যদি তুমি বলো পর্ব ২০

যদি তুমি বলো পর্ব ২০
আফনান লারা

তিথি আসার পর থেকে খেয়াল করছে কেউ তাকে বকা তো দূরে থাক,একটা কথাও বলছেনা।সবাই ইশানের মায়ের দিকে ফিরে তার শরীর নিয়ে আলাপআলোচনায় ব্যস্ত।
তিথি ভেবেছিল রুমে ঢোকার পরপরই তাকে অনেক বকাঝকা শুনতে হবে।কিন্তু এই দেখি তার উল্টো।
সে চুপচাপ ইশানের মায়ের পাশে বসে তার দিকে তাকিয়েছিল।কিছু সময়ের মধ্যেই ইশান ডাক্তার আশুতোষকে নিয়ে ভেতরে আসে।

তিনি ইশানের মাকে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে জানালেন অতিরিক্ত স্ট্রেসের কারণে তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন।আহামরি কিছু নেই,তবে তাকে এরপর থেকে চিন্তামুক্ত রাখতে হবে।কোনো প্রকার ট্রমা দেয়া চলবেনা।
ইশান চুপচাপ সবটা শোনে।ডাক্তার থাকা কালীনই মায়ের জ্ঞান ফেরে।কিন্তু তিনি চোখ খুলেই তিথিকে দেখে ভীষণ রেগে যান।উঠে বসে ওকে ধমকে জানতে চাইলেন সে এখানে কি করে।
তিথি ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে যায়।এর বেশি কিছু করেনা।তখন ইশান বলে সে তিথিকে আসতে বলেছিল। এদিকে মা ইশানের উপর ও ক্ষেঁপে আছেন।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

মাথা নিচু করে ওদের দুজনকেই রুম থেকে যাবার নির্দেশ দেন তিনি।
তিথি চলে গেলেও ইশান গেলোনা,বরং সে সবাইকে রুম থেকে চলে যেতে বললো।
সবাই যাবার পর ইশান মায়ের পাশে বসে তার হাতদুটো ধরে চুমু খেয়ে বললো,’আমি ওকে শাস্তি নিশ্চয় দেবো”
‘আর কবে?’
‘তুমি কি চাও বলো’

‘আমি চাই তুই ওকে ছেড়ে মুনিয়াকে বিয়ে করে নে।এর চেয়ে বড় শাস্তি ওর জন্য আর কিছু হতে পারেনা’
তখন ইশান মুচকি হাসি দিয়ে মায়ের হাতে ফুলে ওঠা রগগুলো মিহীন করে দিতে দিতে বললো,’তিথিকে ছেড়ে দেয়া বাদে আর অন্য কোনো শাস্তি থাকলে বলো’

মা এবার ভীষণ রেগে গেলেন।হাত দুটো ইশানের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন,’আমার রুম থেকে যাঃ।ড্রাইভারকে বল রেডি হতে।আমি মুনিয়াদের বাসায় যাবো।মেয়েটা আজ কয়েকদিন ধরে খুব অসুস্থ। তাকে একবার দেখে আসবো’
ইশান মাথা নাড়িয়ে উঠে বাহিরে আসতেই দেখে তিথি আছে ওখানে।কথাগুলো শুনেছে কিনা তা ওর মুখ দেখে বোঝা গেলোনা।ও এখানে আছে দেখে ইশান একটা ঝাড়ি দিয়ে বললো,’কথা শুনে তোর কি লাভ হলো?’

‘কিছুই শুনিনি।শুধু শুনেছি আন্টি মুনিয়াদের বাসায় যাবেন’
ইশান এই কথা শুনে কোনো রিয়েকশান না দেখিয়ে চলে গেলো।তিথি সব কথাই শুনেছে। এবং হাসছে।মনে মনে ইশান একদিন ঠিক হয়ে যাবার স্বপ্ন বুনে সে ইশানের পিছু পিছু রুমে আসতেই তার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেলো।
ইশান ফোনে মুনিয়ার সাথে কথা বলছে। তিথি একটু এগিয়ে শুনতে পেলো ইশান খুব আবেগের সাথে কথাগুলো বলে যাচ্ছে।যেন মুনিয়া তার বিয়ে করা বউ।
তিথি মনটা আবার খারাপ করে চলে আসে।এসে সোফায় বসে তামিয়ার পাশে। তামিয়া ওর মন খারাপ দেখে বললো,’ভাই বকেছে? ‘

