যদি তুমি বলো পর্ব ৪৯

যদি তুমি বলো পর্ব ৪৯
আফনান লারা

পান্নার দাদুর বাড়িকে স্বাভাবিক মনে করেই এসেছিল ইশান আর তিথি।কিন্তু গিয়াস উদ্দিনের মতন একটা লোকের পৈতৃক বাড়ি আর কিরকমই আশা করা যায়?উনি যেরকম তার চেয়ে দ্বিগুণ হওয়াই তো স্বাভাবিক।
গিয়াস সাহেবের পছন্দ ভিনদেশী ফলফলাদি,আর তার বাবা আসমান আলীর পছন্দ ফুল গাছ।গেইট দিয়ে ঢোকাই যায়না বাগানবিলাসের লতাপাতার জন্যে।তারা লতাপাতা কাটেনা কারণ আসমান আলী নাকি মনে করেন গাছ কাটা মানে আখিরাতে নিজের মাথার একটা করে চুল ছেঁড়া।

তাই কেউ যদি ভুলবশত গাছ কেটেও ফেলে তাকে এর প্রতিদান হিসেবে একটা চুল ছিঁড়ে ওনাকে দিতে হবে।ওনার নিজস্ব জাদুগর আছে এসব মানুষের চুল দিয়ে।সেখানে কাঁচের বাক্সে চুল থাকে আর অপরাধ করা ব্যাক্তির নাম লেখা থাকে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হউন

এইসব বলছিল আসমান আলীর বাগানের কেয়ারটেকার মন্টি।তার মাথায় একটা চুল ও নাই।ইশান জানতে চাইলো এই বয়সে সে টাক হয়েছে কেন।তখন ছেলেটা লজ্জা পেয়ে বলে,’হে হে!টাক হবো কেন!আসলে আমি বাগানের দেখাশুনি করি তো!মাঝে মাঝে ভুলবশত গাছের ঢাল ভেঙ্গে ফেললে চুল ছিঁড়ে প্রতিদান দিতে হয়।’
‘তার মানে তুমি প্রতিদিন ঢাল ভাঙ্গো?’

‘নাহ তা কেন!নতুন চুল গজালেই ঢাল ভেঙ্গে ফেলি ভুলে তখন আর কি!’
‘সাংগাতিক!’
‘চলুন না আমরা চলে যাই।আমার ভয় করছে।কদিন আগেই চুলে কেরাটিন ট্রিটমেন্ট করেছি।আমার এত স্বাদের চুল।যদি ছিঁড়তে হয়?’

‘আমরা কি গাছ কাটবো নাকি?আমরা গিয়ে শুধু কথা বলবো’
কোনোরকমে দুজনে ভেতরে প্রবেশ করে।বাড়িটা এত সুন্দর যে বলে বোঝানো দায়।বাগান থাকা বাড়ি যত শ্যাওলা জমেই থাকুক না কেন,দর্শনার্থীর চোখে সে বাড়ি অপরুপ সুন্দর।ইশান আর তিথির কাছে সেরকম সুন্দরই লাগছে বাড়িটা।তারা দেখতে দেখতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। দরজা খোলাই ছিল।

ভেতরে এসে তারা তো অবাক,সব কিছু প্লাস্টিকের,একটাও কাঠের ফার্নিচার নেই। কি আজব!
আরেকটু ভেতরে যেতেই তারা একজন ভদ্র লোককে দেখে থেমে যায়।উনার ইয়া বড় বড় চুল।শুরুতে মেয়ে মনে করেছিল তিথি,পরে পোশাক আশাকে ছেলে চিহ্নিত করলো।

‘আপনিই কি আসমান আলী?’
‘কে তোমরা? ‘
‘আমরা পান্নার আত্নীয় হই,ওকে ডেকে দিবেন?’
‘তার আগে বলো তোমরা আমার কোনো গাছের পাতা ছিঁড়ো নাই তো?
‘না,ভুলেও না’
‘ঠিক আছে,বসো।কফি আনার ব্যবস্থা হচ্ছে’
তিথি বললো,’আপনারা চা খান না?’

