রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৭

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৭
নবনী নীলা

আদিল নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে শান্ত চোখে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো। হটাৎ আদিলের এমন দৃষ্টিতে শিউরে উঠলো স্নিগ্ধা। আদিল স্নিগ্ধার গলার দিকে ইশারা করে বললো,” এরপর তো তোমাকে ছাড়ার প্রশ্নই উঠছে না। শত রাগের পরেও এই দুই বাহুতে বেধে রাখবো তোমাকে।”
স্নিগ্ধা চোখ পিট পিট করে তাকালো। তারপর আদিলের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালো।স্নিগ্ধার রাগ করা দেখে আদিল মৃদু হাসলো। তারপর একটু ঝুঁকে এসে বললো,” আমি কারণে হলেও শুধু একদিন তোমার থেকে দূরে সরে ছিলাম। এটাই তোমার সহ্য হচ্ছে না? আর ম্যাডাম নিজে যে আমাকে এতদিন দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন?”
স্নিগ্ধা আড় চোখে তাকালো তারপর বললো,” তো? আমি করলে আপনাকেও করতে হবে নাকি?”

আদিল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,” কেনো আমি করলে কি হবে?”
স্নিগ্ধা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। তারপর বললো,” কি হবে জানি না কিন্তু আমি যা করবো আপনি সেটা করতে পারবেন না।”
আদিল স্নিগ্ধার দুইহাত তুলে নিজের এক হাতের মুঠোয় বন্ধ করতেই স্নিগ্ধা চোখ বড় বড় করে তাকালো। আদিলের ঠোঁটের হাসি দেখে সে একটু বিব্রত হয়ে তাকালো। আদিল অন্য হাত স্নিগ্ধার গালে ডুবিয়ে দিতেই শিউরে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। আদিল স্নিগ্ধার কানের কাছে মুখ এনে বললো,” ইউ নো হোয়াট? আমি যা পারি তুমিও সেটা পারো না।” বলে স্নিগ্ধার গালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতেই স্নিগ্ধা চোখ রসগোল্লার মতন করে তাকালো।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আদিলের এই হুটহাট কাছে চলে আসা যে তাকে কতটা অস্থির করে তোলে আদিল সেটা কোনোদিনও বুঝতে না পারলেও,স্নিগ্ধার বুকের ভিতরে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে সেটা শুধু স্নিগ্ধাই জানে। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসতেই স্নিগ্ধা চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো।
আদিলের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। স্নিগ্ধা ধাক্কা দিয়ে যে লোকটাকে সরিয়ে দিবে সেটাও পারছে না। হাত দুটো যে আবদ্ধ আদিলের কাছে। আদিল এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার রক্তিম গালদুটোর দিকে তাকিয়ে আছে। এক হাতে কপালের চুলগুলো পিছনে সরিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,” কি আমি যেটা করলাম পারবে তা করতে?”

স্নিগ্ধা আড় চোখে একবার তাকাতেই আদিল ফোঁস করে হেসে উঠলো। স্নিগ্ধার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এমন উপহাসের কি আছে? সে কি একবারো বলেছে পারবে না? স্নিগ্ধা একবার ভাবলো কাজটা করা যায় কিনা? ভাবতে গিয়েই হার্টবিট বেড়ে গেলো তার, কপাল ঘামতে শুরু করলো। স্নিগ্ধা সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেললো। না। না। তার দ্বারা এইসব হবে না। সে নির্ঘাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবে তখন।

আদিল ঠোঁটের হাসি থামিয়ে বললো,” আচ্ছা, আরেকটা সুযোগ দেই তোমাকে কি বলো?” বলেই আদিল স্নিগ্ধার কাছাকাছি আসতেই ফোন বেজে উঠলো তার। স্নিগ্ধা ফোনের আওয়াজে চোখ খুলে তাকালো। আদিল ফোনের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ কুচকে আছে। ফোনের স্ক্রিনে জিমের নাম ভেসে উঠেছে। আদিল একটু অবাক হয়ে বললো,” এতো রাতে জিম ফোন করেছে কেনো?” ফোনটা যে বিছানার উপর ছিলো আদিল একবারো খেয়ালই করে নি।
স্নিগ্ধা জিমের ফোনের কথা শুনে তাড়া দিয়ে বললো,” নিশ্চই দরকারে ফোন করেছে। ফোনটা ধরুন।”

