মম চিত্তে পর্ব ১৮

মম চিত্তে পর্ব ১৮
সাহেদা আক্তার

রিয়ান আলমারি খুলে ছয় সাতটা শাড়ি একসাথে বের করে ফেলল একসাথে। মম বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে পুরো আলমারি দিয়ে দেবে। মম ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কি করছেন? আরে আমি কি সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি নাকি! রিয়ান ওর দিকে ফিরে বলল, কয় দিনের জন্য যাচ্ছো তবে? এবার মম দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। ও নিজেও জানে না কখন আসবে। ভেবে বলল, আব্বু ভালো হলেই চলে আসবো।

– তাহলে সব নিয়ে যাও।
– এই না না। পাগল নাকি!
– তাহলে বলো কয়দিন পর আসবে? তিনদিন, চারদিন, পাঁচদিন, এক সপ্তাহ?
– নিক্বণ আপুকে জিজ্ঞেস করে নেবেন। এখন চলুন দেরি হচ্ছে।
রিয়ান মুখ ভার করে কোটটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, পরিয়ে দাও। মম উচ্চবাচ্য না করে পরিয়ে দিল। তা না হলে কথা বলে আরো দেরি করবে। ওরা নিচে এসে দেখল যে যার মতো বেরিয়ে গেছে। ওরাও বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গাড়ির সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে মম বলল, কেন এমন আচরণ করছেন?

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

রিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, কেমন? মম জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে বাইরে তাকাল। কালকের সামান্য বৃষ্টির পরও আকাশে এখনো কালো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। সেই দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল, বড্ড বেশি কেয়ারিং মনে হচ্ছে। রিয়ান রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, যার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাকে এতদিন পরে পাওয়ার পর যত্ন করব না? মম ওর কথা বুঝতে পারল না। কিছু বলবে বলেও যেন বলতে ইচ্ছে হল না। চুপচাপ আকাশের মেঘের খেলা দেখতে লাগল।
ওরা বাসায় পৌঁছালো সাড়ে নয়টার দিকে। নক করতে বৃষ্টি দরজা খুলে ভেতরে জানান দিল ওদের আসার কথা। শুনেই রায়হান সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ওদের বসালেন বসার ঘরে। মাধুরী খালা এক পলক উঁকি মেরে নাস্তা বানাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন, আব্বু? তিনি উত্তরে ভালো বলে বললেন, তোমাদের সবাই ভালো আছে?

– জ্বি।
– কই মাধুরী, নাস্তাটা দিয়ে যা।
মম রায়হান সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই আব্বু। আমরা জিনিসগুলো রেখেই বেরিয়ে যাবো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় যাবি? রিয়ানও একই প্রশ্ন করতে মম অবাক হয়ে বলল, অফিস যাবো না?
– কাল না বললাম তোমার ছুটি?
– এত ঘন ঘন ছুটি নিলে অফিসের সবাই কি বলবে? আমি তো জয়েনের পর থেকে কেবল ছুটিতেই আছি।
– তাহলে আর একটা নিলে কিচ্ছু হবে না।
– আচ্ছা, আমি না হয় যাবো না, আপনি?
– আব্বু গেছে। আমি গিয়ে কি করব? আজকে কব্জি ডুবিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভোজ করব।

মম বোকার মতো তাকালো। রায়হান সাহেব হেসে বললেন, বেশ বলেছো জামাই। আজকে ভালো করে খাওয়া দাওয়া করাতে হবে। রিয়ানও মাথা নাড়িয়ে বলল, ঠিক বলেছেন আব্বু। আপনার মেয়েটা কিচ্ছু বোঝে না। দুইজনে মিলে হাসতে লাগল। মম মুখ গোমড়া করে দুইজনের কথা শুনতে লাগল। এমন ভাবে কথা বলছে যেন দুইজনে এককালে বন্ধু ছিল। মাধুরী খালা নাস্তা টেবিলে রাখলেন। রিয়ান তো খুশি হয়ে বলল, কত খাবার! মম দেখল বাসায় যা ছিল সব দিয়ে দিয়েছে। পাঁচ সাত রকমের ফল, মিষ্টি, রসগোল্লা, চানাচুর আরো কত কি! চা আর বিস্কিট দেওয়া বাকি। এই জামাই মানুষটারই ভাগ্য ভালো। যত রকমের বাহারি খাবার এর কপালেই থাকে। আর মেয়েদের যত জ্বালা। নিজের ঘর ছেড়ে পরের ঘরে গিয়ে সংসার করতে হয়।

