মন বিনিময় পর্ব ১১

মন বিনিময় পর্ব ১১
তাসফিয়া হাসান তুরফা

কিছুদিন পরের কথা! আজ শুক্রবার। শাশুড়ির রুমের বিছানায় চুপটি মেরে বসে আছে রাহিতা। এ ক’দিন সব ঠিকঠাক চলছিলো, স্বপ্নিলের সাথেও রাহিতার কোনোরুপ ঝামেলা হয়নি আর। তবু হঠাৎ এ ছুটির দিনের বিকেলবেলা এভাবে কেন দিলারা বেগম তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দিহান দেখা দিলো মেয়েটাকে! মনের ভাবনার মাঝেই মুখে প্রশ্ন করে ফেললো,

—কি হয়েছে, মা? হঠাৎ এ সময় ডাকলেন যে?
—কিছু হয়নি এখনো, তবে হবে।
—মানে?
উনার কথা না বুঝায় কপালে ভাজ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো রাহিতা। তার মুখ দেখে মৃদু হেসে দিলারা বেগম বললেন,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—ওসব পরে বলছি আগে দেখ তো এই শাড়িটা কেমন লাগছে তোর?
কথা বলতে বলতেই আলমারি থেকে একটি মেরুন রঙের জামদানি বের করেন তিনি। শাড়িটা মনোযোগ দিয়ে দেখে রাহিতা। জমিনে সুতোর কাজ করা, বেশ সুন্দর ও মনোমুগ্ধকর শাড়িটা। সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস যাকে বলে। শাড়ি দেখে বিমোহিত রাহিতা মুগ্ধ গলায় বলে,

—এ তো ভীষণ সুন্দর। আপনার শাড়ি, মা?
মুচকি হেসে দিলারা বেগম মাথা নাড়েন। তিনি আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন এ সময় হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকে পড়ে সামিরা। হুট করে রুমে ঢুকে মায়ের সাথে ভাবীকে দেখে থমকে যায় সে। সেভাবেই তার নজর চলে যায় রাহিরার হাতে ধরে থাকা শাড়িটার দিকে। প্রশস্ত হেসে সে বলে,

—আরে মা, এটা তোমার সেই শাড়ি না যেটা তুমি কোনোদিন আমায় পড়তে দাওনি?
—হুম। এটা যে আমি আমার একমাত্র ছেলের বউয়ের জন্য তুলে রেখেছিলাম সেই কবে থেকে। তোকে পড়তে দিবো কেন? তোর জন্য তো অন্য শাড়ি আছেই।

—হ্যাঁ হ্যাঁ সবই তো বুঝি। এখন তো এগুলোই বলবে। কিন্তু আজ হঠাৎ এ শাড়ি বের করার বিশেষ কারণ?
মুখ ভেংচিয়ে জিজ্ঞেস করলো সামিরা। এতক্ষণ ওদের মা-মেয়ের কথা হাসতে হাসতে শুনলেও সামিরার প্রশ্নে মনোযোগী দৃষ্টিতে দিলারা বেগমের পানে তাকায় সে নিজেও। ওদের আগ্রহ দেখে তিনি এক গাল হেসে বলেন,

—আজ আমার ছেলে ও ছেলের বউ বাহিরে ঘুরতে যাবে যে। তাই তো এ আয়োজন!
—ঘুরতে যাবো মানে? কোথায়? কখন? আমি তো এ ব্যাপারে কিছুই জানিনা, মা!
বিস্ময়ের সহিত বলে উঠে রাহিতা। ওর বিস্ময়কে গায়ে না মাখিয়ে নির্বিকার ভাবে শাশুড়ি বলেন,
—আমি জানি তুই জানিস না। এমনকি স্বপ্নিল নিজেও জানেনা। আমিও আজ সকালেই ভেবেছি তোদের বাইরে কোথাও ঘুরতে পাঠাবো তাই এখন তোকে ডেকে আনলাম সেটা বলার জন্য৷
খানিক বাদে সামিরার উদ্দেশ্যে বললেন,

—এই সামু, যা তো তোর ভাইকে ডেকে আন। যে নিয়ে যাবে তাকেই তো জানানো হয়নি এখনো! ওকে না বলেই আমি এত কিছু প্ল্যান করছি! জলদি যা।
—এক্ষুনি যাচ্ছি, মা।
মায়ের কথায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্ছ্বাস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সামিরা। দশ মিনিটের মাথায় ওর সাথে রুমে প্রবেশ করে স্বপ্নিল। মায়ের দিক তাকানোর মাঝেই আড়চোখে একবার খাটে বসে থাকা রাহিতাকে দেখতে ভুলে না সে!
ওকে দেখে দিলারা বেগম গম্ভীর মুখে বলেন,

