যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ১৬

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ১৬
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

হাসিব অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে মাত্র। তখনই আহনাফের কল এসেছে। সে মেইনগেটের লক খুলতে খুলতে আহনাফের কথা শুনছিল এবং যারপরনাই অবাকও হয়েছে সে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে হাসিব বলল,
“আর ইউ সিরিয়াস?”
আহনাফ বলল,
“ইয়েস।”

“হঠাৎ তোর কেন মনে হলো শশীকে সব বলা প্রয়োজন?”
“আমি অর্ষাকে এড়িয়ে চলতে পারছি না। এদিকে শশীকেও সবটা বলতে পারছি না। আমার নিজের ভীষণ গিল্টি ফিল হচ্ছে। তাই আমার মনে হয়, এবার সত্যটা শশীর মুখোমুখি করা প্রয়োজন।”
“কিন্তু শশী যদি না মানে?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আহনাফ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,
“আগে ও-কে সবটা জানাই। তারপর ও যা ডিসিশন নেবে তাই হবে।”
হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,
“আল্লাহ্ তোর সহায় হোক।”

অর্ষা বাড়িতে ফিরে আহিলকে শুধু জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছিস?”
আহিল মৃদুস্বরে বলল,
“আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো। তুই?”
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। একটু বোস, আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
“আচ্ছা যা।”

অর্ষা রুমে যাওয়ার পর সকালও উঠে দাঁড়াল। বলল,
“আপু তো চলে এসেছে। এবার আমি যাই।”
আহিল প্রত্যুত্তরে হ্যাঁ, না কিছুই বলল না। সকালও উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে প্যাটিসকে নিয়ে ঘরে চলে যায়। সে মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়ছে যাতে অর্ষা বিড়াল দেখে কোনো রিয়াক্ট না করে। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অর্ষার দৃষ্টি যায় প্যাটিসের দিকে। ভ্রুঁ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

“বাসায় বিড়াল এনেছিস কেন?”
“ও দেখতে কত কিউট না বল আপু?”
“আমি তোকে জিজ্ঞেস করেছি বাসায় বিড়াল কেন এসেছিস?”
সকাল মুখটা কাঁদোকাঁদো করে বলে,

“আমার একটা বিড়াল পালার ভীষণ শখ! প্লিজ, তুই রাগ করিস না।”
“তোর এসব শখ আমার একদম পছন্দ না সকাল।”
“ও খুব ভালো বিড়াল। কিচ্ছু করবে না। ও-কে বের করে দিতে বলিস না।”
অর্ষা কিয়ৎক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,

“বিড়াল পালবি পাল। কিন্তু খবরদার আমার আর খাবারের আশপাশে যেন না আসে।”
“যাবে না, যাবে না। আমি ও-কে দেখে রাখব।”
অর্ষা এই ব্যাপারে আর কিছু বলল না। মুখ মুছে বারান্দায় গিয়ে আহিলের পাশে বসল। বলল,
“সিভি আনতে বলেছিলাম। এনেছিস?”
“হ্যাঁ।”
“দে।”

আহিল তার ব্যাগ থেকে সিভিটা বের করে বলল,
“তুই কি এখন ফ্রি আছিস?”
“ছ’টা অব্দি ফ্রি আছি। এরপর কয়েকটা বাচ্চা আসবে। ওদের পড়াতে হবে।”
আহিল তার ফোনে সময় দেখে নিয়ে বলল,
“ত্রিশ মিনিটেরও বেশি সময় আছে। চল কলেজ গেইট থেকে ঘুরে আসি।”
“এই সময়ে?”

