মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪০

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪০
সাদিয়া জাহান উম্মি

ভোড় সকালে এসে ট্রেন থামলো শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে।অথৈ তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন রুদ্রিকের বুকের উষ্ণতার মাঝে।রুদ্রিকের জাগাতে ইচ্ছে করছে না অথৈকে।মেয়েটা কি সুন্দর লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে ওর সাথে।কিন্তু কিছু করার নেই।রুদ্রিক শ্বাস ফেলল।অথৈয়ের নরম গালে আলতো করে থাপ্পড় মেরে ওকে ডাকতে লাগল,’ অথৈ?অথৈ?উঠো।আমরা এসে পরেছি।উঠো জান।’

বেশ কয়েকবার ডাকার পর অথৈয়ের ঘুম ভাঙ্গে। পিটপিট করে তাকালো।চোখ মেলে রুদ্রিকের মুখশ্রীটা নজরে আসলো ওর।ঝলমলিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেলো অথৈয়ের।এই মানুষটার মুখটা দেখলেই শান্তি শান্তি লাগে।অথৈ মুচঁকি হাসল।বিনিময়ে রুদ্রিকও ওকে হাসি উপহার দিলো।অথৈ সোজা হয়ে উঠে বসল।আড়মোরা ভাঙ্গলো।ঘুম ঘুম মুখশ্রী,ফোলা ফোলা চোখ মুখ,এলোমেলো চুলে থাকা অথৈকে ভীষণ আবেদনময়ী লাগলো রুদ্রিকের কাছে।হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেলো যেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

এই মেয়ে নির্ঘাত তাকে পাগল করে দিবে।পাগল করে দিবে কি?পাগল তো হয়েই গিয়েছে এই মেয়েটার প্রেমে পরে।সেই কবেই।এখন কবে জানি এই মেয়ের রূপের ঝলকানিতে রুদ্রিক ঝলসে ছাড়খাড় না হয়ে যায়।আড়মোড়া ভেঙ্গে অথৈ রুদ্রিকের দিকে তাকালেই। দেখতে পায় রুদ্রিকের মুগ্ধ দৃষ্টিজোড়া।মুহূর্তেই যেন শরীরটা শিরশির করে উঠল।এই লোকের চাহনী মারাত্মক।অথৈয়ের মনের ভীতরে তুফান উঠিয়ে ছাড়ে।যেন সবকিছু লন্ডভন্ড করে দেয়।অথৈ মাথা নিচু করে নিলো।কানের পিঠে এলোমেলো চুলগুলো গুজে দিয়ে।ঘুমভাঙা কণ্ঠে বলে উঠে,’ এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?বিশ্রি লাগছে বুঝি আমায় দেখতে?মুখটাও তো তেলতেলে হয়ে আছে।’

রুদ্রিক অথৈয়ের কথা শুনে ওর শক্তপোক্ত হাতটা অথৈয়ের নরম গাল ছুঁয়ে দিলো।রুদ্রিকের ছোঁয়া অনুভব করে আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো অথৈ। রুদ্রিক ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে,’ মেয়ে, তুমি যদি জানতে আমার চোখে তুমি ঠিক কতোটা সুন্দর আর আবেদনময়ী।তাহলে এই কথাগুলো কখনই বলতে না।যদি অনুভব করতে পারতে আমি তোমাকে দেখলে ঠিক কতোটা পাগল হয়ে যাই।তাহলে লজ্জায় তুমি মরেই যেতে মেয়ে।’

