যদি তুমি বলো পর্ব ২৫

যদি তুমি বলো পর্ব ২৫
আফনান লারা

ইশান চুড়িগুলো ফিরিয়ে দেয় তিথিকে।চুড়ি হাতে পেয়ে তিথি জানতে চাইলো আসলেই কি তার তিন দিনের জন্য শাস্তি মাফ?

তার উত্তরে ইশান কড়া জবাব দেয়।সে বলে এ শাস্তি মাফ হবার নয়।কথাটা বলে সে সামনের সিটে গিয়ে বসে এরপর লম্বা লম্বি ভাবে শুয়ে পড়ে।তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল।ইশান খুবই শক্ত একটা মানুষ।শক্ত বলার পর তার মনে আসলো একটা কথা।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

আগেকার ইশান খুবই নরম ছিল।একেবারে মাটির মতন। মাটি কখনও শক্ত হয়না।যে আকারই থাকুক ঝরে পড়বেই।ইশান ছিল সেরকম।তিথি তাকে কত অপমান,কত ধুরছার করেছিল তার পরেও দিনের পর দিন সে কেবল তিথিকেই চাইতো।তিথির কাছে তার কত আবদার ছিল তখন।

তিথি তার একটি আবদার ও কখনও পূরণ করেনি,বরং তার বদলে দিয়েছে হাজার হাজার দুঃখ যা বলে কয়ে শেষ করা যাবেনা।ইশান তিথিকে ভালবাসে বলে সে দুঃখ গুলো সে মাঝে মাঝে ভুলে গিয়ে তিথিকে আবারও আগের সেই ভালবাসা ফিরিয়ে দিতে চায় কিন্তু যখনই তার মনে পড়ে এই মেয়েটা তার জন্মদাত্রী মাকে কষ্ট দিয়েছিল,কাঁদিয়েছিল তখন তার বুক ফেটে আসে।ইচ্ছে করে মেয়েটাকে খুন করে প্রতিশোধ নিতে।ভালবাসা,প্রতিশোধ, মায়ের মমতা,অশ্রু সব মিলিয়ে তাকে পাগল করে তুলছে দিনের পর দিন।

মাথার উপর হাত রেখে এইসবই ভাবছিল ইশান।তিথি ও ওর মতন করে পিছনের সিটে লম্বা হয়ে শুয়েছে।কিন্তু চুল ভিজা থাকার কারণে তার ঘুম আসছিল না।সে শুয়ে শুয়ে ভাবছে সংসারটা কি ছেড়ে দেবে নাকি ইশানের কাছে মন থেকে ক্ষমা চাইবে।ইশান হয়ত ক্ষমা করবেনা।তবে কি সংসারটা ছেড়ে দেয়াই শ্রেয়?

তিথি সিদ্ধান্ত নেয় সে ইশানের সঙ্গে যাবেনা।বাসায় ফিরে যাবে।অতীতের করা ভুল নিয়ে এত মাশুল সে আর দিতে পারবেনা।তার ও তো জীবন আছে,শখ আছে,সুখ আছে।এভাবে দিনের পর দিন সে কেন কষ্ট করে যাবে?যদি সে জানতো তার সাথে ইশানের বিয়ে হচ্ছে তবে সে কখনওই রাজি হতোনা কারণ যাকে এক সময় কটু কথা বলে সে আঘাত করেছিল,তার সংসারে যে শান্তি মিলবেনা এটা তো জানা কথা।

দুজনার ভাবনার বেড়াজালে ভোর হয়ে গেলো।মামা ফজর নামাজ পরতে টুপি পরে দরজা খুলে চললেন মসজিদের দিকে।দরজাটা মুখোমুখি দেয়া ছিল,আটকানো ছিলনা।কারণ আর বাকিরা সবাই ঘুমে।নানু হয়ত নিজের রুমে নামাজ পড়ছেন।
তিথি শুয়ে থেকে মামাকে যেতে দেখে উঠে বসে।মামা চলে যাবার পরই সে গাড়ীর দরজা খুলে বের হয়ে যায় সোজা নানুর রুমে।

