মহাপ্রস্থান পর্ব ১২

মহাপ্রস্থান পর্ব ১২
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

শিমুলের জ্বর তরতর করে বাড়ছে। তার মাথার কাছে বসে পানি দিয়ে দিচ্ছে পৃথুলা। বাকিরা সবাই রুমে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়টা অত্যাধিক পর্যায়ের ছিল সেটা শিমুলের এহেন অবস্থা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।
আরশান নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে। শিমুলের এত অবনতি তার সহ্য হচ্ছে না। সামান্য একটা বিষয়ে এতটা ভয় পেয়ে গেল যে, ডিরেক্ট জ্বর এসে পড়েছে? ভেতরে ভেতরে সে রাগে ফেটে পড়লেও সামনা-সামনি ছিল স্থির। সে আহনাফ-অর্ষা এবং বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল,

“অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনারা প্লিজ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাদের জন্য অযথাই আপনাদের কত সময় নষ্ট হলো।”
অর্ষা বলল,
“সমস্যা নেই ভাইয়া। এই অবস্থায়…”
“আমরা আছি এখানে। আপনারা যান প্লিজ! এভাবে জেগে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার নিজের খুব খারাপ লাগবে।”
আরশানের খারাপ লাগাটা যেমন চোখে লাগছিল, তেমনই আবার তাদের সবার চোখেই ছিল ঘুম। তাই আর কেউ দ্বিমত করেনি। যার যার মতো ঘুমাতে চলে গেছে। ঘর ফাঁকা হতেই আরশান পৃথুলার ওপর ক্ষিপ্ত হলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কাজটা কী ঠিক করেছেন? এভাবে ভয় না দেখালেও পারতেন।”
পৃথুলা ভ্রুঁ কুঞ্চন করে বলল,
“আমার কী দোষ? আপনি আমাকে কেন বকছেন?”
“কাজই তো করেছেন বকার মতো। মাথায় তুলে নিচে একটা আ-ছা-ড় মারতে পারলে শান্তি হতো।”
“ঢং দেখলে আর বাঁচি না। এত দরদ কেন আপনার তার প্রতি? আমি ইচ্ছে করে তাকে ভয় দেখাইনি।”
“ইচ্ছে করে ভয় দেখাননি তাতেই জ্বর চলে এসেছে। আর ইচ্ছে করে যদি দেখান তাহলে তো ওকে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।”

“এখানে আমার কী দোষ বলুন? এমন দুর্বল হার্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাথে রাখেন কেন?”
“শিমুল এমন ছিল না। আপনার সঙ্গ পেয়ে এমন হয়েছে।”
“আমি ভীতু?”
“উত্তরটা আপনার ভালো করেই জানার কথা।”
“এত রাতে আপনার সঙ্গে আমার তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমাব।”

“আটকে কে রেখেছে? যান।”
“কোন রুমে ঘুমাব? আমার রুমে তো ওরা আছে।”
“আমার রুমে।”
“ছি, ছি মুখে মুখে কবুল বলেছি বলে কি সত্যি সত্যিই বউ ভাবা শুরু করে দিয়েছেন? আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে থাকতে পারব না।”
আরশানের চক্ষু চড়কগাছ। মেজাজ ক্ষিপ্ত। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আমি আপনার সাথে থাকব কে বলল? আপনি একা থাকবেন। মেয়েরা এক লাইন বেশি বোঝে জানতাম। আপনি তো ১০০ লাইন বেশি বোঝেন। কোন ধাতু দিয়ে তৈরি আপনি?”
“মাটি দিয়ে বানানো হয়েছে আমাকে।”
“এই আসুন তো আমার সাথে।”
বিরক্ত হয়ে বলল আরশান। পৃথুলাকে নিজের রুমে রেখে বাইরে থেকে লক করে দিলো। কোনো রকম রিস্ক সে নিতে চায় না। আপাতত আজ রাতটা সে শিমুলের ঘরে থাকবে বলেই মনস্থির করে।

অর্ষা ওপাশ হয়ে শুয়ে আছে। সে ঘুমে মত্ত। আহনাফ শুয়ে আছে আকাশমুখী হয়ে। তার দু’চোখে ঘুম নেই। শ্যালক এবং শালিকারা মিলে দুজনকে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিল অথচ মহারানী ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। আহনাফের খুব করে ইচ্ছে করছে অর্ষার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে। একটু দুষ্টুমি করার বাসনা মনে। সে অর্ষার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। নিজে হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ঘুমন্ত অর্ষার দিকে। মুচকি হেসে আহনাফ অর্ষার নাকে একটা চুমু খেল। গালে আলতো করে স্লাইড করতে করতে বিড়বিড় করে বলল,

“সাইজে ছোট্ট একটা মেয়ে, অথচ রাগ তার থেকেও দ্বিগুণ!”
অর্ষা ঘুমের ঘোরেই আবার অন্যপাশ হতে গেলে আহনাফ তাকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে আসে। মাথাটা তুলে নিজের হাতের ওপর রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অর্ষা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
“গরম লাগে!”
আহনাফ বাঁধন হালকা করল। অর্ষার ঠোঁটে চুমু খেয়ে অর্ষাকে কপি করে বলে,
“গরম লাগে!”

দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। আরশান শিমুলের রুম থেকে সেই শব্দ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে। শব্দটা আসছে তারই ঘর থেকে। সে শিমুলের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল। পৃথুলাকে আর কী বকাঝকা করবে; পৃথুলা নিজেই রেগেমেগে বো-ম হয়ে আছে। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলে,

“কতক্ষণ ধরে ডাকছি, কানে শোনেন না?”
“আস্তে কথা বলুন। কী হয়েছে?”
“কী আবার হবে? বিয়েই তো হলো না এখনো।”
“বাজে কথা না বলে কেন ডেকেছেন বলেন।”
“আমার ঘুম আসছে না।”
“তো?”
“তো আবার কী?”

“আপনার ঘুম আসছে না তো আমি কী করব?”
“আমাকে সঙ্গ দেবেন।”
“মানে!”
“চোখ দুটে ওমন বড়ো বড়ো করেছেন কেন? সঙ্গ বলতে আপনি কী বুঝলেন?”
আরশান গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“কিছুই বুঝিনি। বুঝিয়ে বলুন।”
“চলেন চাঁদ দেখি।”
“কোথায়?”

“ছাদে?”
“না। এত রাতে ছাদে যাওয়া যাবে না।”
“তাহলে বারান্দায় আসেন।”
আরশান কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,
“পারব না। ঘুম না আসলে চুপচাপ শুয়ে গিয়ে শুয়ে থাকেন।”
“আপনি আমার সঙ্গে চাঁদ দেখবেন না?”
“না।”

“তাহলে আমি এখনই সবাইকে ডেকে বলব আপনি আমাকে কি’ড’ন্যা’প করে এখানে আটকে রেখেছেন। ডাকব?”
“ব্ল্যাকমেইল করছেন আমাকে?”
“না, হোয়াইটমেইল করছি। আপনি নিষ্ঠুর,পাষাণ। আপনার কথা তো আমি শুনেছি। বউ না হয়েও বউ হওয়ার অভিনয় করেছি। আর আপনি…”
আরশান পৃথুলার ননস্টপ বকবকানি থামাতে বলল,
“চুপ! থামুন। আর কিছু বলতে হবে না। আপনি বারান্দায় যান। আমি শিমুলের ঘরের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসছি।”
“দেরি হয় না যেন।”

শিমুলের ঘরের দরজা চাপিয়ে নিঃশব্দে আরশান নিজের রুমে প্রবেশ করল। পৃথুলা বারান্দার দোলনায় বসে আছে। গুনগুনও করছে সম্ভবত। আরশানকে দেখা মাত্রই তার ঠোঁট নাড়ানো থামল। একটা টুল হাত দিয়ে ঠেলে সামনে দিয়ে বলল,
“বসুন।”
বিনাবাক্যে বসল আরশান।
পৃথুলা দোলনায় বসে দুলতে দুলতে বলল,
“আপনার রুমে এত সুন্দর বারান্দা আছে। অথচ আমি আগে দেখিইনি!”

“দেখলে কী হতো?”
“আমি নিয়ে যেতাম। অবশ্য সমস্যা নেই। সকালে শিমুল তুলাকে বলব দোলনাটা যেন আমার রুমে দিয়ে আসে।”
“আপনি কি এখানে সারাজীবন থাকার প্ল্যান করছেন নাকি?”
“থাকতে পারলে মন্দ হতো না। ফ্রিতে খাওয়া-দাওয়া, থাকা কার না ভালো লাগে?”
আরশান স্মিত হাসল। পৃথুলা নিজের হাসিটা চওড়া করে বলল,
“হাসলে আপনাকে কত সুন্দর লাগে! হাসেন না কেন?”

আরশান উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড মৌনতা পালন করে পৃথুলা নিজেই বলল,
“আচ্ছা আপনি কি ওয়েটারের কাজ করেন?”
প্রশ্ন শুনে আরশানের মুখ হা হয়ে যায়। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“মানে? এতদিনে আপনার এটাই মনে হলো যে, আমি ওয়েটারের জব করি?”
”মানে কী আবার? আরবীতে তো কিছু বলিনি। চাইনিজ ভাষায়ও কিছু বলিনি। তাহলে বুঝলেন না কেন?”