ইশ,এতো সুন্দর লাগে কেন লোকটার কথাগুলো?হৃদয় নাড়িয়ে দেয় অথৈয়ের।রুদ্রিকের বুকে ঝাপিয়ে পরতে ইচ্ছে করল অথৈয়ের।কিন্তু লাজুক অথৈ তো তো এটা করতেই পারবে না।তাকে যে লজ্জারা আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে ধরে।অথৈয়ের গাল ভাড়ি হয়ে আসল লজ্জায়।রুদ্রিক আরেকটু এগিয়ে যায় অথৈয়ের দিকে।বুকটা ধ্বুকপুক করছে অথৈয়ের।লোকটা এভাবে আগাচ্ছে কেন?অথৈ আঁড়চোখে তাকালো রুদ্রিকের দিকে লোকটার মাদকতা ভড়পুর দৃষ্টিজোড়া যে তার ওষ্ঠজোড়ার দিকে তা বুঝতে পেরেই ঢোক গিলল অথৈ। লোকটা কি এখন ওকে চুমু খাবে?কিন্তু এখন এই সময় কিভাবে?অবশ্য এখন কেউ নেই এখানে।সবাই ট্রেন থেকে নেমে গিয়েছে।ফ্রেস হচ্ছে।শুধু রুদ্রিক আর অথৈও রয়ে গিয়েছে।এদিকে রুদ্রিককে আগাতে দেখে অথৈ থেমে থেমে বলে,’ কি করছেন?এভাবে আগাচ্ছেন কেন?’

রুদ্রিক হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো অথৈয়ের পাতলা নরম ওষ্ঠজোড়া।কেঁপে উঠল অথৈ। রুদ্রিকের শীতল কণ্ঠস্বর,’ কিস করতে ইচ্ছে করছে এখানে অথৈ। অ্যা ডিপলি কিস।’
চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো অথৈ। মানুষটা এমন সব কথা বলে যে অথৈয়ের মন চায় লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে।অথৈকে চুপ থাকতে দেখে রুদ্রিক আরেকটু ঘনিষ্ঠ হলো।মাথা ঝুকিয়ে যেই না অথৈয়ের অধরজোড়া ছুঁতে যাবে তখনই বাহির থেকে গলা খাকারি দেওয়ার শব্দ হলো।চমকে গেলো অথৈ। দ্রুত রুদ্রিকের বুকে হাত দিয়ে ওকে থামিয়ে দিলো।রুদ্রিকও নিজেকে দমিয়ে নিলো।চট জলদি সর আসল।শোনা গেলো অনিকের কণ্ঠস্বর,’ রুদ্রিক?অথৈ উঠেছে?জলদি আয়।নাস্তা খেয়েই আমরা রওনা হবো।নাহলে দেরি হয়ে যাবে।’

রুদ্রিক কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে বলে,’ হ্যা অথৈ উঠেছে।আমরা আসছি।’
‘ আচ্ছা তোরা আয়।আমি যাচ্ছি।’
‘ হুম!’
অনিক চলে গেলো।এদিকে অথৈ কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,’ অনিক ভাইয়া কি কিছু দেখেছে?এখন আমি বাহিরে যাবো কিভাবে?আমার লজ্জা লাগছে।’
রুদ্রিক ভ্রু-কুচকে ফেলল অথৈয়ের কথায়।বলে,’ কেভিনের দরজাটা চাপানো আছে।ভালোভাবে দেখে নেও।আর অনিক ভীতরে আসেনি।তো কিছু দেখবে কিভাবে?’

‘ তবুও…!’
‘ হয়েছে এতো ভাবতে হবে না আপনাকে।এখন জলদি আসুন।আপনাকে ফ্রেস করিয়ে আমিও ফ্রেস হবো।নাস্তা করা বাকি আছে।দেরি হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি আসুন।’
রুদ্রিক উঠে দাঁড়িয়ে অথৈয়ের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলো।অথৈ মুখ ফুলিয়ে রুদ্রিকের হাত ধরল।রুদ্রিকের অন্যহাতে অথৈয়ের পার্স ব্যাগ।অন্যান্য ব্যাগ অনিক, নীল ওরা নামিয়ে নিয়েছে।অথৈকে নিয়ে হাটতে হাটতে রুদ্রিক হঠাৎ বলে উঠল,’ কিস তো করতে পারলাম না ম্যাডাম।আর আরও কিছু এখনও আপনাকে দেওয়া বাকি আছে। আপনি আমাকে যা দিয়েছেন তার দশগুন তো আপনাকে ফিরিয়ে দিতেই হবে।নাহলে যে নাইনসাফি হয়ে যাবে আপনার সাথে।আফটার ওল আমি আপনার স্বামী।একবার গন্তব্যে পৌছে নেই।সুযোগ মতো সুধে আসলে আপনাকে সব ফিরিয়ে দিবো।’