নানু নামাজ পড়ছিলেন।
তিথি চেয়ারে বসে নানুর নামাজ পরা দেখছিল।নানু নামাজ পড়ে জায়নামাজ নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই তিথিকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে চমকে ওঠেন।এরপর ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,’কিরে তিথু!কি হলো তোর?কাল থেকে দেখছি মুখ ভার করে আছিস।

কতবার যে জানতে চাইলাম কি হয়েছে,কিছুই তো বলিসনি।আমায় বল!বললে মন হালকা লাগবে।আমি হয়ত কিছু উপদেশ ও দিতে পারি যা তোর কাজে লাগবে’
তিথি তখন বলে,’নানু তোমার মনে আছে? আমি একবার একমাসের জন্য তোমার বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেছিলাম? তখন তোমাকে বলতাম না যে আমার পড়ার টেবিলের জানালা দিয়ে মনে হয় কেউ আমায় দেখছে? তুমি বলতে মনের ভুল।

আসলে সে ইশতিয়াক ছিল।’
‘কোন ইশতিয়াক? ঐ যে এক কালে তোর পিছু নিছিলো,তোর জন্য পাগল হই গেছিলো,সে?’
‘পাগল হয় নাই।বরং দেখিয়ে দিয়েছে কি করে অসম্ভব কোনো কিছু নিজের করে নিতে হয়।’

‘সে এখন কেমন আছে?দেখা করেছিস নাকি?’
‘সেই তো ইশান’
এ কথা শুনে নানু অবাক হয়ে গেলেন।কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,’তুই যখন জন্মেছিলি তখন তোর বাবার হাতের অবস্থা ভাল ছিল না।আমার খুব ইচ্ছে ছিল তোকে হাসপাতালেই সোনার চামচ দিয়ে মধু খাওয়াবো যাতে তোর ভাগ্য সোনার হালে বাড়তে থাকে।

আমার এ কথা কেউ শোনে নাই।তারপর আমি আমার হাতের একটা চুড়ি বিক্রি করি নিজে নিজে।কাউকে বলিনি।তারপর একটা চামচ ও বানাই।হাসপাতালে তোকে সেই চামচ দিয়ে মধু ও খাইয়েছিলাম।সবাই বকছিল কুসংস্কার বলে।তাও আমি করেছি।তারপর থেকে শুরু হয় তোর বাবার পদন্নোতি।

সবাই বলতো তুই তোর বাপের ভাগ্য খুলে দিয়েছিস।তোর গায়ের রঙ তোর বয়সের সাথে সাথে যেন আরও উজ্জ্বল হতে লাগলো।শুধু কি ইশান?আরও কত ছেলে যে তোর জন্য পাগল ছিল।হিসাব নাই সেসকলের।শুধু হিসাব আছে ইশানের।কারণ সে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে।আসলেই এখন বলতে হয় তোর সেদিনের সোনার চামচের মধুর গুণ আছে!

এই বলে নানু হাসতে থাকলেন।হঠাৎ হাসিটা থামিয়ে বললেন,’আচ্ছা তবে যদি সেই ইশানই তোর জামাই হয়ে থাকে,তবে তোর চোখে পানি কেন?’
‘সোনার চামচ কখনও ভাগ্য বদলায় না নানু।বরং যারা সোনার চামচ মুখে নিয়ে বড় হয় তাদের অনেকের সাথেই নিকৃষ্ট কিছু ঘটে!যেমন আমার সাথে হলো।

আমি সেই ছেলেটার এবং তার মায়ের সাথে এত বাজে ব্যবহার করেছি যার মাশুল আমাকে এতগুলো বছর পর দিতে হচ্ছে।তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন আমি কখনও স্বামীর সোহাগ পাবোনা’

নানু তিথির চোখ মুছে দিয়ে বলেন,’মানুষ অভিশাপ দিলেই যদি ফলে যেতো তবে দুনিয়াতে কেউ টিকতোনা।ওসব ভাবিস না।তোর ভাগ্য ভাল বলেই ইশানের মতন একটা ছেলের বউ হয়েছিস।সে তোকে অতীতে যেমন পাগলের মতন ভালবাসতো,এখনও তাই বাসে।যে একবার প্রেমে পাগল হয় তার বাহ্যিক পরিবর্তন আসলেও পাগলামি কোনোদিন যায়না।বিশ্বাস হয়না তোর, তাই তো?নিজ থেকে একবার ধরা দিয়ে দেখ!তোর পুরো জীবন বদলে যাবে’

