রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৮

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৮
নবনী নীলা

স্নিগ্ধা হাতের ইশারায় অভ্রকে রুমের ভিতরে আসতে বললো। দরজার পিছন থেকে অভ্র ছুটে স্নিগ্ধা কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। অভ্রকে দ্বিতীয়বার দেখছে ফাহাদ। এর আগে একবার টিভিতে যখন আদিল আর স্নিগ্ধাকে নিয়ে তুমুল হইচই শুরু হয়েছিল তখন একপলক দেখেছিল এই ছোট্টপ্রাণ টিকে। লাল ফর্সা গায়ের রঙ, তার চেহারার আকর্ষণীয় বিষয়টি হলো তার রসগোল্লার মতন দীর্ঘ পল্লব বিশিষ্ট চোখ দুটি। বাচ্চাটিকে দেখে বড্ড মায়া হলো ফাহাদের। কিন্তু এই বাচ্চাটিকে সঙ্গে নিয়ে স্নিগ্ধার হটাৎ এই আগমনের কারণ তার কাছে স্পষ্ট

অভ্র তার চোখের পাতা ফেলে কয়েকবার ফাহাদের দিকে তাকালো। হয়তো সামনে বসে থাকা মানুষটির এমন বেহাল অবস্থা কেনো সেটাই বুঝবার চেষ্টা করছে। চারিপাশে এত মেশিন, ওষুধের বাজে গন্ধে ভ্রূ কুচকে এলো অভ্রর। জায়গাটা তার মোটেই পছন্দ হয় নি।
স্নিগ্ধা অভ্রর দুই বাহু ধরে তাকে ফাহাদের বেডের একপাশে বসিয়ে দিতেই অভ্র অবাক হয়ে ফাহাদের দিকে তাকালো। ফাহাদের যেনো চোখ সরছে না এই মিষ্টি চেহারা থেকে। স্নিগ্ধা ফাহাদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো তারপর বললো,” ওর সাথে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতেই আজ আমি এসেছি। মনে আছে আগের বার অভ্রর পরিচয় নিয়ে কত প্রশ্ন করেছিলেন আপনি। তাই ভাবলাম যখন আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসছি ওকে নিয়েই আসি।”
ফাহাদ অভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকালো তারপর বললো,” তোমার এইখানে আসা ঠিক হয় নি। আবরার ফাইয়াজ যদি জানতে পারে কি হবে বুঝতে পারছো?”
স্নিগ্ধার মুখের মলিন হাসিটা আগের জায়গায় রেখে বললো,” আমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি যা করছি বুঝে শুনেই করছি। আমি তো পাখি না যে আমাকে খাচায় বন্ধি করে রাখা হবে। ব্যাক্তিসাধীনতা আমারো আছে।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ফাহাদ স্নিগ্ধার কথায় নিরবে কিছুটা উপহাস করেই হাসলো। অভ্র রুমটা দেখতে ব্যাস্ত, বড়দের কথা শুনার মধ্যে তার বিশেষ কোনো আগ্রহ কোনো কালেই ছিলো না। ওরা এমন জটিল জটিল কথা বলে যেগুলা তার জন্যে বোঝা কঠিন।
স্নিগ্ধা ফাহাদের উপহাস গায়ে মাখলো না। আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো,” আচ্ছা। আরোহীর যে ডায়রি লেখার অভ্যাস ছিলো। আপনি সেটা জানেন?”
হটাৎ আরোহীর প্রসঙ্গে কেমন থমথমে হয়ে গেলো ফাহাদের চেহারা। তার চোখের ভাষা বোঝা কঠিন। ফাহাদের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে স্নিগ্ধার আবার বললো,” আপনি কি কখনো পড়ে দেখেছেন তার ডায়রিগুলো?”

স্নিগ্ধার এই প্রশ্নে ফাহাদ মুখ খুললো। হাসপাতালের জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। অন্যমনস্ক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে বললো,” নাহ, ও আমাকে কখনোই ওর ডায়রি পড়তে দিতো না। এমনকি আমি ওকে না জানিয়ে ডায়রি পড়বো ভেবে সবসময় লুকিয়ে রাখতো।”
স্নিগ্ধা তার সাইড কাধের বাদামি রঙের ব্যাগটা থেকে একটা ডায়রি বের করে ফাহাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,” আপনার জন্যে আমি ওনার একটা ডায়রি নিয়ে এসেছি। এটা আপনি রাখুন।” বলেই ডায়রিটা ফাহাদের বালিশের পাশে রেখে উঠে দাড়ালো স্নিগ্ধা।
ফাহাদ বিস্ময় নিয়ে স্নিগ্ধার দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা অভ্রকে কোলে নিতে নিতে বলল,” শুনেছি আপনাকে নাকি সকালে নিয়ে যাবে। আমি আর অভ্র কাল আবার আসবো আপনাকে দেখতে। চললাম, ভালো থাকবেন।”