ঘরে যা খাবার দাবার বানানো হবে সব মেহমানদের; না হয় জামাই আসলে খাবে। নিজে বানালেও খাবার কপালে থাকে এক কোণা। এসব ভাবতে ভাবতে মম রিয়ানের দিকে চোখ ছোট করে তাকালো। রিয়ানের খেয়াল হতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, কি? হিংসে হচ্ছে? মম ডোন্ট কেয়ার ভাব করে রান্নাঘরে রওনা দিল। এজন্য বোধহয় ছেলেদের ভুঁড়ি এত তাড়াতাড়ি বাড়ে। ভেবে মুচকি হাসতে হাসতে চুলার সামনে এসে দাঁড়ালো। চা হচ্ছে ওখানে। কাপে চিনি আর দুধ নিতে নিতে নিজেকে বলল, নিনিটাকে দেখছি না আজকেও। কালও হুট করে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কোথায় এখন কে জানে। বর্ষা উঁকি মেরে বলল, তুই এখানে? যা সোফায় গিয়ে বোস। আমি চা নিয়ে আসছি।

– আরে চাই তো। আমি নিতে পারব। আচ্ছা নিনি কোথায় গো বর্ষাপু?
– ও……? আছে তো…। বাইরে কোথাও ঘুরতে গেছে।
– বাইরে!? ও তো বাইরে যায় না। আজ হঠাৎ!?
– ঐ আর কি। দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়েছে। ভাবলাম বাসা থেকে তো বের হয় না তেমন থাকুক একটু বাইরে।
মমর বর্ষার কথা শুনে কেমন যেন লাগল। কি যেন লুকাচ্ছে মনে হচ্ছে। কেমন নকল হাসি দিচ্ছে। নিজে ব্যাপারটা বোঝা দরকার; ভাবতে ভাবতে চা নিয়ে বসার রুমে এল। দেখল বৃষ্টিও ওদের সাথে আড্ডায় বসেছে। মাধুরী খালা খাবার টেবিল গুছিয়ে রাখছেন। মম চা দিয়ে এসে একবার ভাবল নিনির কথা জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তার আগেই রিয়ান এসে বলল, মম, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে।

– তো?
– চলো ভিজবো।
– পাগল? তাছাড়া বাসার সবাই কি ভাববে?
– আরে কি আর ভাববে? চলো তো।
রিয়ান ওর হাত ধরে দরজা খুলে সোজা চলে এল ছাদে। আসলেই ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তার মাঝেই ওকে টেনে নিয়ে এল। মম প্রথমে আপত্তি করলেও পরে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে রইল। এভাবে কবে শেষ ভিজেছে মনে পড়ছে না। অনেক আগে একবার একজনের সাথে ভিজেছিল। কত হাসি কত মজার ছিল দিনগুলো। ভেজা শেষে মায়ের হাজার একটা বকা খাওয়ার পরও দুজনে খিলখিল করে হেসেছিল রুমে গিয়ে। দিনগুলো মনে পড়লে চোখ ভিজে আসল ওর। গড়িয়ে পড়া নোনতা পানি বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেল। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিয়ান জিজ্ঞেস করল, কিছু হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে?

