সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৭

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৭
লেখিকা সানজিদা বিনতে সফি

বিয়ের সাজে স্টেজে বসে আছে ফায়জা।ঘড়ির কাটা গিয়ে ৪ টায় ঠেকেছে কিন্তু বরযাত্রী আসার খবর নেই।ফারহান আর ফরহাদ গিয়েছে খোঁজ নিতে। ফারহানা বেগমের চিন্তায় প্রেসার ফল করেছে।সায়েবা তার পাশে বসে আছে। বিয়ে বাড়িতে কানাঘুষা বেরেই চলেছে।ফায়জার চাদের মতো মুখটা আষাঢ়ের কালো মেঘে ঢেকে আছে। নিজের মতো স্থির হয়ে বসে আছে সে।কোন দিকে কোন খেয়াল নেই তার।ফোনের ম্যাসেজ টোন বাজতেই চোখ তুলে তাকালো সে।

‘কি বলে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। তোমাকে যেদিন প্রথম দেখেছিলাম সেদিন নিজের মনের মধ্যে তোমার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম।গম্ভীর একটা মেয়ে এভাবে আমার হৃদয় নাড়িয়ে দিয়েছে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিলো। ভালোবেসে ফেললাম তোমায়।তোমার আম্মু খু স্নেহ করতেন আমাকে।আমি জানি তোমাদের তুলনায় আমরা কিছুই না।তবুও সাহস করে নিজের মনের কথা জানিয়েছিলাম তোমার আম্মু কে। আমার মনে হয়েছিলো তোমাকে পাওয়ার একটা চেষ্টা করা উচিত। যাতে ভবিষ্যতে এটা ভেবে আফসোস করতে না হয় যে চেষ্টা করলে হয়তো তোমাকে পেয়ে যেতাম।বিশ্বাস করবে কিনা জানি না, যেদিন আমাদের এনগেজমেন্ট হলো সেদিন বাসায় এসে বাচ্চা ছেলেদের মতো কেদেছিলাম।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এনেগেজমেন্টের পর থেকে খুব চেষ্টা করেছি তোমার সাথে সহজ হতে।তোমাকে বুঝতে।কিন্তু বরাবর ই ব্যার্থ হতে হয়েছে। তবে এই টুকু বুঝতে পারতাম, তুমি আমাকে মেনে নিতে পারছো না।আমি সামনে আসলেই তোমার চোখে মুখে অস্বস্তি ভর করে।ভাবলাম বিয়ের পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। একবারের জন্যও মাথায় আসে নি তুমি অন্য কাওকে ভালোবাসতে পারো।যখন বুঝলাম তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। তোমাকে এ পর্যন্ত টেনে আনতে চাই নি বিশ্বাস করো। নিজের সাথে বার বার যুদ্ধ করে হেরে যাচ্ছিলাম। খুব স্বার্থপর হতে চাইছিল মন।আমার ভালো থাকার খোরাক যে তুমি।তাই একটু স্বার্থপর হয়ে তোমাকে নিজের করে নিতে চেয়েছিলাম।কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে হেরে গেলাম।

দুজন কে কষ্টের সাগরে না ভাসিয়ে আমি নাহয় একাই ভেসে গেলাম। তবুও তো আমার ভালোবাসার মানুষ টা সুখী হলো। ছোট বেলা থেকে অভাবের সংসারে বড় হয়েছি।বাবা মা খুব কষ্ট করে আমাকে এ পর্যন্ত এনেছে।তোমার কথা বাড়িতে জানানোর পর থেকে মা একটু রেগে ছিলেন। তবে পরে মেনে নিয়েছিলেন।আমার এতো প্রচেষ্টা বিফলে গেল। সত্যি করে একটা কথা বলি ফায়জা,আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতর অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে, তুমি কেন আমাকে ভালোবাসলে না!আমাকে কি একটু ও ভালোবাসা যেতো না? একবারের জন্যও কি হাসি মুখে কথা বলা যেতো না? জানো,আমি চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম তোমার একটু হাসি দেখার জন্য। কিন্তু আফসোস তা আর দেখা হলো না। আমি চলে যাচ্ছি তোমার শহর ছেড়ে। জীবনের বাকে আবার যদি কখনো দেখা হয় আমার সাথে হাসি মুখে কথা বলো প্লিজ। বিয়ের আসরে অপেক্ষা করানোর জন্য ক্ষমা চাইছি।সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হলো তাই,,,,,
ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।
‘জাবের’

চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো ফোনের স্ক্রিনে। ঝাপসা চোখে একবার আসে পাশে তাকালো ফায়জা।ফায়জার অসহায় দৃষ্টি দেখে বুক কেপে উঠলো আদিবের।দুই পা এগিয়ে যেতেই ফায়জা নিজ জায়গা থেকে উঠে গেলো। সামনেই সানোয়ার সাহেব মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন।তার পায়ের কাছে বসে শান্ত গলায় বললো,
— বিয়ে টা হচ্ছে না আব্বু।জাবের চলে গেছে এ শহর ছেড়ে।এতে তার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।তুমি এসব কিছু বন্ধ করতে বলো আব্বু।আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।আমি রুমে যাচ্ছি। কিছুক্ষন একা থাকতে চাই।আর পারলে আমাকে ক্ষমা করো।আমার ভুলের জন্য আজ তোমাদের এতো অসম্মান হতে হলো।
সানোয়ার সাহেব অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে।ফায়জার সব কথা না বুঝলেও এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে,বিয়ে টা আর হচ্ছে না। মেয়ের বিদ্ধস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বুক চিনচিন করে উঠছে তার।
— সবাই কে খাইয়ে সসম্মানে বিদায় দেও আদিব।বিয়ে টা হচ্ছে না। আর এ নিয়ে আর কোন কথা শুনতে চাই না।
আদিব মনে মনে খুশি হলেও ফায়জার বিদ্ধস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে খারাপ লাগছে তার। তবে প্রেয়সীর সব কষ্ট ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দিবে সে।তাই আর মাথা ঘামালো না।

