মেঘফুল ফুটলো মনে গল্পের লিংক || আবরার আহমেদ শুভ্র

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ১
আবরার আহমেদ শুভ্র

– তোকে আমি বিয়ে করতে পারবো না তানজিম৷ আমি অথৈকে ভালো বাসি। আরও মা ও তাকে পছন্দ করেন আমার বউ হিসেবে। তুই পারলে ভুলে যা আমায়।
ছাদে প্রিয় গাছগুলোতে আপন মনে পানি দিচ্ছিলো তানজিন, হঠাৎ পরিচিত প্রিয় মানুষের এমন কথা শোনে বুক কেঁপে উঠল তার। পিছন ফিরার সাথে সাথে আবারও বলে উঠল,

– আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না তানজিম, মা আমার সাথে অথৈ এর বিয়ে ঠিক করেছে। মেইবি কাল সামাজিকভাবেই বিয়েটা হয়ে যাবে।
– কি বলছেন আপনি এসব? আমাদের এতোদিনের প্রেম ভালোবাসা সবই কি এক নিমিষেই মুছে ফেলবেন মন থেকে? পারবেন তো?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– কি করবো বল, আর মা যে অথৈকে চাই নিজ ছেলে বউ করতে৷ তাহলে কেমনে আমি তোকে বউ করে ঘরে তুলবো?
– তাহলে প্রেম করার আগে এসব মনে ছিলো না আপনার? এতবছর তা হলে আমার সাথে প্রেমের নাটক করেছিলেন! এভাবে আমায় কেন ঠকালেন তানিম ভাইয়া? কেন আমার সাথে এতোবড় বিশ্বাসঘাতকা করলেন? আপুর জায়গায় তো আমার থাকার কথা ছিলো, তাই না? বিয়েটা কি আমায় করলে আপনার জীবনে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যেত? তাহলে কেন করলেন এমনটা আপনি? কি ক্ষতি করেছিলাম আপনার?

উপরোক্ত কথাগুলো শোনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো তানিম। যেন কথাগুলো তার কাছে ছেলেখেলাই মাত্র।
– জানিস তো কিছু কিছু জিনিসের টেস্ট নেয়াটা খুবই জরুরি। যেন জিনিসটার স্বাদটা একটু আধটু বুঝা যায় সেই জন্যই, আর সেই জিনিসগুলোর মাঝে তুইও একজন। আমি তো তোকে কখনও ভালোবাসিনি রে। যা ছিলো সবই তো প্রেম প্রেম খেলা। বুঝলি, মিস তাহিয়া তানজিম?

তানিমের এমন বাজে কথাগুলো শোনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে সে! নিজেকে সামলে মলিন হাসি দিয়ে বলে উঠল,
– যায়হোক আমার সাথে খুব ভালোই অভিনয়টা করেছিলেন। বলা যায় পারফেক্ট অভিনেতা আপনি। আমার সাথে করেছেন ভালো কথা, কিন্তু আপুর সাথে প্রতারণা করিয়েন না প্লিজ। নাহয় সে বেচে থেকেও জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে।
এটুকু বলে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে সেখান থেকে প্রস্থান করলো সে। এখানে আর কয়েক মূহুর্তের জন্য থাকলে তাকে আরও অনেক বাজে কথা শোনতে হবে সেই প্রতারকের কাছ থেকে।

নিস্তব্ধ রজনীর মধ্যপ্রান্ত এখন! চারিদিকটা ঘন কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। ধরনীর বুকে এখন সকলেই ঘুমিয়ে আছে। আর নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে তারাই যারা নিঃস্বার্থ ভালোবেসেও পেয়েছে শুধু অবহেলিত অপমান। রেশমের একটি চাদর গায়ে জড়িয়ে আনমনে আকাশপানে চেয়ে আছে তানজু। আর বিড়বিড় করে বলে উঠল,

– কেন এমন হলো আমার সাথে? তাকে তো কখনও কষ্ট দিয়েও কথা বলি নি কিংবা তার সাথে প্রতারণা করার সাহস করিনি! তাহলে কেন সে আমাকে এভাবে ঠকালো? কি দোষ ছিলো আমার? আর মনে রাখবেন একটা কথা মিস্টার তানিম মাহমুদ, আপনাকে কখনো ক্ষমা করবো না আমি! কখনো না!