‘চা গাছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে বানানো হয়।কোনো গাছপ্রেমী মানুষ এই জঘন্য কাজ করতে পারেনা।আমি কফি খাই।কফি বীজ থেকে তৈরি হয়।বুঝেছো?’
‘জ্বী দাদু’

তিথি ভয়ে ভয়ে ইশানকে দেখছে। ইশান ও চুপচাপ ওর পাশে বসে পড়ে।এরপর হেসে হেসে বলে,’আপনাদের দেখছি সব ফার্নিচার প্লাস্টিকের।ভালো ভালো!।তা শোয়ার খাট ও কি প্লাস্টিকের?’
‘গাছপ্রেমী হতে হলে সর্বদিক দিয়ে হতে হয়।আমার বাড়ির সব খাট সিমেন্ট দিয়ে ঢালায় করে বানানো।বুঝেছো?’
‘হুম বুঝেছি।আচ্ছা আপনার চুল এত লম্বার কারণ জানতে পারি?যদি কিছু মনে না করেন?’
‘কিছু মনে করি কিনা সেটা ভাবলে আর জিজ্ঞেস করেছো কেন?এমনিতেও হুটহাট আসা মেহমান আমার পছন্দ না।পান্নাকেও পছন্দ হয়নি,আসার সময় বলে আসতে পারতো!’

এই শুনে তিথি আর ইশান চোরের মতন বসে থাকলো।ভদ্রলোক এবার ওদের সামনের চেয়ারে বসলেন।এরপর বললেন,’গাছের পাতা অযথা ছিঁড়লে তাদের মাথার চু্ল ছিঁড়াই আমি।কিন্তু আমি কোনোদিন গাছের পাতা ছিঁড়ি না।তাই আমার চুল ভাল এবং সুস্থ এবং লম্বা আছে।বুঝেছো?’
ইশান আর তিথি মাথা নাড়ায়।কফি এসে গেলো। দুজনেই চুপচাপ কফি খাচ্ছে।পান্না নাকি জাদুগর পরিষ্কার করতে গেছে তাই ওর আসতে দেরি হচ্ছে।

এই সুযোগে ইশান বলে সে আর তিথি ওনার বাগানটা ঘুরে দেখতে চান।
‘আপনার কি মাথা গেছে?জেনেশুনে কুয়োতে লাফ দিতে চান কেন?বাই চান্স গাছের পাতা ছিঁড়ে ফেললে কি অবস্থা হবে জানেন?’

‘আরে সমস্যা নাই।এতদূর যখন এসেছি এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যায়না’
ইশান তিথিকে জোর করে বাগানের দিকে নিয়ে আসে।বাগান দেখে তিথি অবাক হয়ে যায়।এত সুন্দর ফুলের বাগান!
তিথি হাত দুটো পিঠের সাথে লাগিয়ে হাঁটছে যাতে ভুলেও তার হাত দিয়ে কোনো পাতা না ছিঁড়ে,আসমান আলী ওদের পিছু পিছু আসছে।

ইশান তখন বললো,’ এত এত ফুল আপনার গাছে। বিক্রি করলে তো অনেক টাকা পেতেন’
‘ফুল বিক্রি করেই তো আমার বাগানের এত বিস্তর হলো।ফুল ছেঁড়া যায় তবে গাছ না।প্রতিদিন ভোর ৫টায় দুটো ট্রাক আসে।সাদা,হলুদ আর লাল গোলাপ,অর্কিড,গাঁদা এসব নিয়ে চলে যায়।’
‘আপনার তাহলে অনেক টাকা’
‘হুম।আমি বাগান আরেকটা করেছি সেটা নরসিংদী থেকে অনেকদূরে।’
‘তার মানে ফুল ছেঁড়া যাবে?’

এটা বলেই তিথি একটা গোলাপ গাছ থেকে ফুল কতগুলা নিয়ে নিলো।খুশি আর তার ধরেনা।
ইশান তখন ওকে বলে ধীরে সুস্থে করতে,তাড়াহুড়া যেন না করে।
কিন্তু তিথি এতটাই এক্সাইটেড ছিল যে গোলাপ ছিঁড়ার জন্য টান দিতেই গাছটা গোড়া থেকে উঠে ওর হাতে চলে আসলো।এটা দেখে আসমান আলীর যেন মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়েছে।
তিথি ভয়ে ভয়ে গাছটাকে মাটিতে পুঁতে দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই আর আগের মতন ঠিক করতে পারেনা।যেমন গাছ তেমনই পড়ে থাকে।

