মহাপ্রস্থান পর্ব ১১

মহাপ্রস্থান পর্ব ১১
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

‘অসহায়’ নামে একটা প্রদেশ থাকা জরুরী ছিল। শুধু জরুরী বললে ভুল হবে। বলা দরকার ভীষণ, অসম্ভব দরকার ছিল। তাহলে পৃথুলা এক্ষুণী তল্পিতল্পা গুছিয়ে ‘অসহায়’ নামক প্রদেশে চলে যেত। এই দেশে সে অসহায় হয়ে থাকতে পারছে না আর। অসহায় ব্যক্তিদের অসহায় নামক দেশেই থাকা উচিত। কিন্তু বিধিবাম! সৃষ্টিকর্তা এমন কোনো প্রদেশ তৈরি করেননি। অগত্যা অসহায় বেশে তাকে এখানেই থাকতে হবে। মনে মনে সে আরশানের পিণ্ডি চটকালেও মুখে লেগে আছে তার অমায়িক হাসি; যার সম্পূর্ণটাই অভিনয়।

আশিকসহ উপস্থিত সবাই উৎসুক হয়ে পৃথুলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে গান শুনবে বলে। এবার আশিকের সঙ্গে তাল মেলাল শিমুল নিজেও। সে খিচুড়ির প্লেটে লেবু চিপড়ে রস বের করতে করতে বলল,
“একটা গান গেয়ে শুনিয়ে দেন না ভাবি!”
পৃথুলার মাথার র-ক্ত গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটছে। এই গরমে শিমুল ব্যাটাকে চুবাতে পারলে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও পৃথুলা স্বস্তি পেত। সে মনে মনে স্বগতোক্তি করে। দাঁতমুখ খিঁচে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কেন রে হতচ্ছাড়া, তোর স্যার কি কম ছিল? সে তো এক বাঁশ দিয়েছেই মিথ্যা বলে। উপরন্তু এমন সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো সেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার গান শোনার জন্য। আমার গান শুনলে ওরা এখানে টিকতে পারবে রে? তার ওপর তুই আসছিস তাল মেলাতে? কেন রে এত বাঁশ কে দিতে বলেছে তোদের? আমাকে শেষমেশ বাঁশবাগানের মালিক বানানোর ধান্দা! হতচ্ছাড়া, খুব শখ আমার গান শোনার? শোনাচ্ছি। তোর ভাবি তোকে এমন নাকানিচুবানি খাওয়াবে এবার তুই ভাবতেও পারবি না।”

“কী হলো আপু? গান গাইবেন না?”
পৃথুলার মনে মনে বকাঝকায় ভাঁটা পড়ল। সে সকালের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাবছিলাম। গান তো অনেকদিন গাওয়া হয় না। গলার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। গান গাইতে গেলে গলায় ব্যথা লাগে।”
অর্ষা বলল,

“তাহলে আপু থাক। কষ্ট করে গান গাইতে হবে না।”
সবাই অর্ষাকে সমর্থন করলেও আশিক কিছুটা হতাশ হলো। সে হতাশসুরে বলল,
“অনেক আশা নিয়ে বসে ছিলাম।”
পৃথুলা আড়চোখে আরশান এবং শিমুলের দিকে তাকাল। খুব আয়েশ করে খাচ্ছে দুজন। সে মুচকি হেসে বলল,
“তবে আপনি চাইলে, আমি ছোটোবেলার একটা ছড়া শোনাতে পারি সুর দিয়ে। ছোটোবেলায় খেলার সময় ছড়াটা বলতাম আমরা। বলব এখন?”

আশিক উৎসাহিত হয়ে বলল,
“শিওর। এত বড়ো একজন গায়িকা আমাদের জন্য হলেও যে ছোটোবেলার একটা ছড়া শোনাবে এটাও আমাদের জন্য অনেক।”
পৃথুলা হাসল। গলা পরিষ্কার করে ছড়া বলা শুরু করল,
“টুনটুনি গো পাখি
নাচো তো দেখি,
না বাবা নাচব না;
পড়ে গেলে বাঁচব না…”

ছড়া সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই শিমুলের নাক-মুখ দিয়ে খাবার উঠে যায়। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে নড়েচড়ে বসে আরশান। পৃথুলা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে শিমুলের কাছে গেল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“আহারে ভাইয়া! কী হলো হঠাৎ? টুনটুনি পাখির কথা মনে পড়ে গেল বুঝি?”
শিমুল পানি পান করে কাশতে কাশতে বলল,

