মন বিনিময় পর্ব ৩৪

মন বিনিময় পর্ব ৩৪
তাসফিয়া হাসান তুরফা

স্বপ্নিলের প্রশ্নে এক শীতল স্রোত বয়ে গেলো রাহিতার শিরদাঁড়ায়। বিস্মিত সে হতভম্বতায় ঝট করে সরে দাঁড়ায় স্বপ্নিলের বুক থেকে। রাহিতার হঠাৎ এভাবে সরে যাওয়ায় খানিকটা অবাক হয় স্বপ্নিল। ওর অগোচরেই রাহিতার বুকে দুরুদুরু হৃদকম্পন বাড়তে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস পাল্লা দিয়ে উঠানামা করে। শুষ্ক ঢোল গিলে রাহিতা ইতস্তত কণ্ঠে বলে,
—এমন কিছুই হবেনা! এক্ষুনি লাইট এসে যাবে। আমি জানি!

রাহিতার কথা বলার ধরনে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। নিশ্চুপ কক্ষে ওর হাসির শব্দে আরেকটু লজ্জা পায় মেয়েটা। তবে অন্ধকারে একে-অপরের চেহারা দেখা না যাওয়ায় কেউ কারও রিয়েকশন দেখতে পায়না। বাতাসে জানালার পর্দা সরে যায়, ক্ষী’প্ত মেঘের ঘ’র্ষ’ণে বিদ্যুৎ চমকে উঠে। সেই আলোতে এক মুহুর্তের জন্য দুজনের দৃষ্টি বিনিময় হয়। এ আবছা অন্ধকারেও দুজন অনুভব করে নিজেদের হৃদয়ে ছুটতে থাকা ভিন্ন ভিন্ন অনুভুতির জোয়ার। একজনের মনে যেখানে ভয়, লজ্জা ও উৎকণ্ঠা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সেখানে অপরজনের মনে নবপ্রেমের জোয়ার। বৃষ্টিস্নাত এ রাতে অনুভুতির সাগরে ভেসে যেতে যেন হিমশিম খাচ্ছে দুজনেই। মনের নি’ষিদ্ধ অনুভুতিগুলোকে নাড়া দিতেই প্রচণ্ড জোরে বজ্রপাতের শব্দ হয়। বিদ্যুতের ঝলকানিতে যেমন এক মুহুর্তের জন্য চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠে, ঠিক তেমনি বিকট গর্জনে ভয় পেয়ে পুনরায় স্বপ্নিলের কাছে যেতে বাধ্য হয় রাহিতা। চোখমুখ খিচে সর্বশক্তি দিয়ে আকড়ে ধরে প্রিয়তমকে। রাহিতার উৎকণ্ঠা বুঝে ওকে শক্ত করে বাহুবন্ধনীতে আবদ্ধ করে রাখে স্বপ্নিল। বেশ কিছুক্ষণ সময় দেয় শান্ত হওয়ার। তবুও রাহিতার কম্পন থামছেনা ওকে অভয় দিতে শেষমেশ স্বপ্নিল এক অদ্ভুত কাণ্ড করে বসে। ক্রমাগত চুলে হাত বুলানোর এক ফাঁকে হঠাৎ অতি সন্তপর্ণে খুব যতনে এক গাঢ় চুমু খায় রাহিতার কপালে।

প্রায় দু’মাস হতে চলা বিবাহিত জীবনের এ প্রথমবার স্বপ্নিলের উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট মিস করে রাহিতা। অনুভুতিতে অসাঢ় হয়ে যেন কিছুক্ষণের জন্য শ্বাস নিতেও ভুলে গেলো সে। অক্ষিদ্বয় একিসাথে ভালো লাগা ও বিস্ময়ে বড় হলো নিমিষেই। স্বপ্নিলের বুক থেকে মাথা তুলে উপরে তাকালো রাহিতা। না দেখেও এ অন্ধকারেই সে অনুভব করলো স্বপ্নিল মাথাটা ঝুকিয়ে রেখেছে এবং এখনো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