রুদ্রিক কথাটা বলেই ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়ালো।তারপর হাত বাড়িয়ে দিলো অথৈয়ের দিকে।চোখের ইশারা করল ওর হাত ধরে সাবধানে ট্রেন থেকে নামতে।এদিকে অথৈ রুদ্রিকের বলা বাক্যগুলোতে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।লোকটা কিসের কথা বলছে?কিসের ইঙ্গিত দিচ্ছে ওকে?হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পরে গেলো অথৈয়ের।ও যে লোকটাকে চুমু খেয়েছে তা কি সে জেনে গিয়েছে?কিন্তু কিভাবে?মানুষটাতো তখন ঘুমিয়ে ছিলো।জানলো কিভাবে?তবে কি অভিনয় করছিলো ঘুমের?অথৈ চোখ বড়ো বড়ো করে রুদ্রিকের দিকে তাকালো।তা দেখেই রুদ্রিক অথৈকে চোখ মেরে দিলো।অথৈ যা বোঝার বুঝে ফেলল।তাজ্জব বনে গিয়েছে ও।লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে ওর।অথৈ কাঁপা গলায় বলে,’ আপ..আপনি।তার মানে আপনি তখন ঘুমান নি?অভিনয় করছিলেন?বাটপার লোক।’

রুদ্রিক ভাবলেশহীনভাবে বলে,’ আমি তো ঘুমিয়েই ছিলাম।কিন্তু ওইযে তুমি আমার বুকে ঘুমিয়ে তোমার ওই নরম শরীরটা নিয়ে যখন নড়চড় করছিলে।তখন আমার কেমন কেমন যেন লেগছিলো।আর আমার ঘুমটা ছুটে যায়।অবশ্য যা হয়েছে ভালোর জন্যেই হয়েছে। নাহলে কি আমি জানতে পারতাম কেউ একজন যে আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আমায় চুপিচুপি চুমু খায়?’

অথৈ হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে। ঠিক কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না ও।অথৈকে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এইবার তাড়া দিলো রুদ্রিক,’ অথৈ! জলদি নেমে আসো।দেরি হয়ে যাবে।’
অথৈ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুদ্রিকের হাত ধরে নেমে দাঁড়ালো। প্লাটফর্মে বেশি একটা ভিড়াভিড়ি নেই।রুদ্রিক অথৈকে নিয়েই এগিয়ে গেল প্যাসেঞ্জার ওয়েটিং সিট কর্নারে।সেখানে গিয়েই সবাইকে দেখতে পেলো।ওরা যেতেই পিহু অথৈকে উদ্দেশ্য করে বলে,’ বাহ বাহ! আজ যেই ঘুম দিয়েছিলি।মনে তো করেছিলাম আজ আর তুই উঠতে পারবি না।রুদ্রিক ভাইয়ার তোকে কোলে নিয়েই বাকি রাস্তা পার হতে হবে।’