‘না’
‘মা?’
‘উহু’
‘আচ্ছা,আমরা সবাই মুনিয়াদের বাসায় যাবো। তুমি যাবে?’
তিথি খুশি হয়ে বললো সেও যাবে।ঠিক তখনই ইশান এসে বললো তিথি যাবেনা।এটা শুনে তিথি আর কিছুই না বলে উঠে চলে যেতেই,তামিয়া ওর কাছে জানতে চাইলো তিথি কেন যাবেনা।
ইশান হাসি দিয়ে তামিয়ার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো কারণ ইশান ও যাবেনা।তামিয়া এবার ইশানের গাল ধরে টান দিয়ে ফিক কররে হেসে বলে,’মা জানলে অনেক রাগ করবে’

‘মাকে বলে দিও, তিথিকে ঘাটের পানি খাইতে রেখে দিচ্ছি’
মা নাস্তা করে তার দুই বোন আর তামিয়াকে নিয়ে মুনিয়াদের বাসায় চলে গেছেন সেই কখন।ইশান পুরোটা সময় আদিলের সাথে অফিসে ছিল।তিথি মনে করেছে ইশান ও চলে গেছে।তাই সে চিন্তা করলো তার বাসায় যাবে।এভাবে একা একা এই বাসায় থাকা অসম্ভব।

এই চিন্তা করে যেইনা সে দরজা খুলতে টান দিলো সে বুঝতে পারলো দরজা বাহিরে দিয়ে লক করা।
এ তো মহা মুশকিল হয়ে গেলো!কে তাকে লক করে গেছে!সবাই তো জানে তিথি বাসায় থাকবে।তাহলে জেনেবুঝে এই ভুল কেন!
এদিকে তিথির কাছে কোনো ফোন নেই।

সে এক দৌড়ে ল্যান্ড লাইনের কাছে এসে কল দেয়ার জন্য ফোন হাতে নেয়ার পর তার মাথায় আসলো সে তো বাসার নাম্বার মুখস্থ পারেনা।একমাত্র নিজের নাম্বারটাই মুখস্থ পারে,আর তাও সেই ফোনটা ইশান ফেলে দিছে।
নিজের মাথায় নিজে বাড়ি দিয়ে তিথি ইশানের রুমের বারান্দায় এসে গেইটের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।যদি দারোয়ানকে একবার দেখে তাহলে চিৎকার করে ডাক দিবে।

কিন্তু দারোয়ান তখন ছিল না।রাত আটটা বাজে দারোয়ান চলে যায়।দ্বিতীয় দারোয়ান আসে সাড়ে আটটায়।
তিথি কপালে হাত দিয়ে বসেছিল ওখানে।হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে সে ছুটে যায় ওদিকে।গিয়ে দেখে দরজা এবার ভেতর থেকে লক করা।তিথি ঢোক গিলে দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ওমনি।এত অল্প সময়ের মধ্যে কেউ বাসায় ঢুকলো আবার লক ও করে নিলো,আবার উধাও ও হলো।তিথির বুকের ভেতর ধুকধুক করছে।

সে এখন কোনোভাবে ইশানের রুমে ঢুকে দরজা লাগাতে পারলেই নিজেকে নিরাপদ মনে করবে।
হাঁপাতে হাঁপাতে সে ওদিকটায় যায় ধীরে ধীরে।তার হঠাৎ মনে হলো পিছনে কেউ একজন আছে। তখনই সামনে টিভির পাশের ফুলদানিটায় চোখ পড়তেই তিথি ওটা হাতে তুলে পিছনে তাকিয়ে দিলো এক বাড়ি।
‘আহঃ!’

