রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩১

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩১
নবনী নীলা

মায়ের কোলে কিছুক্ষন মাথা রেখে নিজেকে শান্ত করলো স্নিগ্ধা। এই সবকিছু কি তার মাকে জানানো যায়? সে বুঝে উঠতে পারছে না। মাকে কাছে পেয়ে মনটাকে সে শান্ত করতে পেরেছে।
মনের মধ্যে তার একটা প্রশ্ন ছিল কিন্তু কখনই সেটা তার মাকে জিজ্ঞেস করা হয় নি। আজ সেই প্রশ্ন করার দিন এসেছে। স্নিগ্ধা মাথা তুললো নিজের মায়ের কোল থেকে। তারপর মায়ের দিকে তাকাতেই আয়েশা খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই স্নিগ্ধা বললো,” আচ্ছা মা! একটা প্রস্ন করি?”

আয়েশা খাতুন হাসলেন।তারপর হা সূচক মাথা নাড়তেই স্নিগ্ধা বলল,” তুমি কি আনোয়ার সাহেবকে আগে থেকে চিনো?”
হটাৎ এমন প্রশ্নে আয়েশা খাতুন অবাক হয়ে তাকালেন।কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললেন,” হটাৎ এই প্রশ্ন কেনো?”
” কেনো? প্রশ্নটা কি করা যায় না? তুমি ওনাকে আগে থেকে চিনো তাই না?”, স্নিগ্ধার কথায় আয়েশা খাতুন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,” হুম্, চিনি। উনার বাবা আমাকে ওনার ছেলের বউ করতে চেয়েছিল কিন্তু আমি রাজি হই নি। আমার পছন্দ হয় নি আবরার আনোয়ারকে। লোকটাকে অত্যন্ত অহংকারী মনে হয় আমার।”
মায়ের মুখে এই কথা শুনে স্নিগ্ধার এখন ফাহাদের প্রতিটা কথা সত্যি বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু পরক্ষনেই মনে প্রশ্ন জাগলো সে দেরী না করে বললো,” তাহলে তুমি আমাকে এই বাড়িতে বিয়ে দিয়েছো কেনো?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

” আবরার আনোয়ার লোকটা যেমনই হোক।ওনার বাবা অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আদিলের মধ্যে সেসব গুন আছে আর লোকলজ্জা তো ছিলো বটেই। কিন্তু হটাৎ এমন প্রশ্ন কেনো? আদিলকে তোর পছন্দ না?”, চিন্তিত মুখে তাকালেন আয়েশা খাতুন।
স্নিগ্ধা শেষ প্রশ্নটা চুপ করে রইলো কিছু বললো না। প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো,” এইসব বাদ দেও। স্পৃহা কেমন আছে?”

” ভালোই আছে। কিন্তু দিন দিন মেয়েটা আরো খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। কি যে করবো বুঝতে পারি না।” বলেই চিন্তিত হয়ে ভাবলেন তারপর বললেন,” ও ভালো কথা। এই জিম ছেলেটা কেমন বলতো?”
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” জিম কেমন মানে? হটাৎ জিম কেমন এইটা জানতে চাচ্ছো কেনো?”
আয়েশা খাতুন ভঙ্গিমা না করে বললেন,” স্পৃহার ফোনে দেখলাম বার বার খালি একটা নাম্বার থেকে কল করছিলো।”

স্নিগ্ধা হা করে বললো,” স্পৃহাকে যে জিম কল করছিলো তুমি কি করে জানলে?”
” ওর ফোনটা আমার কাছেই ছিলো। দুইদিন কমপক্ষে তিরিশটা কল দিয়েছে। এই নাম্বারটা আবার কয়েকদিন আগে স্পৃহা আমাকে দিয়েছিল যে নাম্বারটা নাকি ওকে ডিস্টার্ব করছিলো।”, আয়েশা খাতুনের কোথায় স্নিগ্ধা অবাক হয়ে বললো,” জিম স্পৃহাকে ডিস্টার্ব করছিলো?”
” হ্যা, সে তো আমাকে এই নাম্বার দিয়ে বলেছে তাকে এই ছেলে ডিস্টার্ব করে। ভাবছি আজ যখন এসেছি সরাসরি জিজ্ঞেস করবো।” স্নিগ্ধা মাকে থামাতে বললো,” না না একদম না। তুমি কিছু করো না আমি কথা বলবো।”
আয়েশা খাতুন জিমকে আর কিছু বললেন না। শুধু যাওয়ার সময় ছেলেটার দিকে তাকালেন। আয়েশা খাতুনকে জিম বরাবরই বেশ ভয় পেয়ে এসেছে। হটাৎ তার এমন তীক্ষ্ণ চাওনিতে সে যেনো দম আটকে মরেই যাচ্ছিলো।