“এছাড়া তো আর সময়ও নেই। ক্লাসের ওরাও চাইছিল দেখা করতে।”
অর্ষা আর কোনো কিছু না ভেবেই বলল,
“চল।”

সেলিনা বেগমকে বলে অর্ষা আহিলের সঙ্গে বের হলো। যাওয়ার পথে সবাইকে ফোন করে আহিল কলেজ গেটে আসতে বলেছে। সূর্য এখনও অস্ত যায়নি বলে দিনের আবির্ভাব এখনও রয়ে গেছে। আহিল আর অর্ষা পৌঁছানোর পূর্বেই আশিক আর দিদার পৌঁছে গেছে। একে একে রেশমি, লামিয়া আর জুঁইও চলে আসে। ওরা বিশাল বড়ো একটা বটগাছের নিচে বসে। পাশের দোকানেই তেলে ভাজাপোড়া খাবার তৈরি হচ্ছে। ওরা বেগুনি, আলুর চপ আর ডিমের চপ অর্ডার দিয়ে গল্প করছে।
রেশমি চুলে আঙুল পেঁচিয়ে আশিকের উদ্দেশ্যে বলল,

“দোস্ত তুই তো খুব ভালো কবিতা বানাতে পারিস। তোর গানের গলাও নিশ্চয়ই সুন্দর? এই ডুবু ডুবু সন্ধ্যায় একটা গান শোনা তো।”
সবাই রেশমির সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হয়ে যাক একটা গান।”
আশিক গদগদ একটা ভাব ধরে বলল,

“যদিও গান গাইতে আমি একটু লজ্জা-টজ্জা পাই; কিন্তু তোরা বলছিস বলে গাচ্ছি।”
“হ্যাঁ, এখন ঢং বাদ দিয়ে শুরু কর।” বলল জুঁই।
আশিক ওর কথার উত্তরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“জুঁইয়ের বাচ্চা জুঁই, মারমু একটা কনুই!”
দিদার ওদেরকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

“আহা! ঝগড়া পরে করিস তো। এখন গান শুরু কর। খাবার চলে আসলে তখন তোর গান আর কেউ শুনবে না।”
“এটা কি তাড়া দিলি নাকি অপমান করলি?”
রেশমি গুনগুন করে বলল,
“তুই যেটার প্রাপ্য।”

আশিক এবার আর ঝগড়ায় মন দিলো না। সে চোখ বন্ধ করে গান গাইছে।
আশিকের গান শেষ হতে না হতেই বটগাছের নিচু ডাল থেকে দুটো কাক সমানে কা, কা শব্দ করছে। বন্ধুমহলে হাসির ধুম পড়ে যায়। জুঁই হাসতে হাসতে বলে,

“তোর গান শুনে কাকও বিরক্ত হয়ে গেছে। তাহলে বোঝ আমাদের কী অবস্থা!”
আশিক মুখটা গোবেচারা করে সবার দিকে একবার করে দৃষ্টি বুলায়। দু’হাত বগলদাবা করে মলিনকণ্ঠে বলে,
“আমার ভুল হয়ে গেচে। আমাকে ক্ষমা করি দিন।”
এবার সবার হাসি যেন আরও বেশি জোড়াল হলো। এক পর্যায়ে আশিক নিজেও ওদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দেয়।

আহনাফ রাফিকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে আছে। অর্ষা আসবে বলেই হয়তো! কিন্তু তার সকল উৎকণ্ঠা এবং আনন্দকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে সকাল এসে উপস্থিত হয়। সে ভেতরে গিয়ে আহনাফের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভালো আছেন ভাইয়া?”
আহনাফ মৃদু সহাস্যে বলল,
“হ্যাঁ। আজ তুমি এলে যে?”
“এখন থেকে আমিই রাফিকে পড়াব।”
কারণ জিজ্ঞেস করতে গিয়েও অচেনা সংকোচে জড়তাবোধ করছিল আহনাফ। তাই সে আর কোনো প্রশ্ন না করে রাফিকে বলল,

“পড়তে যাও।”
সকাল আসায় রাফি যে খুশি হয়নি, এমনটা নয়। তবে সে অর্ষাকে ভীষণ মিস করছিল। এতদিনে অর্ষার সঙ্গ তার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল বলেই হয়তো! সে গালে হাত দিয়ে সকালকে জিজ্ঞেস করল,
“অর্ষা ম্যামের কী অসুখ করেছে?”
সকাল রাফির সিলেবাস দেখছিল। সিলেবাস থেকে চোখ তুলে প্রশ্ন করল,
“কেন বলো তো?”
“অসুখ না করলে ম্যাম এতদিন আসেনি কেন? আর আসবে না?”
সকাল মিষ্টি করে হেসে বলল,