আলো-আঁধারির খেলায় একে-অপরের মায়ায় মোহাবিষ্ট হয়ে দুজনের মধ্যিখানের দূরত্ব আরও খানিকটা ঘুচবে ঠিক এমন মুহুর্তে নিষ্ঠুরের মতো ব্যাঘাত ঘটালো ইলেক্ট্রিসিটি! লাইটের তেজ আলোয় কয়েক পল চোখ বন্ধ করে রাখলো দুজনে। পুনরায় চোখ খুলতেই যেন মস্তিষ্ক অবশেষে সজাগ হয়ে উঠলো, এতক্ষণ যেটা দখল করে ছিলো আবেগ, সেই রেশ নিমিষেই কেটে গেলো।

অতঃপর মুহুর্তেই একে-অপরের থেকে ছিটকে সরে দাড়ালো দুজনে৷ লজ্জা ও অস্বস্তিতে ইতস্তত করতে লাগলো দুজনেই। বরাবর সব বিষয়ে মজা করা স্বপ্নিলও যেন এবার খানিকটা দমে গেলো৷ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তেও বলার মতো শব্দ খুজতে সক্ষম হলোনা। নিজের কর্মকান্ডে সে নিজেই অবাক! যদিও এ ক’দিনে সে নিজেও বুঝেছে যে সে ধীরে ধীরে রাহিতার প্রতি বেশ ভালোই দূর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে হুট করে এভাবে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারানোর ব্যাপারটা সচারাচর ওর সাথে ঘটেনা।

তবে রাহিতার সংস্পর্শে আসলে যেন সবকিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। অতিকস্টে পাথর হয়ে যাওয়া মনটাতেও যেন রং-বেরঙের ফুল ফুটে, পুনরায় ভালোবাসার ভেলায় চড়তে মন সানন্দে রাজি হয়! অপরদিকে মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ, একবার প্রেমে ধোকা খেয়ে পুনরায় সে পথ মাড়াতে ভয় দেখায়। বারবার প্রশ্ন তুলে আবারও যদি মনের বিনিময়ে মন না মিলে? তবে কি করবে সে? এ ধাক্কা সামলানো যে বড্ড মুশকিল হয়ে যাবে স্বপ্নিলের জন্য!

চোখ বন্ধ করে মন ও মস্তিষ্কের অদৃশ্য লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটায় স্বপ্নিল। তর্জনী ও বৃদ্ধাংগুল কপালে রেখে কিছুক্ষণ ডলে আবার চোখ মেলে। স্বাভাবিক চোখে তাকায় সামনে দাঁড়ানো লাজুক আবরণে মোড়া রাহিতার দিকে। যে পবিত্র মুখ দেখে স্বপ্নিলের নির্লজ্জ মনের আবারো চুমু খেতে মন চায়। কিন্তু মনের এসব লাগামহীন ভাবনা রাহিতাকে বুঝতে না দিয়ে গলা ঝেড়ে ওর মনোযোগ আকর্ষণ করে সে বলে,

—উম, অনেক রাত হয়ে গেছে। আমার অনেক খিদে পেয়েছে। চলো খাই। তোমার পায়নি?
—হ্যাঁ
মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় রাহিতা। সত্যিই খিদে পেয়েছে ওর। সেদিক চেয়ে স্বপ্নিল বলে,
—জার্নি করে এসে তোমায় রান্না করার কস্ট দিতে চাইছিলাম না। বৃষ্টি-বাদল না হলে খাবার অর্ডার দিতে পারতাম। কিন্তু এই বৃষ্টিতে ভিজে কেউ ডেলিভারি দিতে আসবেনা।

—আরে, কিসের কস্ট? এটা কোনো ব্যাপারই না। আমি নিচে যাচ্ছি। দেখছি ফ্রিজে কিছু আছে নাকি!
বলতে বলতেই রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ির কাছে যেয়ে আটকে যায় রাহিতা। যদিও লাইট আছে তবুও ফাকা বাড়িতে এভাবে একা একা নিচে যেতে ওর ভয় লাগছে। কিন্তু সেটা স্বপ্নিলকে কিভাবে বলবে? এমনিই একটু আগে যা হলো তাতে এখনো লজ্জার রেশ কাটেনি ওর, না জানি স্বপ্নিল কি ভেবে বসে? রাহিতা যখন নিজ ভাবনায় বিভোর তখন পেছন থেকে স্বপ্নিলের আওয়াজ কানে ভাসে।

