মন বিনিময় পর্ব ৩৫

মন বিনিময় পর্ব ৩৫
তাসফিয়া হাসান তুরফা

সকাল ১০টা। বারান্দায় চুপচাপ বসে আছে রাহিতা। স্বপ্নিলের উপর রাগে কিছু খায়নি সে সকালে। মনের মাঝে মুঠোভরা অভিমান ও রাগ নিয়ে ফুসছে শুধু! কিছুক্ষণ আগে দিলারা বেগমের সাথে কথা হয়েছে তার, উনারা আগামী পরশু আসবেন ঢাকায়। অর্থাৎ আরও দুটো দিন স্বপ্নিলের সাথে একা থাকতে হবে বাসায়।

এটা ভেবেই রাহিতার বিরক্ত লাগছে এখন। যে আগ্রহ নিয়ে ও ঢাকায় এসেছিলো স্বপ্নিলের সাথে, আজ সকালে করা আচরণে যেন সব মূর্ছা গেলো। রাহিতা যতক্ষণ রাগে বিভোর ততক্ষণে ঘড়িতে ১০.৩০ টা পেরিয়েছে। টুংটাং করে বেজে উঠা মুঠোফোনের ধ্বনি ভেসে আসছে রুম থেকে। রুমে যেয়ে ফোন নিতেই দেখে স্বপ্নিলের নাম জ্ব’লজ্ব’ল করছে স্ক্রিনে। যে নাম দেখে অভিমানের পাল্লা তরতর করে বেড়ে উঠে। মাথাচাড়া দেয় রাগ। তাই কতক্ষণ বেজে উঠে ক্লান্ত হয়ে একা একাই বন্ধ হয়ে যায় ফোন। কল কেটে যাওয়ার পর আরও তিনবারের মতোন ফোন দেয় স্বপ্নিল। রাহিতা তবু ধরেনা। মনে মনে স্বপ্নিলকে জ্বা’লিয়ে বেশ শান্তি পায় সে। নির্ঘাত অনেক বিরক্ত হয়েছে লোকটা। ঠিক হয়েছে! মনে মনে ক্রু’র হাসে রাহিতা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিনিট পাচেক অতিক্রম হয়, কলিং বেল বেজে উঠে। রাহিতা চমকায়। এ সময় আবার কে আসলো? স্বপ্নিল না অফিসে, ও আবার চলে আসেনি তো? কিন্তু অফিসে তো অনেক জরুরি কাজের কথা বললো স্বপ্নিল, এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। তবে কে? ভাবতে ভাবতেই মেইন দরজার ফুটো দিয়ে দেখার চেস্টা করে বাহিরে কে। দারোয়ানকে দেখে আরেকটু অবাক হয়। দরজা খুলে দিতেই রাহিতাকে দেখে সালাম দেয় দারোয়ান। নম্র হেসে একটা বক্স ওর হাতে দিয়ে বলে,

—ম্যাডাম, এটা আপনার জন্য।
—এটা কি, সোলেমান ভাই?
—তা তো জানিনা। এক ছেলে আসছিলো একটু আগে এটা দিয়ে গেলো। এরপর স্বপ্নিল স্যার ফোন দিয়ে বললো আপনারে দিয়ে যাইতে।

দারোয়ান মাথা চুলকে বলে। আর কথা না বাড়িয়ে উনার থেকে বক্সটা নিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় রাহিতা। সোফায় বসে কৌতুহলের সাথে বক্সটা খুলতেই চোখে পড়ে ভেতরে পারসেল। মনে হয় কোনো খাবার, অন্তত ভেতর থেকে আসা সুঘ্রাণ তো তাই বলছে! পারসেলটা তুলতেই নিচে চোখে পড়ে একটি চিরকুট। তাতে গুটিগুটি অক্ষরে ছোট্ট করে লেখা “সরি”। রাহিতার এবার আর বুঝতে বাকি রয়না এটা কে পাঠিয়েছে, কেন পাঠিয়েছে। একিসাথে স্বপ্নিলের দেওয়া চিরকুট ও খাবার দেখে এতক্ষণের মন খারাপ যেন নিমিষেই কয়েকগুন হালকা হয়ে গেলো। সবেমাত্র খাবারের প্যাকেট খুলেছে রাহিতা সে সময় পুনরায় স্বপ্নিলের ফোন আসে। এবার আর রাগ দেখায়না রাহিতা। কোমল সে স্বপ্নিলের নিকট থেকে একটু যত্ন পেয়েই গলে যায়, ফোন না ধরে থাকতে পারেনা আর। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে স্বপ্নিলের বিচলিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে তৎক্ষণাত!