“না, অর্ষা ম্যামের অসুখ করেনি। সে ভালো আছে। কিন্তু ম্যাম তো এখন কাজ নিয়ে অনেক ব্যস্ত, তাই আসতে পারবে না।”
“মামা যে বলেছিল আজ আসবে।”
“বলেছিল নাকি? কই আমি তো জানতাম না!”
“তুমি ম্যামকে বলো, আমি তাকে মিস করেছি।”
“আচ্ছা বলব। এখন পড়ো।”

আহনাফ দরজার সামনে ঘুরঘুর করছে। সকালের কাছে অর্ষার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করবে নাকি করবে না ভেবে দোনোমনা ভাব এখনও কাটিয়ে উঠতে পারছে না। পেছন থেকে শশী এসে আহনাফের কাঁধে হাত রাখায় সে কিছুটা চমকে ওঠে। শশী হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
“কী?”

আহনাফ দু’পাশে মাথা নাড়ে। শশী বলে,
“এখানে ঘুরছ কেন?”
“ঘুরছি না তো! হাঁটছিলাম। তুমি কখন এলে?”
“মাত্রই। আন্টি আজ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ল?”
“হ্যাঁ। হালকা ডোজের ঘুমের ওষুধ দিয়েছি। কাল রাতে তেমন ঘুম হয়নি মায়ের।”
“ওহ। তুমি কিছু বলবে বলেছিলে ফোনে।”

আহনাফ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থেকে বলল,
“হ্যাঁ।”
“এখানে নিশ্চয়ই বলবে না? চলো ছাদে যাই।”
আহনাফ রাজি হয়। দুজনের মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব রয়েছে। মুখোমুখি নয়, দুজনে পাশাপাশি দাঁড়ানো। শশী কিছু না বলে অপেক্ষা করছে, আহনাফ কী বলবে তা শোনার জন্য।
“আচ্ছা শশী, তুমি কি আমায় ভালোবাসো?”

আহনাফের হঠাৎ এমন প্রশ্নে শশী যতটা না অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি ভড়কে গিয়েছে। কেননা আহনাফের সঙ্গে তার পরিচয় দু, একদিনের নয়। তবুও এই এতদিনের সম্পর্কে না আহনাফ কখনও শশীকে এমন প্রশ্ন করেছিল, আর না শশী! দুজনের কারও মনে কখনও এই প্রশ্নটি আসেনি বিধায় হয়তো কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি। সর্বদা তাদের মন হয়তো ভাবত, এটা একটা অবান্তর প্রশ্ন। যেহেতু প্রশ্নটি অপ্রত্যাশিত ছিল তাই শশী কিছুটা বিচলিতবোধ করে। আহনাফ উত্তরের জন্য ব্যস্ততা প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে,

“কী হলো? বলো?”
শশী তার চমৎকার হাসিটি হাসল। মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ব্যাপার কী বলো তো? আজ হঠাৎ এই প্রশ্ন করছ? আগে কখনও তো এসব প্রসঙ্গে কোনো কথা বলোনি।”
“আজ যখন বলছি, তখন অবশ্যই এর পেছনে কারণ আছে বলেই বলছি। তুমি আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।”
শশী এবার কিছুটা নড়েচড়ে বলে,

“দেখো আহনাফ, যদি সত্যি কথা শুনতে চাও তাহলে বলব, ভালোবাসার সাথে সম্পর্ক কিংবা সাক্ষাৎ কোনোটাই এখনও আমার হয়নি। আমি ছোটো থেকে মিশুক হলেও ভালোবাসার পরিপন্থী ছিলাম। এর কারণটাও তুমি জানো। আমার বাবা-মায়ের লাভ ম্যারেজ হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যকার বন্ডিং কতটা নিম্নস্তরে রয়েছে সেটা আমি তোমায় বলেছিলাম। তাই সবসময়ই চেষ্টা করেছি রিলেশন থেকে দূরে থাকার। তাই বলে, আমি এটা বলব না যে পৃথিবীর সব ছেলে এক কিংবা খারাপ।