—কি হলো? দাঁড়িয়ে গেলে কেন মাঝপথে?
পেছন ফিরে স্বপ্নিলকে আসতে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হয় রাহিতা, যে খুশির রেশ ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ভাসে। সে মাথা নাড়িয়ে “কিছুনা” বলে পুনরায় হাটা আরম্ভ করে। নিচে নেমে সোজা রান্নাঘরে চলে যায় দুজনে। ফ্রিজ ঘেটে দুজনে খাওয়ার মতো যখন কোনো তরকারি পেলোনা, তখন পেছন ফিরে স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে রাহিতা বলে,
—তরকারি তো নেই তেমন। রহিমা খালা তো জানতেন না আমরা আসছি, আর উনি বাড়ি চলে যাবেন দেখে বোধহয় কিছু রাধেননি। এখন কি রান্না করবো? কি খাবেন বলুন?

—ঝটপট হয়ে যাবে এমন কিছু বানাও তো। আমার ভীষণ ক্ষুধার্ত, রাহি। একটা কিছু বানালেই হলো পেট ভরার মতো।
—হুম,,ঠিক আছে। খিচুড়ি খাবেন? ফ্রিজে বেগুন দেখলাম কয়েকটা। খিচুড়ি, বেগুনভাজি ও সাথে ডিমভাজি করলে কেমন হয়?
—বেস্ট হয়! বৃষ্টির দিনে খিচুড়ির চেয়ে ভালো কিছু হতেই পারেনা। চলো তাড়াতাড়ি শুরু করো। আমিও হেল্প করছি তোমার।
স্বপ্নিলের কথায় মাথা নাড়িয়ে কাজ শুরু করে রাহিতা। চাল বের করতে করতে হেসে জিজ্ঞেস করে,

—কি হেল্প করবেন? আমিই করছি। লাগবেনা আপনার কিছু করা!
—কেন? নিজের বউয়ের হেল্প করতে সমস্যা কোথায়? এখানে লজ্জার তো কিছুই নেই। আমার মা আমাকে এই শিক্ষা দিয়েছে। আমি বেগুন কাটতে পারবো মনে হয়। দেখি দাও তো এদিকে।
কথা বলতে বলতেই ফ্রিজ থেকে বেগুন বের করে ধুয়ে ফেলে স্বপ্নিল। রাহিতা খিচুড়ি চুলোয় বসিয়ে এসে ওর সাথে বেগুন কাটতে আরম্ভ করে। দুজনে মিলে কথার ফাঁকে ফাঁকে বেশ খানিকটা কাজ এগিয়ে নেয়। কাটা শেষে স্বপ্নিল সবেমাত্র হাত ধুয়েছে এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠে। হাত মুছে সেদিক এগিয়ে যেতেই দেখে মা ফোন দিয়েছে। ফোন ধরতেই দিলারা বেগম বলেন,

—কিরে? বাসায় পৌঁছেছিস তোরা? একটাবার ফোন দিয়ে জানালিও না! আমার কি টেনশন হয়না?
—সরি মা, এদিকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে তো। আমরা বাসায় পৌঁছেছি ঘণ্টাখানেক হবে। ফোন দিতে যেয়ে ভুলে গেছিলাম।
—আচ্ছা। রাহি কোথায়? ওকে ফোন দে তো। কি খাবি তোরা আজ? রহিমাকে বল বানিয়ে দেবে।
—রহিমা খালার ভাই অসুস্থ তাই গ্রামে চলে গেছে, মা। বাসায় এসে জানতে পারি দারোয়ানের থেকে। চাবি রেখে গেছে। তুমি চিন্তা করোনা আমরা ম্যানেজ করে নিচ্ছি। রাহিতা রান্না করছে। স্পিকার এ দিচ্ছি দাড়াও।
স্বপ্নিল ফোন স্পিকারে দিতেই রাহিতা কথা বলে।

