মনের কোণে পর্ব ২৮

মনের কোণে পর্ব ২৮
আফনান লারা

ঘরভরা আসবাব দেখে নাবিলের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
আর যে এই কান্ড ঘটিয়েছে সে নিশ্চিন্তে এক কোণায় বসে পানি গিলছে ঢকঢক করে বোতল থেকে।
তার পানি খাওয়ার পর্ব শেষ হতেই নাবিল হুমড়ি খেয়ে জানতে চাইলো এই অসাধ্য সাধন কি করে করেছে ও।

লিখি বললো নিউমার্কেটে ঢুকে গেছে সোজা।ঢুুকলেই হয়না।দামাদামি করতে হয়,জানতে হয়।নাবিল তাই ভাবছে,দামাদামি জানলে এসব সম্ভব।
লিখি উঠে এবার সব গুছিয়ে ফেলছে এক এক করে।সবার আগে তার রুমে তোষক পেতে তাতে চাদর বিছিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে এখন।
নাবিল ওখানে একটু জায়গা করে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।শক্ত ফ্লোরে বসে থাকতে থাকতে পা ধরে গেছিল।
লিখির চোখে ঘুম এসে গেলো।তারপর যখন চোখ খুললো তখন রাতের দশটা বাজে।রান্না করা হলোনা মনে করে লাফ দিয়ে উঠে বসে পড়েছে সে।
নাবিল ওর পাশেই বসে শর্মা খাচ্ছিল,অর্ডার করে এনেছে।সেটা ওকেও খেতে বলে আবার কাজে মন দিলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

লিখি চোখ ডলতে ডলতে ওয়াশরুমের দিকে চললো।ঘুম থেকে উঠলে পাঁচ মিনিট এ জগতের কারোর হুশ থাকেনা।মনে হয় অন্য জগৎয়ে উঠে চলে এসেছি।
মুখ ধুয়ে বের হয়ে সে চড়াও হয়ে গেলো নাবিলের ওপর।সে নাকি তরকারি কিনে এনেছে তাহলে নাবিল শর্মা অর্ডার করে টাকা নষ্ট করলো কেন।
‘রাতের দশটার সময় তুমি ভাত রাঁধবে?’
‘কেন?কি সমস্যা তাতে?’
‘লাগবেনা’
বিড়বিড় করতে করতে লিখি বাইরে গেলো দেখতে।যা যা আগোছালো ছিল সেসব কিছু পরিপাটি করে গোছানো।কাজটা নাবিলের বুঝে লিখি খুশি হলো।সদাই করে এসে প্রচণ্ড টায়ার্ড হয়ে পড়েছিল সে।আজ আর কোনো কাজ তাকে দিয়ে হতোনা।

শর্মা খেতে খেতে লিখি নিজের রুমের জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দূরের একটা ফ্ল্যাট দেখছিল।নাবিল তখন ল্যাপটপের কাজ শেষ হওয়ায় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসেছে।লিখিকে মনযোগ দিয়ে বাইরেটা দেখতে দেখে তার মাথায় আবারও দুষ্টু বুদ্ধি এসে গেলো।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,’বউ??’
বউ ডাক শুনে লিখির গলায় খাবার বিঁধে গেছে।অনেক কষ্টে গিলে পেছনে তাকালো।তার বড় করে রাখা চোখ বলে দিচ্ছে সে ভীষণ ভয় পেয়ে আছে।নাবিল তার চোখে ভয় দেখে ভয়টাকে আরেকটু নাড়াচাড়া দিতে বললো,’আসো পাশে বোসো।প্রেমালাপ করি’

‘আপনার কি শরীর খারাপ?’
‘না তা হবে কেন?হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?’
‘বেশি রোমান্টিক হয়ে গেছেন তাই জানতে চাইছি’
‘তুমি হলে আমার ওয়াইফ।তোমার জন্য রোমান্টিক হবোনা তো কার জন্য হবো?আসো পাশে বোসো বলছি’
নাবিলের জোর দেওয়া দেখে লিখি দু কদম আরও পিঁছিয়ে দাঁড়ালো।গেলো না ওর কাছে। শর্মা শেষ করে কিণারা দিয়ে হেঁটে হাত ধুয়ে এসেছে।নাবিল তখনও বিছানাতে ছিল।শুতে হলে তো ঘুরেফিরে তাকে এই জায়গাতেই আসতে হবে,তাই সে পড়েছে মহাবিপদে।নাবিলকে সুবিধার মনে হয়না।
দুষ্টামি মাথায় চলছে, আবার কি করে বসে তাই ভাবছিল কতক্ষণ। ওকে জানালার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখে লিখি রুমের আলো নিভিয়ে চো/রের মতন বসে গেলো নিচে পাতানো তোষকের ওপর।