—তোকে একটা কাজ দিবো। কর‍তে পারবি তো?
—কি কাজ, মা? কেন পারবোনা? আজ পর্যন্ত তোমার দেওয়া কোনো কাজ আমি করিনি এমন হয়েছে কি?
খানিকটা অবাক সুরেই বলে উঠে স্বপ্নিল। ওকে দেখে মাথা নাড়িয়ে দিলারা বেগম পুনরায় বলেন,
—বেশ। তবে এখন তোকে একটাই কাজ দেওয়া হলো এবং সেটা হচ্ছে আজ বিকেলে তোর বউকে তোর ইচ্ছেমতো কোথাও থেকে ঘুরিয়ে আনা।

—হঠাৎ এখন? মানে আগে থেকে না বলে…
—আগে থেকে বলবো কিভাবে? আমার মাথায়ও ব্যাপারটা সকালেই এসেছে যে। পরে এ-কাজ সে-কাজের চক্করে ভুলে গেছি। নতুন নতুন বিয়ে তোদের। এ সময় তো তোর নিজে থেকে বউকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো উচিত অথচ তোর সেদিকে হুশ-ই নাই। আজ শুক্রবার, দুজনেই বাসায় আছিস। এ সুযোগে ঘুরে আয় বাহিরে থেকে। কাল থেকে তো আবার তোর অফিস ও রাহির ভার্সিটি শুরু হয়ে যাবে। তখন তো চাইলেও সুযোগ পাবিনা।

এবার মায়ের কথায় থমকে গেলো স্বপ্নিল। একিসাথে হঠাৎ মায়ের এমন আবদারে আরেকটু চমকে উঠলোও বটে। এবার সরাসরি তাকায় খানিকটা দূরে অবস্থিত রাহিতার দিকে। এতক্ষণে রাহিতাও দাঁড়িয়ে গেছে বিছানা থেকে। ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে তার নিজেরও এ বিষয়ে পূর্ব ধারণা ছিলোনা। ওদের নিশ্চুপ থাকার মাঝেই ছেলেকে ঝাকিয়ে দিলারা বেগম পুনরায় জিজ্ঞেস করেন,

—কি রে, চুপ করে আছিস কেন এভাবে? নিয়ে যাবিনা রাহি কে? কথা বলছিস না কেন, বাবা?
—আচ্ছা। আমরা যাবো, মা। এই সামু, তুইও চল!
ভাইয়ের কথায় থতমত খেয়ে গেলো সামিরা। অন্য সময় হলে সে হাসিমুখে রাজি হয়ে যেতো ঘুরতে যেতে কিন্তু বিয়ের পর ওরা এই প্রথম বেড়াতে যাচ্ছে, সেখানে ওদের সাথে ওর যাওয়াটা একদমই ঠিক হবেনা! তাইতো রসিকতার ছলে বললো,
—সরি, ভাইয়া। আজ যেতে পারবোনা তোমাদের সাথে। বিয়ের পর প্রথম ডেট তোমাদের, আমি কাবাবে হাড্ডি হতে চাইনা বাবা!

ওর এমন কথায় খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে গেলো স্বপ্নিল, লজ্জায় নতজানু হয়ে গেলো রাহিতা! এই মেয়েটা এত পেকে গেছে কিভাবে? এর মুখে কিছুই আটকায়না! বিস্ময় গিলে বোনকে চোখ রাঙিয়ে স্বপ্নিলের উত্তর,
—যাবিনা সেটা নরমালি বললেই তো হয়। এভাবে বলার কি আছে? বড় ভাইয়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে গেছিস? বেয়াদব!
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রুম ছেড়ে যেতে যেতে রাহিতার দিক এক পলক তাকিয়ে বললো,

—রেডি হও।
অতঃপর কক্ষ ত্যাগ করলো সে। স্বপ্নিল রুম ছেড়ে যেতেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো মা-মেয়ে। অস্বস্তি ঘিরে ধরলো রাহিতাকে! সেদিক চেয়ে দিলারা বেগম এগিয়ে গেলেন ওর দিকে। শাড়িটা রাহিতার গায়ে ধরে বললেন,
—এই রঙটা বেশ মানাবে তোকে। ভালো হয়েছে এ শাড়িটা আমি রেখেছিলাম তোর জন্য।
একটু থেমে বললেন,

—এই রাহি, শাড়ি কি তুই নিজে পড়বি নাকি আমি পড়িয়ে দিবো?
শাড়ি পড়ার কথা শুনতেই রাহিতার মস্তিষ্কে সেদিনের স্মৃতি খেলে গেলো যেদিন স্বপ্নিল নিজ হাতে ওর শাড়ির কুচি ঠিক করে দিয়েছিলো, মুহুর্তটি স্মৃতিচরণ হতেই রক্তিম লালিমা ছেয়ে গেলো ওর মুখশ্রীজুড়ে! আড়ষ্ট কণ্ঠে বললো,
—আপনিই পড়িয়ে দিন, মা।

ওর কথায় মুচকি হেসে নিজহাতে ওকে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন দিলারা বেগম। ছেলের বউকে মনমতো সাজিয়ে দিলেন আজ। অতঃপর সব সাজগোজ শেষে রাহিতার মুখের দিক চেয়ে মন তৃপ্ত হলো তার। মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো “মাশাআল্লাহ!” একিসাথে সামিরাও তারিফ করলো ওর রুপের।