—হ্যালো, মা। আপনার চিন্তা করার দরকার নেই, আমি চুলোয় খিচুড়ি বসিয়ে দিয়েছি। এখন বেগুন ভাজা করবো, সাথে ডিম ভাজা। এটুকুই আজ ডিনারের জন্য বেশ হবে!
—বাহ। ভালো করেছিস তো। তা তুই একা একাই সব করছিস নাকি? আমার বাদরটা কি শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নাকি তোর সাহায্যও করছে?
—রাহিতা, তোমার শাশুড়িকে বলে দাও আমি বসে বসে খাওয়ার মানুষ নই। কাজ করে তবেই খাই।
মায়ের কথার বিপরীতে ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে বলে উঠলো স্বপ্নিল। ওর কথায় মুখ টিপে হাসলো রাহিতা। শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,

—উনি আমায় হেল্প করছেন, মা। দুজন মিলেই করছি সবকিছু।
—আচ্ছা, যাক তাহলে তোরা রান্নাবাড়া কর। কাল কথা হবে। রাখছি কেমন?
—আল্লাহ হাফেজ।
কথা শেষ হতেই ফোন কেটে দিয়ে রাহিতার পাশে কেবিনেটের সাথে হেলান দিয়ে স্বপ্নিল বলে,
—দেখেছো? বলেছিলাম না তোমার শাশুড়ি থাকলে এটাই জিজ্ঞেস করতো? এবং হয়েছেও তাই!
—হুম। আমার শাশুড়ি মা অনেক ভালো!

মুচকি হেসে বলে রাহিতা। অতঃপর বেগুন মাখানো শেষ করে হাত ধুতে বেসিনে চলে যায় সে। হাত ধোয়ার মাঝেই অনুভব করে নিজের ঠিক পেছনে কারও উপস্থিতি। ঘাড় ঘুরিয়ে স্বপ্নিলকে এভাবে পেছনে দাড়াতে দেখে চমকে উঠে সে। কিন্তু স্বপ্নিল সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নিঃশব্দে পেছন থেকেই রাহিতার দু’হাতের উপর হাত রেখে ওর হাতে লেগে থাকা বাকি সাবানের ফেনাগুলো ধুয়ে দিতে দিতে বলে,

—আর শাশুড়ির ছেলে? তাকে কেমন লাগে তোমার?
হঠাৎ স্বপ্নিলের এমন কাজে ও কথায় এতক্ষণ শান্ত হয়ে থাকা হৃদস্পন্দন আবারো বাড়তে থাকে রাহিতার। মনে মনে ভাবে মায়ের ছেলেকে তার কেমন লাগে এটা ঠিক কিভাবে জানাবে তাকে? যদি স্বপ্নিল কিছু মনে করে? স্বপ্নিল এখন যতোই সহজ হোক রাহিতার সাথে, যতই হাসিখুশি হয়ে মেলামেশা করুক দিনশেষে তাদের সম্পর্কে ওই একটা জায়গায় কেন যেন একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন থেকেই যাচ্ছে! কবে ওরা পুরোপুরি স্বাভাবিক একটা দম্পতি হবে সেটা রাহিতার জানা নেই।

প্রত্যাখ্যানের ভয়ে না সে নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে নিজের ভালোবাসার কথা বলতেও পারছেনা। পাছে ভয় হয় যদি স্বপ্নিল আবারো ওর মন ভেঙে দেয়? এটলিস্ট আজকের ঘটনার পর রাহিতা বুঝেছে স্বপ্নিল ওর প্রতি দূর্বল কিন্তু সে এখনো বিষয়টা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। তাইতো তখন এভাবে প্রসংগ পালটে রাহিতাকে নিয়ে নিচে চলে এলো। স্বপ্নিল টের না পেলেও রাহিতা ঠিকি বুঝেছে, তাই সে-ও আর কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চুপচাপ চলে এলো।

