যদি তুমি বলো পর্ব ১৬

যদি তুমি বলো পর্ব ১৬
আফনান লারা

এদিকে এত ভোরে ওঠায় তিথির না ঘুম আসছিল আর না কিছুতে মন বসছিল।তাই সে রুমে ফিরে ফোন খুঁজে তানিয়ার নাম্বারে একটা কল করে।কিন্তু গাধীটা তখনও পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছিল।বিরক্ত হয়ে সে বাসার নাম্বারে কল দেয় এবার।
কাল সকলে মিলে দেরি করে ঘুমালেও রিদম ঘুমিয়েছিল জলদি জলদি।যার কারণে এই ভোরবেলা উঠে সে বাসায় হেঁটে হেঁটে অন্নের সন্ধান করছিল।ফ্রিজ খুলে কেক দেখতে পেয়ে সেটাতে হাত দিতেই ধুমধাম রিংটোন বেজে বাসার যে ফোনটা আছে সেটা বেজে উঠলো।রিদম শুরুতে হকচকিয়ে গিয়েছিল।এরপর বুকে থুথু দিয়ে গালের ভেতর এক পিস কেক পুরে ফোনটা কানে ধরে।

‘হ্যালো,রানবীর কাপুর স্পিকিং।হু আর ইউ?’
‘আমি’
‘টুকু?এই ভোরবোলা?আজ কি আদৌ সূর্য উঠবে?’
‘চুপ থাক!তানিয়া কোথায়?’
‘মরা লাশের মতন ঘুমাচ্ছে।উঠাবো লাশটাকে?’
‘না থাক।ও উঠলে বলবি আমায় একটা কল দিতে’
‘তা দুলাভাই কই টুকু?’

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

তিথি রাগ করে কলটাই কেটে দেয়।এরপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে নরম বিছানায়।
মখমলের বিছানার চাদর।হাত লাগলেই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।সেটাতে শুয়ে তিথি ছাদ দেখতে দেখতে ভাবছে ইশানের সেই পুরোনো বাড়ির কথা।
মরিচা ধরা টিনের ঘর ছিল তাদের। তিথিদের বাড়ির গলিতেই ইশানদের বাড়ি ছিল।
তিথি টিউশনে যাবার পথে রোজ রোজ ইশানকে সে দেখতো।

তার বান্ধুবীরা সকলেই তার চাইতে অধিক সুন্দরী ছিল বলে তিথি কখনও কল্পনাও করেনি ওদের বাদ দিয়ে এই হ্যাংলা ছেলেটা শেষমেশ ওকে সেই লেভেলের ভালবেসে বসবে।
তার এই ভুলধারণা একদিন ইশান গুছিয়ে দিলো।সেই দিনটা ছিল ভ্যালেন্টাইনস ডে।
তাজা নীল রঙের গোলাপ তিনটা হাতে ইশান তিথিকে প্রোপোজ করতে আসে।
নীল গোলাপ ছিল না মোটেও,লাল গোলাপকে নীল রঙের কৌটায় চুবিয়ে নীল করেছিল সে,এরপর রোদে শুকিয়ে নিয়েছিল।কারণ তিথির নীল রঙ ভীষণ পছন্দের।প্রায় সময় সে নীল জামা পরে টিউশনে আসতো।

ইশান তাই এই কারবার করে।
সকলে যার যার বাড়ির রাস্তায় ঢুকে গেলেও তিথির বাড়ি ছিল সবার পরে।
তিথিকে একা পেয়েই ইশান ওকে প্রোপোজটা করে বসে।
চোখের সামনে রোদে পোড়া,পায়ে কাদা শুকানো।গায়ের পোশাক এবং গন্ধ শুঁকে তিথির মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো।
সে তখন উঠতি বয়সী মেয়ে।চোখে মুখে তার রিত্তিক রওশানের মতন ছেলেদের নিয়ে স্বপ্ন।সেই জায়গায় কিনা এই রকম একটা ছেলে এসে তার কপালে জুটলো!