আদিল রুমে ঢুকতেই স্নিগ্ধা বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো।স্নিগ্ধাকে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে দেখেই আদিল এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধার হাত ধরে আটকে দিয়ে বললো,” দাড়াও,কোথায় যাচ্ছো?”
স্নিগ্ধার আদিলের হাত সরিয়ে দিয়ে বললো,” অভ্রর রুমে যাচ্ছি। আমি সেখানেই থাকবো।”
আদিল নিশ্চুপে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো,” কেনো আমার রুমে থাকা যায় না?”

” অবশ্যই,যদি আপনার প্রয়োজন হয় তাহলে তো আমি না চাইলেও আপনি আমাকে জোর করবেন। কি ঠিক বলিনি? বলুন, আবরার ফাইয়াজ আজ রাতে কি আপনার আমাকে প্রয়োজন?”, তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো স্নিগ্ধা।
আদিলের দৃষ্টি আরো কঠিন হলো। স্নিগ্ধার কথার ইঙ্গিত সে ঠিকই বুঝেছে। স্নিগ্ধা তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলো কিন্তু আদিল স্নিগ্ধাকে শক্ত করে ধরে কোলে তুলে নিলো। হটাৎ আদিলের এমন কাণ্ডে স্নিগ্ধা হকচকিয়ে তাকালো। আদিলের চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। স্নিগ্ধা হাত পা ছুরে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই আদিলের বাঁধন আরো শক্ত হলো।

স্নিগ্ধাকে এনে বিছানায় বসাতেই স্নিগ্ধা বিস্ফোরিত কণ্ঠে বললো,” একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেন না। আমি কি এতটাই তুচ্ছ যে আপনার যখন যা ইচ্ছে তাই করবেন আমার সাথে। আমার জীবনটা তো নাটকীয়তায় ভরিয়ে দিয়েছেন। আমি চুপ থেকেছি তাই বলে আপনার যা ইচ্ছে আপনি তাই করবেন?”
স্নিগ্ধার কথা যেনো আদিলের কর্ণপাত হলো না সে স্থির দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে থেকে স্নিগ্ধার আরো কাছে এগিয়ে এলো। স্নিগ্ধার কঠিন দৃষ্টি আস্তে আসতে ভীত হয়ে গেলো।চোখ নামিয়ে সে পিছিয়ে যেতেই আদিল স্নিগ্ধার হাতের বাহু ধরে একদম টেনে নিজের সামনে নিয়ে এলো। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
আদিল স্নিগ্ধার মুখ বরাবর এসে কঠিন গলায় বললো,” তুমি যদি তুচ্ছ হতে তাহলে তোমাকে খোজার জন্যে আমি এতোটা পাগলামি করতাম না। তোমার অনুপস্থিতে আমার কি অবস্থা হয়েছিলো সবটাই তোমার অজানা। হতে পারে তোমার আমার দেখা হয়েছে কোনো এক ভুল সকালে কিন্তু আমি যে সেদিন ঠিক মানুষটিকে বেছে নিয়েছি সেটা আমি জানি। নয়তো আবরার ফাইয়াজ কেনো এক দিনের পরিচয়ে একটি মেয়েকে বিয়ে করেছে? সেটা তুমি কখনই বুঝতে পারবে না।কারণ এটা বোঝার ক্ষমতা তোমার নেই।” বলেই আদিল স্নিগ্ধার হাত ছেড়ে দিলো তারপর সরে গেলো।

স্নিগ্ধা হতবাক হয়ে বসে রইলো। প্রতিটি কথা যেনো তার কানে বাজছে। স্নিগ্ধা চুপচাপ আদিলের প্রতিটি কাজ পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।
আদিল স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে পড়তেই বললো,” আর কতক্ষন এইভাবে বসে থাকবে? তুমি নিশ্চই চাও না যে আমি উঠে এসে তোমাকে শুইয়ে দেই। তখন তো আবার বলবে তোমার উপর জোড় খাটাচ্ছি। এই রূমের বাইরে তোমার যাওয়া হবে না তাই শুয়ে পরো।”

