মহাপ্রস্থান পর্ব ৯

মহাপ্রস্থান পর্ব ৯
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

আতোয়ার চৌধুরী গালে হাত দিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বসে আছেন। কাজকর্মে মন নেই। মনেও তার সুখ নেই। সুখ থাকবেই বা কীভাবে? আদরের ছেলে যদি জেলে থাকে তবে তো কোনো বাবার-ই ভালো থাকার কথা নয়। আরশান দরজায় নক করে বলল,
“আব্বু, আসব?”
তিনি দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আসো।”
আরশান তার সম্মুখের চেয়ারে বসে বলল,

“এত রাত হয়েছে। আপনি এখনো বাড়িতে ফেরেননি কেন?”
“বাড়িতে মন টেকে না। রাফসান জেলে। তুমি যে কোথায় কোথায় থাকো সেই খবরও এখন আমার কাছে থাকে না।”
“আপনাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে।”
“দুশ্চিন্তার তো শেষ নেই। শিলা মেয়েটা হুট করেই উধাও হয়ে গেল। অন্য কেউ রাফসানের কেসটা নিচ্ছে না।”
“কেন নিচ্ছে না আপনি জানেন না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জানি। জার্নালিস্ট রাত্রি ইসলাম গতকাল রাতে মা-র্ডা-র হয়েছে। এই নিউজ তো এখন মিডিয়াতে আরও হৈ-চৈ ফেলে দিয়েছে। আমি তো রাফসানের মুক্তির কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।”
আরশান বাবার হাতের ওপর এক হাত রেখে বলল,
“আপনার কি আমার ওপর ভরসা নেই আব্বু?”
আতোয়ার চৌধুরী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আরশান বলল,

“রাফসানকে আমিও কম ভালোবাসি না। ও আমার ছোটো ভাই। ওকে জেল থেকে বের করে আনার দায়িত্ব আমার। আজ হোক বা কাল হোক ওকে আমি ছাড়িয়ে আনবই। আপনি শুধু আমার ওপর একটু ভরসা রাখুন।”
“তোমার ওপর ভরসা আছে বলেই এখনো নিঃশ্বাস নিতে পারছি।”
আরশান মৃদু হাসল। বলল,

“এখন তাহলে উঠুন। বাসায় যান। মা তো একা রয়েছে।”
“যাব। একটু দেরি হবে।”
“কাজ আছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে আমি উঠছি। যেতে হবে আমার।”

আতোয়ার চৌধুরী মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন। আরশান দরজা অব্দি যেতেই তিনি পেছন থেকে বললেন,
“আরশান, শিলাকে না তোমরা কি-ড-ন্যা-প করেছিলে? তাহলে ও এখন দেশের বাইরে কী করে গেল?”
আরশান বাবার মুখপানে তাকাল। সত্যটা গোপন করে বলল,
“শিলা ভেবে অন্য একটা মেয়েকে তুলে এনেছিলাম। ছেড়ে দিয়েছি তাই। তাছাড়া শিলা চৌধুরী এখন কোন দেশে আছে এসব খবরা-খবর বের করার জন্য লোক লাগিয়েছি। আশা করছি, পজিটিভ কিছুই হবে।”

“বেস্ট অফ লাক। সাবধানে যেও।”
আরশানের বাংলোবাড়িতে আসতে আসতে রাত দশটা বেজে গেল। দরজা খুলে দিল শিমুল। আরশান ভেতরে প্রবেশ করে প্রথমেই পৃথুলার কথা জানতে চাইল। শিমুল বলল,
“সে ছাদে গেছে।”
আরশান আতঙ্কিত হয়ে বলল,

“এত রাতে ছাদে গেছে মানে? তাও একা! তুমি বারণ করোনি কেন?”
“স্যার আপনার কি মনে হয় সে বারণ শোনার মতো মেয়ে? ভীষণ একরোখা টাইপ! হাজারবার নিষেধ করেছি। শোনেনি।”
আরশান আর কথা না বাড়িয়ে নিজেই ছাদে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল।

অন্ধকার রাত। চারদিকে বড়ো বড়ো গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছের পাতার ফাঁকফোকর গলে চাঁদের মৃদু রশ্মি ছাদে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে। অদূরে শোনা যাচ্ছে ঝিঝি পোকার ডাক। পৃথুলা ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথম প্রথম তার এখানে ভয় লাগলেও এখন আর ভয়ের লেশমাত্র তার মধ্যে নেই। এই বন-জঙ্গল, গাছপালা, চাঁদ, ঝিঝি পোকা, অদৃশ্য হাওয়া সবই এখন তার পরিচিত। বন্ধুর মতো। বন্ধুদের আবার ভয় পায় কে?