সকাল হতেই বিয়ের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে রওশন প্যালেসে। হওয়ারই কথা রওশন বেগমের বড় নাতির বিয়ে বলে কথা৷ উৎসবমুখর এই দিনে সকলের চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছে আনন্দের ছাপ। শুধু একজন ছাড়া! হা তানজু ছাড়া। তার বেহায়া আঁখি যুগল একমনে তানিমকে খুঁজে চলছে!

সে নিজেও বুঝতে পারছে না কেন তার এমন লাগছে? সারা কিছু মুখে তোলেনি সে! এর মাঝেই তানজুর মা শায়লা বেগম তাকে অনেকবার তাকে খেতে ডেকেছে। কিন্তু প্রতিবারই সে না করে দিয়েছে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে শায়লা বেগম তানজুর হাত ধরে ওনার রুমে নিয়ে এলেন নিজের মেয়েকে। বিরক্ত মাখা মুখে মেয়ের দিকে তাকালেন। তানজু এখনও নিচের দিকে তাকিয়ে আছে! শায়লা বেগম মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। টলমল চোখে মায়ের দিকে তাকালো সে। মেয়ের চোখে জলে দেখে বুক কেঁপে উঠল শায়লা বেগমের।

– কি হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন?
– না আম্মু, এমনেই!
-আমায় কি পাগল ভেবেছিস? নাকি অবুঝ ভেবেছিস? কোনটা?
– আসলে আম্
– বুঝছি আমি ক্ষিদে লেগেছে বলে এভাবে কাঁদছিস পাগল মেয়ে? বস এখানে, আমি খাবার নিয়ে আসছি। একদম নড়বি না।
মাথা নেড়ে সায় দিলো সে। তার মাঝে চলে যেতেই বিড়বিড় করে বলে উঠল সে,

– তুমি বুঝতে পারোনি আম্মু! আসলেই বুঝতে পারেনি তোমার মেয়ে ঠিক কোন দহনে পুড়ছে। যদি দেখতে তাহলে কখনও খাওয়ার কথা বলতেই না। কারণ ওসব খাবার আমার গলা দিয়ে নামবে না।
ওয়াশরুম থেকে গুনগুন গানের আওয়াজ শোনে চমকে উঠলো তানজু। একটা খানিকটা চেনা পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে কানে।

ভাবলে কে হতে পারে? পরক্ষণেই মনে পড়ল বিয়েবাড়িতে কতো লোক থাকতে পারে! তাদের মধ্যে হয়তো কেউ একজন হবে। সে কি করবে বুঝতে পারলো না। তার মা তাকে এখানে খুঁজে না পেলেও লঙ্কা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে তার ইয়ত্তা রাখা মুশকিল। এখান থেকে নড়তেও পারছে। তাই এমনভাবে বসে রইল যেন সে জানে না রুমের ওয়াশরুমের ভেতর কেউ আছে। হঠাৎ দাঁড়াতে গিয়ে কেমন যেন তার চোখ গুলিয়ে উঠল, সাথে সাথে বিছানার একপাশে পড়ে গেলো সে।

মাত্রই চেম্বার থেকে বাড়ী না গিয়ে ডিরেক্ট মামার বাড়িতে এসেছে ফুয়াদ। ফুয়াদ আহমেদ, সম্পর্কে তানজিমের ফুফাতো কাজিন সে। গতমাসে ইউকে থেকে ডাক্তারিতে পিএইচডি করে সবে মাত্রই ডাক্তারিতে জয়েন করলো। আর আজ মামাতো ভাই তানিমের বিয়েতে এটেন্ড করার জন্য ডিরেক্ট রাজশাহী হতে চট্টগ্রামে এলো সন্ধ্যায়। এসেই শাওয়ার নিবে বলে ওয়াশরুমে গেলো মিনিট দশেক আগেই। শাওয়ারের সময় গুনগুন করে গান না গাইলে যেন শাওয়ারই নিতে পারে না সে।