—কোথায় ছিলে তুমি? ফোন ধরছিলেনা কেন?
স্বপ্নিলের প্রশ্নে অদ্ভুত ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা টের পায় রাহিতা। তবু শান্ত স্বরে বলে,
—এমনিই। আপনার কি সমস্যা? এত ফোন দিচ্ছিলেন কেন?
—এমনি মানে? তুমি এতক্ষণ ইচ্ছা করে আমার ফোন ধরছিলেনা? মজা করছো আমার সাথে?
—মজা করবো কেন? সবসময় আপনার ফোন ধরতে বাধ্য নই।
—অবশ্যই বাধ্য তুমি।

দাতে দাত চেপে বলে স্বপ্নিল। ভেবেছিলো এবার ফোন দিয়ে ভালোভাবে কথা বলবে রাহিতার সাথে, সকালের আচরণের জন্য সরি বলবে। কিন্তু এখন মেয়েটার ত্যাড়া উত্তর শুনে নিজেরই মেজাজ আবার ক্ষি’প্ত হচ্ছে। রাহিতা উত্তর না দেওয়ায় স্বপ্নিল নিজেও ফোস করে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে সামলে এবার নরম কণ্ঠে বলে,
—বাসায় কেউ নেই। তোমায় একা রেখে এসেছি। এদিকে তুমি এতবার ফোন দেওয়ার পরেও ধরছিলেনা, আমি কত টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম তুমি জানো? কেন এমনটা করলে, রাহি?

রাহিতা এবারও নিশ্চুপ রয়। তবে এবার তার অনুভূতি ভিন্ন। এখন সে উপলব্ধি করে স্বপ্নিলের তখনকার বিচলিত হওয়ার কারণ। সে ওর জন্য এতটা চিন্তা করছে, ওর খেয়াল রাখছে বিষয়টা হৃদয় জুড়িয়ে দেয়। রাহিতা নিচু স্বরে বলে,
—সরি। আর করবোনা এমন।
এতক্ষণ পর রাহিতার স্বাভাবিক কণ্ঠ শুনে স্বস্তির শ্বাস ফেলে স্বপ্নিল। সে নিজেও স্বাভাবিক গলায় জিজ্ঞেস করে,
—খাবার পেয়েছো?
—হ্যাঁ। মাত্রই পেলাম।
—তাহলে খেয়ে নাও।
—আচ্ছা।
—এখনো মুড অফ?

নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করে স্বপ্নিল। রাহিতা একবার ভাবলো বলবে এখনো রেগে আছে স্বপ্নিলের উপর। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হলো এমনটা করা ঠিক হবেনা। স্বপ্নিল অফিসের ঝামেলায় এ ক’দিন কেমন অস্থিরতায় দিন কাটাচ্ছিলো সেটা রাহিতা বেশ ভালোই দেখেছে। সকালে যদিও স্বপ্নিলের উপর রাগ হয়েছে তবুও বিচক্ষণ রাহিতা বুঝে কারণছাড়া হুট করে স্বপ্নিল এমনটা করবেনা। তাইতো এতকিছুর মাঝেও স্বপ্নিল ঠিকি মনে করে ওর জন্য খাবার পাঠিয়েছে, সাথে ছোট চিরকুট। তাই এ মুহুর্তে আর মনোমালিন্য বাড়ানোর ইচ্ছে হলোনা রাহিতার। কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্বপ্নিলের উদ্দেশ্যে সে বলে,

