সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৫

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৫
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

এক সপ্তাহ যাবত চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের অলিগলি চষে বেড়িয়েছে আদিব।আশানুরূপ কোন ফল না পেয়ে হতাশার নিশ্বাস নিচ্ছে প্রতি মুহুর্ত। এভাবে চলতে থাকলে ফায়জা কে হারাবে নিশ্চিত। বিয়ের আর মাত্র তিন দিন বাকি!কালকে গায়ে হলুদ ফায়জার।যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে। আর যদি কিছু করতে না পারে তাহলে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিবে।ওই ডাক্তার ভালো না খারাপ তাতে কিছু যায় আসে না। যে কোন পরিস্থিতিতে ফায়জা শুধু তার। বিয়ে তো ফায়জার তাকেই করতে হবে। রাস্তার পাশের একটা বেঞ্চে বসে পরলো আদিব।পকেটে থেকে টিস্যু বের করে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে পাশের ডাস্টবিনে ফেলে দিলো।বেলা দুটো বাজতে চললো। মাথার উপরের সুর্য টা তার সমস্ত তেজ ঢেলে দিচ্ছে ধরনীর বুকে।আদিব আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করলো, রোদের তেজে তাকিয়ে থাকা যাচ্ছে না। চোখ নামিয়ে মনে মনে বিরবির করলো,

— এক নিষ্ঠুর নারী হৃদয় পোড়াচ্ছে। তুই ই বা বাদ যাবি কেন? তুই না হয় শরীর পোড়া।
ফোনের রিংটোনে বিরক্তিতে মুখ কুচকালো আদিব।একটু বসে যে নিজের বিক্ষিপ্ত মন কে শান্ত করতে তার জো নেই।বেয়াদব ফোন টা সেই কখন থেকে বেজেই চলেছে। ফোনেত স্ক্রিনে ফারহানের নাম দেখেও পাত্তা দিলো না সে।দুই হাতে ভর দিয়ে পিছনের দিকে হেলে বসলো। মাথার উপর কারেন্টের তারের উপর একটা কাক থেমে থেমে ডেকে যাচ্ছে। বিরক্তি তে ভ্রুদ্বয় আরো বেশি কুচকে গেলো আদিবের।বেঞ্চ থেকে উঠে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। এখানে বসে থেকে কাজ নেই।এর চেয়ে বাসায় গিয়ে কিভাবে বউকে শিহরণ বইয়ে দেয়ার মতো বাসর উপহার দেয়া যায় তা নিয়ে একটা জম্পেশ প্ল্যানিং করতে হবে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রাত দশটার দিকে উত্তরার বিলাশ বহুল বাড়িতে প্রবেশ করলো আদিব।গাড়ি থেকে নামতেই প্রচন্ড আঘাতে দুই পা পিছিয়ে গেলো সে। হঠাৎ আক্রমনে হচকচিয়ে সামনে তাকালো আদিব।ফারহান রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঠোঁটের কিনারায় স্রোতের আভাস পেতেই বুঝতে পারলো বন্ধু তার ঠোঁট ফাটিয়ে দিয়েছে।ফারহানের দিকে তাকিয়ে আহত কন্ঠে বললো,
— হবু দুলাভাইয়ের ঠোঁট ফাটিয়ে দিতে লজ্জা করলো না তোর?এই ঠোট দিয়ে তো বউ কে চুমু ও খেতে পারবো না! এখন বউয়ের রাগ ভাঙাবো কেমনে শালা?
— ফোন রিসিভ করছিলি না কেন?এতোবার কল দিচ্ছি তাহলে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।
ফারহানের চিৎকার শুনে ভরকে গেলো আদিব।চিন্তিত গলায় বললো,
— কি হয়েছে দোস্ত?সব ঠিক আছে তো?

একটু থেকে শঙ্কিত গলায় বললো, ফায়জা ঠিক আছে তো? চুপ করে আছিস কেন? আমার ভয় হচ্ছে ফারহান!
আদিব কে দেখে কষ্ট হচ্ছে ফারহানের।এখন যা বলবে তা শুনে ছেলেটা হয়তো খুব ভেঙে পরবে।
আদিবের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো ফারহান।নিজেকে শক্ত করে গমগমে গলায় বললো,
— আপু তোকে বিয়ে করতে চায় না আদিব।আজ সে সরাসরি বলেছে, তোর প্রতি তার কোন অনুভূতি নেই।তোকে বিয়ে করার কথা বললে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।আমি অনেক বোঝাতে চেয়েছি ভাই।কিন্তু আপু আমার কোন কথাই শুনলো না।আজকের মধ্যে ই বিয়ে সেরে ফেলতে চাইছিলো।আমি খুব কষ্টে ম্যানেজ করেছি।আমাকে মাফ করে দে ভাই।আপুর মতের বিরুদ্ধে যেতে পারবো না। আমি আগেই বলেছিলাম, আপু যা চায় তাই হবে। এখানে আমার কিছু করার নেই।

আদিব অনুভূতিহীন নির্জীব চোখে তাকিয়ে আছে ফারহানের দিকে। বুকের ভেতর কিছু একটার ভাঙন চলছে। ভাঙ্গনের তীব্র শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। ফারহান কি শুনলতে পাচ্ছে সেই শব্দ?কি জানি!শুনতে পাচ্ছে না হয়তো। এই ভাঙ্গনের শব্দ শুধু ক্ষতবিক্ষত হওয়া প্রেমিক পুরুষই শুনতে পায়।সফল প্রেমিক পুরুষের কি এই ভাঙ্গনের শব্দ শুনার ক্ষমতা আছে!
ফারহানের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো আদিব।কান্না গুলো গিলে ফেলে কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করে ফারহান কে বললো,