এই বলে নানু তার ছেলের বউকে ডাকতে চলে গেলেন।
তিথি চুপচাপ ওখানেই বসেছিল।অনেক ভেবে ইশানের কাছে না গিয়ে সে নানুর বিছানাতেই শুয়ে পড়ে।

ইশান গাড়ীতেই ঘুমিয়েছিল।মামা নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরবার সময় ইশানকে গাড়ীর ভেতর দেখে জানালায় ধাক্কা দিয়ে ওকে জাগানোর চেষ্টা করলেন।
‘ইশান বাবা?কি হয়েছে?এখানে ঘুমাও কেন?’

আওয়াজে ইশান জেগে যায়।উঠে বসে দেখে চারিদিকে আলোতে ভরে গেছে।মামা দাঁড়িয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।সে চোখ ডলে গাড়ী থেকে বের হয়ে কিছু বলবে তখনই মামা বললেন সে যেন ভেতরে গিয়ে ঘুমায়।
উনি চলে যাবার পর ইশান তিথিকে ডাকার জন্য পেছনে তাকিয়ে দেখে সে নেই।তার মানে সে আগেই চলে গেছে।

তাই সেও ভেতরে চলে আসে।কিন্তু ভিতরে এসে দেখে তিথি রুমে নেই।
ইশান আর খোঁজেনা ওকে।চুপচাপ বিছানায় মাথাটা এলিয়ে শুয়ে পড়ে।হঠাৎ মনে পড়ে ফোনে চার্জ লাগবে।অফিসের জরুরি কল মিস হতে পারে।তাই তাড়াহুড়া করে সে ফোন নিয়ে এসে চার্জ দেয়।এরপর আবার শোয় কিন্তু তার আর ঘুম আসেনা।তাই খাটে হেলান দিয়ে বসে হাই তুলতে তুলতে কালকে রাতের কথা ভাবতে থাকে।

‘ইশান নাতি,, সকালে কি খাও? ‘
নানুর কথা শুনে ইশান ঠিকঠাক হয়ে বসে।নানু হাতের এক কাপ চা ওর সামনে রেখে বললেন,’শুনলাম তুমি সকালে রঙ চা খাও।ঘরে মশলাপাতি শেষ তাই দুধ চা দিলাম।’

‘সমস্যা নেই’
‘আচ্ছা একটা কথা বলবে?’
‘কি বলুন?’
‘তিথিকে ভালবাসো?’

ইশান চুপ করে তাকিয়ে থাকে।নানু ওর পাশে বসে বললেন,’জানো?ভালবাসার মানুষের কোনো দোষ থাকেনা।যদি ভালোই বাসো তবে ওর দোষ নিয়ে পড়ে আছো কেন?ভালবাসায় দোষ গুণ জায়গা পায়না।যদি জায়গা পায় তবে সেটা ভালবাসা হতে পারেনা।তুমি তিথিকে সেই কোন বছর থেকে পাগলের মতন ভালবেসে এসেছো!এখন তার চোখে পানি কেন তবে?

যে ভালবাসায় মানুষটা কাঁদে সেটা আবার কিসের ভালবাসা?
জানো,, তোমাদের নানা আমার গুণ যেমন দেখতেন না তেমনই দোষও দেখতেন না।
রাঁধলে মজা করে খেতেন।রান্না মজা হলে আনন্দর সহকারে খেতেন আর খারাপ হলে চুপচাপ খেতেন।

যদি তুমি বলো পর্ব ২৪

কখনও বলতেন না ভাল হয়েছে কিংবা খারাপ।আমার শুরুতে খারাপ লাগতো কিন্তু দিন এগোতেই বুঝতে পারলাম পারুলের রান্না খারাপ হওয়ায় ওর স্বামী ওকে মেরেছিল আর আমার সাহেব নিরব ছিল তখন নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করলাম।সেদিন বুঝলাম কাউকে ভালবাসলে তার দোষগুণ খুঁজা চলবেনা’

যদি তুমি বলো পর্ব ২৬