এরকমটা ভাবলে হয়তো আমার কোনো ছেলে বন্ধুও থাকত না। আমিও চাই আমার সুন্দর একটা সংসার হবে। তাই আমি সবসময় ভাবতাম, নিজের মধ্যে যতটা ভালোবাসা আমি জমিয়ে রেখেছি বিয়ের পর সেই ভালোবাসাগুলো নিজের একান্ত মানুষটাকে উজাড় করে দেবো। আমি যদি বলি, তোমায় ভালোবাসি তাহলে সেটা মিথ্যা বলা হবে। তোমাকে আমি ভীষণ পছন্দ করি। তুমি বেস্ট একটা মানুষ। তবে সত্যি এটাই যে, ভালোবাসা এখনও গড়ে ওঠেনি। সেরকম সময়, সুযোগও কিন্তু আমাদের মাঝে তৈরি হয়নি তাই না? তুমি কখনও আমাকে সেভাবে ট্রিট করোনি, এমনকি আমিও না। আমাদের বিয়ে ঠিক হলেও আমরা সেই শুরুর দিকের মতো বন্ধুত্বটাকেই ধরে রেখেছি।”

আহনাফ চুপচাপ শশীর কথাগুলো শুনছিল। এতক্ষণ তার মনের ভেতর যেই ভয়গুলো ছিল, তা কিছুটা হলেও কমেছে। সে রুদ্ধশ্বাসে বলল,
“ওয়েল, আমার আজ এই প্রশ্নটা করার কারণ হচ্ছে আমি অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। হ্যাঁ, আমি জানি আমি তোমার সাথে কমিটেড। এমতাবস্থায় কাউকে ভালোবাসা অন্যায়ও হতে পারে। কিন্তু আমি এখানে কী করব বলে? ভালোবাসা কি নিজের ইচ্ছেয় হয়? নাকি জোর করে হয়?”

শশী চুপ করে আছে। আহনাফ বলল,
“যেহেতু তোমার সাথে আমি কমিটেড তাই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে তোমাকে বিয়ে করতেই পারি। তবে ভালোবেসে নয়, মায়ের জন্য। বিয়ের পর আমি কোনো রকম গিল্টি ফিল নিয়ে থাকতে পারব না বলেই আজ ক্লিয়ারলি কথাগুলো বলছি। এখন তুমি যা চাইবে তা-ই হবে।”

শশী হেসে বলে,
”এই কথাগুলো বলতেই তুমি এতটা নার্ভাস ফিল করছ? দেখো, আমি তোমাকে খুব ভালো করেই চিনি।
তুমি নিশ্চয়ই যেই সেই মেয়ের প্রেমে পড়োনি। তোমার মন জয় করতে পেরেছে মানে ঐ মেয়ের মাঝে বিশেষ গুণ আছে। ও তোমার মায়ের মনও জয় করে ফেলবে দেখো। ও-কে তোমার মায়ের কাছাকাছি থাকার সুযোগ করে দাও আগে। আমি এখন থেকে যত পারব কম আসব এখানে। এতে ঐ মেয়ের সঙ্গ বেশি করে পাবে আন্টি।”
“তার মানে তুমি…”

“আমি চাই তুমি যাকে ভালোবাসো তাকেই বিয়ে করো।”
“মন থেকেই চাইছ? আমার প্রতি তোমার রাগ, ক্ষোভ?”
“রাগ, ক্ষোভ কোনোটাই নেই। আমি মুখে এক আর মনে আরেক রাখি না। আমি স্পষ্টভাষী জানোই তো। মন থেকেই চাই, যাকে ভালোবাসো তাকেই বিয়ে করো।”

“তবুও আমি ক্ষমাপ্রার্থী শশী। অজান্তেও যদি কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে ক্ষমা করে দিও প্লিজ!”
“যাহ্ পাগল! এখানে ক্ষমা চাওয়ার কী আছে? বরং তুমি যে মনে এসব রেখে আমায় বিয়ে করোনি আমি এতেই খুশি। আমি কি কোনোদিক দিয়ে কম?”
“একদম নয়!”