—আপনি খেয়েছেন?
—হ্যাঁ, মাত্র খেলাম। তুমিও খেয়ে নাও এখনি।
—আচ্ছা, আপনি কিভাবে জানলেন আমি না খেয়ে বসে আছি?
রাহিতার প্রশ্নে স্বপ্নিল হাসে। সে বলে,
—এতদিন তোমার সাথে থেকে থেকে তো এটুকু চিনিই তোমায়। এর আগেও একদিন আমাদের ঝগড়া হয়েছিলো ওইদিন তুমি রাগ করে খাওনি আমি খেয়াল করেছি। এটা তোমার অনেক বাজে অভ্যাস, রাহি। এ অভ্যাস ছাড়ো। কতক্ষণ খালিপেটে আছো সে খেয়াল আছে তোমার?
স্বপ্নিলের কথার বিপরীতে রাহিতা আস্তে করে বলে,

—এখন থেকে আমি যতবার রাগ করে না খেয়ে থাকবো, আপনি কি ততবার আমার জন্য খাবার পাঠাবেন?
রাহিতার এহেন বোকা বোকা প্রশ্নে জোরে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। ওর হাসির আওয়াজে ফোনের এপারে লজ্জায় মিইয়ে যায় রাহিতা। সে কি মনের কথা বলে ভুল কিছু বলেছে? স্বপ্নিল নিশ্চয়ই এখন মজা নিবে! রাহিতার ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল কিছু বলবে তার আগেই ওর ম্যানেজার চলে আসে রুমে। তাই আর কথা বলার সুযোগ পায়না স্বপ্নিল।
“পরে কথা বলছি” বলে ফোনটা কেটে দেয়।

এদিকে স্বপ্নিলের হুট করে ফোন কেটে দেওয়ায় খানিকটা মিইয়ে যায় রাহিতা। ভাবে ওর সেই প্রশ্নটা করা উচিত ছিলোনা হয়তো। মনে হয় স্বপ্নিল ইতস্তত বোধ করেছে যার ফলে এভাবে ফোন কেটে দিলো। মনে মনে হতাশ হয়ে খাবারের প্যাকেট খোলে রাহিতা। দুটো চিকেন স্যান্ডউইচ পাঠিয়েছে স্বপ্নিল। তা দেখে প্রশস্ত হাসে রাহিতা। ও একদমই ভারী নাস্তা করতে পারেনা সকালে, এ বিষয়টাও খেয়াল করেছে স্বপ্নিল! ভাবতেই অন্যরকম ভালো লাগে!

মিটিংরুমে অফিসের সদস্যদের সাথে বসে আছে স্বপ্নিল। তার অধীনে কাজ করা এক কর্মচারী তাদের কোম্পানির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এক বড় বিদেশি কোম্পানীর সাথে ডিল করার জন্য স্বপ্নিলদের কোম্পানির যে প্রেজেন্টেশন রেডি করেছিলো তা ওই ব্যক্তি আরেকটি প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির কাছে ফাস করে দিয়েছে। জুবায়ের নামক সেই ব্যক্তি মূলত ওই কোম্পানির স্পাই হিসেবে কাজ করছিলো যা কিছুদিন আগেই জানতে পারে স্বপ্নিল।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। যার ফলে সব মিলিয়ে এ ব্যাপারে বেশ বিপাকে পড়েছে স্বপ্নিলের কোম্পানি। এ স্বল্প সময়ে কিভাবে সব সামাল দিবে ভেবে পাচ্ছেনা কেউ৷ সে বিষয়ে আলোচনা করতেই কোম্পানির সব গুরুত্বপূর্ণ পোস্টের মেম্বারদের নিয়ে আজকের এ মিটিং। সবার আলোচনা শেষে ঠিক করা হলো ওরা যেয়ে সরাসরি ওই বিদেশি ডিলারদের সাথে দেখা করবে এবং এ বিষয়ে কথা বলবে। উপায় না পেয়ে শেষমেশ স্বপ্নিল নিজেও রাজি হয়। ম্যানেজার জিজ্ঞেস করে, সব ঠিকঠাক করে কবেকার ফ্লাইট বুক করবে। কিছুক্ষণ ভাবনা-চিন্তা করে স্বপ্নিল বলে সামনের সপ্তাহের টিকেট বুক করতে। একিসাথে ওর সাথে যারা যাবে তাদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,

—কারও কোনো সমস্যা নেই তো?
—না, স্যার। আমাদের যেহেতু ভিসা করাই আছে। তাহলে সামনের সপ্তাহে গেলে কোনো প্রবলেম হবেনা। সবাই গোছগাছও করতে পারবো।
—হুম। তাহলে আজকের মিটিং এখানেই শেষ। যে যার মতো কাজ হ্যান্ডেল করুন। আর যে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকে আমি দেখে নিবো।
—ওকে, স্যার। আমরাও চাই ওর বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
—হুম। আমাদের কাছে কিছু প্রমাণ আছে। ওর বিরুদ্ধে জলদিই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