দ্বিধান্বিত রাহিতার চিন্তাধারায় ব্যাঘাত ঘটলো যখন মুখে উপর ভেজা কিছুর উপস্থিতি অনুভব হলো। চোখ পিটপিটিয়ে সামনে তাকাতেই দেখে ওর মুখে হাতের পানি ছিটিয়ে দিয়েছে স্বপ্নিল। চোখমুখ কুচকে রাহিতা সেদিক তাকিয়ে স্বপ্নিল ভ্রু নাচায়। যা দেখে বিরক্তের সহিত তাকাতেই ওকে ছেড়ে সরে দাঁড়ায় স্বপ্নিল। রাহিতা দাতে দাত চেপে বলে,
—শাশুড়ির ছেলে একটা আস্ত ফাজিল। এখন সরুন এখান থেকে। ডিম, বেগুন ভাজতে হবে। খিচুড়িও প্রায় হয়ে গেছে। সময় নস্ট হচ্ছে!

রাহিতার কথায় সায় দিয়ে স্বপ্নিল নিজেও সরে গেলো। অতঃপর দুজন মিলে গল্পের সাথে সাথে আজকের জন্য রান্নার আয়োজন সম্পন্ন করলো। খেতে বসে স্বপ্নিলের মনে হলো রাহিতার রান্নার হাত বেশ ভালো। এত সাধারণ খাবার, তবুও যেন দুজনে মিলে তৈরিতে করা আজকের খাবারে অন্যরকম এক পরিতৃপ্তি আছে। ভোজনরসিক সে সানন্দে পেট ভরে খেলো। খাওয়া শেষে সব গুছিয়ে রাহিতার হাত ধরে নিজেদের রুমের উদ্দেশ্যে চললো দুজনে। বিছানায় শুয়ে পাশে তাকিয়ে রাহিতার উদ্দেশ্যে স্বপ্নিল বললো,

—কাল সকাল ৮টায় ডেকে দিও তো, রাহি। খাওয়াদাওয়া সেড়ে ৯টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়বো অফিসের উদ্দেশ্যে। কাল সময়মতো অফিস পৌঁছানো খুব দরকার।
—আচ্ছা। আমি ডেকে দিবো। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।
—হুম। তুমিও ঘুমাও।
অতঃপর চোখ বন্ধ করতেই সারাদিনের ক্লান্তিতে কিছুক্ষণের ঘুমে তলিয়ে গেলো দুজনে। জার্নি শেষে ভরপেট তাদের এখন একটা ভালো ঘুমের বড্ড প্রয়োজন!

বৃষ্টি শেষে হালকা রোদের দেখা মিলেছে সকালে। জানালার পর্দা ভেদ করে সকালবেলা সেই আলো এসে উঁকিঝুঁকি দিলো রাহিতার চোখে। পিটপিটিয়ে সদ্য ঘুম ভেঙে চোখ মেলে আস্তেধীরে উঠে বসলো সে। পাশে তাকিয়ে ঘড়িতে দেখলো ৭.০৫ বাজে। আস্তেধীরে উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলো সে। কাল জার্নি করার পর রাত হয়ে যাওয়ায় আর গোসল করেনি সে। তাই সকালে উঠেই ঝটপট গোসল করে নিলো। এসব করে বের হতে হতেই ৭.৪৫ বেজে গেছে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে যখন চুল ঝাড়ছে রাহিতা ঠিক তখনি ওর মনে হলো ফোনের ভাইব্রেশনের মৃদু শব্দ আসছে। তোয়ালে মেলে দিয়ে সন্দেহ মোতাবেক এগিয়ে গিয়ে নিজের ফোন চেক করলো সে। না এখানে তো কোনো ফোন আসেনি। স্বপ্নিলের দিকের সাইড টেবিলে হেটে যেতেই আবারো ফোন বেজে উঠায় এবার বিষয়টা স্পষ্ট হলো রাহিতার কাছে। স্বপ্নিলের ফোন সাইলেন্ট করা, এখান থেকেই আওয়াজ আসছে বারবার।