“তাহলে? আমি যার হব তার সম্পূর্ণ ভালোবাসাটাই আমার চাই। একবিন্দুও কম নয়।”
“সত্যিকারের ভালোবাসা খুব শীঘ্রই খুঁজে পাও দোয়া করি। আর শশী, সত্যি বলছি তুমি ভীষণ ভালো মনের মানুষ।”
“মাই প্লেজার! এনিওয়ে মেয়েটা কে?”
আহনাফ কাঁধ নাচিয়ে বলল,

“সময় হোক। বলব।”
“নো, প্রবলেম। আমাদের বন্ধুত্ব রাখতে তো আপত্তি নেই?”
“একদম নেই!”
শশী মুচকি হাসল। আহনাফ মনে মনে বলে,
“মিস অর্ষা, এবার প্রস্তুত হও তুমি!”

ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘর। আশেপাশে আলোর বিন্দুমাত্র রেখাও দেখা যাচ্ছে না। চারিদিকে নিস্তব্ধতা। মাথার ওপর সিলিংফ্যানের সামান্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ ব্যতীত অন্য কোনো শব্দ নেই। সকাল মৃদুস্বরে ডাকে,
“আপু?”
“হু?”
“ঘুমিয়েছিস?”
“না।”
“একটা প্রশ্ন করি?”
“হু।”

“তুই রাফিকে কেন পড়াবি না?”
“তোকে একবার বলেছি, সব বিষয়ে এত কৌতুহল রাখবি না।”
“রাখলে কী হয়?”
অর্ষা নিশ্চুপ। সকাল বলল,
“রাফি তোকে অনেক মিস করে।”
“করুক।”
“আমার তো মনে হয়…”

সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অর্ষা বলল,
“তোর মনে হওয়াকে আপাতত বস্তায় বেঁধে রেখে ঘুমা প্লিজ!”
“আহা! পুরো কথাটা তো শোন।”
“সকাল! সকালে আমার অফিস আছে।”

“সকালে সকালেরও কলেজ আছে। পেটের মধ্যে কথা চেপে রাখলে রাতে ঘুম হবে না আমার।”
অর্ষা চুপ করে রইল। এর মানে দাঁড়ায় সে সকালের কথা শুনতে রাজি। সকাল ভীষণ সন্তর্পণে বলল,
“আমার কী মনে হয় জানিস? আহনাফ ভাইয়াও তোকে মিস করে।”

অর্ষা সকালের বকবকানি এড়িয়ে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিল। আহনাফের নামটি শুনেই তার চোখের পাতা আপনা-আপনি মেলে যায়। বুকের ভেতর সেই পরিচিত ব্যথাটা উন্মোচন হয়। ভারী দীর্ঘশ্বাসে বুক উঠানামা করে। মনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাকে ভুলে থাকার আকুল প্রয়াস, সে-ই কেন এভাবে ছায়ার মতো সর্বাবস্থায়, সর্বাঙ্গে লেপ্টে থাকে?
ধমকে উঠল অর্ষা,

“এসব বাজে কথা কেন বলিস?”
“বাজে কথা না। সত্যি বলছি। আজ অনেকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করেছে।”
“তো? এতেই প্রমাণ হয়ে যায় সে আমাকে মিস করে? তোদের যন্ত্রণায় এখন আর আমি মনে হয় বাড়িতেও থাকতে পারব না। পাগল হয়ে যাব আমি!”

অর্ষা উত্তেজিত হয়ে যায়। চাপা রাগ, কষ্ট কোনোটাই আর চেপে রাখতে পারেনি। এদিকে ভয়ে সকালও আর কথায় বাড়ায়নি। অর্ষার সঙ্গ সবচেয়ে যদি কেউ বেশি পেয়ে থাকে তাহলে সে হচ্ছে সকাল। তাই সে খুব ভালো করেই অর্ষার পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারে। কেমন যেন একটু একটু করে অনেকটা বদলে যাচ্ছে তার বোন!
রাতে অনেক চেষ্টার পর ঘুমুতে পেরেছিল অর্ষা। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল তখন সেলিনা বেগম দরজায় এসে দাঁড়ায়।আয়নাতে তার দিকে তাকিয়ে অর্ষা জিজ্ঞেস করল,

“কিছু বলবে মা?”
সেলিনা বেগম কিঞ্চিৎ ইতস্ততা প্রকাশ করে বললেন,
“রুহুলের কোনো খবর পেয়েছিস?”
“না।”

“ছেলেটার জন্য খুব মন পোড়ে রে! কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে!”
অর্ষা কিছু বলল না। তিনি বললেন,
“তুই একটু সময় পেলে তোফায়েলকে ফোন দিস তো।”
“কেন?”

