মনের কোণে পর্ব ৬

মনের কোণে পর্ব ৬
আফনান লারা

একটা গাড়ী এসে থেমেছে গেটের ওপারে।নাবিল তখন লিখির গাল টিপে ধরে পানি খাওয়াচ্ছিলো।দারোগা শুনিয়ে গেছে অফিসার এসে গেছেন।পানির বোতল রেখে নাবিল তাই বাহিরে গেলো দেখার জন্য।বাবার বন্ধু একজন আছেন যিনি পুলিশ অফিসার।সিওর হয়ে নেবে তিনি কিনা।যদি তিনি হোন তবে সে এক্ষুনি পালাবে।
মেদযুক্ত ভুড়িওয়ালা মানুষটাকে সে চিনতে পারেনি বলে মুখে হাসি ফুটিয়ে আবার গিয়ে লিখির পাশে বসে পড়েছে।লিখি গাল ফুলিয়ে রেখেছে।এর আগে দুবার ধরা খেয়েছিল,মেয়ে বলে কেউ হাত তোলেনি,পুলিশেও দেয়নি।কিন্তু এবার ফেঁসে গেলো।ভেবেই বিরক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত তাকে এই ছেলেটার কাছে ধরা খেতে হয়।শেষমেষ এই পরিণতি।

সেই অফিসার এসে বসলেন নিজের চেয়ারে।নাবিলকে দেখেই ব্রু কুঁচকে বললেন,’তোমায় কোথায় য়েন দেখেছি।ওয়েট আ মিনিট’
জনাব মকবুল তার ফোন ঘেটে কি যেন দেখলেন।কয়েকবার করে নাবিলের বডি দেখলেন।তারপর বললেন,’তোমার বাবার নাম কি?’
নাবিল চেয়ারে হাত রেখে ভাবছে কোনদিক দিয়ে ছুটবে।তার ভাবনায় ছেদ ঘটালেন মকবুল।তিনি দারোগাকে ইশারা করে দরজা আটকাতে বলে ফেলেছেন ততক্ষণে।
নাবিল বাধ্য হয়ে লিখির দিকে একবার চেয়ে আবার মকবুলের দিকে চেয়ে বললো,’বাবার নাম কাসেম।’
‘এই মেয়েটা কে?তোমার বাসা কোথায়?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

নাবিল মাথা চুলকে বললো,’বরিশাল,এখানে চাকরিসূত্রে এলাম’
‘ওহহ।এই মেয়েটা কে?’
নাবিল হাত নিয়ে লিখির ঘাড়ে রেখে মুচকি হেসে বললো,’আমার বউ।নতুন বিয়ে করেছি।’
‘তুমি বিবাহিত? তবে এখানে কেন আসলে?’
‘ওর পরিবার ঝামেলা করে বেশি তাই রিপোর্ট লেখাতে এসেছি।সাময়িক জিডি’
মুকবুল হাতের উপর হাত রেখে সন্দেহসূচক দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করলেন,’তবে মেয়েটার হাত বাঁধা কেন?আর মানিক তো বলছিল এই মেয়েটা নাকি চোর?’

‘আরে ওকে দেখে চোর মনে হয়?কিসব বলছেন এসব?আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ’
লিখি চোখ কপালে তুলে একের পর এক নাবিলের মিথ্যে প্রলাপ শুনে যাচ্ছে।আগাগোড়া কিছু না বুঝলেও এটা বুঝতে পেরেছে যে তার চুপ থাকাই শ্রেয়। বোঝা গেলো নাবিল আজ তাকে জেলে পুরবেনা।বরং তার কোনো দূর্বলতা আছে এই পুলিশের সাথে।তাই চোরের মতনই বসে থাকলো।
জনাব মকবুল ফোন টিপে বললেন,’আসলে আমার বড় ভাইয়ের ক্লোজ ফ্রেন্ড একটার ছেলে বাসা ছেড়ে পালিয়েছে।তার নাম নাবিল।চেহারা যদিও আমি ওরে অনেক আগে দেখেছিলাম।ডিটেইলস জানি।ভাইয়া সেন্ড করছিল।ছবিটা সেভ করতে ভুলে গছি।কিন্তু সে এখনও বিয়ে করেনি যতদূর জানি, করলে তো আমাদের ১৪গুষ্টিকে দাওয়াত করতো অনাবিল স্যর।।আমি ভাবলাম তুমি তার ছেলে কিনা।কারণ তোমার বেশ-গড়ন একেবারে নাবিলের মতই।।আচ্ছা তোমার নাম কি?’