আদিল এক দৃষ্টিতে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” ইউ জাস্ট স্পইল মাই মুড।”
স্নিগ্ধা কড়া চোখে তাকিয়ে বললো,” আপনি ফোনটা ধরুন নয়তো আমি ধরছি। আমাকে ছাড়ুন।”
আদিল স্নিগ্ধার শত ছোটফট করা সত্ত্বেও হাত ছাড়লো না। অন্য হাত বাড়িয়ে ফোনটা হাতে নিলো। স্নিগ্ধা অবাক হয়ে আদিলের কান্ড দেখছে। মানে তাকে লোকটা কোন মতেই ছাড়ছে না। আদিল কল রিসিভ করে স্নিগ্ধার দিকে দৃষ্টি রাখলো।

জিম ভালোই বিপাকে পরে আদিলকে কল করেছে। আয়েশা খাতুন কিছুক্ষন আগে জানিয়েছেন তিনি জিমের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে চান। জিমের বাবা মা কেউই বেচেঁ নেই। বাবা ছোট থাকতেই মারা গেছেন আর মা শেষ বয়সে কান্সারে ভুগে দুবছর আগে মারা গেলেন।থাকার মধ্যে এক মাত্র বড় বোন আছে তার। সেও আবার একজন পুলিশ। সরকারি কর্মকর্তা মানেই কয়দিন পর পর বলদি হবেই। এক বছর হলো তার বোনের সিলেটে বদলি হয়েছে। পরিবার নিয়ে সে সেখানেই আছে। বললেই নিজের বোনকে এইখানে হাজির করতে পারবে না সে।

জিম কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আয়েশা খাতুন এর সাথে তার কথা বলা প্রয়োজন কিন্তু তিনি কিছুতেই তার সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। তাকে যে জোর করবে তারও উপায় নেই। জিম কোনো উপায় না দেখে আদিলকে ফোন করলো।
সবটা শুনে আদিল হতভম্ব। কখন ঘটলো এইসব! সবটাই তার আন্দাজের বাইরে। আদিলের বিস্ময়ের সুযোগ নিয়ে স্নিগ্ধা ফট করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে বসলো। আদিল সবটা শুনে চুপ করে বসে আছে। সম্পূর্ণ বিষয়টা বুঝতে তার সময় লাগছে।ওপাশ থেকে জিম আদিলকে ডাক দিতেই আদিল বললো,” ওয়েইট এ মিনিট, আমাকে বুঝতে দাও বিষয়টা।”

পাশ থেকে স্নিগ্ধা ফোনটা আদিলের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জিমের সাথে কথা বললো। তার মায়ের এমন আবদার শুনে স্নিগ্ধা বলল,” আচ্ছা ঠিক আছে, চিন্তা করো না। আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।” বলে ফোনটা রেখে দিলো। আদিল স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো,” তোমার মা জিমের বোনের সঙ্গে দেখা করতে চায় কেনো?”
স্নিগ্ধা বেশ আগ্রহ নিয়ে আদিলকে সবটা বললো। স্পৃহা আর জিমের প্রেমের এই অবিশ্বাস্য গল্প শুনে আদিল হতবুদ্ধির মতন তাকিয়ে রইলো।
উপায় না পেয়ে গভীর রাতেই বাড়িতে ফিরতে হলো তাদের। ফরিদা আপাকে ম্যানেজ করে বাড়ির ভিতরে ঢুকে অবাক স্নিগ্ধা জিম ড্রয়িং রুমের সোফায় গা হেলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। বারান্দার অস্পষ্ট আলোয় স্নিগ্ধা আর আদিল একে ওপরের দিকে তাকালো। আদিল নীচু গলায় বললো,” তুমি উপরে যাও আমি দেখছি।”

স্নিগ্ধা উপরে এসে অবাক। স্পৃহা আর অভ্র কেউই ঘুমায়নি। এত রাতে এরা জেগে বসে আছে কেনো? অভ্র কে তো সে ঘুম পাড়িয়ে গিয়েছিল। দুষ্টুটা দেখো, জেগে বসে আছে। স্নিগ্ধাকে দেখে দুজনেই খুশিতে আত্বহারা।
স্নিগ্ধা ভ্রূ কুচকে তাকিয়ে বললো,” জেগে আছিস কেনো তোরা?”
স্পৃহা এগিয়ে এসে বললো,” আপু,মার মনে হয় রাগ পড়েছে। ”
স্নিগ্ধা একটা ভ্রূ তুলে বললো,” কি করে বুঝলি?” বলতে বলতে অভ্রর কাছে এসে বসলো সে।
স্পৃহা নিচের ঠোঁট কামড় বললো,” বাতাসে গন্ধ পাচ্ছি, বুঝলি তো?”
অভ্র ভ্রূ কুচকে কয়েকবার নিশ্বাস নিলো। তারপর বললো,” কোথায়! গন্ধ পাচ্ছি না তো।”
অভ্রর কথায় স্নিগ্ধা হেসে ফেললো। অভ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাবলো তাদের জীবনটা যেনো এইবার আকাশের রংধনুটার থেকেও বেশি সুন্দর হয়ে উঠে।