সবাই হেসে দিলো পিহুর কথায়।রুদ্রিক অথৈয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে,’ এটা একটা ভালো বুদ্ধি। এতে আমার কোনো সমস্যা ছিলো না।আমি তো এক পায়ে রাজি।কিন্তু ম্যাডাম তো লজ্জায় একেবারে মরে যাবে।আর আমার একটা মাত্র বউ।তাকে জেনেশুনে মরতে দিতে পারি কিভাবে বলো?’
অথৈ লজ্জায় হতবাক।ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই এই লোক তাকে লজ্জা দিয়েই যাচ্ছে।এখানে যে ওর বড়ো ভাই আছে সেই খেয়াল পর্যন্ত নেই।অথৈ সবার অগোচরে রুদ্রিকের কোমড়ে চিপটি কাটলো।রুদ্রিকের এতে কোনো হেলদোল হলো না। সে এখনও হাসছে।এদিকে ইহান খুক খুক করে কেশে উঠে।নীল বলে উঠে,’ কিরে তোর আবার কি হলো?যক্ষা রোগির মতো কাশছিস কেন?’

ইহান রাগি চোখে তাকালো।সে যক্ষা রোগি?ও তো শুধু কেশে রুদ্রিককে ইঙিত দিচ্ছিলো যে সে অথৈয়ের বড়ো ভাই।আর একটু যেন সামলে কথা বলে।ইহান মারিয়াকে বলে,’ এই মারির দাঁত শোন।’
মারিয়ার নিজের নামকে এইভাবে ব্যঙ্গ করতে শুনে কটমট করে তাকালো।দাঁত খিচিয়ে বলে,,’ এই কি বললি তুই?আমি মারির দাঁত?এখন আমি তোর মারির দাঁত ঘুষিয়ে ভেঙে দিবো।’

ইহান থতমত খেয়ে যায়।সে বুঝেছে ভুলভাল বলে বলেছে।নামটা ব্যঙ্গ করা ঠিক হয়নি।অন্তত এখন নয়।নাহলে নীলকে শায়েস্তা করবে কিভাবে?ইহান বোকাসোকা হেসে বলে,’ নাহ মারিয়া তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড।তোরে আমি স্পেশালভাবে ট্রিট দিমু।এই নীলরে কষাইয়া একখান নিচে লাগা.!’
বাকিটা বলার আগেই নীল হুংকার ছুড়লো,’ ওই তুই আমার বউরে কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছিস?থাপ্পড় তো আমি তোরে দিমু।’

ইহান নীলকে পাত্তা দিলো না।সে ফের মারিয়াকে বলে,’ এই মারিয়া?দিবি নাহ?’
মারিয়া অন্যপাশে হেটে চলে যায়।যেতে যেতে বলে,’ আমি পারবো না।তোর কারনে আমি আমার সংসারে আগুন লাগাবো কেন? তোর স্পেশাল ট্রিট নিয়া তুই থাক।’
নীল মারিয়ার কথায় খুশি হয়ে ওকে দূর থেকে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিয়ে বলে,’ এই নাহলে আমার বউ।আই লাভ ইউ মাই জান।’

সবার সামনে নীল এভাবে বলায় মারিয়া লজ্জা পেলো।সিয়ার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এদিকে নীল হাসছে।
অথৈ বার বার হাম দিচ্ছে।ঘুমের রেশটা এখনো পুরোপুরি কাটেনি।চোখ লেগে আসছে আবারও।রুদ্রিক বিষয়টা বুঝতে পেরে ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করল।অথৈয়ের হাত ধরে বলে,’ ওদিকটায় চলো।হাত মুখ ধুয়ে নিবে।তাহলে ঘুমের রেশটা কেটে যাবে।ভালো লাগবে।’

অথৈ মাথা দুলিয়ে চলল রুদ্রিকের সাথে।রুদ্রিক একটা নিরিবিলি জায়গায় এনে অথৈকে ইশারা করল হাত পাততে।অথৈ মাথা নিচু করে হাত পেতে দিলো।আর রুদ্রিক বোতল থেকে পানি ঢালছে।অথৈকে ফ্রেস হতে সাহায্য করল রুদ্রিক।দূর থেকে তা দেখে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো ইহান।সত্যি রুদ্রিকের ভালোবাসা একেবারে নিখুঁত। মানুষটা যে তার বোনটাকে অনেক সুখে রাখবে তা আর বলতে নেই।