ইশান তখন আসমান আলীকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে,’দাদু আমরা গাছটাকে আবার পুঁতে দিবো,আপনি এত প্যানিক হইয়েন না।একটু সময় দিন’
‘খামোশ!!মন্টি চন্টি,খন্টিকে ডাক দে!’
ওমনি দুজন পালোয়ান এসে হাজির হলো।তিথি ভয়ে ইশানের পেছনে লুকিয়ে পড়ে।

আসমান আলীর নির্দেশে ইশান আর তিথিকে একটা বড় গাছের সাথে বাঁধা হলো।তিথি কান্নাকাটি করছে তার চুল নিয়ে।ইশানকে বাঁধা হয়েছে কারণ তার হাত খোলা থাকলে সে তিথিকে বাঁচানোর চেষ্টা করবে।
‘মন্টি!এই মেয়ের মাথার চুল ছিঁড়ো।লম্বা দেখে একটা ছিঁড়বে’
‘না না!ইশান আপনি কিছু করছেন না কেন!’
ইশান ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,’তোকে ১০০বার করে বলছি গাছে হাত দিস না,দিস না!তাও শুনলিনা তো!এবার ভোগ!’

‘কেমন স্বামী আপনি?’
মন্টি তিথির মাথার চুল একটা ছিঁড়ে জাদুঘরে রাখতে চলে গেছে। তিথি চিৎকার চেঁচামেচি করতে লাগলো।কত বড় পাগলের পাল্লায় পড়েছে তার হুশ ওর এখন আসলো।তাই ভয়ে আর শোকে চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে তিথি।
এবার তিথির আর ইশানের হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হলো।পান্না এসে এই অবস্থা দেখে নিজেই ট্রমাতে চলে গেছে।দাদুকে সে বকাও দিলো এমনটা করার কারণে।কিন্তু দাদুর কাছে অপরাধ মানে অপরাধই।সে যেই হোক না কেন!গাছের ক্ষতি করলে শাস্তি পেতেই হবে’

ইশান পান্নাকে জানায় সে যেন ওদের সাথে ফিরে ঢাকায়।কিন্তু পান্না সাথে সাথে মানা করে দেয়।
‘কি হয়েছে পান্না?রিদম কিছু বলেছে?’
‘না ভাইয়া।আমার ইচ্ছে আমি এখন থেকে এখানেই থাকবো ‘
‘কিন্তু কেন?আমাদের বলতে কি সমস্যা? ‘
‘কিছু হয়নি’

‘ঠিক আছে থেকো।কিন্তু বিয়েটাতে তো অন্তত এটেন্ড করবা।চলো!ব্যাগ গোছাও’
‘আমি যাব না ভাইয়া’
তিথি কাছে এসে পান্নার হাত দুটো ধরে বলে,’আমাকেও শেয়ার করবেনা?’

তিথির মায়া জড়িত কথায় পান্না আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারলোনা।হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো।তিথি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,’আমায় বলো,আমি সব সমাধান করে দিবো’
‘আমি চাই রিদম ভাইয়া আর পিংকি আপু যেন বিয়ে করে।কিন্তু আমি কখনও তাদের খারাপ চাইনা আপু।বিশ্বাস করো!’

তিথি ইশানের দিকে তাকায়।তার মানে গোড়ার ভেজাল পিংকি লাগিয়েছে।
তিথি পান্নাকে বলে,’ঠিক আছে!এখানেই থেকো।কিন্তু তুমি কি জানো?আমরা তানিয়ার বিয়ে শেষ হলে জাপান যাবার সময় রিদমকে সাথে নিয়ে যাবো?’

‘একটু শুনেছি ‘
‘এটাই সত্যি।শেষবার ওকে দেখবেনা?’
‘উনি কি আর আসবেন না কখনও?’
‘বিয়ে করার জন্য আসবে কয়েক বছর পর’
‘ওহ!ঠিক আছে।কিন্তু আমি বাসায় যাব না।বুবু দেখলে রাগ করবে’
‘যেতে হবেনা।তুমি আমাদের বাসায় থাকবে, কেমন?’

যদি তুমি বলো পর্ব ৪৮

‘স্যার?স্যার?’
ইশান বিরক্ত হয়ে পেছনে চেয়ে বললো,’কি?’
মন্টি বললো,’আমাদের দাদার জানের জান,কলিজার কলিজা বিদেশী বুনো ফুলের চারার উপর দাঁড়িয়ে আছেন আপনি।যে চারা দাদাজান নিজে বিদেশ গিয়ে এনেছিল তিনদিন আগে’

যদি তুমি বলো পর্ব ৫০