যদি তুমি বলো পর্ব ১৫

যদি তুমি বলো পর্ব ১৫
আফনান লারা

ইশানের চোখের দিকে তাকিয়ে তিথির ভীষণ ভয় হচ্ছিলো।অথচ কত গুলো বছর আগে ইশান তার চাহনিতে ভয় পেতো।
বছর কত কতকিছু পাল্টে দিতে পারে।
তিথিকে চুপ করে থাকতে দেখে ইশান এক চিৎকার দিয়ে বললো,’আমাকে যা নয় তা বলে অপমান করেছিলি।তা নাহয় বাদই দিলাম,কিন্তু তুই তাতেও ক্ষান্ত হোসনি সেদিন।আমার মা যখন সেদিন আমার কান্না দেখে তোর কাছে আমার জন্য প্রেম ভিক্ষা চাইতে গিয়েছিলো তুই আমার মাকে এত অপমান করার সাহস কই পেয়েছিলে?সেদিন হয়ত আমার কোনো ক্ষমতা ছিল না আমার মায়ের চোখের পানির প্রতিশোধ নেয়ার।কিন্তু আজ আছে’

এই বলে ইশান তিথির হাতটা শক্ত করে ধরে এরপর টানতে টানতে নিয়ে যায় রুমের বাহিরে।করিডোর দিয়ে শেষ কোণার রুমের কাছে নিয়ে আসে সে তিথিকে।এরপর দরজায় আলতো ভাবে নক করে বলে,’মা। জেগে আছো?’
‘ইশান?কি হয়েছে বাবা?’
মায়ের মৃদু স্বরের আওয়াজ শুনে ইশান দরজা খুলে ভেতরে ঢোকে।
ইশানকে দেখে মিসেস আরাফাতের মুখে হাসি ফুটলেও, তার পাশে নাইটি পরে দাঁড়িয়ে থাকা তিথিকে দেখে মোটেও মনে শান্তি পাননি তিনি।তার মুখটা গোমড়া হয়ে গেলো তৎক্ষনাৎ।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

ইশান তিথিকে টান দিয়ে মায়ের সামনে ছুড়ে মারলো এরপর বললো,’মায়ের পা ধরে তার কাছে তোর যত কৃতকলাপ ছিল সে বিষয়ে ক্ষমা চা।’
তিথি ছলছল চোখে মিসেস আরাফাতের দিকে চেয়ে ছিল।কোনো কথা বলছিল না বলে ইশান তাকে আবারও ধমক দিয়ে বলে ক্ষমা চাইতে।

তিথি চোখ মুছে উনার পা ধরে বলে,’আন্টি সেদিন আমি ইশানের উপর রাগ টা আপনার উপর ঝেড়ে ছিলাম।আমার সেই কাজটা করা উচিত হয়নি।বড়দের সাথে সেরকম ব্যবহার কোনো ভদ্র ঘরের মেয়ের কাজ নয়।আমি তো অভদ্র তাই সেদিন এত দূর ব্যবহার করেছিলাম।আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিবেন’
মিসেস আরাফাত সব ভুলে গেলেও অপমান কোনোদিন ভুলেন না।আর তিথির করা অপমানটা না ভুলার মতই ছিল।সে ইশানের উপর ক্ষেপে মিসেস আরাফাতকে সেদিন যা নয় তাই বলে মনে আঘাত করেছিল।সেই আঘাত উনার এখনি কাঁচা আছে।

মা কিছু বলছেনা দেখে ইশান বললো,’আমার মা তোকে ক্ষমা করবেনা।কারণ তুই ক্ষমার অযোগ্য কাজ করেছিস।এর মাশুল তোর থেকে আমি আজীবন ধরে নিবো।মনে রাখিস!’
এই বলে ইশান চলে যায়।তিথি চোখ মুছতে মুছতে আবারও চেপে ধরে মিসেস আরাফাতের পা।এরপর ধীর গলায় বলে,’আমি জানিনা এখন আমার কি করা উচিত।সব কিছু কল্পবা মনে হচ্ছে।আমার মতো মেয়ে আপনার ছেলের বউ হবার যোগ্যতা রাখেনা।আমি আসলে….’