দুজনের প্রশংসায় লাজুক হেসে ওদের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো রাহিতা। স্বপ্নিলটা এখনো রেডি হয়েছে কি না কে জানে? এতক্ষণ স্বাভাবিক থাকলেও প্রতি কদম রুমের দিক এগোতেই ওর কদমের সাথে সাথে তাল মিলিয়ে যেন বেড়েই চলেছে হৃদস্পন্দন! কেন যেন এভাবে স্বপ্নিলের সামনে যেতে প্রচুর লজ্জা পাচ্ছে আজ রাহিতা! যদিও সে জানে স্বপ্নিল এখনো তাকে বউয়ের নজরে দেখেনা, হয়তো আজও দেখবেনা। তবুও কেন বুকের মাঝে এরকম অনুভূতি হচ্ছে সেটা তার অজানা!

আজকের বিকেলের সৌন্দর্য অন্যরকম। এই যে সাদা আকাশে নীল নীল মেঘ উড়ছে, একিসাথে চলছে কিছু ডানা মেলা পাখিদের আনাগোনা। সবমিলিয়ে উপভোগ করার মতোই প্রকৃতি বটে! পাশাপাশি হাটছে স্বপ্নিল-রাহিতা। রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করে হাটার জন্য এ জায়গায় থেমেছে স্বপ্নিল। এতে অবশ্য লাভ-ই হয়েছে রাহিতার, চুপচাপ গাড়ির ভেতর ভালো লাগছিলোনা ওর! এখনো দুজনের মাঝে কথা না হলেও পরিবেশটা বেশ উপভোগ করছে সে!

পাশাপাশি হাটা হলেও হাত ধরার অবকাশ এখনো আসেনি। মনে মনে ইচ্ছেপোষণ করলেও এখনো ওতটা সহজভাবে মিশে উঠতে পারেনি দুজন একে-অপরের সাথে। তবুও দুটো চোখে কিছু না বলা কথা, কিছু আকুতি ভাসে। যা চোখে দেখা যায়না, শুধু অনুভব করা যায়।

এই যেমন রুমে ঢুকার পর আনমনেই রাহিতার দিক চোখ পড়তেই কিছুক্ষণ থমকে গিয়েছিলো স্বপ্নিল। আড়চোখে হলেও বিষয়টা খেয়াল করেছে সে, এবং মনে মনে আশা করেছিলো অন্তত বন্ধুত্বের খাতিরে হলেও তাকে কেমন লাগছে এ ব্যাপারে ভালোমন্দ কিছু বলবে স্বপ্নিল। কিন্তু মেয়েটার আশায় গুড়েবালি দিয়ে স্বপ্নিল কিছু না বলে চোখ নামিয়ে ওকে নিজের সাথে নিচে যেতে নির্দেশ দেয় শুধু। এ নিয়ে রাহিতার সামান্য মন খারাপ। কিন্তু ওর মন খারাপ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা। নিমিষেই স্বপ্নিলের আওয়াজে ঘোর কেটে গেলো ওর,

—এভাবে আকাশের দিক তাকিয়ে কি দেখছো, রাহি?
—এই যে দেখুন না, আকাশটা আজ কত্ত সুন্দর লাগছে! কি স্নিগ্ধ, কি সুন্দর! তাকিয়ে থাকতে থাকতে যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে চোখে! বলুন?
হাতের ইশারায় আকাশের দিক দেখিয়ে মুগ্ধ চোখে বলে উঠলো রাহিতা, প্রায় একিসাথে কানে এলো স্বপ্নিলের কোমল কণ্ঠস্বর,

—হুম! কিছু জিনিস এত বেশি সুন্দর যে তার থেকে চোখ ফেরানো মুশকিল হয়ে যায়!
এ প্রথম স্বপ্নিলের এক অন্যরকম কণ্ঠস্বর শুনে চকিত ভঙ্গিতে পাশ ফিরে রাহিতা। স্বপ্নিল তখনো ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো। চোখাচোখি হতেই কিছুক্ষণ পর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। সেই দৃষ্টিতে কিছু ছিলো আজ, সেই কণ্ঠস্বরে ভিন্ন কিছু ছিলো!

মন বিনিময় পর্ব ১০

যার দরুণ হঠাৎ করে রাহিতার মনে হয় স্বপ্নিল যেন এতক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো এবং কথাটা ওর উদ্দেশ্যেই বললো? কিন্তু পরক্ষণেই নিজেই নিজের ভাবনায় বেকুব হয়ে গেলো! এসব আকাশকুসুম চিন্তাভাবনাকে আর প্রশ্রয় দিলোনা সে! স্বপ্নিলের পাশাপাশি হাটতে হাটতে পুনরায় ডুবে গেলো নিজ ভাবনায়। কিন্তু একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলে সে দেখতে পারতো, তার ধারণা নেহাৎ মিথ্যে নয়। এ পুরোটা সময় স্বপ্নিল মুগ্ধ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো!

মন বিনিময় পর্ব ১২