ইশানের আর্তনাদে তিথি হাত থেকে ফুলদানিটা রেখে দিলো।ইশান কপালে হাত দিয়ে সোফায় বসে গেছে।
তিথি মুখে হাত দিয়ে বললো,’সত্যিই আমি বুঝতে পারিনি আপনি থাকবেন!আই এম সরি’
তিথি কাছে বসে ইশানের কপাল থেকে হাতটা সরাতে নিতেই ইশান ওকে সরিয়ে দিয়ে বললো,’ইচ্ছে করে এমন করিস তুই! ‘

তিথি কি করবে না করবে ভেবে না পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে বাসার সব ড্রয়ার খুলে মলমপোটি খুঁজতে লাগলো।
ইশান পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালে চেপে ধরে।তিথি কোথা থেকে তুলা আর স্যাভলন এনে বললো,’আমি মুছে দিই?’
‘থাক!’

এই বলে ইশান উঠে চলে গেছে।তিথি মন খারাপ করে ফুলদানিটার দিকে তাকিয়ে থাকলো।এতই মজবুত যে মানুষের কপাল ফেটেছে কিন্তু ফুলদানিটার কিছুই হয়নি।
তিথি এবার ইশানের কাছে গিয়ে দেখে সে নিজে নিজে কপালের রক্ত মুছছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
তিথি ওর আরও কাছে এসে অসহায়ের মতন চেয়ে থেকে বলে,’আমাকে মাফ করে দিন।আমি ভেবেছিলাম চোর ডাকাত হয়ত।আমার ক্ষতি করতে এসেছে’

‘আমি কি তোর ভাল চাই?আমিও তো ক্ষতিই করতে চাই’
ওমনি তিথি ফুলদানিটা এগিয়ে ধরে বললো ‘নিন,একটা বাড়ি মেরে দিন।তাহলে কাটাকাটি হয়ে যাবে’
‘আমি এত সহজ ক্ষতি চাইনা’

এই বলে ইশান পেছনে ফিরে তাকায় তিথির দিকে।তিথি ফুলদানিটাকে পিঠের সাথে লাগিয়ে চুপ করে আছে।ইশান একটু একটু করে এগিয়ে চলছে আর তিথি পিছিয়ে যাচ্ছে।ইশান যেতে যেতে বললো,’যখন তোকে ভাল লেগেছিল,তখন ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম বিয়ের পর তোকে আমি এত এত সুখ দিবো যে বাসার বাকি মেয়েরা হিংসা করবে।’
তিথি কাঁপা গলায় বললো’আর এখন তাহলে কি চান?’

‘এখন?এখনও একই জিনিস চাই।পার্থক্য হলো সুখের সাথে দুঃখের সংমিশ্রণ। ‘
এই বলে ইশান দেয়ালে হাত রেখে দাঁড়ায়।তিথি ফুলদানিটাকে তার আর ইশানের মাঝে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
ইশান হাত বাড়িয়ে তিথির মুখের সামনের চুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে নাক লাগিয়ে ঘ্রাণ নিলো।এরপর হালকা আওয়াজে বললো,’এখনও সেই শ্যাম্পু দিস!’

তিথির ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে।হাতের ফুলদানিটা কাঁপছে।হঠাৎ লোডশেডিংয়ে রুমের অন্ধকার তার ভয় হাজারগুণে বাড়িয়ে রেখেছে।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় যা একটু ভয় কাটছিল,ইশানের ছায়ায় সে আলোটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ইশান চুলে একটু খিঁচিয়ে টান দিয়ে বললো,’বলতে পারবি আমি এখন তোর সাথে কি করবো?’

যদি তুমি বলো পর্ব ১৯

তিথি ভয়ে ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।ইশান তখন ওর আরেকটু কাছে আসতে নিতেই তিথি ভয় পেয়ে এবার ফুলদানিটাই ছেড়ে দিলো।এটা পড়লে তিথির পা একেবারে থেঁতলে যেতো কিন্তু ইশান কেমন করে যেন ফুলদানিটা ধরে ফেলেছে ঠিক সময়ে।
সে ফুলদানিটা সরিয়ে রেখে বাকি হাতটা তিথির আরেক পাশে দেয়ালে রেখে বললো,’তুই তো আমায় এত ভয় পেতিনা তিথি।বরং পারলে আমাকে মাড়িয়ে চলতি।এখন তিথির সেই তেজ কোথায় গেলো?আমার দেহের বলিষ্ঠ ভাব আর সহায় সম্পদের তোড়েই কি তিথি আজ দূর্বল?নাকি তিথি ইশানকে ভালোবেসে ফেলেছে?’

যদি তুমি বলো পর্ব ২১