তিথির ভাবভঙ্গি দেখে ইশান ফুলটা আরেকটু এগিয়ে ধরে।
তিথি এদিক ওদিক তাকিয়ে ফুলটা হাতে নেয়।এরপর উল্টে পাল্টে বলে,’নীল গোলাপ পেলে কই?’
‘এটা লাল গোলাপ।তোর তো নীল পছন্দ তাই নীল রঙ করিয়ে এনেছি’
‘আমাকে তুই করে বলছো কেন?’
‘আমার অনেক ছোট তো তাই’

তিথি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,’কত ছোট?’
‘এই যে তুই ক্লাস এইটে পড়িস।আর আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।’
‘আমাকে তুই বলবানা।আর ধরো তোমার গোলাপ।’
‘তোর ভাল লাগেনি?’

‘ফুল ভাল লেগেছে,কিন্তু তোমাকে ভাল লাগেনি’
সেবার তিথির এই কথাটা শুনে ইশান বলেছিল “আচ্ছা” এর বাহিরে আর কিছুই বলেনি।রোজ সে আগের মতন করে তিথির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো টিউশনের বাহিরে।
তিথির এটা অনেক বিরক্তিকর মনে হতো।
একদিন তো সে ইশানকে!!

সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে তার এখন ভয় হয়।ইশান যদি সেই ব্যবহার গুলো ওর সাথে আবারও করে যেগুলো সে অতীতে করেছিল তার সাথে?
কত অত্যাচার সে ইশানকে করেছিল।তাও শেষ পর্যন্ত ইশান তার ভালবাসা পাবার অপেক্ষায় রয়ে যেতো।
চোখের কোণার পানি মুছে তিথি বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।

সকাল সাতটা বেজে গেছে।বাসার সামনে বিয়ের গেট লাগানোর লোক চলে এসেছে।
তিথি সেটা দেখছিল হঠাৎ তার ডাক পড়ে ইশানের খালার।
খালার ডাক শুনে তিথি শাড়ীর আঁচলের কোণা টেনে কাঁধ ঢেকে তার কাছে চলে আসে।তিথিকে দেখে খালা চমকে উঠলেন প্রথমেই।

‘একি বউ!গোসল করো নাই?’
‘করেছি’
‘তাহলে আগের শাড়ী কেন পরেছো?নতুন একটা পরবে।রিসিপশানের আগে পরার জন্য আমরা একটা কাঞ্জিভরম শাড়ী দিয়েছিলাম তো বেগুনী রঙের।সেটা কোথায়?’
‘আসলে খালামণি ওটা ভুলে বাসায় রেখে এসেছি’
‘সেকি!কাল রাত থেকে এই ভারী শাড়ীটা পরে আছো তুমি?দাঁড়াও আমি তামিয়া থেকে নিয়ে দিচ্ছি’
এই বলে খালা চলে যাওয়া ধরতেই তিথি তাকে বাধা দিয়ে বলে সে তার বাবাকে কল দিয়ে বলেছে।তারা রিদমকে দিয়ে ব্যাগটা পাঠিয়ে দেবে।

খালা তিথির থুুতনি ধরে টেনে বলে,’খিধে পেয়েছে তোমার?কিছু খাবে?’
‘নাহ’
তিথি লজ্জায় বলতে পারছেনা সে আসলে সকালে কি খায়।আপাতত নতুন বউয়ের মতন লাজুক হয়ে মাথা নিচু করে রইলো।
তখনই খালা বলে উঠলেন ইশান এসে গেছে।এ কথা শুনে তিথির বুকের ভেতর ঝড় এসে গেলো।ভয়ে সে পেছনে তাকালোনা।ইশান সামনে দিয়ে তার রুমে চলে গেছে।
ও চলে যাবার পর তিথি পেছনে তাকাতেই

খালা ওকে জোর করে ইশানের পিছন পিছন ওর রুমের দিকে পাঠিয়ে দিলেন।তিথি কতবার করে বললো সে এখন যাবেনা।কিন্তু কে শুনে কার কথা।তাকে জোর করে পাঠিয়ে দেয়া হলো।
রুমের বাহিরে এসেও তিথি ভয়ে ঢুকছিল না।
ইশান ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ি খুলছে।
তিথি ধীরে ধীরে রুমে এসে বিছানায় অন্য দিকে মুখ করে বসে থাকলো।ইশান হাতের ঘড়ি আর টাইটা খুলে নিজের আলমারি থেকে পাঞ্জাবি বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে গেছে।তিথি ওমনি চুপিচুপি ইশানের মানিব্যাগের কাছে এসে হাজির হয়।