শাওয়ার শেষ করে বের হতেই বিছানায় কোনো মেয়েকে শোয়ে থাকতে দেখে খানিকটা ভ্রুকুঞ্চন হলো তার! তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গলা খাঁকারি দিলো। কিন্তু তার কোনো রেসপন্স না পেয়ে সামনে গিয়ে দেখলো তানজিম বিছানায় শোয়ে আছে৷ ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে গেছে। তাই তাকে রাগানো জন্যই বলে উঠলো,

– এই উড়ুফড়িং, উঠ.. এখন কি কেউ ঘুমায়?
কিন্তু কোনো রেসপন্স না পেয়ে খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো সে! সে সময় রুমে প্রবেশ করলো তার ছোট মাম্মি অর্থাৎ তানজিমের মা শায়লা বেগম। তিনিও মেয়েকে এমন করে পড়ে থাকতে দেখে ঘাবড়ে গেলেন। সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল। তার একমাত্রই মেয়ে। ফুয়াদ মামির সামনে তোয়ালেতে বেশ বিব্রতবোধ করলো। তাই সে দ্রুত গ্যান্জ্ঞি আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে গিলে চেঞ্জ করে এলো। তারপর তার মামির উদ্দেশ্যে বলল,

– মাম্মি ঘাবড়ানোর প্রয়োজন নেই আমি দেখছি। কিচ্ছু হবে না ওর। আমি আছি তো।
বলে সে তানজিমের দিকে এক পলক তাকালো। কেমন মায়াবী লাগলো মুখখানি! তারপরে দ্রুত তার ব্যাগ থেকে বিপি মেশিন বের করে ব্লাডপ্রেশার চেক করার পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। তারপরে সে শায়লা বেগমের দিকে ফিরে বলল,

– ছোট মাম্মি চিন্তার কোনো কারণ নেই ওর ব্লাডপ্রেশার লো হয়ে গেছে তাই ও সেন্সলেস হয়ে গেছে।
এতোক্ষণে বাড়ির সকলে এসে উপস্থিত তাদের রুমে। তানজিমের বাবা নাবিল আরমান ফুয়াদের কাছে এসে বললেন,
– ভাগ্যিস তুমি ছিলে বলে নয়তো আমাদের চিন্তার সীমা থাকতো না৷
– আসলে মামা খাবার কমে খাওয়া, দুশ্চিন্তা, আর পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমের অভাবে তানজুর প্রেশার লো হয়ে গেছে৷ আপনি চিন্তা করবেন না৷ কিছুক্ষণ রেস্ট করুক তারপরেই ওর জ্ঞান ফিরবে৷

– যাক তাহলে চিন্তামুক্ত হলাম৷
তারপরে তিনি সকলের মনোযোগ আকর্ষনের উদ্দেশ্যে বললেন,
– আপনারা সবাই প্লীজ বিয়ের অনুষ্ঠানে যান। এখানে গেদারিং করে কোনো লাভ নেই৷ সো প্লীল, লেটস ইনজয়।
সকলে যে যার মতো অনুষ্টানের দিকে চলে গেলো৷ এতক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে সবাই দেখ ছিলো তানিম। মুখে তার বিরক্তিভাব। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল,

– ডিজগাস্টিং লেডি! ড্রামা করে আমার বিয়ের অনুষ্ঠান নষ্ট করতে আসছে।
তার এমন বাজে বিহেভ আরও কেউ না শুনলেও একজন ঠিকই শুনেছে। রাগে তার চোয়াল শক্ত করে এলো। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে সে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাই না। নাহয় তার প্রেয়সীর বদনাম করতে দ্বি বার ভাববে না এই ষ্টুপিড পার্সন। তাইতো সে মনে মনে বলে উঠল,
– নিশিতের কোনো এক রজনীর বিবর্তনে তুই ঠিকই পুড়বি বিহনে! পারবিনা সইতে, পাবি না কইতে! নিশিতে তুই পুড়বি ঠিকই।

মেঘফুল ফুটলো মনে পর্ব ২