সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৬

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৬
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

খুব সাধারণ ভাবেই অনুষ্ঠিত হচ্ছে ফায়জার হলুদ সন্ধ্যা। ফারহান প্রথমে নিষেধ করেছিলো এসব করতে।কিন্তু ফারহানা বেগমের জন্য আর না করতে পারে নি। তবে কড়া গলায় বলে দিয়েছে,অনুষ্ঠানে কোন ছেলে মানুষ থাকতে পারবে না। আর কোন গান বাজনা চলবে না। ফারহানের রাগের সাথে না পেরে একটু মন খারাপ হলেও সবাই মেনে নিয়েছে।ফায়জার এসবে কোন মাথা ব্যাথা নেই। জীবন্ত পুতুলের মত বসে আছে সে।কয়েক জন এসে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে গেছে।বিয়েটা কমিউনিটি সেন্টারে হবে।তাই বাসায় খুব একটা চাপ নেই।তবুও যে আত্মিয় স্বজন এসেছে তাদের আপ্যায়ন করার জন্য ফারহান কয়েকজন লোক নিয়োগ করেছে।রান্না বান্না সব বাসার ছাদে হচ্ছে। রান্না করে খাবার বাসায় পৌঁছে দেয়া তাদের কাজ।বাসার ভিতরের সমস্ত কাজ সুমি আর কয়েকজন মেয়ে মিলে করে ফেলছে।তাদের কে ফারহান ই নিয়ে এসেছে।তদারকি করা ছাড়া ফারহানা বেগমের আর কোন কাজ নেই।সায়েবা নিজ থেকে কিছু করতে গেলেই ফারহানের চোখ রাঙানির শিকার হচ্ছে।
পর পর কয়েকটা ধমক খেয়ে সায়েবা অসহায় গলায় বললো,

— এভাবে ধমকাচ্ছেন কেন?বাড়িতে এতো কাজ।আর আমি বাড়ির বউ হয়ে এভাবে পটের বিবি সেজে বসে থাকলে মানুষ কি বলবে?আর আমার নিজের কাছে ও ভালো লাগছে না। কিছু একটা তো করতে দিন?
সায়েবার অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেললো ফারহান।ফোনে কাউকে কিছু টাইপ করতে করতে বললো,
— কোন দরকার নেই।কাজ করার জন্য যথেষ্ট লোক আছে। তুমি শুধু আপুর কাছাকাছি থাকো।আর যদি বেশি বউগিরি করতে ইচ্ছে হয় তাহলে রুমে আসো।আমি ই একমাত্র মানুষ যার কাছে আসলে তোমার নিজেকে বউ মনে হবে। আর আমার বউ পটের বিবি ই।তাতে কারোর কোন সমস্যা হলে আমার কিছু যায় আসে না।
সায়েবা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। কি নির্লজ্জ লোক।মুখে কিছুই আটকায় না!সায়েবা চেহারায় দুঃখী দুঃখী ভাব এনে ফারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। ফোনের কাজ শেষ করে সায়েবার দিকে তাকালো ফারহান। সায়েবার করুন মুখ দেখে ভ্রু কুচকে ফেললো। ফোন পকেটে ভরে গম্ভীর গলায় বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— চুমু চাই?
সায়েবা সাথে সাথে আর্তনাদ করে উঠে বললো,
— মুখ বন্ধ রাখুন অসভ্য লোক। কখন থেকে কি সব বলে যাচ্ছেন! আপনার লজ্জা শরম লোপ পাচ্ছে জেনে রাখুন।
— আমি লাজুক কোন কালেই ছিলাম না রানী সাহেবা। তবে নির্লজ্জ ও ছিলাম না। বিয়ে করার পর থেকে এই রোগ দেখা দিয়েছে। আর আমার রোগের মেডিসিন হচ্ছো তুমি।আসো একটা চুমু খেয়ে বিকেলের ডোজ টা নিয়ে নেই।বলা তো যায় না, কখন রোগ টা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। তখন তোমার ই সমস্যা হবে। (গম্ভীর গলায়)
ফারহানের মুখভঙ্গি দেখে সায়েবা বিরক্ত হয়ে গেলো। এত রোমান্টিক কথা ও কেউ এমন গম্ভীর গলায় বলে। মনে হচ্ছে চুমু খেতে না ফাসিতে ঝুলাতে চাইছে। বিরক্তি ঝেরে সায়েবা ক্লান্ত গলায় বললো,

— চুমুর অভাবজনিত রোগে আপনি আপনি অসুস্থ হয়ে যান এই দোয়া ই করি।আপনার মতো মানুষ চুমু না খেয়ে করলা খেলে বেশি ভালো লাগবে।বাসায় করলা নেই।বাজার থেকে আনতে হবে। আমি লোক দিয়ে আনিয়ে দিচ্ছি। যত্তসব।
রাগে গজগজ করতে করতে সায়েবা নিচে চলে গেলো। তাতে ফারহানের কোন হেলদোল নেই। সে আবার ফোনে মন দিলো।
কয়েক সিরি নিচে নামতেই সায়েবার ফোনে টুং করে ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। ম্যাসেজ চেক করতেই আনমনে ঠোঁট প্রসারিত হলো সায়েবার।

