রংধনুর স্নিগ্ধতা শেষ পর্ব 

রংধনুর স্নিগ্ধতা শেষ পর্ব 
নবনী নীলা

স্নিগ্ধাদের বাড়ি আত্মীয় স্বজনে হৈ হৈ করছে। দুপুরের পর বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে। স্পৃহাকে তৈরি করতে করতে স্নিগ্ধা শাড়িটাও বদলাতে পারেনি এখনো। স্পৃহাকে সাজিয়ে দিয়ে রুমে এসে গোসল সেরে বের হলো মাত্র। ভিজে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে রেখে সুন্দর করে শাড়িটা পড়ে নিলো। ঠোঁটে সুন্দর করে লিপস্টিক দিতেই হটাৎ দরজা বন্ধের আওয়াজ পেয়ে পিছনে ঘুরে তাকালো স্নিগ্ধা।
পিছনে ঘুরতেই আদিলের চোখে চোখ পড়লো। পাঞ্জাবিতে আদিলকে এতো সুন্দর লাগে জানা ছিল না স্নিগ্ধার। এর আগে লোকটাকে পাঞ্জাবিতে কখনো দেখেনি সে। স্নিগ্ধা কিছুক্ষন তাকাতেই বুঝতে পারলো আদিলও তার মতনই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা চোখ নামিয়ে এদিক সেদিক তাকালো তারপর বললো,” কি! ব্যাপার আপনি হটাৎ দরজা বন্ধ করলেন কেনো?”

আদিল দরজায় হেলান দিয়ে বুকের কাছে হাত গুজে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর বললো,”কেনো বন্ধ করেছি বুঝতে পারছো না?” বলেই মৃদু হাসলো সে।
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর হাতের লিপস্টিকটা টেবিলে রেখে এগিয়ে এসে আদিলের সামনে দাড়ালো। তারপর কঠিন গলায় বললো,”বাড়ি ভর্তি মানুষ কেউ যদি দেখে এইভাবে দরজা লাগানো তাহলে কি ভাববে? আর তা ছাড়া কারোর কোনো প্রয়োজন হলেও তো ডাকতে পারবে না আমাকে।” শাসিয়ে বললো স্নিগ্ধা।
আদিল হাত বাড়িয়ে স্নিগ্ধার বাহু ধরে দরজা সামনে এনে দাড় করিয়ে দরজার দুপাশে হাত রেখে এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে দেখতে দেখতে বললো,” সবার প্রয়োজনের কথা ভাবছো আর আমারটা? আমারও যে তোমাকে প্রয়োজন।” বলতে বলতে স্নিগ্ধার মুখের সামনের এলোমেলো চুল কানের পাশে গুজে দিলো। স্নিগ্ধা ভরকে গিয়ে তাকালো কিছু বলার আগেই দরজায় মুনিয়া নক করলো। মুনিয়া স্নিগ্ধার ছোটখালার মেয়ে। দরজার আওয়াজে স্নিগ্ধা হুরমুড়িয়ে দরজা খুলতে যাবে তার আগেই আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে নিজের কাছে নিয়ে এলো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে বললো,” কি করছেন কি? ছাড়ুন। ডাকছে তো আমাকে।”
আদিল স্নিগ্ধার গলায় মুখ ডুবিয়ে দিতেই স্নিগ্ধার নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করলো। শিউরে উঠে আদিলকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেও পড়লো না। মুনিয়া আরো শব্দ করে দরজা ধাক্কা দিতে দিতে বললো,” আপু তাড়াতাড়ি দরজা খুলো। খালা তোমাকে ডাকছে।”
মুনিয়ার কথায় স্নিগ্ধা হুড়মুড়িয়ে কয়েক পা সরে গেল। তারপর দরজা অল্প একটু খুলে মুখটা বের করতেই মুনিয়া রেগে গিয়ে বললো,” কোথায় ছিলে? তোমাকে ডাকতে ডাকতে তো গলা ভেঙে ফেললাম।”

স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে বললো,” তুই নিচে যা। আমি আসছি।” বলেই দরজা চাপিয়ে দিয়ে বুকে হাত রাখলো। ভাগ্যিস মা খালা কেউ আসেনি। স্নিগ্ধা যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু সামনে তাকাতেই আদিলের রাগান্বিত চেহারা দেখে বেশ মায়া লাগলো স্নিগ্ধার। দুদিন এত ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে যে, যখনই আদিল কথা বলতে এসেছে কিংবা কথা বলতে চেয়েছে তখন কেউ না কেউ কাবাবে হাড্ডি হয়েছে।
স্নিগ্ধা ঠোঁট চেপে হাসি থামতেই আদিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। স্নিগ্ধা পা টিপে টিপে আদিলের সামনে এসে বললো,” আপনার সাথে আমার কথা আছে একটু এইদিকে আসুন।”