স্বপ্নিল যখন বাড়িতে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা ৬টার মতোন হবে। রাহিতা একা বাসায় আছে তাই অফিসের কাজ মিটিয়ে অন্ধকার নামার আগে আগেই ক্লান্ত শরীরে তড়িঘড়ি করে সে বাসায় আসার চেস্টা করেছে৷ কয়েকবার কলিং বেল বাজাতেই রাহিতা মিস্টি হেসে দরজা খুলে দিলো। নীল রঙের সালওয়ার কামিজ পড়ে মাথায় কাপড় দেওয়া স্নিগ্ধ রাহিতাকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য মন-প্রাণ জুড়িয়ে গেলো স্বপ্নিলের। এতক্ষণের ক্লান্তি যেন নিমিষেই জিইয়ে গেলো।
আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, কিন্তু এ মুহুর্তে স্বপ্নিলের মনে হলো তার ব্যক্তিগত চাঁদের সামনে আকাশের চাঁদ যেন কিছুই না! বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেট লক করে রাহিতার সাথে উপরে যেতে যেতে স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,

—কি করছিলে তুমি? মাথায় কাপড় কেন?
—নামাজ পড়ছিলাম। আপনি আজ তাড়াতাড়ি এলেন যে?
—ভাবছিলাম আজ যদি আবার কারেন্ট যায় আর তুমি ভয় পেয়ে বাসা থেকে পালিয়ে যাও তাহলে তো আমার বিপদ। তাই তাড়াতাড়ি এলাম!
দুস্টু হেসে স্বপ্নিল বলে। ওর কথায় লাজুক হেসে ওর বাহুতে হালকা মারে রাহিতা। রুমে যেতেই স্বপ্নিল ফ্রেশ হতে চলে যায়। বের হয়ে আসতেই রাহিতার পাশাপাশি বিছানায় বসে। স্বপ্নিল খেয়াল করে রাহিতা গম্ভীরভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ভ্রু কুচকে স্বপ্নিল সুধায়,

—কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, হুম? আমায় কি আজ একটু বেশিই হ্যান্ডসাম লাগছে?
স্বপ্নিলের কথায় চোখ পাকায় রাহিতা। আগের ন্যায় গম্ভীর ভংগিমায় বলে,
—এসব বাদ দিন। আপনি সকালে আমার সাথে ওমন করলেন কেন সব খুলে বলুন আমায়!
—এখনি? আমি তো মাত্রই বাসায় এলাম। পরে বলি?
—না। আমার সকাল থেকেই সবটা জানার জন্য ভেতরে খচখচ করছে। আপনি এখনি বলবেন। প্লিজ, স্বপ্নিল। মানা করবেন না!

রাহিতার এত কৌতুহল দেখে আর দ্বিমত করেনা স্বপ্নিল। হঠাৎ সব জড়তা ভেঙে রাহিতাকে অবাক করে দিয়ে বলে,
—তোমার কোলে একটু মাথা রাখতে দেবে, রাহি? আমি ভীষণ ক্লান্ত।
এ প্রথম স্বপ্নিলের তরফ থেকে এমন নিঃসংকোচ আবদার শুনে মানা করার দুঃসাহস পায়না রাহিতা। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে স্বপ্নিলকে কোলে মাথা রাখতে ইশারা করে।

মন বিনিময় পর্ব ৩৪

ওর সম্মতি পেয়ে আর বিলম্ব করেনা স্বপ্নিল। সাথে সাথেই এসে রাহিতার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। বিষাদময় নিঃশ্বাস ফেলে এক এক করে সবকিছু খুলে বলে। রাহিতাও এক হাতে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে পুরো কাহিনি শুনতে থাকে স্বপ্নিলের থেকে। নিশুতি রাতের পূর্ণিমা চাঁদ যেন আরও একবার সাক্ষী হয় দুজনের মন বিনিময়ের এক নতুন অধ্যায়ের!

মন বিনিময় পর্ব ৩৬