”আমি ওয়েটারের চাকরী কেন করতে যাব? আপনার কি আমার সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?”
”না,নেই তো। আচ্ছা বুঝলাম আপনি ওয়েটারের চাকরী করেন না। তাই বলে কি আপনার আর কোনো জামা-কাপড়ও নেই! সেই এক সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট পরেন অলওয়েজ।”
এ কথার জবাব না দিয়ে আরশান ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। আলমারি খুলে বলল,

“আমি এক পোশাক প্রতিদিন পরি না বরং এক কালারের পোশাক পরি।”
পৃথুলা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলো সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট আলমারির কেবিনেটে রাখা। বোঝাই যাচ্ছে মানুষটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট লাভার। একটু মিনমিন করা গলায় সে বলে,
”অন্য কালারেও আপনাকে দারুণ মানাবে। ট্রাই করে দেখতে পারেন।”

আরশান এ কথারও কোনো জবাব দিল না। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে বলল,
“রাত কিন্তু অনেক হয়ে গেছে। ঘুমাতে হবে।”
“আপনার ঘুম পেয়েছে?”
“হ্যাঁ।”
“ঠিক আছে! ঘুমান তাহলে।” মন খারাপ করে বলল পৃথুলা।
আরশান পৃথুলার মন খারাপকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শিমুলের রুমে চলে গেল। অগত্যা বাধ্য হয়ে পৃথুলাকেও ঘুমানোর চেষ্টা করতে হলো।

সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য নাস্তা টেবিলে সাজায় পৃথুলা। তাকে সাহায্য করেছে শিমুল। জ্বর আর এখন নেই। ভোরের দিকেই সে বাজারে গিয়ে সবার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে।
নাস্তা শেষ হলে আহনাফ-অর্ষা এবং গ্যাঞ্জাম পার্টিরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। খুবই বিনয়ের সঙ্গে পৃথুলা, আরশানকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে গেছে আহনাফ এবং অর্ষা। ওদেরকে এগিয়ে দিতে গিয়েছে শিমুল।
পৃথুলা নিজের রুমে যাচ্ছিল। আরশান তখন পেছন থেকে বলে,

“রেডি হয়ে নিন।”
পৃথুলা অবাক হয়ে বলে,
“কেন? আজ আবার কোথায় নিয়ে যাবেন?”
“আপনার ঠিকানায়।”
“আমার ঠিকানায় বলতে? আমাকে একেবারে দিয়ে আসবেন বলতে চাইছেন?”
“হ্যাঁ।”

এমন কথা শুনে পৃথুলার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু সে খুশি তো হতেই পারছে না; উলটো ভেতরটা ভেঙেচূড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আরশান তাড়া দিয়ে বলল,
“সময় নেই। জলদি করুন।”

পৃথুলা আলতো মাথা নাড়িয়ে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে এলো। আজও আরশান একটা কালো কাপড় দিয়ে পৃথুলার চোখ বেঁধে দেয়। চোখ বাঁধার সময় আলতো করে আরশানের হাত স্পর্শ করে সে। কী নিদারুণ এক যন্ত্রণা বুকের মাঝে উথালপাতাল ঢেউ তুলছে। জঙ্গলের পথটুকু কেউ কোনো কথা বলল না।সারাদিন ননস্টপ কথা বলা পৃথুলাও যেন আজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। গাড়িতে বসে শুধু জিজ্ঞেস করে,

“শিমুল তুলার সঙ্গে দেখা হবে না?”
“না।” আরশানের উত্তর।
পৃথুলাকে যেখান থেকে কি’ড’ন্যা’প করা হয়েছিল সেখানে এসেই গাড়ি থামায় আরশান। পৃথুলার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল,
“চলে এসেছি।”

পৃথুলা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। আরশান তার ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল,
“কয়েকদিন একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। আর পারলে মাস্ক ক্যারি করবেন।”
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পৃথুলা। আরশান জানতে চায়,
“কিছু বলবেন?”
পৃথুলা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আরশান জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে,
“ভালো থাকবেন।”

পৃথুলা নিরুত্তর। একরাশ অদৃশ্য অভিমানের ছায়া তার চোখে-মুখে। আরশান গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথুলা ব্যস্ত হয়ে বলে,
“শুনুন, শুনুন।”
আরশান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। পৃথুলা বলে,
“আমাদের কি আর কখনো দেখা হবে না?”
আরশান কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বলল,
“আমার সাথে দেখা না হওয়াটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক পৃথু।”

এরপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে আরশান চলে যায়। পথহারা পথিকের ন্যায় নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পৃথুলা।

মহাপ্রস্থান পর্ব ১১

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ এই পর্বে আহনাফ-অর্ষা, গ্যাঞ্জাম পার্টির বর্ণনা তেমন দিতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, ইদের আগেই চেষ্টা করব ওদের নিয়ে একটা সারপ্রাইজ পর্ব দেওয়ার, ইন-শা-আল্লাহ্।
এনিওয়ে, মহাপ্রস্থান ভালো লাগছে তো? আপনাদের কি মনে হয় ওদের পথচলা এখানেই শেষ নাকি এখান থেকেই অপেক্ষা করছে নতুন কিছু?

মহাপ্রস্থান পর্ব ১৩