হাত বাড়িয়ে রাহিতা দেখে “তুষার” নামের একজনের ছয়টা মিসডকল। রাতে ঘুমের ডিস্টার্ব না হওয়ার জন্য ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমিয়েছিলো স্বপ্নিল। তাই রাহিতাকে ডেকে দিতে বলেছে সকাল সকাল। ঘড়িতে সময় দেখে এবার স্বপ্নিলকে ডাকে রাহিতা। বেশ কয়েকবার ডাকার পর যখন স্বপ্নিল উঠেনা তখন রাহিতা বলে ওর ফোন এসেছে আর এটাতেই কাজ হয়। হুট করে চোখ মেলে তাকায় স্বপ্নিল।

রাহিতার হাত থেকে ফোন নিয়ে কানে লাগাতেই কথা হয় ছেলেটার সাথে, যে পারতপক্ষে স্বপ্নিলের অফিসের ম্যানেজার। রাহিতা খেয়াল করে, কথা বলার মাঝেই ক্ষণে ক্ষণে স্বপ্নিলের মুখ পেশি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কোনো কারণে ব্যাপক রা’গান্বিত সে! কৌতুহলী রাহিতা কল কাটার পর কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই যেন স্বপ্নিল রা’গে ফেটে পড়ে। ফোনের রাগ ওর উপর ঝেড়ে বলে,

—আটটা ষোল বাজে এখন। তোমায় বলেছিলাম না আমায় ৮টার আগে ডেকে দিতে? এখন রেডি হবো কখন, খাবো কখন আর যাবো কখন! একটাদিন ডেকে দিতে বলেছি, তাও করতে পারলেনা তুমি?
অনেকদিন পর স্বপ্নিলের এমন ধমকে অবাকের চুড়ান্তে পৌঁছে যায় রাহিতা। কস্টে ওর চোখে পানি চলে আসে। সে তো ঠিক সময়েই ডেকেছিলো স্বপ্নিলকে, সে নিজেই তো ফোনে কথা বলে এতগুলো সময় নস্ট করলো। এটা কি রাগের মাথায় খেয়াল করেনি সে? রাহিতা নিজের পক্ষে কথা বলতে ধরে। চোখের পানি বের হতে দেয়না। চোখমুখ শক্ত করে মুখ ফুটে বলে,

—একদম আমার উপর দোষ দিবেন না বলে দিচ্ছি। আমি ঠিক ৮ টাতেই আপনায় ডেকেছি। আপনিই ফোনে এতক্ষণ সময় নস্ট করলেন আবার এখন শুধু শুধু আমার উপর রাগ ঝাড়ছেন!
রাহিতার পালটা জবাব দেওয়ায় যেন রাগ আরেকটু বেড়ে গেলো স্বপ্নিলের। তবে এবার আর জবাব না দিয়ে রা’গে গজগজ করতে করতে দ্রুতপায়ে উঠে যায় সে। রাগের মাত্রা বুঝাতে ঠাশ করে বাথরুমের দরজা লাগিয়ে বুঝিয়ে দেয় সে ক্ষে’পে আছে! ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ওর কাপড়চোপড় বিছানার উপর রেডি করে রাখা দেখেও কিছু বলেনা স্বপ্নিল। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বিনা নাস্তা করেই চলে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার আগে রাহিতার সাথে আর একটা কথাও বললোনা সে। ব্যস্তহাতে কাকে যেন ফোন করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো বাসা হতে। হঠাৎ স্বপ্নিলের এমন বদলে যাওয়া আচরণে অভিমান জন্মে রাহিতার ছোট্ট মনে!

মন বিনিময় পর্ব ৩৩

কই সে তো কিছু করেনি, তবে কেন স্বপ্নিল ওর উপর এভাবে রাগ ঝাড়লো? ওর কি খারাপ লাগেনা? আর তার চেয়েও বড় কথা – কিসেরই বা এত রাগ, এত ক্ষো’ভ জন্মালো স্বপ্নিলের মনে, যার কারণে সে এভাবে এত তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় আসলো? হয়েছেটা কি ওর অফিসে?
বারান্দার রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে স্বপ্নিলের চলন্ত গাড়ির দিক তাকিয়ে ভাবতে থাকলো রাহিতা!

মন বিনিময় পর্ব ৩৫