শেষবার ইশানের মানিব্যাগে তিথি তার নিজের ছবি দেখেছিল।এখনও আছে কিনা সেটা পরোক করতে সে আবারও মানিব্যাগটা ধরে।
কিন্তু এবার তিথির কোনো ছবি নেই।তিথি মন খারাপ করে সেটা রেখে দেয়।কিন্তু তিথি জানতোনা ইশানের মানিব্যাগে দুইটা পার্ট।তিথির ছবি অন্য পার্টে ছিল যেটা তিথি খুলেই নাই।
ওটা আগের জায়গায় রেখে তিথি আবার বিছনায় এসে বসে।

ইশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে হঠাৎ তিথির দিকে বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে থাকলো।তিথি বসে বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উল্টাচ্ছিল।ইশান তার দিকে তাকিয়ে আছে খেয়াল করে সেও ওর দিকে তাকায়।কিন্তু ইশান এমনভাবে কেনোই বা তাকিয়ে আছে সে বুঝতে পারেনা।শেষে ও বাধ্য হয়ে বললো,’কি হয়েছে?’

তার উত্তরে ইশান কিছু বলেনা।হনহনিয়ে রুম থেকে চলে যায়।তামিয়ার রুমে গিয়ে ওর নতুন শাড়ীর সেট থেকে একটা সেট নিয়ে এসে তিথির মুখের উপর মারে সে।তিথি এটার জন্য প্রস্তুত ছিল না।শাড়ী মুখ থেকে সরিয়ে সে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকলো আগের মতন।ইশান ধমকে বললো,’কাল রাত থেকে এই শাড়ীটা পরে থেকে কি বুঝাতে চাচ্ছিস?আমি তোকে শাড়ী কিনে দেই না?এটাই তো?এক ব্যাগ শাড়ী বাঘে নিছে?’

তিথি তার হাতের শাড়ীটা দেখে চুপ করে থাকলো।কিছু আর বললো না।
এর কিছু সময় বাদেই তার কেন যেন খুব রাগ হলো।সে বিছানা থেকে নেমে শাড়ীটা ইশানের দিকে পাল্টা ছুড়ে ফেলে বললো,’বাঘে নেয়নি।আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই পরিনি।এই শাড়ীটা আজকেও পরে থাকবো।তোমার কোনো সমস্যা আছে?’
ইশান তার পায়ের কাছে শাড়ীটার দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু হয়ে শাড়ীটা তুলে নিলো হাতে।এরপর বললো,’যতক্ষণ না তুই এই শাড়ী পরছিস, ততক্ষণ এই রুমেই থাকবি’

এই বলে ইশান বের হয়ে রুমের দরজা বাহিরে দিয়ে আটকে রেখে চলে যায়।যাবার পথে খালাকে দেখে বলে যায় এ দরজা যেন কেউ না খোলে।
তিথি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।ভেবেছিল তার সেই পুরোনো রুপ থেকে ইশান হয়ত ভয় পাবে।এদিকে ভয় তো পেলোই না পাল্টা ওকে শাস্তি দিয়ে চলে গেলো!
কি হলো এটা!

ইশান সোফার মাঝখানে বসে আছে।তিথিকে রুমে সে আটকে রেখে এসেছে এটার কথা মিসেস আরাফাত তার বোন থেকে শুনেছেন।তাই ছেলের কাছে আসলেন সোজা।
ইশান রাগে বসে বসে টিভির চ্যানেল একটার পর একটা পাল্টাতে লাগলো।

যদি তুমি বলো পর্ব ১৫

মা তখন ওর হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে বললেন,’ওকে কষ্ট দিতে চাইছিস মানছি।কিন্তু এভাবে লোক হাসিয়ে কি লাভ হলো?কাজের লোকেরা এসব জানলে পাঁচ কান করবে মানুষ কি ভাববে?’
‘ভাবুক।তারাও জানবে কেনোই বা আমি এসব করছি!’

যদি তুমি বলো পর্ব ১৭