সবাই ফ্রেস হয়ে নিতেই এইবার ওরা সকালের নাস্তা সেরে নিলো।কারন আর সময় পাবে নাহ।তাই সবার না চাওয়া সত্ত্বেও নাস্তা করতে হলো।অথৈ তো খাবেই না।রুদ্রিক ওকে জোড় করে কোনোরকম অর্ধেক পরোটা আর একটা ওমলেট খাইয়েছে।খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই ওরা আবার রওনা হলো।তিনটে সি এন জি নিয়ে ওরা রওনা হলো তামাবিল সীমান্তের উদ্দেশ্যে।তামাবিল পৌছেই ওরা সবাই প্রথমেই ইমিগ্রেশনের কাজ সম্পন্ন করতে লাইন ধরে দাঁড়ালো। তারপর পুলিশের কাছ থেকে একটা বহিরাগমন কার্ড (Departure Card) সংগ্রহ করে পূরণ করে নিলো এরপর তা পাসপোর্টসহ জমা দিলো।

ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টমস অফিসে চলে গেলো এন্ট্রি করতে। এরপর ভ্রমণ করের রশিদ জমা দিলো।সেই কর ওরা আগেই জমা দিয়ে দিয়েছিলো।আর সেটার রশিদই জমা দিয়েছে। কাস্টমসের কাজ শেষ হয়ে যেতেই বিজিবি নাম এন্ট্রি করে নিলো তাদের নির্ধারিত খাতায়।

ওরা বাংলাদেশ অংশের কাজ শেষ করেই। ভারতের অংশে ঢুকে পরে।তবে তার আগে বিএসএফ পাসপোর্ট চেক করে তবেই ভিতরে প্রবেশ করতে দিয়েছে।পরে ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস অফিসে পাসপোর্ট জমা দিলো।সেখানে Arrival Card পূরণ করে ইমিগ্রেশন শেষ করে নিলো।এসব করতে করতে অনেকটা সময় কেটে গেলো।সবাই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে।বেশির ভাগ মেয়েরা।রিধি ক্লান্ত গলায় বলে,’ ভাই রে ভাই এইখানে ঘুরতে আসার আগে যে এতো কিছু করতে হয় জানলে আমি আসতাম না।পা ব্যথা হয়ে গেলো আমার।উফ!’

ইহান রিধির পাশেই দাঁড়িয়েছিল। রিধির কথা শুনে নরম গলায় বলে,’ বেশি ব্যথা করছে?’
রিধি হকচকালো।তবে তা ইহানকে বুঝতে দিলো না।মাথা দুলিয়ে বলে,’ ওই আসলে একটু একটু।’
‘ এইতো আর একটু! এখনই গাড়ি নিচ্ছি আমরা। এই রুদ্রিক?চল গাড়ি ভাড়া করে আসি।’

ইহান আর রুদ্রিক চলে গেলো গাড়ি ভাড়া করতে।তারা ট্রেভেলার নামে পরিচিত একটা গাড়ি ভাড়া করল।যেহেতু তারা বারোজন। আর এই গাড়িতে মোট পনেরো থেকে ষেলো জন মানুষ বসতে পারবে।তাই এটাই ভাড়া করল।সবাই একে একে গাড়িতে উঠে বসল।গাড়ি চলল রিসোর্টের উদ্দেশ্যে। যা রুদ্রিক আগেই বুক করে রেখেছিলো।এইটার দায়িত্ব রুদ্রিক নিয়েছিলো।গাড়ি চলছে নিজ গতিতে।