“ও কোনো খবর পেয়েছে নাকি শুনিস একটু। ওকে তো বলেছিলাম। আমার সাথে আর দেখাও হচ্ছে না।”
অর্ষার হিজাব পরা শেষ। সে এবার ড্রেসিংটেবিলের ওপর থেকে ঘড়িটা নিয়ে সেলিনা বেগমের দিকে ঘুরে দাঁড়াল। কিছুটা কঠোরভাবে বলল,
“প্রতিদিন এক ঘ্যানঘ্যান, প্যানপ্যান ভালো লাগে না আমার। আর কীভাবে বোঝালে তোমরা বুঝবে? ও আর কীভাবে তোমাদের কষ্ট দিলে ভুলতে পারবে? লজ্জা হয় না তবুও তোমাদের। পেটেও তো ধরোনি। তাও কেন মায়া ছাড়তে পারো না বুঝি না।”

সেলিনা বেগমের চোখ ছলছল করছে। অর্ষা ঘড়ি পরে ব্যাগ কাঁধে নেয়। দরজায় গিয়ে মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে দু’কাঁধে হাত রেখে ডাকে,
“মা!”
তিনি ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন। অর্ষা তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
“কেঁদো না মা। যার তার জন্য চোখের পানি ফেলো না। যে আমাদের ছাড়াই ভালো থাকতে চায়, আমাদেরও তাকে ছাড়াই ভালো থাকতে হবে।”

সেলিনা বেগম শাড়ির আঁচলে চোখ মোছেন। তবে কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা করলেন না। অর্ষার কষ্ট হয় ভীষণ এই মানুষ দুটোর জন্য। কষ্টগুলো সে অব্যক্তই রাখে। তাই তো সবসময়ের মতো এবারও নিজেকে নিষ্ঠুর প্রমাণ করতে সেলিনা বেগমের ক্রন্দনরত অবস্থাতেই অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততা দেখিয়ে বেরিয়ে পড়ে। যাওয়ার পূর্বে শুধু বলে গেল,
“বাবার খেয়াল রেখো। আর তুমিও ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া কোরো।”
অফিসে যাওয়ার পরপর অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, যার জন্য অর্ষা প্রস্তুত ছিল না। স্মৃতি এসে জানাল,
“জিসান স্যার তোমায় খুঁজে গেছে।”

আহনাফ যেদিন জিসানকে কথা শুনিয়েছিল সেদিনের পর থেকে জিসান কখনও অর্ষার সাথে কথা বলেনি। এমনকি প্রয়োজনেও না। সবসময় তাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছে। তাকে দেখলেই কপালে কুঞ্চনরেখা সৃষ্টি হতো যেগুলো অন্তত তার সামনে মসৃণ হয়নি। রাগে যেন সে পারত না শুধু অর্ষাকে কাচা গিলে খেয়ে খেলতে! এমতাবস্থায় গতকাল খেল তার সঙ্গে ধাক্কা। আজ আবার খুঁজে গিয়েছে। এবার বোধ হয় রাগ আর চাপা রাখবে না! অর্ষার ভেবেই ভয় হচ্ছে না জানি কোন ঝড় তার জন্য অপেক্ষা করছে। সে ভয়ে ঢোক গিলে স্মৃতির উদ্দেশ্যে বলে,

“কেন খুঁজছে বলো তো?”
“জানিনা তো! আমাকে বলে গেল তুমি আসলে যেন, তোমাকে তার কেবিনে যেতে বলি।”
“ভয় লাগছে!”
“ধুর! ভয় পেও না। রাগারাগি করলে সোজা এইচ.আর-এ নয়তো আহনাফ স্যারকে বলে দেবে।”
“আগে শুনে আসি, দেখি কী বলে।”
“হ্যাঁ, যাও।”

