সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৪

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৪
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

নিকষ কালো অন্ধকারে ঘিরে ধরেছে চারিপাশ। ঠান্ডা বাতাসের সাথে বসন্তের নতুন পাতার গন্ধ।আশেপাশের কোন এক আম গাছ থেকে ভেসে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক।
ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে আদিব।বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে তাকিয়ে আছে অন্ধকারে ঘেরা আকাশের পানে।
— তুই আবারো সিগারেট খাচ্ছিস?
ফারহানের কথায় মলিন হাসলো আদিব। ঠোঁটের কোনে ম্লান হাসি ধরে রেখেই বলে,

— নিজের ভিতরে দগ্ধ হওয়া আগুনের ধোঁয়া তো আর বের করতে পারছি না। তাই নিকোটিনের ধোয়াই না হয় উরালাম।
ফারহান গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আদিবের দিকে। প্রিয় বন্ধুটির জন্য তারও কষ্ট হচ্ছে।
— নিজেকে কেন কষ্ট দিচ্ছিস?এতো ভেঙ্গে পরলে চলে?আমরা আছি তো তোর সাথে। টেনশন নিস না ইয়ার।
ফারহানের কথা শুনে বাকা হাসলো আদিব। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে পা দিয়ে পিসে ফেললো। নিজের কার্জ শেষ করে হালকা করে ঘাড় কাত তাকালো ফারহানের দিকে। ফিচলে হেসো অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
— নিজেকে কেন শেষ করবো!শেষ করার জন্য তোর বোন আছে না?টেনশন নিস না, আমার ভিতরে জ্বলা আগুনে তোর বোনকেও খুব তারাতাড়ি পোড়ানোর ব্যবস্থা করছি।ডাক্তার বিয়ে করার সখ সারা জীবনের মতো ঘুচিয়ে দিবো।
ফারহান মনে মনে হাসিতে ফেটে পরলেও চেহারায় রাগী ভাব এনে বললো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

— আমার বোন কে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললেও এখান থেকে ধ’ক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিবো বেয়াদব।
— দুলাভাই ডাক শালা।এখন থেকে দিনে দুই বার করে দুলাভাই ডাকা প্র‍্যাক্টিস করবি।আর দুলাভাই প্রজাতি একটু বেয়াদপ টাইপের ই হয়।না হলে দুলাভাই দুলাভাই ভাব আসে না। বুঝেছিস?
আদিবের কথা শেষ হতেই দুজনেই একসাথে হেসে দিলো।
— ডাক্তারের বিষয় কোন ইনফরমেশন পেয়েছিস?
— তার জন্য চট্টগ্রাম যেতে হবে। দেড় বছর আগে তারা ওখানেই ছিলো। এখনের সবাই তাদের সম্পর্কে ভালো কথাই বললো। তবে ডাক্তারের মায়ের ব্যবহার কিছুটা সন্দেহজনক।
— হুম।বিয়ের জন্য খুব তাড়া দিচ্ছে। এতো তারাহুরোর কি আছে বুঝতে পারছি না। সব কিছু ঘরোয়া ভাবে করতে চাইছে।আজকে এ কথা বলতেই এসেছিলো।