স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার আদিলের তাকালো তারপর আদিলের দিকে পিঠ করে শুয়ে পড়লো। ঘরের বাতি নিভে গেলো। জ্বলে রইলো টেবিলের এক কোণে আধো আলোর একটি টেবিল ল্যাম্প। স্নিগ্ধা এক মনে সেইদিকেই তাকিয়ে রইলো। মনে এখনো তার ক্ষোভ। সবসময় লোকটা শুধু তার উপর হুকুমই করে গেলো।
আদিল ঘাড় ঘুরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে রইলো। এতক্ষনে কি ঘুমিয়ে পড়েছে স্নিগ্ধা? আদিল চুপ থেকে হটাৎ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,” আমার জীবনে তোমার প্রয়োজন আমার শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত থাকবে।” বলেই আদিল নিশব্দে নিশ্বাস ফেললো।

স্নিগ্ধার বুকের ভিতরটা অস্থির হয়ে গেলো।আদিলের কথাগুলো সে টেবিল ল্যাম্পের ওই আবছা আলোর মতোই শুনেছে কিন্তু কথাগুলো সাজিয়ে উঠতেই তার আবার সেই আগের অনুভূতিগুলো অনুভব হচ্ছে। এতোক্ষণ আদিল তার এতো কাছে থাকার ফলেও নিজের মধ্যে সে কোনো অনুভূতির সৃষ্টি পায়নি কিন্তু শেষ কথাটি যেনো তার মনের মধ্যে লুকায়িত কোনো এক নাম না জানা অনুভূতি নামক ফুলটির সৌরভ ছড়িয়ে দিলো। স্নিগ্ধার আদিলের চোখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে হলো কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে সে ইচ্ছেকে প্রশ্রয় দেবার সাহস যে তার নেই।

স্নিগ্ধা আনোয়ার সাহেবের সামনে বসে আছে। অন্যদিনের মতো লোকটা আজও হাসিখুশি কিন্তু স্নিগ্ধা চুপচাপ, সে বাধ্য হয়েই লোকটির সামনে বসে আছে। নিজেকে সংযত রাখার সম্পূর্ন চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। লোকটাকে সরাসরি প্রশ্ন করতে মন চাইছে বার বার। কিন্তু সে সব সম্ভব নয়। স্নিগ্ধা চুপ করে নির্বিকার ভঙ্গিতে লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে আনোয়ার সাহেবের কথায় চোখের পাতা ফেলছে।

আনোয়ার সাহেব স্নিগ্ধার এই মৌনতা লক্ষ্য করেছে। মেয়েটি চুপচাপ কিন্তু ঠিক এতটা চুপচাপ তাকে এর আগে কখনো দেখেনি সে। হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার কারণে মেয়েটি মানসিক ভাবে একটু ডিস্টার্ব আছে। তবুও স্নিগ্ধার আচরণ খুব অদ্ভুত লাগছে তার কাছে। যেই দৃষ্টিতে স্নিগ্ধা তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টিতে আজও একজন তাকে দেখে প্রতিনিয়ত। আনোয়ার সাহেবের ভয় হলো কিছুটা। ফাহাদ কি কোনোভাবে স্নিগ্ধাকে সবটা বলে দিয়েছে?
ফাহাদকে আরোহীর জীবন থেকে সরাতে সে অনেক কিছু করেছে ঠিকই কিন্তু তার ফল সে পেয়েছে। আরোহীকে সে একেবারেই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু আদিল এইসবের কিছুই জানে না। জানলে হয়তো কোনদিন আনোয়ার সাহেবের মুখ দেখবে না সে। ছেলেকে হারানোর ভয়ে সে প্রচুর মিথ্যে বলেছে কিন্তু দিন দিন সেই ভয় তাকে গ্রাস করছে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩০

আদিল সেই সময় দেশের বাইরে পড়াশোনায় ব্যাস্ত। আরোহীর মৃত্যুর সংবাদে সে দেশে ফিরে। তখন অভ্র ছয় মাসের শিশু। লোকলজ্জার ভয়ে আরোহীর বিয়ে ও সন্তান দুটো বিষয় গোপন রাখেন তিনি। আদিলের কাছে সে সবটা মিথ্যে বলে, ফাহাদ জানতে পারলে অভ্রকে মেরে ফেলবে এই ভয় আদিলের মনে ঢুকিয়ে দেয়। মিথ্যে বলার আরো একটি বড় কারণ ছিল মিডিয়াতে আবারার পরিবারের মান সম্মান রক্ষা।
কিন্তু বোন হারিয়ে আদিল প্রতিশোধের এমন নেশায় মেতে উঠবে সেসব আনোয়ার সাহেবের আন্দাজের বাহিরে ছিলো। নিজের বিছানো জালে যেনো এক এক করে তিনি নিজেই আটকা পরে যাচ্ছেন।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩২