মন বিনিময় পর্ব ৩৩

মন বিনিময় পর্ব ৩৩
তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাসায় পৌঁছে বিছানার এক কোণে এক মনমরা হয়ে বসে আছে রাহিতা। ওর মন খারাপের কারণ হলো রুমে ঢুকতেই স্বপ্নিল চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে জানিয়েছে ওর অফিসে বড়সড় ঝামেলা হয়েছে, যার ফলে ওদের ঢাকা যেতেই হবে। তাই এখনি নিজের ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিতে তাগিদ দিয়েছে সে রাহিতাকে। মন খারাপ করে রাহিতা ব্যাগ গুছাবে এমন সময় দিলারা বেগম এলেন ওদের রুমে। দুজনকে দেখে বললেন,

—তোরা কি ব্যাগ গোছানো শুরু করেছিস?
—না, মা। আমি তো মাত্রই জানালাম রাহিতাকে। এইতো গোছাবে এখনি। কেন কিছু লাগতো তোমার?
স্বপ্নিল জবাব দেয়। ওর কথায় দিলারা বেগম হাসি হাসি মুখে বলেন,
—আমি ভাবছিলাম আজ যাওয়ার দরকার নেই, স্বপ্নিল। তোর বোন তো জেদ ধরে বসে আছে আজকে থাকবেই থাকবে। আর আমিও চাইছিলাম থেকে যেতে। এতদিন পর বাপের বাড়ি এসেছি, বিয়ে শেষ না হতেই চলে যাওয়া বিষয়টা কেমন দেখায় না? তোর কি যাওয়া খুব জরুরি?
শাশুড়ির কথায় মুহুর্তে হাসির রেখা দেখা দেয় রাহিতার এতক্ষণের মেঘে ঢাকা মুখে। মনের উচ্ছ্বাস মুখে ফুটিয়ে সে নম্র স্বরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—একদম ঠিক বলেছেন, মা। আমিও যেতে চাইছিলাম না আজ। সবাই কত্ত মজা করবে এখানে আর আমরা কিনা এত জলদি ফিরে যাবো?
একটু থেমে আবার স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে বলে,
—শুনুন না, আজকে না গেলে হয়না? আমরা থেকে যাইনা প্লিজ? আপনি কিন্তু বলেছিলেন আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবেন!
মা ও বউয়ের কথায় খানিকটা বিপাকে পড়ে স্বপ্নিল। তবু সে এখন নিরুপায়, কেননা অফিসের ঝামেলাটা এবার বেশ জটিল। তার ম্যানেজার বারবার ফোন করে বলছিলো সকাল থেকে এজন্যই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া নয়তো স্বপ্নিলের নিজেরও মন চাইছিলোনা এত দ্রুত এখান থেকে যেতে। তাই মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

—এবার কোম্পানিতে একটা বড়সড় ঝামেলা হয়ে গেছে, মা। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে ম্যানেজার। তাই আমার কালকেই অফিসে যাওয়া ভীষণ প্রয়োজন। নয়তো আমার নিজেরও ইচ্ছা ছিলোনা এতদিন পর এসে এত দ্রুত চলে যেতে। কিন্তু এখন আর উপায় নেই। কি করবো বলো?
এরপর খানিকটা সময় নিয়ে কিছু একটা ভাবে স্বপ্নিল। হঠাৎ রাহিতার উদ্দেশ্যে বলে,

—এক কাজ করা যায়। আমি যেহেতু একেবারেই থাকতে পারবোনা, তাই লাঞ্চ করেই ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যাবো। কিন্তু মা ও সামিরার তো যাওয়া ইম্পর্টেন্ট নয়। ওরা যখন থাকতে চাইছে তখন থাকুক এখানে। আর তুমিও চাইলে মায়ের সাথে এখানেই থাকতে পারো। তুমি কি থাকবে?
স্বপ্নিলের কথা শুনে দিলারা বেগমও সায় দিলেন। রাহিতাকে বললেন,

—কথাটা কিন্তু খারাপ বলেনি, স্বপ্নিল। ওর যদি একান্তই যাওয়া প্রয়োজন হয় তবে ও যাক আজকে। আমরা তিনজন কয়দিন পর যাবোনি। এছাড়াও বাসায় রহিমা খালা তো আছেই। স্বপ্নিলের কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
শাশুড়ির কথা শুনে আড়চোখে একবার স্বপ্নিলের দিকে তাকালো রাহিতা। স্বপ্নিল ওর দিকেই তাকিয়ে ছিলো।