— এই ডাক্তার আমার হাতে কঠিন মার খাবে ভাই।আমার বউয়ের সাথে ঘোরাঘুরির সখ সারা জীবনের মতো ঘুচিয়ে দিবো। (রেগে)
— আগে ডাক্তারের একটা ব্যবস্থা করি।তারপর তোদের ব্যবস্থা ও হয়ে যাবে। তবে একটা কথা আমি স্পষ্ট ভাবে বলে দিচ্ছি আদিব,আমার আপু যদি রাজি না থাকে তাহলে আমি কিছুই করতে পারবো না। তোকে আগে আপুকে রাজি করতে হবে। আপুর অমতে গিয়ে আমি বা আমারা কিছুই করবো না।
— শালা বেইমান।নিজে তো ঠিকই সায়েবার কে জোর করে বিয়ে করে নিয়েছিস।আমার বেলায় আলাদা নিয়ম কেন?
— কারন সায়েবা আমাকে ভালোবাসে। তাই আমি তার উপর জোর খাটাতে পারি।
— তোর বোন ও আমাকে ভালোবাসে। শুধু বয়সের তারতম্যের জন্য মুখ ফুটে বলতে পারে না।
— ঠিক আছে। তাহলে তো হয়েই গেলো। আপু রাজি থাকলে আমাদের পক্ষ থেকে কোন সমস্যা নেই।
— হুম।
— আমি নিচে যাচ্ছি। বউ অঅপেক্ষা করছে।তোর তো আবার বউ নাই।তুই বুঝবি না।(শয়তানি হেসে)
আদিব ফারহানের কথায় মন খারাপের ভান করে বললো,
— আজ তোর বোন অবহেলা করে বলে।নাহলে আমি ও দুই বাচ্চার বাপ হয়ে দেখিয়ে দিতাম।
ফারহান আদিবের পিঠে ধুম করে কিল বসিয়ে দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেলো।

আয়নার সামনে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে ব্যস্ত সায়েবা। আজ অনেকদিন পরে সে সেজেছে।তাও নিজের প্রান পুরুষের জন্য। সোনালী পাড়ের টকটকে লাল শাড়ীতে তার রুপ ঠিকরে পড়ছে। কোমড় পর্যন্ত কোকড়ানো খোলা চুলে বেলি ফুলের গাজরা টা আরেকটু ভালো করে লিগিয়ে আলতা পড়ায় মন দিলো সায়েবা।আলতা লাগানো শেষ করে মোটা নুপুর গুলো পড়তেই ধবধবে পায়ের সৌন্দর্য আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো। হাত ভর্তি লাল চুরির রিমঝিম শব্দে চারিপাশ মুখরিত হয়ে আছে।চিকন চেইনের কোমড় বন্ধনিটা পড়তেই এক রাশ লজ্জা এসে ভর করলো সায়েবার মুখে।লাল টকটকে লিপিস্টিক আর গাঢ় কাজলে অপরুপ সুন্দর লাগছে সায়েবা কে।নাকের নোলক আর হাতের চুরি গুলো ছাড়া আর গয়না পরতে ইচ্ছে হলো না। তাই সীতাহার টা আবার রেখে দিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখে নিলো।ঘড়িতে এখন বারোটা তেইশ।ফারহান হয়তো এখুনি চলে আসবে।ফারহানের উপস্থিতি চিন্তা করতেই লজ্জায় নুইয়ে গেলো সে।ঘরের লাইট অফ করে মৃদু আলোর ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলো সে।জানালান কাচ খুলে দিতেই বাতাসের ঝাপটা এসে শীতল করে দিয়ে গেলো অঙ্গ। ঠিক সেই মুহুর্তে আগমন হলো ফারহানের।দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই পা জোড়া থেমে গেলো তার। কয়েকটি হৃদস্পন্দন মিস হতেই বুকের বা পাশে হাত রাখলো সে।হৃদপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে লাফাচ্ছে। শুকনো ঢোক গিলে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো ফারহান। এই মেয়ে কি তাকে মা’রার প্ল্যান করেছে নাকি!সে আজ খু’ন হয়ে যাবে এই রুপে।

ফারহানের আসার শব্দ পেয়েছে সায়েবা।কিন্তু অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও ফারহানের উপস্থিতি টের না পেয়ে কপাল কুচকে গেলো তার।চিন্তিত হয়ে পিছনে ঘুরতেই ফারহানের স্তব্ধ দৃষ্টি দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো। প্রেয়সীকে এই রুপে দেখে ফারহানের বুকে চিন চিন ব্যথা হতে লাগলো। এক অজানা শক্তি টেনে নিয়ে গেলো সায়েবার পানে।ফারহানের গরম নিশ্বাস আচড়ে পরতেই চোখ তুলে তাকালো সায়েবা।সায়েবার শরীরের কম্পন স্পষ্ট বুঝতে পারছে ফারহান।আস্তে করে চিবুক ধরে মুখ উচু করতেই চোখ বন্ধ করে নিলো সায়েবা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুকাল। কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিয়ে নেশালো গলায় বললো,
— আমাকে খু’ন করতে চাও?শ্বাস বন্ধ করে মারতে চাও? এই দেখো আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। বুক ধুকপুক করছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছো?