ফাহাদ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, স্নিগ্ধা নামের মেয়েটির দিকে। কি চায় সে? আরোহীর এই ডায়রি এত বছর পর তাকে দেওয়ার মানে কি? তার পক্ষে কি সম্ভব আরোহীর এই ডায়রি পড়া? কত আবেগ জড়িয়ে আছে এই ডায়রির প্রতিটা পাতায় পাতায়। সে কি সহ্য করতে পারবে? স্নিগ্ধাকে থামাতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ফাহাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,” বাচ্চাটির পরিচয় দিয়ে গেলে না?”
স্নিগ্ধা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বললো,” ওর পরিচয় আমি নয় ওই ডায়রিটা যার সে নিজেই আপনাকে দিবে।”
স্নিগ্ধার শেষ কথাটি ফাহাদকে চিন্তার গভীর সাগরে ভাসিয়ে দিলো। বুকের ভিতরে হটাৎ যন্ত্রণা শুরু হলো যেনো। আরোহীর ডায়রিটা হাতে নেওয়ার পর অদৃশ্য এই ব্যাথা যেনো আরো তীব্র হয়ে উঠলো।

স্নিগ্ধা বের হতেই দেখলো আদিল বাইরে চিন্তিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। স্নিগ্ধা আর অভ্ররকে দেখে যেনো তার প্রাণ ফিরে এলো। চোখ বন্ধ করে সস্থির নিশ্বাস ফেললো সে। স্নিগ্ধা এগিয়ে এসে বলল,” আপনি এতক্ষন এইখানেই দাড়িয়ে ছিলেন?”
আদিল অভ্রকে নিজের কোলে নিয়ে বললো,” না দাড়িয়ে থেকে উপায় আছে? যে পুলিশ অফিসারকে মারতে পারে তার দ্বারা সবই সম্ভব। হাসপাতালে পর্যন্ত পিস্তল নিয়ে ঘুরছে? আমাকে তো তুমি যেতেই দিলে না, চিন্তা হবে না?”
” আপনি গেলে আরো সমস্যা বাড়তো। হয়তো ক্ষিপ্ত হয়ে উল্টো পাল্টা কিছু করে বসতো।”, বলেই উদাস চোখে তাকালো আদিলের দিকে। আদিল এগিয়ে এসে আদুরে হাতে স্নিগ্ধার গাল তুলে ধরে বললো,” কি হয়েছে? এত ভয় পাচ্ছো কেনো?”

স্নিগ্ধার চোখে একটু পানি ভেসে উঠতেই সে বললো,” কেমন অস্থির লাগছে আমার।”
আদিল স্নিগ্ধার গাল থেকে হাত নামালো। তারপর গাড়ির দরজা খুলে অভ্রকে পিছনের সিটে বসিয়ে দিয়ে বললো,” চুপ করে বসে থাকো আমি আসছি।”
অভ্র ঠোঁট চেপে হেসে না সূচক মাথা নাড়ল।আদিল অবাক হয়ে তাকাতেই অভ্র বললো,” চকলেট দিলে চুপ থাকবো।”
আদিল আর পারে না এই দুষ্টুটাকে নিয়ে। পকেট থেকে একটা চকলেট অভ্রর হাতে দিয়ে বলল,” ওকে তাহলে ডিল রইলো।”
অভ্র খপ করে চকলেট টা হাতে নিয়ে সুন্দর করে হাসলো। তারপর বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বললো,” ডিল।”

স্নিগ্ধা নিজের মুখে ফাহাদকে অভ্রর কথা বলতে চায় নি। তার পক্ষে এই কথা বলা সম্ভব নয়। সে কি করে এতো বড় সত্যি ফাহাদের সামনে আনবে। সত্যটা জেনে কি অবস্থা হবে তার? যদি অভ্রকে কেড়ে নিতে চায় তখন। এখন ভয়টা আরো বাড়ছে স্নিগ্ধার। নিজের সন্তানের অস্তিত্বের কথা যে জানতোই না আজ হটাৎ এই সত্যটা তার সামনে এলে যে কোনো কিছুই সম্ভব ছিলো তার পক্ষে।
তাই ইচ্ছে করেই সে আরোহীর ডায়রিটা নিয়ে গিয়েছিল। ফাহাদকে হটাৎ একদিন চমকে দিবে বলে যেই মানুষটির কতো আশা করে ছিলো তার সেই আশা কি করে ভাঙবে সে?
থাক না, সম্পূর্ন বাস্তবে না হলেও অন্তত অভ্রর কথাটা ফাহাদ আরোহীর কাছ থেকেই শুনে, আরোহীর অপেক্ষার ইচ্ছা পূরণ হোক।