“আপনি এত রাতে ছাদে কী করছেন?”
আরশানের গম্ভীর গলার স্বর ভেসে এলো। নিস্তব্ধতা ভেঙে গেল মুহূর্তেই। ভ্রুঁ কুঞ্চন করে পিছু ফিরে তাকাল পৃথুলা। ততক্ষণে আরশান কাছাকাছি চলে এসেছে। তার চোখে-মুখে রাগ। সে মৃদু ধমকেরসুরে বলল,
“ভয় নেই নাকি মনে হ্যাঁ?”

পৃথুলা ভেংচি কেটে বলল,
“কি-ড-ন্যা-পা-রকেই ভয় পাই না। আর নাকি ভয় পাব অন্যকিছু!”
“নিচে নেমে আসুন।”
“না। আমার এখানেই ভালো লাগছে। আপনি চলে যান। আমি একা থাকব।”
“শখ দেখলে মনে চায় ঠাটিয়ে দুটো থা-প্প-ড় বসাই।”
“থা-প্প-ড় বসাবেন মানে কী? এটা কি সরকারি গাল পেয়েছেন নাকি?”
“আপনি নামবেন?”

“বললাম তো না।” এই বলেই সে ছাদের মেঝেতে বসে পড়ল।
অগত্যা রাগে, জিদ্দে আরশানও মেঝেতে বসল। মশার অত্যাচার শুরু হয়ে যায়। বসে বসে মশা মারছে আর রাগী দৃষ্টিতে সে পৃথুলাকে দেখছে। পৃথুলার চোখে-মুখে হাসির ঝলক। মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আরশান শিমুলকে ফোন করে বলল কয়েল জ্বা-লি-য়ে নিয়ে আসতে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শিমুল মশার কয়েল, একটা পাটি আর ফ্লাক্স ভর্তি চা নিয়ে এল। এতসব সরঞ্জাম দেখে আরশানের চক্ষু চড়কগাছ। সে জানতে চাইল,

“এসব কী?”
“চন্দ্রবিলাসের সরঞ্জাম। কয়েল যখন আনতে বললেন তখনই বুঝতে পেরেছি আপনারা এখানে চন্দ্রবিলাস করবেন। তাই বুদ্ধি করে পাটি আর চা-ও নিয়ে এসেছি। চা খেতে খেতে চাঁদের আলোয় গল্প করবেন।”
“তুমি মনে হয় আজকাল বেশি বোঝা শুরু করেছ।”
শিমুলের মুখটা পাংশুটে হয়ে গেল। আগ বাড়িয়ে ভালো করতে গিয়ে ভুলভাল কিছু করে ফেলল নাকি কে জানে! সে কণ্ঠ খাদে ফেলে বলল,

“আমি যাই স্যার। শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“যাও।”
বলার সঙ্গে সঙ্গেই শিমুল দৌঁড়ে নিচে নেমে গেল। তখন রাগ দেখালেও শিমুল চলে যাওয়ার পর আরশান ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে চুমুক দিল। কতক্ষণ এই নিরবতা চলল ঠিক মনে নেই। তবে মৌনতা কাটিয়ে হঠাৎ-ই পৃথুলা বলল,
“ছোটোবেলায় গ্রামে যখন কারেন্ট চলে যেত, মা তখন আমাদের দু-বোনকে নিয়ে উঠানে পাটি পেতে বসত। চাঁদের আলো উপভোগ করতাম শুয়ে শুয়ে। মা হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে অনেক গল্প শোনাত। রাজা-রানির গল্প, ভূতের গল্প আরও কতশত গল্প!”