লজ্জাবতী গাছের মতো নেতিয়ে গেলো সায়েবা।সায়েবা কে ঘুরিয়ে ঘারে মুখ গুজলো ফারহান। আবেদনময়ী গলায় প্রশ্ন করলো,
— দেনমোহর বুঝে পেয়েছো বউ?
ফারহানের বেসামাল স্পর্শে ততক্ষণে নেতিয়ে সায়েবা।মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কোন রকম মাথা নারিয়ে বোঝালো পেয়েছে।
সাথে সাথে সায়েবাকে কোলে তুলে নিলো ফারহান। ফিসফিস করে বললো,
— আমার তো আরো দুই রাকাত শুকরিয়া নামাজ পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে আমার হুরদের সর্দারনী।
সায়েবা তখন চোখ বন্ধ করে ফারহানের বুকে মুখ লুকাতে ব্যস্ত।
সায়েবাকে শুয়িয়ে দিয়ে তার হাতে চুমু খেলো ফারহান।ভারি নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
— আমার তোমাকে চাই বউ।আমার অস্তিত্বের ভিতর তোমার অস্তিত্ব চাই।

সায়েবা ফারহানের আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে তাকে হাত উচু করে জরিয়ে ধরলো। ফারহান হাসলো।যাকে বলে বিশ্ব জয় করা হাসি।প্রিয়তমার কপালে চুমু খেয়ে তার গলায় মুখ ডুবিয়ে আদরের ঝড় তুলে দিলো।সেই ঝড়ের তান্ডব চললো সারা রাত।এতদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো দুজনের।
ফজরের আজান হতেই মুয়াজ্জিনের সাথে আজানের জবাব দিলো ফারহান। তার বুকের মাঝেই গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সায়েবা।চেহারার মলিন হয়ে আছে।সায়েবা কে দেখে একটু কষ্ট হলো তার।মলিন মুখে পরপর কয়েকটা চুমু খেয়ে বুকের সাথে নিবিড় ভাবে চেপে ধরলো। নিজেকে কয়েকদফা গালি দিলো নিজের বারাবাড়ির জন্য।মেয়েটার অনেক কষ্ট হয়েছে মনে হয়!আদুরে স্বরে কয়েক বার ডাকার পরে পিটপিট করে চোখ খুললো সায়েবা।একটু নড়াচড়া করে আবার চোখ বন্ধ করে নিলো।
— আজান হয়ে গেছে বউ।নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়ো।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৩

ফারহানের আদুরে ডাকে উঠে বসলো সায়েবা। শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি অবশিষ্ট নেই। ফারহান বুঝতে পেরে কোলে করে নিয়ে গেলো ওয়াশরুমে।কিছুক্ষণ সাহায্য করে বেরিয়ে এলো সে।সায়েবার গোসল শেষ হতেই চটপট নিজে চলে গেলো ফ্রেশ হতে।
নামাজ শেষ করে সায়েবা কে বেডে শুইয়ে দিয়ে নিচে চলে গেলো ফারহান। হালকা কিছু খাবার খাইয়ে সায়েবা কে পেইন কিলার দিতে হবে। গায়ে জ্বর জ্বর ভাব চলে এসেছে।একদিনের ভালোবাসায় এই হাল!বউ তো নয়,যেন ননির পুতুল। মুচকি হাসলো ফারহান।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৫