চোখ ভিজে এলো স্নিগ্ধার, মনে পড়ে গেলো লাইনটা,” চাইলে এখন মধ্যরাতে ফাহাদের ঘুম ভাঙিয়ে তাকে আমি অন্য এক ভালোলাগার স্বাদ দিতে পারি কিন্তু আজ না। আমি অপেক্ষায় আছি কারণ।সামনে ফাহাদের জন্মদিন।” স্নিগ্ধার চোখ বেয়ে কয়েকফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়তেই হটাৎ কারোর উষ্ণ বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করলো সে। আদিল তাকে নিজের বুকে এনে দুই বাহুতে জড়িয়ে নিয়েছে। রাতের শহরের এই রাস্তায় হটাৎ আদিলের এতো কাছাকাছি এসে দূরে সরতে চাইলো সে। কিন্তু আদিল বাঁধন খুললো না। স্নিগ্ধার ও কেনো জানি সরতে ইচ্ছে হলো না। মিশে থাকতে ইচ্ছে হলো। হারানোর ভয়টা তার মাঝে এ কয়দিনে এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে। প্রতি মুহূর্তেই প্রিয় মানুষগুলোকে হারানোর ভয়ে সে কেপে কেপে উঠে।

তাই শহরের ব্যাস্ত রাস্তার কোলাহলের ভিড়ে এই মানুষটিকে আকড়ে ধরতে দ্বিধা করলো না সে। প্রকৃতি ও যেনো আজ এই একান্ত মুহূর্তে নিজের রূপে সেজে উঠলো। বাতাসে গাছের নতুন পাতা যেনো গান গাইতে লাগলো। কোলাহলের এই শহরে স্নিগ্ধতা এনে দিলো ঝুম বৃষ্টি। মানুষ ছুটছে নিজেদের আশ্রয়ে কিন্তু শহরের বুকে থমকে আছে দুটি মানুষ। কারণ এদের আশ্রয় এরা দুজনেই।
ফাহাদ অবাক হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ঝড় তার মনকে আরো অস্থির করে তুলেছে। আরোহীর ডায়রি হাতে সে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। পাতা উল্টোনোর সাহস নেই তার। আজ নিজেকে বড় ভীতু মনে হচ্ছে। মনকে সামলে নিয়ে সে ডায়রি পড়তে শুরু করলো। সেই হাতের লেখা, সেই সুগন্ধ প্রতিটা জিনিসই যেনো তাকে আরোহীর অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে।

বাড়ি ফিরে একটু অসস্থির মধ্যে পড়তে হলো স্নিগ্ধা আর আদিলকে। দুজনেই ভিজে একাকার। সবাই কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। স্নিগ্ধার মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তারপর বললেন,” জলদি কাপড় চোপড় বদলে নাও। এই মৌসুমে ঠান্ডা লাগিয়ে বসবে না যেনো” বলেই তিনি চলে গেলেন। কি হয়েছে? কেন ভিজেছে কিছুই জানতে চাইলেন না। এতে ওরা দুজনেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
অভ্রকে দেখেই বিষয়টি তিনি আন্দাজ করতে পারলেন। অভ্রর গায়ে এক ফোটা বৃষ্টির জল পড়েনি আর সঙ্গে গাড়ি থাকার পরও দুটি মানুষ এইভাবে ভিজে একাকার হয়ে এসেছে তার মানে বোঝাটা খুব কঠিন কিছু না।

আয়শা খাতুন ওদের হাফ ছেড়ে বাঁচতে দিলেও স্পৃহা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অভ্র একটুও ভিজলো না আর এইদিকে এরা দুজন এক সমুদ্র পানিতে যেনো ডুব দিয়ে উঠেছে। স্পৃহা অভ্রর পাশে বসতে বসতে বললো,” তোমরা ভিজলে কি করে?”
স্নিগ্ধা যেনো প্রশ্নটা শুনতে পেলো না। তড়িঘড়ি করে সিড়ি বেয়ে রুমে চলে গেলো। স্পৃহা অভ্রকে টেনে কাছে নিয়ে বললো,” কি করে ভিজলো বলতো?”
অভ্র ভ্রু কুঁচকে বললো,” বৃষ্টিতে!”
স্পৃহা আড় চোখে তাকিয়ে বললো,” বৃষ্টিতে ভিজেছে সেটা আমিও দেখতে পাচ্ছি। কি করে ভিজলো সেটা বল।”

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৭

অভ্র না সূচক মাথা নাড়তেই স্পৃহা ভ্রূ কুচকে বললো,” ও আচ্ছা। তার মানে তুই সব জানিস?” অভ্র আবার হা সূচক মাথা নাড়লো।
স্পৃহা অভ্রকে কোলে বসিয়ে আদর করে বললো,” আমাকে কে বললে কিন্তু চকলেট দিবো।”
চকলেটের কথা শুনে অভ্র মিটমিটিয়ে হাসলো তারপর এক লাফ দিয়ে স্পৃহার কোল থেকে নেমে গিয়ে বললো,” আমি বলবো না।” বলেই দৌড়ে আদিলের কাছে চলে গেলো। আদিল স্পৃহার কঠিন মুখটা দেখে হেসে ফেললো। মুখ বন্ধ রাখার জন্যে বেশ কিছু চকলেট আগেই সে অভ্রকে দিয়ে রেখেছে।

রংধনুর স্নিগ্ধতা পর্ব ৩৯