অর্ষা যাওয়ার আগে জিসান-ই সেখানে চলে আসে। অর্ধেক পথেই থমকে দাঁড়ায় অর্ষা। সে চোখ বড়ো বড়ো করে জিসানের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যাকে কখনও হাসতে দেখা যায় না। আজ সে হাসছে। হেসেই অর্ষাকে জিজ্ঞেস করল,
“কেমন আছো এখন?”
অর্ষা তৎক্ষণাৎ কথা বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। অবস্থা হয়েছে অনেকটা স্ট্যাচুর মতো। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলল,

“হ্যাঁ, ভ…ভালো স্যার! আপনি ভালো আছেন?”
“হ্যাঁ। গতকালকের জন্য স্যরি।”
“নো,নো স্যার! স্যরি তো আমার বলা উচিত। আমার ভুল ছিল। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি স্যার। গতকাল ওমন একটা সিচুয়েশনে স্যরিও বলা হয়নি। আমি এজন্যও দুঃখিত এবং লজ্জিত।”
“বি ইজি অর্ষা! যা হওয়ার হয়েছে, ভুলে যাও। এই ফাইলগুলো নাও।”
“এগুলো কী করব?”

“এগুলো দেখে কম্পিউটারে আপডেট করবে। তারপর প্রিন্ট বের করে এখানে আহনাফ স্যারের সিগনেচার, এখানে এইচ.আর-এর শিরিন ম্যামের সিগনেচার নেবে। এই পুরো কাজটা দ্রুত কমপ্লিট করে ফাইল এবং প্রিন্টগুলো আমায় জমা দেবে।”
অর্ষা মাথা নাড়িয়ে বলল,
“ঠিক আছে স্যার।”

জিসান মুচকি হেসে চলে যাওয়ার পর স্মৃতি মুখ টিপে হেসে বলে,
“সব আহনাফ স্যারের কীর্তি! সেদিনের বকা ভুলেনি হয়তো বেচারা। অবশ্য আর একটা কারণও হতে পারে।”
অর্ষা ফাইলগুলো নেড়েচেড়ে দেখে বলল,
“সেটা কী?”
“ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়ার সাথে সাথে হয়তো তোমার প্রেমেও পড়ে গেছে।”
“ধুর যা!”

স্মৃতি খিলখিল করে হেসে ওঠে। নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে বসতে বলে,
“ভেবে দেখো, এমনটা হলে কিন্তু মন্দ হবে না। রাগী হলেও সে দেখতে মারাত্মক!”
“তোমার মাথা।”
অর্ষা জিসানের বলা কথা মোতাবেক ফাইলগুলো তৈরি করে আহনাফের কেবিনে যায়। আহনাফ নিজেও এতক্ষণ অর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে চেয়ারে বসে দু’দিকে নড়তে নড়তে বলে,

“বসুন।”
অর্ষা বলল,
“ইট’স ওকে।”
“আমি বসতে বলেছি।”
“সমস্যা নেই। আপনি সাইন করুন। আমার আরও কাজ আছে।”
“কিন্তু আমার আপাতত কোনো কাজ নেই। বসুন। একটু গল্প করি।”
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। কপালে উড়ে আসা কয়েকটা ছোটো চুল কানের পিঠে গুঁজে নিয়ে বলল,
“সমস্যা কী আপনার?”

“আমি জানতে চাই, আপনার সমস্যা কী?”
অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলে,
“আমার সমস্যা মানে?”
“আমি বলেছিলাম, সাদা পোশাক পরে আমার সামনে আসবেন না।”
অর্ষা নিজের পোশাকের দিকে তাকায়। তার খেয়ালই ছিল না কথাটা। আহনাফ আবার বলল,
“কথায় কথায় হাত দিয়ে কপালের ওপর থেকে চুল সরাবেন না।”

“কেন? আপনার সমস্যা কী?”
“সমস্যা আমার নয়, আপনার হবে। আমি যদি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারি তখন কিন্তু আমায় দোষ দিতে আসবেন না।”
“এসব কী ধরণের কথাবার্তা?”
“আমার স্পষ্ট কথাবার্তা। হঠাৎ চুমুটুমু খেয়ে বসব তখন দোষ দিয়ে লাভ নেই।”
“আপনি কিন্তু আমার সাথে বাজে বিহেভ করছেন।”