‘থাক!আমার রুম থেকে যাও এখন।রাত বারোটা বেজে গেলো।আমি এত রাত জাগিনা,জাগলে দিনে মাথা ধরে।যাবার সময় দরজা লাগিয়ে যাবে।আর এইসব রঙঢংয়ের পোশাক জামাইর রুমের ভেতরে পরে থাকবে।বাহিরে নয়।আমার বোনের ছেলেপেলে আছে বাসায়।সবাই ইশানের বয়সী।তারা কি চোখে দেখবে?’
তিথি তার হাতের শাড়ীটাকে গায়ে পেঁচিয়ে চলে যায়।ইশানের এমন ব্যবহারে তিথির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ছে।
একের পর এক অবাক করার মতন পরিস্থিতির সামনে পড়ছে সে।

অবশ্য তার কপালে এটাই ছিল।সে ওদের সাথে যা যা করেছে এটাই তার প্রাপ্য!
তিথি হাঁটতে হাঁটতে ইশানের রুমের কাছে চলে আসে।ইশান তার বারান্দায় ছিল তখন।
তিথি দরজাটা আলতো করে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে যায়,
ইশানকে বারান্দায় দেখতে পেয়ে সে ওয়াশরুমে গিয়ে নাইটিটা বদলে বিয়ের শাড়ীটা পরে বের হয়।এরপর বিছানায় বসে তানিয়ার নাম্বারে কল করে।

তানিয়া ঘুমে ছিল বলে রিসিভ করেনি।তিথি ওর জামাকাপড়ের ব্যবস্থা করার জন্য ওকে কল করছিল বারবার।কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না আসায় সে রুমের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ে।শুয়ে তো পড়েছে ঠিক,কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই।
হুট করে তার দুনিয়া এভাবে বদলে যাবে তা সে কল্পনাও করে নি।যাকে ঘৃনা করতো,আজ সেই মানুষটা তার স্বামীর আসনে বসেছিল আর সে বুঝতেও পারেনি।
‘আচ্ছা তানিয়া তো ইশানকে চিনতো।তাহলে সে বিয়েতে ইশানকে দেখে কেন আমাকে একবারও জানায়নি?
নাকি তার মনে নেই!
তখন তানিয়ার বারো বছর ছিল।মনে হয় সে ভুলে গেছে।হতে পারে!নাহয়।তানিয়ার তো এই বিষয় লুকানোর কোনো মানে দাঁড়ায় না।’

এসব ভাবতে ভাবতে তিথি উঠে বসে।কাঁদলে তার মাথা ভীষণ ব্যাথা হয়।এখন মাথাটা ধরে সে বারান্দার দিকে তাকায় একবার।ইশান সেখানে নেই।এই অল্প সময়ে কোথায় গেলো!
তিথি বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় চলে আসে।ওখানে ইশানকে না দেখে সে পেছনে তাকায়।অন্ধকারে ইশানের রুমের সোফায় কাউকে বসতে দেখে তিথি রুমে ঢুকে আলো জ্বালায়।ইশান কপালে হাত রেখে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।
তার সামনে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ।

তিথির লোভ হলো!তার ও এক মগ কফি খেতে ইচ্ছে হলো।তাই সে ইশানের সামনে দিয়ে হেঁটে বাহিরে গিয়ে রান্নাঘর খুঁজে বের করে দেখে সবই আছে কিন্তু কফি শেষ।
তিথি মন খারাপ করে রুমে চলে এসে দেখে ইশান রুমে কোথাও নেই।ওয়াশরুমের থেকে শাওয়ারের আওয়াজ পেয়ে তিথি বুঝলো ইশান গোসল করতে গেছে।তিথি টেবিলের কফির মগটা দেখলো তখন।কফিতে মনে হয় ইশান দুইটা চুমুকই দিয়েছিল।এখনও সব কফি পড়ে আছে।
তিথি মুচকি হাসি দিয়ে কফিটা হাতে নেয়।