গাড়ি যতোই এগোচ্ছে।সবাই যেন মেঘালয়ের রাজ্যের প্রেমে পরে যাচ্ছে।মনে হবে কোনো এক মেঘের দেশে এসেছে ওরা। হাত বাড়ালেই মেঘ। প্রতি মুহূর্তে মেঘ, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও ঠান্ডা হওয়া এসে যেন ভিজিয়ে দেবে একনিমিষেই। যেন পুরো এলাকাকে মেঘে ঘিরে রেখেছে। প্রত্যেক পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজেও মেঘ।উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম অনিন্দ্য সুন্দর মেঘালয়।কেউ কেউ মেঘালয়কে রূপের রাজা বলে।কথাটা আসলেই ঠিক।

পাহাড়, ঝরনা আর পাহাড়ি লেক মিলে শিলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর।মেঘালয়ের শিলংয়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৫ হাজার ৬ ফুট। পাহাড়, ঝরনা আর পাহাড়ি লেক মিলে শিলং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। শুধু সৌন্দর্য নয়, মেঘালয় নামের মধ্যে রয়েছে মাহাত্ম্য। মেঘের আলয়, মানে মেঘের বসত যেখানটায়। পাহাড়ের কোলে মেঘের নিত্য খেলা আর জলপ্রপাতের গর্জনের সঙ্গে অপরূপ মেঘালয় ঘুরতে হবে সৌন্দর্য পিপাসু মন নিয়ে। এ ছাড়া খাসিয়া, গারো ও স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবনযাপন এবং সংস্কৃতি, ঐতিহ্য শিলংকে দিয়ে বাড়তি রূপ।

ওরা যাত্রা পথে মেঘালয়ের সৌন্দর্য লুফে নিলো।ওরা বুক করেছে ক্যাফে চেরাপুঞ্জি। সেখানে ওরা পাঁচটা কটেজ বুক করেছে।একটাতে অথৈ, পিহু,রিধি একসাথে।প্রিয়ান,আহিদ একসাথে।রুদ্রিক, ইহান, সাফাত একসাথে।নীল, অনিক একসাথে।সিয়া আর মারিয়া একসাথে।রুদ্রিক সবাইকে সবার কটেজ দেখিয়ে দিলো।কিন্তু বেঁকে বসল পিহু।ও ফরফর করে বলে,’ এটা হবে না ভাইয়া।আপনি আর অথৈ একটা কটেজে থাকবেন।আলাদা থাকবেন কেন?ঘুরতে এসেছেন।একত্রে নিজেদের মতো টাইম স্পেন্ড করতে না পারলে এতোদূর এসে লাভ কি?’

পিহুর এমন কথায় রুদ্রিক নিজেও লজ্জায় পরে যায়।হ্যা সে আর অথৈ স্বামী স্ত্রী।কিন্তু এখনও অথৈকে নিজের কাছে নিয়ে যায়নি রুদ্রিক।রুদ্রিক গম্ভীর স্বরে বলে,’ কিন্তু পিহু! এটা কিভাবে? ‘
‘ কিভাবে মানে?আপনি আর অথৈ স্বামী স্ত্রী।এখানে এতো আমতা আমতা করার কি আছে?’
অথৈ ফিসফিস করল,’ আরে কি বলছিস এসব?ভাইয়া এখানে আছে।আমার লজ্জা লাগছে।’
পিহু ভ্রু-কুচকে বলে,’ এখানে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু হয়নি।আন্টি নিজেই তো তোকে বলেছে।রুদ্রিক ভাইয়ার সাথে থাকতে।’

রুদ্রিক আর অথৈ দুজনেই অসস্থিতে পরে গিয়েছে।রুদ্রিক অথৈয়ের দিকে তাকিয়ে ইশারা করল।সে রাজি কিনা?অথৈ বিনিময়ে চোখের পলক ফেলে ইশারায় কি যেন বুঝালো।তা দেখে রুদ্রিক লম্বা শ্বাস ফেলল।এদিকে এমন একটা পরিস্থিতি থামানোর জন্যে ইহান আসল রুদ্রিকের কাছে।তার লজ্জা করছে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে।কিন্তু পিহু যা বলছে ঠিক বলছে।ইহান শান্ত কণ্ঠে বলে,’ তুই আর অথৈ এক কটেজে যা।আমি সাফাত আর নীল এক কটেজে থাকবো সমস্যা নেই।’

