলেই সে উঠে চলে যায়।দেরি করেনা আবার জলদি জলদি ও যায় না।বাবু ইংরেজী পড়তে পড়তে একশোবার করে স্যারের ঘড়ির দিকে তাকায়,কখন নয়টা বাজবে আর প্রাণ খুলে একটু দম ফেলতে পারবে।মানিক স্যারকে যতটা সহজসরল মনে হয় ততটা নয়।প্রচুর বদমেজাজি।যে স্কেল দিয়ে মশা মারছে সে স্কেল দিয়ে হাতের আঙ্গুলে মারে ইংরেজী ভুল হলেই।ভাইয়া তো জানেও না এসব ব্যাপারে।
এ নিয়ে বাবার কাছে একবার নালিশ করেছিল বৈকি।ওমা বাবা তো মহা খুশি।বললেন মা*রতে হলে অবশ্যই মা*রবে।কোনো কিছু শিখতে হলে মা*র খাইতে হবে।মা*র না খেলে উদ্দেশ্য সাধন হয়না।ব্যাথা না পেলে ঐ জিনিস মাথায় ঢোকানোর ইচ্ছা মাথায় আসেনা।তিনি পুরোদমে সাপোর্ট করলেন মা*র দেওয়াকে।
তাই ঐদিনের পর থেকে বাবু নালিশ করা ছেড়ে দিয়েছে।

লিখি করলা ভাজির ঘ্রাণ পেয়ে মৌমাছির মতন এসে পড়েছে রান্না ঘরের পাশে।তার মা খুব সুন্দর করে করলা ভাজি করতেন,তিনি সাথে কুচোচিংড়ি ও দিতেন, স্বাদ বাড়াতে।এখানে এসে দেখলো বাবুর মাও কুচোচিংড়ি দিয়েছেন ওর মায়ের মতন।আজ দু -প্লেট ভাত এমনি খাওয়া যাবে শুধু করলা ভাজি দিয়ে।জিভে পানি এসে যাচ্ছে তার।
নাবিল ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচ মিনিটের বেশি হয়ে যাচ্ছে অথচ তার খেয়ালই নেই।চোখ বড় বড় করে করলা ভাজি করার দৃশ্য দেখছে সে।কি দারুণ!!!মামি ও খেয়াল করেননি জামাই- বউ দুজনই তার রান্না করা দেখছে তখন থেকে।অবশ্য লিখি শুধু দেখছিল রান্না করা,নাবিল তো ওকে দেখছে।

খাবারের প্রতি সব মানুষেরই লোভ থাকে,এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু করলা ভাজির জন্য এত লোভ থাকতে পারে তা ওর জানা ছিলনা।লিখিকে যতই দেখছে,ততই অবাক হচ্ছে।
একটা সময়ে লিখি দেখা শেষ করে পেছনে যাওয়া ধরতেই নাবিলের সাথে ধপ করে এক বাড়ি খেলো।দুজনে কপাল ঘঁষতে ঘঁষতে একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে দুদিকে চলে গেছে।
যেন কত বছরের শত্রুতা তাদের।আর জীবনে চোখে চোখ রাখবেনা।
মামা বাসায় ফিরলেন কিছুক্ষণ আগেই।এসেই মুখটা গোমড়া করে সোফায় বসে পড়লেন।ঘামছেন বেশি করে,বড় বড় শ্বাস নিচ্ছেন।
নাবিল তার এই হাল দেখে পানির গ্লাস এগিয়ে ধরলো।মামা নাবিলের মুখ দেখে যেন তার চিন্তা আরও বেড়ে গেছে।
পানির গ্লাসটাও নিলেননা।মামি রান্নাঘর থেকে এসে বললেন’চা খাবে?’
‘রাখো তোমার চা’

মামি আর নাবিল তব্দা খেয়ে চুপ করে মাামার মুখ চেয়ে রইলো আবারও।দম ফেলে-টেলে এবার মামা নিজেই মুখ খুললেন।বললেন,’আমি না একটা বিশাল বড় ভুল করে ফেলেছি।’
নাবিল পাশে বসে বললো,’কি করেছো?’
‘তোর মা কয়েক মিনিট আগে ফোন করেছিল বুঝলি!’
‘তারপর কি বলেছে?’
‘বললো নাবিল কোথায়?আমি বললাম আমার কাছে।তোর মা নাকি স্বপ্নে দেখছে তুই তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিস।ভয়ে নাকি দুই রাত ঘুমোতে পারেনি।এখন নাহিদকে নিয়ে ছুটে আসছে তোকে দেখতে।ড্রাইভার কে নিয়ে আসছে’
নাবিল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,’আর বাবা?’
‘তোর বাবাকে কি আর এসব জানাবে নাকি!বলবে আমার বাড়ি ঘুরতে আসছে।সমস্যা তো সেটা হতো না।সমস্যা হলো তোর মা তো জানেনা তোর বিয়ের কথা’

মামি চট করে ফ্রিজের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছন একটা বালতি নিয়ে।বালতিতে এক এক করে মুরগী,মাছ বের করছেন।কতদিন পর ননদ আসবে বাসায়।আয়োজনে কমতি রাখা যাবেনা।
নাবিল মাথার চুল টানছে এবার।মামা ওর মুখের দিকে চেয়ে আছেন উত্তরের আশায়।
‘আচ্ছা আমি লিখিকে বাসায় রেখে আসবো?’
‘একা ফ্ল্যাটে রাতে থাকতে পারবে?’
‘তাহলে কি করবো?’
‘লিখি এখানেই থাকুক।বলবো তোর মামির বোনের মেয়ে’
‘তা বলতে পারো।’
মামা এবার একটু শান্তির দম ফেললেন।এতক্ষণ সব অশান্তির দম ফেলে ফেলে যাচ্ছিলেন।কি যে চিন্তায় ছিলেন।প্রেশার বেড়ে গেছিলো।পঞ্চাশ টাকা দিয়ে ফার্মেসীর দোকানে মাপিয়ে দেখেছেন।ঐ মূহুর্তে নিজের দোষটাকে অনেক বড় করে দেখেছিলেন তিনি।এখন একটু
নিশ্চিন্ত হলেন।