‘তৃষাণ হক’
‘ওহ।আচ্ছা তোমার বউকে ওমন বেঁধে রেখেছো কেন?’
‘কোদাল সবসময় বুকের দিকে টানে।ওর হয়েছে তাই।নিজের বাপের বাড়ির পক্ষ নিয়ে কথা বলে বেশি তাই বেঁধে রেখেছি’
লিখি অগ্নি দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।মকবুল হেসে বললেন,’এটা ভারী অন্যায়।তুমি এই ছেলের সাথে পালিয়ে বিয়ে করেছো নিজের ইচ্ছেতে আর এখন তুমি তার পক্ষ না নিয়ে নিজের পরিবারের পক্ষ নিচ্ছো?ছেলেটার কি দোষ?সে তো তোমায় ভালবেসে বাসা ছেড়েছে’
লিখি পা দিয়ে নাবিলের পা মাড়িয়ে দিলো।নাবিল দাঁত খিঁচিয়ে মুখে হাসি ফুটিয়ে ওর হাতের বাঁধন খুলে ওড়না মজবুত করে ধরে রেখে বললো,’জিডি করিয়ে নেন তবে’

অনেক কষ্টে মকবুল স্যারের হাত থেকে বেঁচে নাবিল বের হলো ওখান থেকে।লিখি ওড়না ছাড়িয়ে বললো,’নাটক করার জন্য এনেছিলেন?’আমার তো মনে হয় ঐ নাবিল ছেলেটাই আপনি।ধরিয়ে দিব এখন??’
‘আমায় ধরাইলে তুমি নিজেও ধরা খাবে।তুমি যে চোর সেটা ভুলে গেছি আমি?’
লিখি অর্ধেক পথ গিয়ে থেমে বসে গেলো ফুটপাতে।নাবিল ও ওর পাশে বসে বললো’যাও আজকের পর থেকে তোমায় ফোনের জন্য ধরবোনা।আমার সামনে আসবেনা কখনও’
লিখি ওর কথায় কান না দিয়ে একটা পিলারের দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকে দেরি না করে দৌড় দিয়ে রাস্তার ওপারে চলে গেলো।
পিলারটা থেকে একটা লিফলেট খুলে নিয়ে আসলো এপারে।
সামনে ধরে গড়গড় করে পড়ে শুনাচ্ছে এবার।

“””””নাম-নাবিল ইসলাম
বয়স-২৬
ইম্পোর্ট বিজন্যাস ম্যান অনাবিল ওসমানের বড় ছেলে নাবিল ইসলাম।
যেখানে দেখিবেন উক্ত নাম্বারে কল করে ঠিকানা জানিয়ে দেবেন।”””””
‘আরেহহহহ এইটা তো আমার সামনে।তার মানে আপনি সেই নাবিল??ছবিও তো দেওয়া আছে।
পুরস্কার লেখা আছে পাঁচ লাখ!ইয়াহু!আমার লাইফ সেটেল!’
লিখি নাবিলের চারিদিকে ঘুরছে আর লাফাচ্ছে, আনন্দে সে দিশেহারা। নাবিল গালে হাত দিয়ে ওর নাচানাচি দেখছে।
‘ওরে আমি লাখপতি হয়ে গেলাম।সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে এতদিন হাতছাড়া করছিলাম।আহারে আমি এই টাকা দিয়ে কি কি করবো।কেমনে কি করবো!ডিপ কল লাগাবো নাকি সরকারি পানির লাইন আনাবো।’
নাবিল কপাল কুঁচকে বললো,’তোমায় আমি ৬লাখ দিব।এবার চুপচাপ বোসো এখানে’
লিখি মুখ বাঁকিয়ে বললো, ‘যে একটা ফোনের জন্য আমায় এত কষ্ট দেয় সে কিনা আমায় ছয় লাখ দেবে?বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে’

‘আমি ব্যবস্থা করে দেবো।বাবা এতকিছু করে ফেলেছে আমি জানতাম না’
‘হেহে!!একদম ভাল হয়েছে।আমাকে অনেক খাটিয়েছেন।অনেক অনেক!একদম এবার নিজে চোরের মতন পালিয়ে বেড়াবেন সারাদিন।আর আমি মুক্ত পাখির মতন’
নাবিল লিখির ওড়না টেনে মুখে ধরে বললো,’আমাকে একটা মাস্ক কিনে এনে দাও যাও’
‘টাকা দেন’
নাবিল মানিব্যাগ বের করে একশো টাকা দিয়ে বললো ভাল মাস্ক আনতে
লিখি নোটটা নিয়ে সামনের একজন ফেরিওয়ালার কাছে গেলো।
‘মামা ভাল মাস্কের দাম কত?’
‘ষাট টাকা’
‘ত্রিশ রাখবেন?’
‘না’
‘গুলিস্তানে দশ টাকায় পাওয়া যায়,হুর আপনার মাস্ক আপনি পরে থাকেন।আমার লাগবেনা’
‘আচ্ছা আপা নিয়ে যান’