ইহানের অনুমতি পেয়ে রুদ্রিক আর কি বলবে।তাই রাজি হয়ে গেলো।আর তাছাড়া ও তো সবসময়েই চায় ও যেন অথৈয়ের কাছে থাকে। খুব কাছে।ওরা কটেজের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আরেকটা কটেজ বুক করে নিলো।এইবার রুদ্রিক,অথৈ একসাথে।রিধি আর পিহু।সাফাত আর ইহান।অনিক আর নীল। আহিদ আর প্রিয়ান। সিয়া আর মারিয়া একসাথে।এদিকে অথৈয়ের বুক ধুকপুক করছে।রুদ্রিক আর ও এক কটেজে থাকবে।এটা ভাবলেই কেমন যেন শরীরটা শিরশির করছে।এদিকে যে যার যার কটেজে চলে গিয়েছে।অথৈ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।রুদ্রিক ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বলে,’ চলো।ক্লান্ত লাগছে।ফ্রেস হয়ে একটা ঘুম দেওয়া যাবে।তারপর নাহয় আশপাশ ঘুরে দেখব।’

অথৈ মাথা দুলালো।এরপর কটেজের ভীতরে প্রবেশ করল ওরা।কটেজটা বাহির থেকে দেখতে যেমন সুন্দর।ভীতরটা দেখতে আরও সুন্দর।পুরো কটেজের ডেকোরেশন ক্রিম কালার এবং সাদা কালারের কম্বিনেশনে।রুদ্রিক বলে,’ যাও তুমি আগে ফ্রেস হয়ে আসো।’

অথৈ সম্মতি জানালো।তারপর ব্যাগ থেকে জামাকাপড় নিয়ে চলে গেলো ফ্রেস হতে।অথৈ ফ্রেস হয়ে বের হলে রুদ্রিক গেলো।এদিকে অথৈয়ের ক্লান্তিতে হাত পা ভেঙ্গে আসছে।তাই গিয়েই বিছানায় শুয়ে পরল।চোখ বন্ধ করে নানান কিছু ভাবতে লাগল।কিভাবে কি করবে?কিভাবে ঘুরবে।এসব ভাবতে ভাবতেই চোখ লেগে আসল অথৈয়ের।কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো টেরই পেলো না।

তার কিছুক্ষণ পর মাথা মুছতে মুছতে বের হয়ে আসল রুদ্রিক।এসে সবার আগে নজর চলে গেলো শুভ্র রাঙা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা এক ঘুমন্ত পরির দিকে।হাসল রুদ্রিক।ক্লান্ত হয়ে পরেছে মেয়েটা।বেলা একটা বেজে ছিচল্লিশ বাজে।লাঞ্চ করে তবেই না ঘুমোতো।যাক রুদ্রিকও আর ভাবলো না।কারন এখন বাকিরাও বোধহয় ঘুম দিয়েছে।রুদ্রিক সাত পাঁচ না ভেবে নিজেও বিছানায় শুয়ে পরল।চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল।

কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছে না।পাশে ঘুমিয়ে থাকা তার সহধর্মিণীকে বুকে জড়িয়ে নিতে ইচ্ছে করছে।না রুদ্রিক আর নিজেকে বাধা দিলো না।কেন দিবে?মেয়েটা তার স্ত্রী।অধিকার আছে তার।রুদ্রিক হাত বাড়িয়ে টেনে নিলো অথৈকে নিজের বুকের মাঝে।রুদ্রিকের গায়ের উম পেয়ে।অথৈ যেন আরও বিড়াল ছানার ন্যায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে পরেছে রুদ্রিকের বুকের মাঝে।অথৈয়ের কান্ডে রুদ্রিক হাসল।তৃপ্তির হাসি। অথৈয়ের কপালে ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শ দিয়ে তারপর চোখ বন্ধ করে নিলো।কিছুক্ষণের মাঝেই রদ্রিকও ঘুমিয়ে গিয়েছে।কাল ট্রেনেও ঠিকঠাক ঘুম হয়নি ওর।