ফাহাদ হাসপাতাল থেকে পালানোর সব ব্যাবস্থা করে রেখেছে আজ রাতেই সে পালাবে। কাল সকালে তাকে কোর্টে চালান করা হবে, এর আগেই তাকে পালাতে হবে।তার লোকেরা মাল ভর্তি ট্রাক নিয়ে হাসপাতালের অপরপাশে অপেক্ষা করবে। সেই ট্রাকে করেই সীমানার বাইরে তাকে পালিয়ে যেতে হবে।
ফাহাদ সব প্রস্তুতি শেষ করেছে। নিজের লোকদের দিয়ে একটা পিস্তলের ব্যাবস্থা তার করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় রাখবে সেই জায়গা খুঁজতে ব্যাস্ত ছিলো সে। হটাৎ কারোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে ফাহাদ তার বেডের নিচে পিস্তল রেখে আবার আগের জায়গায় শুয়ে পড়লো। কোনো ভাবেই কারোর মনে সন্দেহের বীজ হতে দেওয়া যাবে না।

কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বেশ অবাক হয়ে গেলো। সে ভেবেছিল পুলিশ অফিসার হয়তো এসেছেন কিন্তু না এসেছে স্নিগ্ধা। হালকা রঙের একটা শাড়ি আছে সে।ফাহাদের ভ্রূ কুচকে গেলো। গতকাল সুনেয়রা এত হট্টগোল করার পরেও তো এরা তার সাথে দেখা করতে দেয়নি। তাহলে স্নিগ্ধা কি করে ভিতরে আসছে?
স্নিগ্ধা ফাহাদকে বেডের উপর আধসোয়া অবস্থায় বসে থাকতে দেখলো। তার ডান পায়ের ব্যান্ডেজটা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার ক্ষত এখনো সারতে অনেক দেরি।
ফাহাদের চোখে মুখে বিস্ময় দেখে স্নিগ্ধা একটু হাসলো। তারপর বললো,” এত অবাক হচ্ছেন কেনো? আমাকে দেখে! আপনি কি ভেবেছিলেন আমার সাথে আপনার আর দেখা হবে না?”
ফাহাদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাসলো। তারপর বললো,’ আমার সাথে তোমার আবার দেখা হওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।”

স্নিগ্ধা না সূচক মাথা নাড়তে নাড়তে বেডের পাশের চেয়ারে বসলো তারপর বললো,” প্রয়োজন আছে বলেই তো এসেছি। আচ্ছা কেমন আছেন এখন সেটা বলুন।”
ফাহাদ অবাক চোখে তাকালো।তারপর বললো,” একজন খুনি কেমন আছে সেটা জানবার জন্যে নিশ্চই তুমি এখানে আসোনি।”
” একটা কারণে আসিনি ঠিকই। দুটো কারণে এসেছি, তার মধ্যে আপনি ভালো আছেন কিনা সেটাও একটা কারণ।”,বলেই সুন্দর করে হাসলো স্নিগ্ধা।

ফাহাদ একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। এতো মায়াবী গলায় অনেকদিন কেউ তার ভালো থাকার কথা জিজ্ঞেস করে নি। ফাহাদ চাইলে আন্তরিকতা দেখাতে পারতো কিন্তু সে কোনো কথা বললো না। দৃষ্টি অন্যদিকে করলো। স্নিগ্ধা একটু মন খারাপ করে বললো,” ঠিক আছে। আপনি বলবেন না যখন তাহলে আমি ডক্টরের কাছ থেকেই জেনে নিবো।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৬

ফাহাদ দৃষ্টি সরালো না স্নিগ্ধার দিকে। স্নিগ্ধা ফাহাদের ব্যাবহার দেখে বুঝতেই পারছে ফাহাদ চায় সে যেনো এখন এইখান থেকে চলে যায়। কিন্তু সে উদ্দেশ্যে তো স্নিগ্ধা আসে নি। স্নিগ্ধা আবার বললো,” আমি আজকে এইখানে একটা বিশেষ কাজে এসেছি।আপনার সঙ্গে একজনের পরিচয় করিয়ে দিতে।”
কথাটা শুনে ফাহাদ একটু বিস্ময় নিয়ে তাকালো। স্নিগ্ধা হাতের ইশারায় অভ্রকে রুমের ভিতরে আসতে বললো। দরজার পিছন থেকে অভ্র ছুটে স্নিগ্ধা কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৮