আরশান বলল,
“তিনি এখন কোথায়?”
“চাঁদ যেখানে থাকে।”
“মানে?”
পৃথুলা আরশানের মুখের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলল,
“আকাশে।”
“তার মানে….”
“মানেটা খুব সহজ। আমার মা বেঁচে নেই। বাবাও না।”
“স্বাভাবিক মৃ-ত্যু ছিল?”
“বাস এ’ক্সি’ডে’ন্ট।”
“তখন আপনার বয়স কত ছিল?”

“মনে নেই ঠিক। তবে খুব ছোটো-ই ছিলাম। বাবা-মায়ের মৃ-ত্যুর পর আমাদের দু-বোনের দায়িত্ব নিয়েছিল মামা-মামি। শিলা ছোটো থেকেই গম্ভীর এবং সিরিয়াস স্বভাবের ছিল। পড়াশোনাতেও ছিল মেধাবী। আর আমি ওর বিপরীত। উশৃঙ্খল, চঞ্চল, পড়াশোনায় সবসময় ডিম পেতাম। আর সিরিয়াসনেসের কথা তো আপনাকে নতুন করে বলতে হবে না। আমার আচরণে এতদিনে বোঝার কথা।”

কথা শেষ করে পৃথুলা হাসার চেষ্টা করল। আরশান চুপচাপ শুনছে। একটু সময় নিয়ে পৃথুলা অনুরোধের সুরে বলল,
“আমি কি আপনার কোলে মাথা রাখতে পারি?”
আরশান আচমকা কোনো উত্তর দিতে পারল না। তবে তার সম্মতি ছিল। পৃথুলা পাটিতে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আরশানের কোলে মাথা রেখে বলা শুরু করল,

“আমি ছিলাম গুড ফর নাথিং। আমার দ্বারা কিছুই হবে না এটা মামা-মামিও বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তারা শিলাকে তাদের কাছে রেখে আমাকে এতিমখানায় দিয়ে আসে। আমার শৈশবের বাকি সময় এবং কৈশোর কাটে এতিমখানাতেই। এস.এস.সির পর আমি এতিমখানার এক শিক্ষকের সাহায্যে সরকারি কলেজে ভর্তি হই। নিজের জীবনটাকে নিজের মতো গোছানোর চেষ্টা করি। ভার্সিটির পড়া শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে জব নিই।”

“এর মাঝে আপনার মামা-মামি কিংবা শিলার সাথে যোগাযোগ হয়নি?”
“মামা-মামি যোগাযোগ রাখেনি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগ করার। কিন্তু যখন থেকে বুঝতে পারলাম, তারা আসলে আমাকে চায় না তখন থেকেই আমিও আর চেষ্টা করিনি। তবে হ্যাঁ, এসএসসির পর মাঝে মাঝেই শিলার সঙ্গে আমার ফোনে কথা হতো। দেখা হয়েছিল হাতে গোণা কয়েকবার। এরপর শিলাও আর যোগাযোগ রাখেনি। পাঁচ বছর পর কোত্থেকে আমার ফোন নম্বর জোগার করে সেদিন দেখা করতে বলল। আর ঐদিনই আপনারা আমাকে কি-ড-ন্যা-প করে নিয়ে এলেন।”

আরশান ভাবছিল পৃথুলার ছোটোবেলার সময়টা নিয়ে। কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে জানে না। পৃথুলার ভারী নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? সে আলতো করে পৃথুলার মুখ ছুঁতে গিয়েও থমকে গেল। চুলের মাঝে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিল। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখল বারোটা পার হয়েছে। আর ছাদে থাকা ঠিক হবে না। সে পৃথুলাকে কোলে তুলে নিল। চাঁদের আলোয় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে পৃথুলার মুখ। চোখে-মুখে মলিনতার ছাপ। গাল কেমন চিটচিটে দেখাচ্ছে। নিশ্চয়ই কেঁদেছে। আরশান আনমনে বলে উঠে,

মহাপ্রস্থান পর্ব ৮

“আমাদের সবারই বোধ হয় একটা করে হলেও গোপন দুঃখ থাকে। সেই দুঃখময় জীবনের গল্প কেউ জানে তো, আবার কেউ জানে না। কিন্তু গোপন দুঃখ আমাদের সকলেরই রয়েছে। চাঁদের মতো সুন্দর তুমি পৃথু। তোমার জীবনে আর দুঃখ না আসুক।”

মহাপ্রস্থান পর্ব ১০