‘ তুমি ই তো আমার করলা বউ।বাজার থেকে আনতে হবে না। আমার করলা আমি সময় মতো নিয়ে নিবো। নিচে মা আর শোয়েব এসেছে।তাদের যেন কোন অযত্ন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে। কারোর ফরমায়েশ পুরোন করতে যাবে না।এ বাড়ির রানী তুমি।সে ভাবেই নিজেকে উপস্থাপন করবে।যা কিছু দরকার হয় আমাকে বলবে।তোমার সেবায় তোমার রাজা মশাই সব সময় হাজির।সাবা আর নীতি কে কল করে দেখো কতটুকু এসেছে।আমি গাড়ি পাঠিয়ে ছিলাম।আর লিজার থেকে দূরে থাকবে বউ।আমি কিন্তু তোমার ব্যাপারে এক চুল ও ছাড় দিবো না। তোমাকেও না।তাই নিজের খেয়াল রাখবে। আমার আমানত তুমি।আমার আমানতের যেন খেয়ানত না হয়। আপুর আসেপাশে থাকবে।ভালোবাসি বউ।’
সায়েবা মুচকি হেসে নিচে চলে গেলো। নিচে যেতেই লিজার মুখোমুখি হলো। লিজা ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সায়েবা এসব পাত্তা না দিয়ে শোয়েব আর আর মায়ের কাছে গেলো।

— আপুর কাছে যাও মা।আম্মু ওখানেই আছে। আর শোয়েব আমার সাথে আয়।
সাহেরা বেগম সায়েবার কথায় সায় জানিয়ে ফায়জার কাছে চলে গেলেন।
— আপু তোমার ফোন টা একটু দাও তো।আমি গেম খেলবো।এসব মেয়েদের অনুষ্ঠানে আমার বোর লাগে।
— তোর ফোন কোথায়?
— চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
সায়েবা নিজের ফোনটা শোয়েবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— খেয়েছিস কিছু?
— একটু আগেই খেয়েছি আপু।এখন আর কিছু খাবো না। আমি উপরে গেলাম।তোমার রুমে ই থাকবো। ফারহান ভাইয়া কোথায়?
— রুমেই আছে।তুই যা।বারান্দায় তোর পছন্দের বই আছে।
শোয়েব ফোনে গেম খেলতে খেলতেই উপরে চলে গেলো। সায়েবা কিচেনের দিকে পা বাড়ালো। সকাল থেকেই সানোয়ার সাহেব মন মরা হয়ে বসে আছেন।দুপুরে ঠিক করে লাঞ্চ ও করেনি।বিয়ে বাড়ির ভীড়ে হয়তো কেউ খেয়াল করে নি।সায়েবা হালকা কিছু খাবার নিয়ে সানোয়ার সাহেবের রুমের দিকে গেলো।

সুন্দরী রমনীদের হাসির শব্দে বিয়ে বাড়িতে পরিবেশ মুখরিত। তাদের মধ্যমনি হচ্ছে আদিব। মৌমাছির মতো ঘিরে ধরছে সবাই তাকে।আদিব ও দাত কেলিয়ে তাদের সাথে হাসি তামাশা করে যাচ্ছে। আপাতত তার কোন কাজ নেই।দূর থেকেই প্রেয়সীর হৃদয় পোড়া গন্ধ তাকে তৃপ্তির শ্বাস দিচ্ছে। না তাকিয়ে ও বুঝতে পারছে এক জোড়া তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
হাসি তামাশার মাঝেই খুশিতে গদগদ হয়ে উপস্থিত হলো আদিবের মা।হাসি হাসি মুখ করে আদিব কে বললো,
— বাবু তোর বিয়ের ব্যাপার টা ফাইনাল করে ফেললাম বুঝলি।মেয়ে তো আমার সেই পছন্দ হয়েছে।দেখতে যে কি সুন্দর। সাক্ষাৎ পরী।তোর কোন আপত্তি নেই তো?