নাবিলের হাতের ঘড়ি ডাক দিয়েছে।এগারোটা বাজে।লিখি চোখ বুজতে গিয়েও পারেনা,নাবিল কখন কি করে বসে তা নিয়ে চিন্তায় ঘুম নেই চোখে।ঘুম না হবার আরও একটা কারণ হলো কিছুসময় আগেও সে ঘুমিয়েছে।এখন আড্ডা দিলে মন্দ হতোনা।কিন্তু নাবিল যে রোমান্টিক ভাব দেখাচ্ছে তাতে মনে হয় আড্ডা দেওয়ার নাম ও নেয়া যাবেনা।
নাবিল ঠিক সেসময়ে লিখির হাতটা টেনে ধরলো আঁধারের মাঝে।
লিখি তো ভয়ে শেষ।চিৎকার করে বললো ‘হাত ধরলেন কেন?কি করবেন?’
‘প্রেম’

লিখি উঠে বসে বললো,’মজা পায় আপনার?আমরা কিসের মধ্যে আছি, ভুলে গেছেন?এই সিচুয়েশনে আপনার মজা পায় কি করে আমি তাই বুঝিনা।আমার হাত এত শক্ত করে ধরেছেন কেন?ছাড়ুন নাহয় কামড়ে দেবো’
‘নাহিদের বহুত কামড় খেয়েছি।হেবিট আছে।কামড়াও’
লিখি হাত নাড়তে নাড়তে বললো,’হাত ধরেছেন মানলাম,কিন্তু কিসের জন্য হাত ধরলেন?’
‘সামনে খোলা জানালা,আকাশ কালো,তাতে জ্বলে আছে কোটি কোটি তারা।আকাশের নিচে খালি।থেমে থেমে বাতাসের রাশি,রুম অন্ধকার।
এই মূহুর্তে হাত ধরবোনা তো কবে ধরবো?’

‘ধরে কি হচ্ছে?’
‘চোখ বন্ধ করে ভাবো কি হচ্ছে’
লিখি নাবিলের কথা মতন চোখ বন্ধ করলো।জানালা দিয়ে বাইরের বাতাসে তার চুল নড়ে উঠলো।ঠাণ্ডা আবহাওয়া,আর নাবিলের হাতের ছোঁয়া তাকে এক অন্যরকম দুনিয়ায় নিয়ে চলে গেছে।সেই অনুভূতিটা শিহরণ জাগালো মনে।কেঁপে উঠলো সে।নাবিল তখন হেসে বললো,’বলেছিলাম না?’
‘আপনি অদ্ভুত ‘
‘আর তুমিও’

‘এই রাত কি শেষ হবেনা লিখি?গান পারো?হয়ত পারোনা।বেশি ঝগড়াটে মেয়েদের গলা ভাল হয়না তাই গাইতে বলবোনা।আচ্ছা গল্প জানো?’
নাবিলের কথা শুনে লিখি কিছু বললোনা।দু মিনিট চুপ থেকে খালি দু লাইন গাইলো।
“””মনের কোণে””””
“””গহীন ঘরে,,,থাকবি রে শুধু তুই””
“””কল্পনাতে,ভেলায় ভেসে”””
“””” ঘুরবো আমি, তুই……””””
গানটা এত ভাল যে লিখির চিকন স্বরে দারুণ শোনা গেলো।নাবিল অবাক চোখে ওর দিকে ফিরে চেয়ে রইলো এতক্ষণ কিন্তু অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছিলনা।গানটা শুনে সে বললো,’জানো আমাদের সাথে গানটা মিলে গেছে।’
‘কিভাবে?’
‘একদিন বুঝবে’