– না। ভেজা হলে ঘরে চলুন।
– মাত্র তো এলাম। কি হয়েছে বলতো।
– পুরানো দিনের কিছু রঙিন স্মৃতি মনে পড়ল।
– তাই নাকি? কি শুনি।
– পরে শুনবেন। এখন নিচে চলুন৷ যা ভিজেছেন তাতেই ঠান্ডা লেগে যাবে।
মম পিছন ফিরে রওনা দেওয়ার আগে রিয়ান ওকে জড়িয়ে ধরল। সাথে সাথে কেঁপে উঠল ও। রিয়ান আবদারের সুরে বলল, থাকি না কিছুক্ষণ। মম কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। কেমন অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে ওর মাঝে। এই ভালাে লাগার কি নাম দেওয়া যায়!?

ওর ভাবনার মাঝে কারো ছবি তোলার শব্দ হলো। ও চোখ খুলে দেখল বৃষ্টি দাঁত দেখিয়ে হাসছে। হাতে ফোন। মম লজ্জায় সাথে সাথে রিয়ানকে সরিয়ে দিয়ে বলল, নিচে চলুন। সবার সামনে আমাকে একেবারে লজ্জায় মিশিয়ে ফেলবেন দেখছি। ও দ্রুত নিচে রওনা দিল। রিয়ানও হেসে ওকে অনুসরণ করল।
বাসায় এসে দেখল বর্ষা আর বৃষ্টি ফিসফিস করে কথা বলে হাসছে। মাধুরী খালা রান্নাঘরে দুপুরের খাবারের আয়োজন করছেন। রায়হান সাহেব নিজের রুমে। মম দ্রুত কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে বদলে এল। রিয়ান এসে ওর রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। মম বের হয়ে বলল, আপনি কাপড় বদলে এসে বসুন আমি চা করে দেই। টাওয়ালটা দিয়ে মাথাটা মুছে নিন। কাপড় তো আনেননি।
– কে বলেছে? ঐযে লাগেজ।

মম তাকিয়ে দেখল ওর ব্যাগের সাথে একটা ছোট লাগেজ। আগে খেয়াল করে নি। মম মনে মনে ভাবল, আগে থেকেই তাহলে তৈরী হয়ে ছিল। মম লাগেজ এগিয়ে দিয়ে বলল, তাহলে আর কি। কাপড় নিয়ে পরে ফেলুন।
– আমার হাত ভেজা। নিয়ে দিন।
মম বেশ বিরক্ত হয়ে লাগেজ খুলল। একটা সেট বের করতে বলল, আরে এটা না। ঐযে হালকা আকাশিটা। মম বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল, এটায় কি সমস্যা? ওটা নিতে গেলে সব কাপড় এলোমেলো হয়ে যাবে৷ রিয়ান জেদি বাচ্চাদের মতো বলল, আমার ঐটাই লাগবে৷
– কেন? ওটাতে কি আছে?
– তোমার সাথে মিলবে।

মম এবার খেয়াল হলো। ও হালকা আকাশি একটা শাড়ি পরেছে। রিয়ানের জামা কাপড় দেখে যা মনে হচ্ছে সে মমর সাথে মিলিয়ে জামার সেট এনেছে। রিয়ানের দিকে না তাকিয়ে কাপড়ের সেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি রান্নাঘরে গেলাম চা গরম করতে। তখন তো খাননি। রিয়ান কাপড় নিতে নিতে বলল, লজ্জায় তোমার কান লাল হয়ে আছে মম। ও কিছু না বলে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে গেল।
রিয়ান ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এল। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে মমর রুম দেখতে লাগল। ভেজা জামা কাপড়ের পানিতে রুমে বন্যা বয়ে গিয়েছিল। এখন দেখছে শুকনো। কেউ মুছে গেছে। রিয়ান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রুম পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। রুমের এক কোণায় দুইজন শুতে পারে এমন একটা বিছানা। তাতে লাল গোলাপের বিছানার চাদর বিছানো।