সে চোখে খানিকটা আকুতি, যেন সে চায়না রাহিতা থেকে যাক এখানে। কথায় আছে, চোখ মনের কথা বলে। সে চোখে তাকিয়েই রাহিতাও যেন ঠিক বুঝে গেলো স্বপ্নিলের মনের খবর। সিদ্ধান্ত নিলো সে চলে যাবে স্বপ্নিলের সাথে। কেননা এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলেও, স্বপ্নিলকে ছাড়া একা একা তার মন কিছুতেই বসতোনা। তাই সে নিজেও চায়না স্বপ্নিলকে একা যেতে দিতে। সবমিলিয়ে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে সে বলে,

—মা, আমিও উনার সাথে বাসায় যেতে চাইছি। আমারও ভার্সিটি শুরু হবে দু’দিন পর। চাইলেও থাকতে পারছিনা। আপনি আর সামিরা থাকুন না। কয়দিন থেকে ধীরেসুস্থে আসুন। আমি না হয় পরে আবার আসবোনি।
—কিন্তু তুই না থাকতে চাইছিলি, রাহি। হঠাৎ আবার কি হলো? এখানেই থাক আমাদের সাথে? একা একা যেয়ে কি করবি বাসায়?

—আরে মা, ও তো কাউকে তেমন চিনেই না এখানে। থেকেও কি করবে? রাহি যখন যেতেই চাইছে বাসায়, তখন যাক না আমার সাথে। সমস্যা কই? তুমি আর সামু এ কয়দিন মজা করো। ওকে আমি পরে নিয়ে আসবো।
মায়ের কথার বিপরীতে উত্তর দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা তো রাজি হয়েই গেলো, তাহলে মা এমন করছে কেন? ভেবে পেলোনা সে। অদ্ভুত! এদিকে স্বপ্নিল-রাহিতার কথা শুনে বাহিরে থেকে স্বাভাবিক থাকলেও মনে মনে হাসলেন দিলারা বেগম। দুজনের মন বিনিময়ে যে বাকি নেই বিষয়টি বুঝতে বেগ পেতে হয়না তার অভিজ্ঞ চোখের! মুখভঙ্গি স্বাভাবিক রেখে তিনি দুজনের উদ্দেশ্যে বলেন,

—আচ্ছা, তোরা দুইটাই যখন যেতে চাইছিস তাহলে এটাই হোক। আমরা মা-মেয়েই না হয় ক’দিন থেকে যাই। তোরা বাসায় যা।
মায়ের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্বপ্নিল। কথা বলে চলে যেতে লাগেন দিলারা বেগম। হঠাৎ কি মনে করে যেন থেমে গিয়ে বলেন,

—এই যে বউমা, তোমার ভরসায় ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু আমার ছেলেকে। ওর খেয়াল রেখো!
শাশুড়ির কথায় লজ্জা পেলো রাহিতা, আড়চোখে পাশে তাকিয়ে দেখে মায়ের কথা শুনে ঠোঁটে হাসি নিয়ে স্বপ্নিল তাকিয়ে আছে ঠিক তারই দিকে। মা চলে যেতেই স্বপ্নিল ভ্রু নাচিয়ে বলে,
—কি বললো তোমার শাশুড়ি শুনেছো তো? মনে থাকে যেন, মায়ের বউমা!
ওর কথা শুনে লজ্জার মাত্রা আরেকটু প্রবল হলো রাহিতার। খানিকটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে আর কোনোকিছু না বলেই দ্রুতপায়ে তাদের দুজনের ব্যাগ গুছাতে অন্যদিকে এগিয়ে গেলো সে। লাঞ্চের পর বেরোতে হবে যে!

দুজন বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেলো। ঢাকার আকাশে তখন বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব! মেঘ ডাকছে একটু পর পর। এমন সময় বাড়ির দরজা লক থাকায় চমকে গেলো স্বপ্নিল। বাসায় তো রহিমা খালাকে রেখে গিয়েছিলো তারা। হঠাৎ কোথায় গেলেন তিনি না বলে? এত বছরের বিশ্বস্ত তিনি কখনোই এমন করেন না!

এজন্যই বাসা রেখে গিয়েছিলেন তার ভরসায়। কপালে ভাজ পড়ে স্বপ্নিলের। নিজের চাবি দিয়ে গেট খুলে বাসায় ঢুকতে ঢুকতে দারোয়ানকে ডাকলো সে। রাহিতাকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়ে গেটে দাঁড়িয়ে দারোয়ানের সাথে কথা বলার জন্য দাড়ালো সে। খানিকবাদে দ্রুতপদক্ষেপে চলে এলো দারোয়ান। স্বপ্নিলকে দেখে আরেকবার সালাম দিতেই সে জিজ্ঞেস করলো রহিমা খালা কোথায় গেছেন। তাকে বলে গেছেন কিনা? স্বপ্নিলের প্রশ্নে মাথা চুলকে বোকা হেসে দারোয়ান বললো,

—আসলে স্যার, রহিমা খালা সন্ধ্যায় গ্রামে চলে গেছে। তার ভাই নাকি অনেক অসুস্থ, দেখতে গেছে। তার ফোনে ট্যাকা ছিলোনা, আমারে কইয়ে গেছিলো আপনাদের ফোন দিয়ে জানায় দিতে। বাসার চাবিও দিয়া গেছে। আমিই ফোন দিতে ভুলে গেছিলাম, মাফ করবেন।
দারোয়ানের সরল স্বীকারোক্তিতে স্বপ্নিল কি বলবে ভেবে পেলোনা। গম্ভীর মুখে শুধু বললো ‘এরপর থেকে যেন এমন না হয়’। অতঃপর দারোয়ানের থেকে চাবি নিয়ে বাসার ভেতর ঢুকলো সে নিজেও। দরজা ভালোভাবে লাগিয়ে দিয়ে উপরে চলে গেলো নিজের রুমের উদ্দেশ্যে।

মাত্রই ফ্রেশ হয়ে জামা পালটে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছিলো রাহিতা। আচমকা সে সময় কারেন্ট চলে যাওয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। ভয়ার্ত সে স্বপ্নিলকে না পেয়ে তাড়স্বরে চিৎকার করে ওঠে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ চমকে উঠে যেন পরিবেশকে আরেকটু ভ’য়ং’কর বানিয়ে দিচ্ছে রাহিতার চোখে। এ ধোয়াশা অন্ধকারে রাহিতা কোনদিক যাবে ভেবে পেলোনা, ওর মনে পড়লো স্বপ্নিল তো নিচে আছে।

এখনো হয়তো আসেনি উপরে। আর এখান থেকে তো ওর চিৎকারও শুনার কথা না! এখন কি হবে? ভয়ে-চিন্তায় জমে যায় রাহিতা। কোনোমতে অনুমান করে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যায় রুমের দরজার দিকে। আঁধার হাতড়ে কিছুটা সামনে এগোতেই নরম অথচ শক্ত কোনোকিছুর সাথে বাড়ি খায় সে। ভয়ে আবারও মৃদু স্বরে চি’ল্লি’য়ে উঠে রাহিতা। পরমুহুর্তে অনুভব করে দুটি হাত ওকে টেনে নিয়েছে নিজের দিকে। কিছুক্ষণের মাঝেই রাহিতা নিজেকে উপলব্ধি করে স্বপ্নিলের প্রশস্ত বুকে। প্রায় সাথে সাথেই স্বপ্নিলের আওয়াজ কানে আসে,

—রাহি? ভয় পেয়েছো? এটা আমি!
স্বপ্নিলের কণ্ঠে যেন প্রাণ ফিরে পায় রাহিতা। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে পড়ে থাকে ওর বুকে। রাহিতার ভয় বুঝতে পেরে ওকে সামলানোর জন্য মাথায় সযত্নে হাত বুলিয়ে দেয় স্বপ্নিল। নরম সুরে বলে,
—এই মেয়ে, ভয় পাচ্ছো কেন এত? আমি আছি তো! জেনারেটর চালু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। রিল্যাক্স! হুশ!
—আপনি কখন এসেছেন? আমার চিৎকার শুনেও আওয়াজ দেননি কেন? আমি কতটা ভয় পেয়েছি আপনি জানেন?

ধীরস্বরে বলে রাহিতা। একিসাথে ভয় ও লজ্জায় কণ্ঠ নেতিয়ে গেছে ওর। কিছুক্ষণ সেভাবেই অতিক্রম হলো। রাহিতা ভয়ে ওকে ছাড়তেও পারছেনা আবার এ প্রথম এতক্ষণ স্বপ্নিলের বুকে লেপ্টে থাকতে বেশ লজ্জা ও অস্বস্তি হচ্ছে ওর! তবে রাহিতার লজ্জা লাগলেও স্বপ্নিলকে অতটা বিচলিত হতে দেখা গেলোনা, সে বেশ নির্বিকার ও স্বাভাবিক। মিনিট পাচেক অতিক্রম হওয়ার পরেও যখন কারেন্ট এলোনা তখন দ্বিধাগ্রস্ত রাহিতা স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে বললো,

মন বিনিময় পর্ব ৩২

—আপনি না বললেন জেনারেটর চালু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে? তবে এখনো লাইট চালু হচ্ছেনা কেন?
রাহিতার প্রশ্নে স্বপ্নিলকে হাসতে দেখা গেলো। হাসির দমকে বুকটা হালকা কেপে উঠলো ওর! সে খানিকটা ঝুকে রাহিতার কানের কাছে মুখ আনলো। অতঃপর বেশ শান্ত অথচ রহস্যময় কণ্ঠে বললো,
—বাইরে বৃষ্টি। বাসায় আমরা দুজন, একা। যদি আজ ইলেক্ট্রিসিটি না আসে তাহলে?

মন বিনিময় পর্ব ৩৪