— কি বলছো আম্মু!আপত্তি থাকবে কেন?তুমি বললে এক্ষুণি কবুল বলে বউ ঘরে তুলবো।
আদিবের মা যেন হাতে ঈদের চাঁদ পেয়ে গেলেন।খুশিতে তার চোখে পানি চলে এসেছে।আনন্দে উত্তেজিত হয়ে বললো,
— আমি তাহলে এখনই সব ব্যবস্থা করছি।
— আরে দাড়াও দাড়াও।আগে এই বিয়ে টা শেষ হোক। তোমার ছেলের বিয়ে হবে পুরো শহর জানিয়ে।এভাবে হুট করে তোমার একমাত্র ছেলের বিয়ে করালে মানুষ কি বলবে?
আদিবের মা চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। আসলেই তো। এভাবে তো আর একমাত্র ছেলের বিয়ে করাবে না সে।ঢাক ঢোল পিটিয়ে ছেলের বিয়ে দিবেন।
— আমি বরং সব কথা পাকা করে রাখি।তুই আমার সাথে আয়।মেয়ে দেখবি।
— আমার মায়ের পছন্দ বেস্ট। তোমার পছন্দ হলেই হবে।আমাকে দেখতে হবে না।
আদিবের মা আবেগী হয়ে গেলেন।হাত দিয়ে ছেলের চিবুকে চুমু খেয়ে বললেন,
— আমার সোনার টুকরো ছেলে।

কমিউনিটি সেন্টারের সব কিছু ফরহাদ সামলাচ্ছে। প্রায় দুই হাজার মানুষের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক নামীদামি লোক আসবে কাল।তাই কোন কিছু ভুল হওয়া যাবে না। ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে বার বার।পরনের শার্ট টা ঘেমে গায়ের সাথে চিপকে আছে।রান্নার সমস্ত আয়োজন শেষ বারের মতো চেক করে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হলো ফরহাদ।বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ তার প্রিয় মানুষ টা আসবে।যাকে সে অন্তরালে ভালবাসে বহুকাল ধরে।কখনো মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠে নি।সবার সামনে বিয়ে নিয়ে দুষ্টুমি করলেও সিরিয়াসলি বিয়ে করার কথা সুক্ষ্ম ভাবে এড়িয়ে গেছে বারবার। তবে বিয়ে তাকে করতেই হবে একদিন।পৃথিবীর নিয়মের বাইরে নয় সে। কিন্তু তাকে কি আর পাওয়া হবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে গা এলিয়ে দিলো সে।

এখন মধ্যরাত।ছাদের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে আদিব।
— একবার জাবের কে বলা দেখা যেতো।
ফরহাদের কথা শুনে বাকা হাসলো আদিব। না বোঝার ভান করে বললো,
— কি বলার কথা বলছো ভাই?
— না বোঝার ভান করিস না আদিব।আমার কথা তুই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিস।জাবের কে বুঝিয়ে বললে হয়তো সে বিয়ে টা ভেঙে দিতো।
— সেটা তো তোমরা ও ভাঙতে পারতে ভাই।তোমরা আপন জন হয়ে যাখন হাত গুটিয়ে বসে আছো সেখানে অপরিচিত একটা ছেলের কাছে সাহায্য চাইবো কেন?

— আব্বু আম্মু বিষয় টি জানে না আদিব।হুট করে এনগেজমেন্ট ও হয়ে গেছে। ফায়জা ও বেকে বসেছে। আমরা কি করবো বল?যেখানে ফায়জা নিজেই চাইছে বিয়ে টা করতে।জাবের বিয়ে ভেঙে দিলে হয়তো কিছু একটা করা যেত।
— আমার জিনিস আমি অন্যের কাছে চাইবো কেন ভাই?যা আমার তা শুধুই আমার।আমার কোন কিছুতে আমি কাউকে ভাগ দেই না।সেখানে তোমার বোন তো আমার কলিজা। কলিজা কি কাউকে দেয়া যায়?চিন্তা করো না ভাই।সময় মতো আমার জিনিস আমি বুঝে নিবো। তবে তোমার বোন কে এর মুল্য দিতে হবে। আমার চোখের পানি এতো সস্তা না ভাই।এই মুল্যবান চোখের পানির দাম তোমার বোন কে দিতে হবে। তবে পেয়ার সে।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৫

— রাগের মাথায় উল্টো পালটা ডিসিশন নিয়ে ফেলেছে।এটা নিয়ে মন খারাপ করিস না ভাই।ওর উপর কতো চাপ যাচ্ছে বুঝতেই পারছিস? তার উপর তোদের বয়সের পার্থক্য!
— তাতে আমার কষ্ট গুলো মিথ্যা হয়ে যাবে না ভাই।নির্ঘুম রাত গুলো ফিরে আসবে না। যে না জেনে ভুল করে তাকে মাফ করে দেয়া যায়।তোমার বোন ইচ্ছে করে জেনে বুঝে আমাকে কষ্ট দিয়েছে।তাকে কি করে ক্ষমা করে দেই।চিন্তা করো না। আমি এতোটা ও পাষাণ নই। একবারে শাস্তি দিবো না। শুধু অবহেলা গুলো ফিরিয়ে দিবো।এখন আবার বোনের উপর মায়া দেখাতে গিয়ে ভাইয়ের উপর অবিচার করো না।আমি কিন্তু তোমার ভাই হই মনে রেখো।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৭

1 COMMENT

Comments are closed.