এমনিতেই মেয়ের বয়স বেশি।তার উপর আবার বিয়ে ভেঙে গেলো। এই মেয়ে কে আর কে বিয়ে করবে।এতো টাকা পয়সা নাম ডাক দিয়ে কি হবে সেই তো ছেলে বিয়ে করবে না বলে বরযাত্রী নিয়েই এলো না।নিশ্চয়ই এই মেয়ের কোন সমস্যা আছে।শুধু শুধু তো আর বিয়ে ভাঙে নি!দেখো গিয়ে কার সাথে কি ইটিসপিটিস ছিলো।
ফারহানের মুখ রাগে লাল হয়ে আছে। এই মহিলাদের কথা শুনে তাতে যেন ঘি পরলো। অগ্নি চোখে তাদের দিকে তাকাতেই ফরহাদ তাকে সামলে নিলো।
— বাদ দে ভাই।এদের কাজ ই হচ্ছে বলা।বলতে দে।এখন এদের কথায় পাত্তা দেয়ার সময় না।ফায়জু কে সামলাতে হবে। ওর এখন আমাদের কে দরকার।এদের জবাব সময় মতো এরা পেয়ে যাবে।
ফারহান আক্রোশে ফেটে পরলো। ফরহাদের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,

— ওদের বোঝা উচিত ওরা কাকে নিয়ে কথা বলছে।আমার বোনের দিকে আঙ্গুল তোলার সাহস পেলো কোথায় এরা?আমার বোন কে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে সব কয়টা কে এখানেই পুতে ফেলবো।ফারহান সাদিকের বোন ও।ওর চরিত্র নিয়ে কথা বলার আগে হাজার বার ভাবতে হবে। এদের এই মুহুর্তে এখান থেকে বিদায় করো ভাই।না হলে আমার দ্বারা কোন অঘটন ঘটে যাবে।
ফরহাদ কে রেখেই ফারহান হনহন করে ভিতরে চলে গেলো। কমিউনিটি সেন্টার অলরেডি খালি হয়ে গেছে।হাতে গোনা কয়েকজন আছে।এতক্ষণ যারা ফায়জা কে নিয়ে নানা ধরনের মন্তব্য করছিলো তারা ফারহানের রক্তিম চেহারা দেখেই কেটে পরেছে।ফায়জা তখন সানোয়ার সাহেবের সাথে কথা বলেই বেরিয়ে গেছে এখান থেকে। ফারহান বাকি সবাইকে পাঠানোর ব্যবস্থা করে সানোয়ার সাহেব আর ফারহানা বেগম কে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। শোয়েব, আদিব,ফরহাদ আর সাহেরা বেগম এক গাড়ি তে যাচ্ছে। সায়েবা ফায়জার সাথেই বেরিয়ে গেছে। নীতি আর সাবা ও ওদের সাথে আছে।ফারহানা বেগম এখনো কেদেই যাচ্ছেন।

— ওখানে গিয়ে ওদের পেলে না ফারহান?
সানোয়ার সাহেবের বিরস গলা শুনে ফারহান তার দিকে তাকালো। বাবার এমন অসহায় চেহারা এর আগে কখনো দেখেনি সে।এতো টাকার মালিক হয়েও তাদের জীবন সব সময় সাধারণ মানুষের মতো ছিলো। সানোয়ার সাহেব খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন।সব সময় হাসি খুশি মানুষ টা আজ মেয়ের চিন্তায় একদম নেতিয়ে গেছেন।
— না আব্বু।ওরা কালকে রাতেই নাকি এখান থেকে চলে গেছে।কোথায় গেছে কেউ কিছু বলতে পারছে না।আত্মীয় স্বজন ও তেমন কেউ এখানে নেই।তুমি চিন্তা করো না আব্বু।আমি ঠিক ওদের খুজে বের করবো।আমার বোন কে ধোকা দেয়ার ফল ওদের পেতে হবে।
শেষের কথা গুলো দাতে দাত চেপে বললো ফারহান।রাগ যেন কিছুতেই কমছে না ওর।না জানি ফায়জা কি অবস্থায় আছে।এসব ভেবে ভেবে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। এখন তারাতাড়ি বাসায় পৌঁছাতে হবে।বোন কে দেখার আগ পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৬

ফারহানের আগেই ফরহাদরা বাসায় পৌঁছে গিয়েছে।গাড়ি থামতেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে বাসার দিকে ছুটলো ফারহান।বোন টা ঠিক আছে তো!এই চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে সে।
একে একে সবাই গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে চলে গেলো। আদিব ড্রাইভিং সিটে বসে আছে এখনো। এই মুহুর্তে বাসায় যাওয়া যাবে না। এখন ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু চিন্তা করতে হবে তাকে।
— শুধু শুধু আমাকে রাগিয়ে দিলে সোনা।তোমার জন্য এখন কত কত ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে দেখো তো। পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে তোমার ওই হতে হতে না হওয়া বর কে রাতারাতি গায়েব করতে হলো। তার উপর এতো এতো কাজ।ইসসস,হাত পা ব্যাথা হয়ে গেছে। এখন যদি গিয়ে দেখি তুমি বরের শোকে ঘরে দোর আটকে মরা কাদা কাদছো তাহলে তোমাকে সাত তালা থেকে ফেলে দিতে আমি একবার ও ভাববো না। গেট রেডি ফর বি মাইন।

সায়েবা আসক্তি পর্ব ২৮