বিছানায় দুটো বড় বালিশ আর একটা ছোট কুশন। সাইডে একটা পাশবালিশ। তার পাশে একটা শেলফ৷ সেখানে নানা রকমের বই। তারপাশে পড়ার টেবিলটা ঠিক জানালার সাথে। অপরপাশে বারান্দা থাকায় বৃষ্টির পানি রুমে ঢুকতে পারছে না। ওয়াশরুমের দরজার পাশে ড্রেসিং টেবিলটা। সেখানে মমর সাজার সরঞ্জামগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল রিয়ান। খুব আহামরি কিছু নেই৷ যা আছে তাও খুব একটা পরতে দেখেনি মমকে। সাথে দিয়ে ওর আলমারির দরজা হা হয়ে আছে। তাড়াহুড়োয় হয়ত মারা হয়নি ঠিক মতো। সেই ফাঁক দিয়ে একটা কোট দেখা যাচ্ছে। রিয়ানের কেমন চেনা চেনা লাগল। ওর কোট হতে পারে আন্দাজ করে আলমারির দরজায় হাত দিতেই নাকে কেমন যেন সুড়সুড়ি লাগল। খানিকের মধ্যে হাঁচি শুরু হয়ে গেল।

ঠান্ডা লাগল নাকি ভাবতে ভাবতেই পায়ের কাছে কি যেন নড়ছে অনুভব হলো। সেই জিনিসটা ঘষে ঘষে এ পা থেকে ও পা করছে। রিয়ান ভয়ে ভয়ে তাকাতেই একটা চিৎকার দিয়ে উঠল।
রিয়ানের চিৎকারে সবাই দৌঁড়ে চলে এল মমর রুমে। দেখল রিয়ান ফ্লোরে পা মেলে বসে আছে। হাঁচতে হাঁচতে নাক মুখ লাল হয়ে গেছে। আর নিনি আরাম করে ওর কোলে বসে পা চাটছে। বর্ষা তাড়াতাড়ি নিনিকে সরিয়ে নিল। মম রিয়ানকে উঠিয়ে বিছানায় বসিয়ে বলল, কি হয়েছে? রিয়ানের হাঁচি তখনো কমেনি। বর্ষা নিনিকে রায়হান সাহেবের রুমে রেখে এসে বলল, ওর বিড়ালে এলার্জি আছে। বিয়ের দিন আদ্রিতা আমাকে বলেছিল। মম রিয়ানের দিকে তাকাল। বেচারার নাক মুখ ফুলে গেছে। হাঁচিটা কিছুটা কমেছে৷ মম তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, কোনো ওষুধ আছে? রিয়ান আস্তে করে বলল, লাগেজের সাইড পকেটে। ও গিয়ে ওষুধ এনে দিল৷ দশ মিনিট পর অনেকটা কমে এল সব। মম রাগের সুরে বলল, এতই যখন এলার্জি তো এসেছেন কেন?

– আমি কি জানি নাকি এখানে বিড়াল আছে?
সবাই চুপ করে রইল। মম বলল, তাহলে দুপুরে খেয়ে বাড়ি চলে যান। এখানে থাকলে আবার শরীর খারাপ করবে। নিনি যেভাবে বসে ছিল কোলে দেখে মনে হচ্ছে আপনাকে পছন্দ করেছে। সুযোগ পেলে কাছে এসে ঘুর ঘুর করবে। রিয়ান অভিমানের সুরে বলল, দেখলেন আব্বু? বিড়াল পর্যন্ত আমাকে পছন্দ করে কাছে এসে বসে থাকে। আর আপনার মেয়ে আমাকে বাসা থেকে চলে যেতে বলছে। আমাকে একটুও পছন্দ করে না। মম ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওর দিকে তাকাল। কি থেকে কি বলল! রায়হান সাহেব ওর পক্ষ নিয়ে বলল, কি রে তুই! জামাইটা আজকে প্রথম এল। আর তুই চলে যেতে বলছিস।

মম চিত্তে পর্ব ১৭

– কিন্তু……
– নিনিকে কেউ রাখলেই তো হলো। তাহলে জামাইর কাছে সে আসবে না।
মম কি বলবে বুঝতে পারল না। সবাই নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। মম যেতে লাগলে রিয়ান হাত ধরে টেনে বিছানায় বসিয়ে বলল, তুমি যাচ্ছো কোথায়?

মম চিত্তে পর্ব ১৯