নাবিলের মা আসার কথা এক ঘন্টার ভেতরেই।মামার বাসা থেকে নাবিলদের বাসা বেশি একটা দূরেনা।নাবিল গেছে লিখিকে বোঝাতে।কোনোমতেই তারা হাসবেন্ড ওয়াইফের মতন থাকবেনা।মাকে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবেনা।লিখি মজা করে বললো,’শাশুমাকে বলবো আমি গর্ভবতী।হাহাহা’
নাবিল কপাল কুঁচকে ওর কাছ থেকে চলে এসেছে।সন্ধ্যা থেকে ওর মাথা খারাপ মনে হয়।এখন সিওর হওয়া গেলো।
ভালোই ভালোই মাকে সব কিছু থেকে অজানা রাখতে পারলেই হলো।
লিখির কাছে ব্যাপারটা দারুণ লাগলো।বিবাহিত হয়েও কারোর সামনে অবিবাহিত আচরণ করা দারুণ একটা ব্যাপার।কি মজা লাগবে।ভেবেই লাফাচ্ছে সে।নাবিলের কপালে চুমু দিয়ে দৌড় দেবে ওর মাকে দেখিয়ে। তারপর তিনি নাবিলকে ধাওয়া করবেন এটা নিয়ে।কি আনন্দ হবে তখন।
লিখিকে ওমন দাঁত কেলিয়ে হাসতে দেখে নাবিলের পেটের ভেতর ডাক দিয়ে উঠলো। নিশ্চয় দুষ্টু কিছু চিন্তাভাবনা করছে।এই মেয়েটা মনে হয় আজকে বিপদে ফেলে তারপর ছাড়বে।এরপরেও ছাড়ে কিনা কে জানে।

রাত দশটার দিকে মা এসেছেন নাহিদকে নিয়ে।মামা বাসার বাইরে বাগানে বসে অপেক্ষা করছিল উনার আসার।গাড়ী এসে থামতেই তিনি বাগানের চেয়ার থেকে উঠে গেলেন দেখতে।নাবিলের মা আর নাহিদ নেমেছেন গাড়ী থেকে।ড্রাইভার তাদের ব্যাগপত্র সব বের করে বাসায় দিতে গেছে।
‘ভাই কেমন আছিস?’
‘ভাল আছি আপু। আসো ভেতরে আসো’
‘মনি কই?’
‘সে তো ভীষণ ব্যস্ত। তুমি আসবে বলে দশ পদ তৈরি করছে’
‘কেন যে জানালি!শুধু শুধু রাত করে পেরেশান করছিস মেয়েটাকে’
নাহিদকে নিয়ে অবশেষে সামিয়া ভেতরে আসলো।নাবিল সোফার রুমেই ছিল।মাকে দেখে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।মা তো কেঁদে ফেলেছেন। কতদিন পর দেখলেন ওকে।
নাহিদকে বাবু কোলে তুলে নিয়েছে।নাহিদ বললো,’বাবাকে বলতে হবে ভাইয়া মামার বাড়িতে’
‘এই চুপ চুপ,এই কথা ভুলেও বলবিনা’
‘তুমি জানো বাবা আমায় জোর করে ধরে ফোন করিয়েছে নাবিল ভাইয়াকে।মিথ্যে কথাও বলিয়েছে।তুমি জানো আমি কখনও মিথ্যে বলিনা?’

নাবিলের পেছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা লিখিকে দেখে সামিয়া জিজ্ঞেস করলেন ও কে
মামা বললেন মামির বোনের মেয়ে।ঐদিকে মামিকে এটা শিখিয়ে দেওয়া হয়নি।তিনি বললেন ভাইয়ের মেয়ে।
সামিয়া কপাল কুঁচকে ওদের দুজনের দিকে চেয়ে বললো,’আসলে কার মেয়ে?’
মামা অগ্নি দৃৃষ্টিতে চেয়ে মামিকে ইশারা করে চুপ থাকতে বলে বললেন,’আরে বোনের মেয়ে।ও রান্না করতে করতে মাথা খারাপ করে ফেলেছে নিজের।তুমি এত পাত্তা দিও না তো ‘

মনের কোণে পর্ব ১৯

সামিয়া লিখিকে সামনে আসতে বললো।লিখি আসার সময় নাবিলকে ধুরুম করে এক ধাক্কা মে*রে এসে দাঁড়িয়েছে পাশে।নাবিল গাল ফুলিয়ে চোখ দিয়ে ওকে কত কি বকলো।
সামিয়া এটা খেয়াল করে হাসলো।ভাবছে মেয়েটা দুষ্টু প্রকৃতির।ওদিকে নাহিদ এটা দেখে বললো,’এই আপুটা আমার ভাইয়াকে ধাক্কা দিলো সবাই দেখলে?’
নাবিল তো ভয়ে শেষ।না জানি আম্মু কি বলে বসে।
কিন্তু তিনি স্বাভাবিক ছিলেন।যুবক- যুবতী এক ঘরে থাকলে এমন দুষ্টুমি লেগে থাকে, এটা তার জানা আছে।

মনের কোণে পর্ব ২১