“আমি ঠিক আছি। আপনি নিজের জায়গায় বসে খাওয়াটা শেষ করুন প্লিজ!”
পৃথুলা ক্রুর হেসে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। প্রসঙ্গ হঠাৎ বদলে গেল। খাওয়ার মাঝেই হুট করে মুন বলল,
“ছেলেরা কি বিয়ের পর মোটা হয়ে যায়?”
মুনের হঠাৎ এমন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে তাকায় আরশান, আহনাফ এবং আদিব। সবার মধ্যে এই তিন বেচারাই বিবাহিত পুরুষ কিনা! আরশান মুন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তাই সে বুঝতে না পেরে বলল,

“এরকম মনে হওয়ার কারণ?”
মুন এক লোকমা খিচুড়ি মুখে তুলে বলল,
“বিয়ের আগে আদিব মানে আমার হাজবেন্ড বেশ স্লিম ছিল। অথচ এখন দেখেন…দেখলে মনে হবে ছোটখাটো একটা হাতি। অন্যদিকে আমাদের দুলাভাই আহনাফ। উনিও কিন্তু বিয়ের আগে স্লিমই ছিলেন। এখন মনে হয় পান্ডা। আমি যদি ভুল না হই, তাহলে আপনিও স্লিম ছিলেন তাই না? পৃথুলা আপু তুমিই বলো আরশান ভাইয়া আগে স্লিম ছিল কিনা?”
পৃথুলা ফ্যাকাশে হাসল। শব্দ করে হাসতে পারলে ভালো লাগত। যার সাথে বিয়েই হয়নি তার আবার বিয়ের আগে-পরে কী কথা? তবুও সে অভিনয়টা চালিয়ে যেতে মৃদু হেসে বলল,

“হ্যাঁ, কিছুটা।”
মুন টেবিলের ওপর চাপড় দিয়ে বলল,
“এর কারণ কি জানিস তোরা?”
সবাই সমস্বরে জানতে চাইল,
“কী?”
“এর কারণ হচ্ছে বউয়ের হাতে রান্না। বউ সুস্বাদু রান্নাবান্না করে আর বর-রা খেয়ে-দেয়ে মোটা হয়।”
হাসিব ইনিয়েবিনিয়ে বলে,

“বলছিলাম যে, আমিও তো মনে হয় স্লিম। একটু মোটা হওয়া উচিত না মুন আপু? তোমার বান্ধবীকে বোঝাও না একটু।”
মুন লামিয়ার দিকে তাকাতেই লামিয়া কাঁটাচামচ তুলে বলল,
“খবরদার! আমার দিকে তাকাবি না। তাহলে তোর আর সাথে বিড়াল কমিটির এই চেয়ারম্যানেরও চোখ গেলে দেবো।”
আদিব মুনের যুক্তিকে নাকচ করে দিয়ে বলল,

“আমার লক্ষী বউ, তোমার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। আমি বিয়ের আগেও যেমন ছিলাম আর এখনও ঠিক তেমনই আছি। এমনকি আহনাফ ভাইয়াকেও বিয়ের আগে যেমন দেখেছি, এখনও তিনি তেমনই আছেন। বাকি রইল আরশান ভাইয়া। উনাকে আমি আগে কখনো না দেখলেও ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সে ভীষণ স্বাস্থ্য সচেতন লোক। আর এরকম লোক কখনো গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে না। সূতরাং আমরা কেউই তোমাদের রান্নাবান্না খেয়ে ফুলে যাইনি। তুমি যেটাকে মোটা বলছ, শব্দটা একচুয়ালি মোটা হবে না। ফিট হবে ফিট।”
আশিক তাল মিলিয়ে বলল,

“জি ভাইয়া। এবার মারেন ওর মাথায় একটা ইট।”
মুন কটমট করে তাকায় আদিবের দিকে। বলে,
“তুমি কি সারাজীবন এখানেই থাকবে? বাড়িতে যাবে না? ফডেং ফডেং করে কথা বলা পরে বুঝাব।”
আশিক প্রশ্ন করল,
“ফডেং ফডেং আবার কী কথা দোস্ত?”
“আপনি বেশি কথা বইলেন না কবি সাহেব। ফডেং ফডেং পরে জাইনেন, আগে আপনেরে করব আমি আলু পোস্ত।”

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবার ঘুমের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেলেদের জন্য আলাদা রুম এবং মেয়েদের জন্য আলাদা রুম। আহনাফের ঘুম আসছিল না। সে অর্ষার ফোনে টেক্সট করে,
“একটু ছাদে আসো প্লিজ!”