এদিকে কটেজে এসেই পিহু অনবরত পায়চারি করছে।ও হতবাক।ওর যে কি হয়েছিলো নিজেও জানে না।আগ বাড়িয়ে ওসব বলার কি ছিলো। কিন্তু ও তো ভুল কিছু বলেনি।রুদ্রিক আর অথৈ হাজবেন্ড ওয়াইফ।ঘুরতে এসে দুজন যদি একসাথে নিজেদের মধ্যে সময় কাটাতে না পারে।তাহলে কিভাবে হয়?যা করেছে বেশ করেছে।রিধি ডেকে উঠল,’ এই পিহু।এমন ধুপধাপ শব্দ করে হাটা বন্ধ কর প্লিজ।তুই যদি না ঘুমাস এটলিস্ট আমাকে ঘুমোতে দে।এমনিতেই কাল ওই লোকটার পাশে বসার কারনে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারিনি।’

লাস্ট কথাটা বিরবির করে বলল রিধি।যা শুনতে পায়নি পিহু।তাই বলে,’ এই কি বললি তুই?’
রিধি থতমত খেয়ে বলে,’ না কিছু না।বলছিলাম যে আয় ঘুমিয়ে নেহ একটু।বিকেলের দিকে তো সবাই ঘুরতে বেড়োবে।’
পিহুও সম্মতি দিলো।আসলেই এতোক্ষণ জার্ণি করায় গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে।পিহু চলে গেলো ঘুমোতে।

সাফাতের হাশফাশ লাগছে।অথৈ আর রুদ্রিক একসাথে থাকবে।এটা ওর মানতে কষ্ট হচ্ছে। ও জানে এসব ভাবা পাপ।কিন্তু কি করবে মনকে মানাতে পারছে না।আজ হোক কাল হোক অথৈকে রুদ্রিকের কাছে যেতেই হবে।তবে তা আজ হলেই বা কি?কিন্তু বেহায়া মন মানতেই চাইছে না।সাফাত তাকালো দেখে ইহান ঘুমোচ্ছে।সবাই বোধহয় ঘুমোচ্ছে।শুধু ওর চোখেই ঘুম নেই।

বুকের মাঝে তীব্র দহন।সাফাত বের হয়ে আসল কটেজ থেকে।একটু খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে। বুক করে শ্বাস নিতে চাইলো।সাফাত বের হয়ে আশেপাশে হাটতে লাগল।তারপর একটা গাছের নিচে শিকড়ের উপর বসে পরল।দৃষ্টি তার নীবদ্ধ দূরে ওই পাহাড়গুলোর মাঝে।মন চাইছে ওই পাহাড়ে ঘণ জঙ্গলের মাঝে হারিয়ে যেতে।

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৩৯

সব কিছু ছেড়েছুড়ে একা একা গহীন বনে ঘুর ঘুর করতে।সাফাত চোখ বন্ধ করে গাছের সাথে হেলান দিয়ে দিলো।এই যন্ত্রণা, এই বুকের তীব্র দহন সে কাকে দেখাবে? হঠাৎ কর্ণকুহরে একটা মেয়েলি স্বরের রিনিঝিনি কন্ঠ শুনতে পেলো,
‘ এক্সকিউজ মি?শুনছেন?আমাকে একটু হ্যাল্প করবেন?’

মন তুমি ছুঁয়ে দেখো না পর্ব ৪১