নাবিল এবার বসা থেকে শুয়ে পড়েছে।লিখির চোখে ঘুম নেই,হয়ত নাবিলও জেগে আছে।তাই সে বললো,’আচ্ছা আপনার বাবা যেদিন জানবে আপনি বিবাহিত, সেদিন তিনি কি করবেন?’
‘তুমি যত ভালই হও না কেন ডিভোর্স দিতে বলবে’
‘তখন?’
‘আমি কি তার কথা শুনি? ‘
লিখি হালকা নিশ্চিন্ত হলো।প্রথমদিন মন চাইছিল ডিভোর্স দিয়ে দিতে আর আজ ডিভোর্সের ভয় জাগে মনে।একটা সম্পর্কের ভিত্তি কতটা মজবুত হতে পারে।
নাবিলের নড়চড় না দেখে বোঝা গেলো সে ঘুমিয়েছে।সন্ধ্যাবেলার ঘুমটা রাতের ঘুম কেড়ে চলে গেছে।
তাই উঠে বসে নাবিলের কথা মতন খোলা জানালা দিয়ে আকাশের তারা দেখছিল সে।মন চাইলো ছাদে গিয়ে দেখতে।ভাবনার ছায়াতলে দরজা খুলে ছাদে চলে আসলো লিখি।

ছাদ ছিল ফাঁকা।সেখানে গোল হয়ে বসে আকাশের দিকে তাকাতেই মনে হলো তারার মেলায় হারিয়ে যাচ্ছে সে।
কি সুন্দর আকাশটা।ইচ্ছে করে এক ছুটে গ্যালাক্সিতে চলে যেতে।
পরিষ্কার ছাদ দেখে মনে স্বাদ জাগলো একবার শুয়ে দেখার।সব পূরণ হয়ে একটা বাদ যাবে কেন?শুয়ে পড়েছে লিখি।এবার আকাশটা যেন কোলে চলে আসবে।মুচকি হেসে তখন পাশে মুখ ফেরাতেই পাশে নবিলের মুখের ঝলক দেখে চমকে গেলো লিখি। নাবিল কখন যে আসলো আর ওর পাশে শুয়েও গেলো সে টেরই পায়নি।নাবিলের মুখে ছিল অসীম হাসি।ছাদের মাঝে জ্বলে থাকা লাল বাতির আলোয় ওর মুখের সাদা রঙটা যেন আরও গাঢ় হয়ে গেছে।নাবিলের ঠোঁটের কোণায় জমে থাকা হাসি লিখিকেও হাসতে বাধ্য করলো।সে হেসে বললো,’আপনি ঘুমাননি?’
‘দেখছিলাম তুমি আমার অজান্তে কি করে,আর এটাও জানতাম তুমি এত জলদি ঘুমাবেনা’

‘কখনও এমন শুয়েছিলেন?’
‘বহুবার’
‘কোনো মেয়ের সাথে?’
‘উহু।’
‘আচ্ছা আপনি প্রেম করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ’
লিখি মাথা উঠিয়ে কুনুই ছাদে রেখে বললো,’সত্যি?’
‘হ্যাঁ’
‘সে মেয়ের সাথে বিয়ে হলোনা কেন?’
‘বাবা তাকে পছন্দ করেনি’
‘তো তাই বলে ভালবাসার মানুষটাকে যেতে দিলেন? ‘
‘তখন আমি ইন্টারে পড়তাম।আমার হাত খরচ বাবা দিতো।বাইরের জগৎ সম্পর্কে দু আনাও জানতাম না।তাকে নিয়ে পালিয়ে উল্টে তাকে বিপদে ফেলতাম।তখন এত আত্নবিশ্বাস ছিলনা’

‘ঐ মেয়ে কাঁদেনি?’
‘কেঁদেছে,হয়ত আমি দেখিনি।আমাকে দেখিয়ে কাঁদেনি।বাবার প্রতি তার ঘৃনা সৃষ্টি হয়েছিল যার কারণে শেষ পর্যন্ত সেও আমায় ঘৃনা করেছে।অবশ্য ঘৃনা করারই কথা’
লিখি উঠে বসে তারপর বললো,’যদি আমার বেলায় ও এমন করে?’
‘তুমি হলে আমার বিয়ে করা বউ,
চাইলেই কি আলাদা করা সম্ভব? ‘
‘আপনার বাবা সব পারবেন’
‘আমার বাবাকে দোষ দিচ্ছো কেন?তোমার ফ্যামিলি কি কম সাংগা/তিক??? ওরা জানলেও একই কাজ করার চেষ্টা করবে’
‘আপনি কি চান আলাদা হতে?’