আরেকজনের মুখের খাওয়া কিছু ওর পছন্দ না হলেও এখন তার হাতে আর কোনো উপায় নেই।
কফির মগটা নিয়ে সে বিছানায় এসে বসে। এক টানে পুরোটা খেয়ে নেয়।
ইশান গোসল করে বেরিয়ে দেখে তার কফির মগটা আগের জায়গায় ঠিকই কিন্তু সেটা খালি।
আর তিথি বিছানায় অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে।
কফিটা ইশান ইচ্ছে করেই রেখেছিল,কারণ সে জানে তিথি কাঁদলে অনেক বেশি পরিমাণে চা,কফি খায়।তাই কাজের লোককে ডেকে সে কফি বানিয়েছিল।

চুল মুছতে মুছতে সে তিথির সামনে এসে দাঁড়ায়।
তিথির ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে থেকে ইশান বলে,’আমি কাঁদাবো,আবার আমিই কষ্ট তাড়াবো!’
এরপর সে রুমের আলো নিভিয়ে আবারও সোফায় এসে বসে।তিথি হয়ত ভুলে গেছে ইশান কফি খায়না।
যদি মনে রাখতো তাহলে এখন ওর সব বোঝা হতো।

“যাকে এত কিছু দিয়ে ভালবেসেছিলাম সে কেবল বাহিরেরটাই দেখে গেলো!
না আমায় চিনলো,না আমায় বুঝলো আর না আমায় ভালবাসলো কোনোদিন!
কি পেলাম তাকে ভালবেসে!
কি পেলাম এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা করে?সেই মানুষটা স্বার্থপর হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো।’

পরদিন ভোর ৫টা ৩মিনিটে তিথির কানের কাছে এলার্ম বেজে ওঠে।
এমনিতে তিথি প্রতিদিন সকাল নয়টায় উঠলেও আজ ভোর পাঁচটার এলার্ম কে দিলো তার জানা নেই।সে লাফিয়ে উঠে বসে ঘুম ঘুম চোখে ঘড়িটা খুঁজতে থাকলো বন্ধ করার জন্য।ঘড়িটা হাতে নিয়ে বন্ধ করে সে চোখ ডলে ডানে বামে তাকায়।
ইশান রুমে নেই।তাহলে এলার্মটা কে দিছে!

এদিকে তিথির ঘুম গায়েব।
বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায় তিথি।
এলার্মটা ইশান দিয়েছিল।তার আজ ভোরভেলা বিদেশ থেকে একজন ক্লায়েন্ট আসবে তাকে নতুন নুডুলসের প্রোডাক্টের মান চেক করাতে।তাই খুব ভোরে যাবার পথে সে তিথিকেও জাগিয়ে দিতে চেয়েছিল।তিথির যত পুরান অভ্যাস আছে সব বিপরীত রেখায় জুড়ে দিবে সে।

তিথি চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখছে।
এত ভোরে ওঠা তার অভ্যাস নেই।
দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে সে রান্নাঘরে কারোর কাজের আওয়াজ পেয়ে ওদিকে যায়।গিয়ে দেখে দুইজন বুয়া মিলে সকালের নাস্তা তৈরি করছে।তিথিকে দেখে তারা মুচকি হাসি দেয় দুজনে কিন্তু কিছু আর বলেনা।
তিথি ওদের কাছে গিয়ে বলে,’বাসায় দেশি কলা আছে?আসলে আমি সকালে কলা দিয়ে মুড়ি খাই’

যদি তুমি বলো পর্ব ১৪

‘ছিল ম্যাডাম।কিন্তু স্যার দেখলাম কাল সব কলা আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য বলে দিছিলো।তাই আমরাও নিয়ে গেছিলাম’
তিথি মনে মনে ভাবছে ইশান এইসব ইচ্ছে করেই করেছে নির্ঘাত!

যদি তুমি বলো পর্ব ১৬