লিখি মাস্ক নিয়ে ফেরত এসে নাবিলের হাতে মাস্ক দিলো।তারপর বললো,’আমি যাই,সময় করে আমাকে ৬ লাখ দিয়ে দিবেন।নাহলে ঐ যে ওসমান আঙ্কেলের কাছে আপনার লোকেশন পাঠিয়ে দিব।
আমার কত কাজ এখন।ভাবতে বসবো কত টাকা কোন খাতে খরচ করবো’
নাবিল গাল ফুলিয়ে বসে থাকলো।লিখি চলে গেছে।যে পরিস্থিতির দেখা মিললো তাতে করে তো ছাত্রাবাসে থাকাও রিস্কি হয়ে যাবে।
‘ছাত্রাবাসের কারোর হাতে যদি পোস্টারটা এসে পড়ে তবে আমি মুখ লুকাবে কোথায়।বাবা এই বুদ্ধি করবে কে জানতো।মা একবার আমাকে ফোন করেও জানালোনা।আমার ফোন ও ধরছেনা।’

লিখি পথে আরও কটা পোস্টার পেলো নাবিলের নামের।সবগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে।নাবিল দূর থেকে সেটা দেখে হাসলো।এত বিষন্নতার মাঝে মুখে হাসি খেলে গেলো তার।
এই মেয়েটা বড় অদ্ভুত একটা মেয়ে।শিক্ষিতা, স্মার্ট, ভাল বংশ বিলং করে এবং ভাল নাম করা হোস্টেলে থাকার পরেও সে চুরি করে।সে চুরি করে অটল থাকে তার আত্নবিশ্বাস নিয়ে।
এই শহরে এমন কটা মেয়ে করে?যদি সে করে তবে কেন করে?কেন সে পতিতালয়ের কথা তুললো?কেন সে একটা ভাল চাকরি করতে পারেনা।কত রহস্য।কিন্তু আমি জানতে চাইনা।
আমার জীবনের সামনে পর্দা সরিয়ে চলতে হবে।বাবা ভুলে গেছে আমি তার ছেলে।তার গুণ আমার মাঝেও আছে,আমাকে খু্ঁজে পাওয়া এত সোজা হবেনা বাবা।আমি পণ যেহেতু করেছি, আমার মত ছাড়া তুমি আমায় ফেরাতে পারবেনা।কখনওনা।’

‘লিখি!!!’
ডাক শুনে লিখি পেছনে তাকালো।হেনা ছুটতে ছুটতে আসছে।তার হাতেও পোস্টার।সে ছুটে এসে বললো,’দেখ ঐ ভাইয়াটা না?আরে ঐদিন যে তোকে ছুটাচ্ছিলো’
লিখি পোস্টারটা কেড়ে নিয়ে বললো,’না তো।এটা সে না।আমারও মনে হয়েছিল তবে উনিনা,অন্য কেউ।ছাড় ওসব।চল আমাদের দেরি হয়ে যায়’

নাবিল কয়েকটা পোস্টার নিজেও দেখতে পেলো।বাবা জেনে গেছে ও এই এলাকায় আছে আর তাই বেছে বেছে এই এলাকাতেই সব পোস্টার লাগানো।একটা পোস্টার টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেললো নাবিল।দেয়ালে পুরোনো আরও শতে শতে পোস্টার লাগানো ছিল।ওর পোস্টার টান দেওয়ার পর সে আরেকটা পোস্টারের দেখা পেলো।
“””নাম-তৃননিকা চৌধুরী লিখি
বয়স-বাইশ

মনের কোণে পর্ব ৫

বিখ্যাত ওয়েল গ্রুপ অভ ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক জনাব রহুল আমিনের ছোট মেয়ে।যে তাঁর দেখা পাবেন উক্ত নাম্বারে যোগাযোগ করবেন।পুরস্কার হিসেবে তিন লাখ টাকা প্রদান করা হবে।””””
নাবিল দাঁত কেলিয়ে পোস্টারটা ছিঁড়ে নিলো।
‘এ দেখি মেঘ না চাইতে জল।
মেয়েটার ও সেম কাহিনী।বাহ বাহ।অসাধারণ।
আমার থেকে ছয় লাখ পাবা তাইনা?দাঁড়াও তোমার থেকে আমি কত লাখ হাসিল করি।হেহে!!এবার বুঝবে আমি কি জিনিস!’

মনের কোণে পর্ব ৭