“তাই নাকি? না হয় করলাম। নিজের মানুষের সাথে সব করা যায়।”
“কে আপনার নিজের মানুষ?”
“এইযে সামনে দাঁড়ানো শুভ্রাবতী।”
“আপনি যে এমন নিচু মনের মানুষ সেটা তো আমি জানতাম না।”
“এখন থেকে জানবে। সব জানবে। কারণ আমি তোমার, তুমি আমার। খারাপ, ভালো সব জানার অধিকার আমার রয়েছে।”
“আপনার শশী জানে এসব?”

“একটু ভুল হলো! আমার শশী না, শুধু শশী বলো। বাই দ্য ওয়ে, ও কী জানবে?”
“আপনার ক্যারেক্টার যে লেস!”
“নাহ্। ওর এসব জানার প্রশ্নই আসে না। আমি যদি কারও সামনে, কারও জন্য ক্যারেক্টারলেস হই তাহলে সেই একমাত্র নারীটি তুমি।”

অর্ষা কিছুটা থমকে যায়। সামলে নিয়ে বলল,
“নতুন কোন নাটক শুরু করলেন?”
“নাটক নয়। যা বলছি সব সত্যি। শশীর বিষয়টা ক্লোজড। ওর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমরা আর কমিটেড নই।”
“তার মানে?”
“আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না। আমি শশীকে সব খুলে বলেছি।”
“কী বলেছেন?”

আহনাফ কয়েক সেকেণ্ড নিরবতা পালন করে বলল,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
অর্ষা ব্যঙ্গ করে হাসল। কথাটিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“প্লিজ স্যার, সাইন করুন। আমার এখনও অনেক কাজ বাকি আছে।”
আহনাফ টেবিলের ওপর কিছুটা ঝুঁকে এসে বলে,

“আমি সিরিয়াস অর্ষা! ট্রাস্ট মি।”
“দুঃখিত আপনায় বিশ্বাস করতে না পারার জন্য।”
“বিশ্বাস করা লাগবে না। ভালোবাসলেই হবে।”
“নেই। আপনার জন্য আমার মনে আর কোনো ভালোবাসা নেই।”
“মিথ্যে কথা।”

“বিশ্বাস করা বা না করা আপনার ব্যাপার। এখন আপনি কি সাইন করবেন?”
আহনাফ কিছুক্ষণ আরক্তিম দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকিয়ে থেকে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
“ঠিক আছে। আমিও তোমার পিছু ছাড়ছি না। দেখব, কতটা এড়িয়ে চলতে পারো।”

অর্ষা কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফ ফাইলগুলোতে সাইন করা মাত্র সেগুলো তুলে নিয়ে অর্ষা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আহনাফ দ্রুত গতিতে উঠে গিয়ে দরজার সামনে পথরোধ করে দাঁড়ায়। আহনাফ যে এমনটা করবে অর্ষা বুঝতে পারেনি, তাই দুজনের দূরত্বও ভীষণ কম। অর্ষার অপ্রস্তুত দৃষ্টি ও ভঙ্গি দেখে আহনাফ দুষ্টু হেসে মাথা নাড়িয়ে Blake Shelton এর গানের একটা লাইন বলে,

“God gave me you for the ups and downs. God gave me you for the days of doubt My Butterfly.”
‘My Butterfly’ ছিল আহনাফের সম্বোধন। বিরক্ত হয়ে অর্ষা বেশ জোরেশোরেই আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যায়।

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ১৫

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ। এক সপ্তাহ্ গল্প দিতে পারিনি। তাই আজ প্রায় তিন হাজার শব্দের একটা পর্ব দিয়েছি। সামনে হয়তো আরও গ্যাপ পড়বে কারণ আমার এক্সাম আছে। সব আসলে একসাথে সামলানো সম্ভব হচ্ছে না। অভিযোগ বা রাগ না রেখে আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা করবেন প্লিজ! টেক লাভ।]

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ১৭