আরশান এবং হানিফ বসে আছে ড্রয়িংরুমে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আরশান রাগে গজগজ করছে। এই ছড়া মেয়েটাকে কে বলতে বলেছিল? দুনিয়াতে কি ছড়ার অভাব? সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এই যুগে গান জানে না কে?
শিমুলের ঘুমে চোখ লেগে আসছিল। সে হাই তুলতে তুলতে বলল,
“স্যার ঘুমাবেন না? অনেক রাত হলো তো।”
আরশান ল্যাপটপ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

“মেজাজ ভীষণ খারাপ। পৃথুলাকে বাইরে আসতে বলো তো।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, এখন। লনে যেতে বলো। আমি আসছি।”
“আচ্ছা।”
আরশান ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য নিজের রুমে চলে গেল।

আহনাফ ছাদে এসে দেখে ছাদ একদম ময়দান। কোথাও কেউ নেই। চারদিকে শুধু বড়ো বড়ো গাছপালা দেখা যাচ্ছে। অর্ষা এখনো আসলো না কেন? সে অপেক্ষা করার জন্য রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ট্যুরে ঘুরতে এসেছে আজ তিনদিন হবে। তার মধ্যে দু’দিন চলে গেছে অর্ষার রাগ ভাঙাতে। সকালে রাগ ভাঙল আর আজ তারা ভবঘুরে হয়ে জঙ্গলে রাত্রিযাপন করছে তাও আবার বউ ছাড়া। দুঃখে তার দুর্দশা জীবন। হঠাৎ দৃষ্টি নিচে যেতেই দেখতে পেল লনে অর্ষা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা একটু বেশিই ঘাড়ত্যাড়া। আসতে বলেছিল ছাদে অথচ দাঁড়িয়ে আছে লনে গিয়ে। সে সময় বিলম্ব না করে গটগট করে নিচে নেমে বাইরে এলো।

লনে গিয়ে দেখল অন্য এক ঘটনা। এ তো অর্ষা নয়। সকাল। আহনাফকে দেখে সকাল কিছুটা চমকে যায়।
“তুমি এত রাতে বাইরে কী করছ?”
সকাল কী বলবে বুঝতে পারছে না। আহিল এত করে দেখা করার কথা বলল যে সে আর না করতে পারেনি। তাই তো ভয়কে উপেক্ষা করে লুকিয়ে বাইরে এসেছে। তার চোখ যায় আহনাফের পেছনে। আহিল এসেছে। তবে সে আহনাফকে এখানে দেখেই তৎক্ষণাৎ গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

“সকাল!”
আহনাফের ভারী কণ্ঠ শুনে সকাল আমতা-আমতা করে বলে,
“ভীষণ গরম লাগছিল তাই আরকি…”
আহনাফ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। সকালের সাহস সম্পর্কে তার জানা আছে। নিশ্চয়ই আহিলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। এখন লুকিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা।

আরশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে। সে পরপর দু’বার হাই তুলে বলল,
“পৃথুলা লনে যেতে পারবে না। ছাদে যেতে বলেছে আপনাকে।”
আরশানের রাগ হলেও সে এই প্রসঙ্গে কিছু বলল না। শুধু শিমুলকে বলল,
“ঠিক আছে। ওকে ছাদ থেকে ড্রয়িংরুমে আসতে বলো।”
“আচ্ছা।”

শিমু্ল ঘুম ভাঙাতে হনহন করে ছাদে গিয়ে মাঝখানে দাঁড়ায়। পৃথুলার পেছনে দাঁড়িয়ে মিনমিনে স্বরে বলে,
“স্যার, আপনাকে ড্রয়িংরুমে যেতে বলেছে।”
“আপনার সমস্যা কী? পেছন থেকে যে ডাকি শোনেন না? আপনার স্যার আসেনি?”
শিমুল পেছন থেকে পৃথুলার কণ্ঠ শুনে আঁৎকে উঠে। এই মেয়ে পৃথুলা হলে সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে কে? একবার পেছনে এবং একবার সামনে তাকিয়ে শিমুল চিৎকার করে বলে উঠে,

মহাপ্রস্থান পর্ব ১০

“আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো! স্যার গো। বাঁচান গো। ভুউউউত…”
সে চোখ বন্ধ করে দোয়া-দরুদ পড়ছে,
“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ্-বিল্লাহ্।”
এদিকে শিমুলের অবস্থা দেখে পৃথুলা এবং অর্ষা হাসবে নাকি তার ভয় দূর করবে বুঝতে পারছে না।

মহাপ্রস্থান পর্ব ১২