লিখির কথা শুনে নাবিল ওর চোখের দিকে তাকালো।প্রশ্নটা সে সিরিয়াসলি করেছে। তাও নাবিল উত্তর দিলোনা। সোজা আকাশের দিকে চেয়ে থাকলো।লিখি উঠে ছাদের বাতিটা নিভিয়ে দিলো হঠাৎ।নেভানোর ওরেও আকাশে আলাদা একটা ভাসমান আলো ছিল।একেবারে আঁধার টাইপের।মেঘলা বলে হয়ত!!চাঁদ কি উঠছিল?নাকি মেঘে ঢাকা??এরকম আকাশের দিকে তাকালে কেমন একা একা মনে হয় নিজেকে।
লিখিকে ওভাবে উঠে যেতে দেখে নাবিল বললো,’আমি আলাদা হতে চাইনা লিখি’
‘কেনো?কারণ জানতে পারি?কদিনে মায়া ধরে গেছে?’
‘মায়া ধরুক বা না ধরুক,বন্ধনে তো আটকা পড়ে গেলাম।এটা কি চাইলেই অস্বীকার করা যায়?’

লিখি রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বললো,’আমাকে আপনার কেমন লাগে?’
‘কেমন লাগে, পাশে আসতে বলেছি বুঝোনা?’
লিখির গাল লাল হয়ে গেছে কথাটা শুনে।রেলিং থেকে হাত সরিয়ে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়েও নিয়েছে।নাবিল আবারও দুষ্টুমি শুরু করবে মনে হয়।
পরিস্থিতি সুবিধার না বলে লিখি পালিয়েই যাচ্ছিলো।নাবিল ছাদের বাতিটা জ্বালিয়ে দরজার সামনে বাধা দিয়ে দাঁড়ালো তখন।ঠোঁটের কোণায় হালকা হাসি আর চোখে দুষ্টুমি ভাসছে তার।লিখি অসহায়ের মতন তাকিয়ে ছিল,নাবিল বললো,’তোমায় ভয় দেখাতে এত ভাল লাগে কেন বলোতো?’
‘আপনি জানেন,কারণটা জানলে আমি শুধরে নিতাম’
‘কারণ হলো তুমি ভয় পাও তাই।

ভয় পাওয়া বন্ধ করে দাও,দেখবে আর ভয় দেখাবো না’
লিখি বুক ফুলিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে, দম আটকে বললো,’আমি স্ট্রং,আপনাকে ভয় পাইনা হুহহহহ’
নাবিল হঠাউ ওর কোমড় জড়িয়ে ধরতেই তার সব সাহস আর দম ছেড়ে গেলো।কোমড় থেকে নাবিলের হাত সরিয়ে দূরে সরে বললো,’আপনি খুব খারাপ’
‘ঐ যে বললাম ভয় পাইলে আরও ভয় দেখাবো’
‘আমি ভয় লাঘব করার জন্য টাইটলি দাঁড়িয়েছিলাম,কি দরকার ছিল কোমড়ে হাত রাখার?’
‘ছুঁয়ে দেখছিলাম ভয় গেলো কিনা’
‘এমন গেম খেলবোনা,আপনি কি আগে বলেছিলেন যে কোমড়ে হাত রেখে চেক করবেন?’

‘গেমসের সব রুলস বলে দিলে এই গেমস আমি নিজেই খেলবোনা।সরো’
‘ঠিক আছে,এবার আবার ট্রাই করবেন’
লিখি আবারও বুক ফুলিয়ে দম আটকে এবার কোমড়ে নিজের হাত রেখে দাঁড়িয়েছে যাতে নাবিল কোমড় ছুঁলেও ওর কাতুকুতু না লাগে।
নাবিল মুখে হাসি ফুটিয়ে কাছের দিকে আসলো।লিখি ভাবছে কোমড়ে হাত রাখলে ভয় পাবেনা,মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল ওসব।
তার ভাবনায় আরও একবার ছেদ ঘটালো নাবিল।ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো কাছে এসে।

মনের কোণে পর্ব ২৭

কোমড়ে হাত রাখেনি অথচ আরও একবার লিখিকে ভয় দেখিয়ে ফেললো।
লিখির হাত সরে গেছে কোমড় থেকে।নাবিল ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,’আমি আবারও জিতে গেলাম’

মনের কোণে পর্ব ২৯