— বাসায় যা ফারহান। তোর বোনের বিয়ে।অনেক দায়িত্ব তোর।এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সময় নষ্ট করিস না দোস্ত।কল রিসিভ না করার জন্য সরি।অযথাই তোর সময় নষ্ট হলো এখানে এসে। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছি।একটু রেস্ট নিতে হবে। আমি রুমে গেলাম।সাবধানে যাস।
ফারহান কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো আদিব।ফারহানের কষ্ট হচ্ছে। বন্ধুর মতো ভাইয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পারছে সে। আদিব ফায়জা কে কতটা ভালোবাসে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।হৃদয়ের শেষ বিন্দু ভালোবাসা টুকুও ফায়জার পায়ের কাছে সপে দিয়েছে সে।তবুও কেন এই প্রত্যাখ্যান!নিজেকে পাগল পাগল লাগছে ফারহানের।শুধু আদিবের বয়সের জন্যই কি এই অবহেলা! আদিবের মতো করে কি জাবের ফায়জা কে ভালবাসবে?নাহ,এভাবে শেষ হতে দেয়া যায় না সবকিছু। শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে ফারহান।দেখা যাক আল্লাহ কি চান।

বদ্ধ্য রুমে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে ফায়জা। চোখ দুটি কদমের ন্যায় ফুলে আছে।চোখের পানি এখন অশ্রু হয়ে ঝরতে ঝরতে ক্লান্ত। তবে ফায়জার ক্লান্তি নেই।
আজ সকালে আদিবের বাবা মা এসেছিলো। ফায়জার মামি কিছুটা অহংকারী। কথার ধাচে বুঝিয়ে দেয় সবার অবস্থান। মামা খুব নিরীহ মানুষ। তবে বউ কে খুব ভয় পান।আদিবের মা এসে কথার ছলে ফায়জা কে অনেক কথা শুনিয়ে গেছেন।তার সোনার টুকরো ছেলের জন্য মেয়ের বাবা রা লাইন দিয়ে থাকে।কিন্তু তাতে তার কোন মাথা ব্যাথা নেই। সে তার বোনের মেয়েকেই আনবে একমাত্র ছেলের বউ করে।ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ফায়জার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে।বাবার টাকার জোর না থাকলে তো বিয়েই হতো না। তাও ভালো একটা ডাক্তার ছেলে জুটেছে। না হলে তো আইবুড়ো হয়ে ঘরেই বসে থাকতে হতো। যতই ডাক্তার হও না কেন, বিয়ে ছাড়া মেয়ে মানুষের কোন মুল্য নেই।

ফায়জা চুপ করে শুধু শুনে গেছে।তার পরিবারের কেউ শুনলে এই মহিলা কে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে।বড়ি ভর্তি আত্মীয়স্বজন। ফায়জা একবার জবাব দিলে চরম অপমান হয়ে যেতে হবে তাকে।আদিবের মা কে সে এতটা অপমানিত কিভাবে হতে দিবে!মামী বলে পরোয়া করে না সে।কিন্তু আদিবের মা বলেই বেচে গেলো আজ।তবে সব কিছু শুনেছে সায়েবা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেতে খেতে বাড়ির সাজ দেখছিলো সে।আদিবের মা জানতো না এখানে সায়েবা ও আছে।রাগে গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে ওর।এই মহিলা কে একটা কঠিন শিক্ষা দিতে হবে। নিজেকে কি রানী এলিজাবেথ মনে করে নাকি। আসার পর থেকে সবাই কে অতিষ্ট করে তুলেছে।সায়েবা একবার ভাবলো ফারহান কে বলবে সব কিছু। পরক্ষণেই এই চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। ফারহান কে বললে ফারহান এক্ষুনি বাড়ি মাথায় তুলবে।একটা বিশ্রী পরিস্থিতিতে পরতে হবে সবাইকে।মামা কে সবার সামনে ছোট হতে হবে। ফায়জা ফোনের রেকর্ডার টা অফ করে আবার কফি খাওয়ায় মন দিলো।এখন কিছু সময় এখানেই কাটাবে।

নিস্তব্ধ রাতে অনেকটা ক্লান্ত হয়েই ঘুমের দেশে পারি জমিয়েছে ফায়জা।সারাদিন কান্নাকাটি করার ফলে সন্ধ্যার পর থেকেই ভয়ংকর মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। অতিরিক্ত কান্নাকাটি করলে মাথা ব্যাথা জেকে ধরে তাকে।তাই নয় টার দিকেই রুম অন্ধকার করে শুয়ে পরেছে সে। আপাতত এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি চাই তার।সামনে আরো কঠিন সময়ের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
ফায়জার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিব।কি নিস্পাপ মুখ।এই মুখের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল পারি দেয়া যায়। কে বলবে,এই নিস্পাপ চেহারার মেয়েটা এতটা নিষ্ঠুর!এই মেয়েটাই তার কলিজা থেকে ভয়াবহ রক্তক্ষরণ করাচ্ছে!
ফায়জার মুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো আদিব,

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৪

— আমি তোমার জীবনে বসন্ত হতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু তুমি আমার জীবন চৈত্রের খড়া নিয়ে এলে!
ক্ষমা করবো না তোমায়।আমার ভালোবাসা এতটা ঠুনকো নয় সোনা।কিন্তু তুমি আমার ধৈর্যের দেয়ালে বারবার আঘাত করছো।তোমার প্রতিটি আঘাতে আমি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি।তোমার অবহেলায় আমি নিশ্বেস হচ্ছি বারংবার। এই অবহেলার দহনে তোমাকেও পুড়তে হবে।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৬