আদিল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,” আমার সাথে কথা বলতে হবে না। তুমি যাও। তোমাকে ডেকে ডেকে সবাই গলা শুকিয়ে ফেলছে।” বলেই তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” অদ্ভুত লোক তো আপনি। সবাই তো ব্যাস্ত দেখেছেন।”
আদিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বললো,” আচ্ছা। তোমার বাড়ির মেয়েরা না হয় ব্যাস্ত আর ছেলেগুলো কিসে ব্যাস্ত?” বোলেই দাতে দাত চিপলো আদিল। স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে তাকাতেই আদিল রাগে দুই হাত বুকের কাছে ভাজ করতে করতে বললো,” বখাটে একেকটা ।”

স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে বললো,” একদম আমার পরিবারে কাউকে নিয়ে আজেবাজে কিছু বলবেন না।”
আদিল আরো রেগে গিয়ে বললো,” আচ্ছা। ওরা আজে বাজে কাজ করতে পারে আমি বলতে পারবো না। ঐযে তোমার চাচাতো ভাই নাহিয়ান নাম। কখন যে ওকে মেরে হাসপাতালে পাঠাই।”
স্নিগ্ধা আরেকদফা রাগ দেখিয়ে বললো,” কি আশ্চর্য! আপনি ওকে মারবেন কেনো? কি করে ও?”

আদিল দাতে দাঁত চিপে এগিয়ে এসে বলল,” তোমার দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকে। দুদিন ধরে আমি সহ্য করছি। বাট নাও অ্যাম লুসিং মাই পেসেন্স। ইডিয়েট একটা।”
আদিলের রাগে কারণ শুনে স্নিগ্ধা ভেবাচেকা খেয়ে গেলো।চোখ পিট পিট করে তাকালো। কি করবে এইবার সে। স্নিগ্ধা একটু কেশে বললো,” শুধু তো তাকিয়েছে। এটা কোনো বড় ব্যাপার না। এত রাগ করছেন কেনো?” বলেই আদিলকে শান্ত করার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিতেই আদিল স্নিগ্ধার হাত শক্ত করে চেপে ধরে নিজের কাছে এনে বললো,” এটা কোনো ব্যাপার না? আমি ছাড়া অন্য কেউ তোমার দিকে তাকালে আমার সহ্য হয় না।” আদিল অবাক করে দিয়ে স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে আদিলের বাহু ধরে টেনে পায়ের পাতায় ভর করে আদিলের গালের অধর ছুয়ে দিলো।

তারপর কানে কানে বললো,” সহ্য না হওয়াই ভালো লক্ষণ। বুঝলেন?” বলেই ছুটে পালিয়ে যাওয়ার আগেই, আদিল স্নিগ্ধার কোমর জড়িয়ে ঝুঁকে এসে অধর দুটি মিলিয়ে দিলো। আদিলের হটাৎ কাছে চলে আসায় স্নিগ্ধা স্তম্ভিত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো। এই মুহূর্তের জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিলো না স্নিগ্ধা। কিছুক্ষন পর আদিল সরে আসতেই স্নিগ্ধা জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো আরেকটু হলে ধম বন্ধ হয়ে আসতো তার। আর আদিলকে দেখো সে হাসছে।
স্নিগ্ধা আদিলকে সরিয়ে দিয়ে বির বির করে বললো,” অসভ্য।” বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

স্নিগ্ধা অভ্রকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো অভ্র স্পৃহা আর জিমের মাঝখানে বসে আছে। বড়রা ওদের দোয়া করতে এসে যখনই মিষ্টি খাওয়াতে যাচ্ছে অভ্র মুখ হা করে বসে আছে। ফলস্বরূপ জিম আর স্পৃহা মিষ্টি নামক অত্যাচার থেকে মুক্ত। স্নিগ্ধা এক কোণে দাঁড়িয়ে অভ্রর দুষ্টুমি দেখছে। আদিল পাশে এসে বুকের কাছে হাত ভাজ করে দাড়ালো। স্নিগ্ধা আদিলের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পিছনে তাকাতেই আদিল এগিয়ে এসে স্নিগ্ধার কাছ ঘেঁষে দাড়ালো। স্নিগ্ধা অভ্রকে দেখতে দেখতে হটাৎ ফাহাদের কথা মনে পড়লো কেনো জানি। শুনেছে লোকটা নাকি উন্মাদের মতন সারাদিন কি সব বলতে থাকে। আপাদত জেলেও আছে। আদিল চেষ্টা করছে যাতে ফাহাদের শাস্তি কিছুটা কমানো যায়। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে মন ঠিক করে নিলো। এইসব ভেবে মন খারাপের দিন নয় আজকে।

বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সুন্দর করেই শেষ হলো। স্পৃহাকে গাড়িতে তুলে দেওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি সে। গাড়িটা চলতে শুরু করতেই আস্তে আস্তে তার চোখ ভেসে উঠলো কেনো জানি। জিম প্রথম স্পৃহাকে কাদতে দেখছে। তার বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। স্পৃহাকে নিয়ে তো সে পালিয়ে যাচ্ছে না যে এইভাবে কাদতে হবে। জিম হাত বাড়িয়ে স্পৃহার দিকে টিসুএগিয়ে দিল। স্পৃহা টিসুর বক্স নিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেললো।

জিম খেয়াল করলো অনেক্ষন হয়েছে কিন্তু স্পৃহা কান্না এখনো থামায় নি। তার কিছু বলা প্রয়োজন কিন্তু বলতেও ভয় লাগছে। কি না কি বলে বসবে শেষে না রেগে যায়। যাক রেগে যাওয়াটা খারাপ হবে না আর যাইহোক কান্না তো থামবে। জিম নীচু স্বরে বললো,” কান্না থামাও। কালকেই তো আবার আসবে। ”
স্পৃহা কান্নার মাঝে একবার আড় চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। জিম স্পৃহার পাশ ঘেঁষে বসতে বসতে বললো,” না মানে তোমার জন্যেই বলছি। কান্না করে তো মেকআপ নষ্ট করে ফেলছো।”

স্পৃহা এবার তীক্ষ্ণ চোখে জিমের দিকে তাকিয়ে বললো,” নষ্ট হোক। তাতে আপনার কি? আপনি কি একবারো আমাকে বলেছেন আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? তাহলে এত চিন্তা কেনো আপনার?” অভিমানী সুরে বলল স্পৃহা।
জিম ঠোঁট প্রসারিত করে একটু হাসলো তারপর বললো,” আমি বাদে সবাই তো বলেছে।”
স্পৃহা আরো চটে গিয়ে বললো,” আশ্চর্য। সবার বলা দিয়ে আমি কি করবো? আমি কি সবাইকে বিয়ে করেছি?”

জিম হাত বাড়িয়ে স্পৃহার হাতটা নিজের হাতের ভাজে রেখে বললো,” নিজের মানুষের প্রশংসা কখনো নিজের মুখে করতে হয় না। তাহলে নাকি নজর লাগে। এটা আমার মা সবসময় বলতেন। আমি কুসংস্কারে বিশ্বাস করি না ঠিকই কিন্তু মায়ের মুখ থেকে শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।”
কথাগুলো শুনে স্পৃহা বিস্ময় নিয়ে জিমের দিকে তাকালো। ভালো লাগায় কেনো জানি মনটা আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। স্পৃহা জিমের চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে চুপচাপ জিমের কাধে মাথা রাখলো। হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো,” তাহলে আমি কি করে বুঝবো? আমাকে কখন সুন্দর লাগছে? কখন খারাপ লাগছে?”

জিম দুহাতে স্পৃহার মুখটা তুলে ধরতেই স্পৃহা অবাক হয়ে তাকালো। তারপর স্পৃহাকে সম্পূর্ন অবাক করে দিয়ে স্পৃহার কপালে গভীর আবেগে অধর ছুয়ে দিয়ে বললো,” এবার বুঝেছো?”
স্পৃহার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো। বোধহয় একটু লজ্জাও পেলো সে। মুখ নামিয়ে নিয়ে হা সূচক মাথা নেড়ে পুনরায় জিমের কাধে মাথা রাখলো। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে অদ্ভুত এক ভালোলাগা নিয়ে জানালার বাইরে তাকাতেই দেখলো বিকেলের আকাশে এক রংধনু যেনো তাদের নতুন জীবনের শুভেচ্ছা জানতে দাড়িয়ে আছে। বৃষ্টি ভেজা রাস্তা গাড়িটি চলছে আপন বেগে একটি নব দম্পতিকে নিয়ে নতুন এক গল্পে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৯

অবশেষে গল্পটা শেষ হলো। যারা আমার নিয়মিত পাঠক পাঠিকা তারা ভালো করেই জানে আমি এর আগে কখনো এত অনিয়মিত হই নি। কিছু সমস্যা ছিলো বটেই তার সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা যুক্ত হয়ে মহা মুশকিলে না ফেললে হয়তো এত অনিয়মিত হতাম না। যাই হোক, গল্পটায় ইতি টানতে পেরেই আমি খুশি। গল্পের শেষটা সবার নাও ভালো লাগতে পারে। কিন্তু সত্যি বলতে গল্প কখনো শেষ হয় না। ওদের নিয়ে ১০০ পর্ব লিখাও তেমন কঠিন কিছু না তবে একঘেয়েমি তো বটেই।
গল্পটা কেমন লাগলো সবাই কমেন্ট করে জানাবেন। সবাইকে ঈদ মোবারক।