হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১২

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১২
সাদিয়া জাহান উম্মি

ঝুম,ঝুম,ঝুম।বাহিরে প্রচন্ড পরিমান বৃষ্টি পরছে।বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশ।কক্ষজুড়ে শীতলতা বিরাজমান।কেননা বারান্দার পুরো দরজাটা খোলা।সেখান থেকেই ঝড়ো হাওয়ার শীতল বাতাস এসে কক্ষটা হিমশীতল করে দিয়েছে।রুমের সাদা পর্দাগুলো বাতাসের দাপটে উড়ে চলেছে অবিরাম।পুরো কক্ষে ফুলের ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। হরেক রকম ফুল দিয়ে আজ সাজানো হয়েছে জায়ানের কক্ষ।সেই সাথে ফেইরিলাইট্স লাগানো।ফুলে সজ্জিত বিছানায় ব

সে আছে আরাবী।একটু আগেই সকল নিয়ম রিতী শেষ করে তাকে রুমে এসে দিয়ে গিয়েছে নূর আর তার কয়েকজন কাজিন। প্রচুর অস্থির লাগছে আরাবীর।ভয়ে,লজ্জায়,উত্তেজনায় শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। ফুলে সজ্জিত কক্ষটার দিকে তাকালেই আরাবীর বুক ধরফর করে উঠে।কিরকম যে এক অনুভূতি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরাবী নিজেই বুঝতে পারছে না।বাহির থেকে চেচামেচির আওয়াজ আসছে।তার মানে জায়ান এসে পরেছে।বুকটা ধুকপুক করছে আরাবীর।পরিহিত বিয়ের লেহেঙা খামছে ধরলো আরাবী। উত্তেজনায় বুক কাঁপছে। আচ্ছা,আয়নার সামনে গিয়ে কি নিজেকে একবার দেখে নেবে আরাবী?তখন কান্নাকাটির কারনে মেক-আপ বেশি না অল্প একটু খা’রাপ হয়ে গিয়েছিলো।পরে অবশ্য নূর জায়ানের কক্ষে দিয়ে যাওয়ার আগে ওর মেক-আপ ঠিক করে দিয়েছে।

সুন্দরভাবে ওকে পরিপাটি করে দিয়েছে।নূর ওকে সাজ ধুয়ে ফেলতে বলেছিলো।আরাবীই বারণ করেছে।কারন জায়ান ওকে এখনো ভালোভাবে বঁধুবেশে দেখেইনি।তাই তো এখনো এইভাবে সেজে আরাবী। আরাবীর ভাবনার ঘোর কাটলো কক্ষের দরজা খোলার আওয়াজে।জায়ান এসেছে।মুহূর্তেই হৃৎপিন্ড ৪৪০ বোল্টের বিদ্যুতের ন্যায় ছুটতে লাগলো।জায়ান এসেই গলা খাকারি দিলো। কেঁপে উঠলো আরাবী।জায়ান ধীরে এসে বসলো আরাবীর পাশে।আরাবী ঘোমটার আড়ালে আঁড়চোখে জায়ানকে দেখার চেষ্টা করলো।জায়ান একদৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে।দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো আরাবী।মনে মনে সাহস জুগিয়ে মিনমিনে স্বরে বলে উঠলো,

-‘ আসসালামু আলাইকুম। ‘
জায়ান ধীর স্বরে জবাব দিলো,
-‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম। ‘
জায়ান এইবার শীতল কণ্ঠে বলে,
-‘ তোমাকে দেখার অনুমতি আছে?’

এমন কথায় আরাবী অবাক হলো।তাও সেই নিচু স্বরে বলে,
-‘ আমি তো আপনারই।অনুমতি নেওয়ার কি আছে?’
জায়ান তৃপ্তির হাসি দিলো।তারপর আরাবীর মাথার ঘোমটা উঠিয়ে ফেললো।আরাবী মাথা নিচু করে ছিলো।জায়ান আরাবীর থুতনী হালকা স্পর্শ করে আরাবীর মুখ উঁচু করে ধরলো। জায়ান যেন থমকে গেলো।চোখের পলক না ফেলে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো আরাবীকে।ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে,

-‘ মাশা-আল্লাহ। আজ যেন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম ফুলটা আমার ঘরে,আমার কাছে।যার তুলনা আর কোন ফুলের সাথেই হবে না।’
আরাবী আগে থেকেই চোখ বন্ধ করে ছিলো।এই কথা শুনে লজ্জায় ও চোখ খিচে বন্ধ করে নিয়েছে।এতো লজ্জা, ইস। জায়ান নরম গলায় বলে,
-‘ তাকাও আরাবী।’

এইভাবে বললে কি সেই ডাক উপেক্ষা করা যায়?আরাবীও পারলো না। পিটপিট করে নয়নজোড়া খুলে তাকালো জায়ানের দিকে।জায়ান এখনো নেশাময় চোখে তাকিয়ে।এই চোখে চোখ মেলাতে পারে না আরাবী।জায়ানের ওই চোখের চাহনী যেন ভয়ং’করভাবে আরাবীর ভীতরটা দু’মড়েমু’চড়ে দেয়।এলোমেলো করে দেয় ওর সমস্ত কিছু।জায়ান আরাবীকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও থেমে গেলো। কি মনে করে যেন উঠে গেলো বিছানা থেকে।তারপর নম্র কণ্ঠে বলে,

-‘ ফ্রেস হয়ে আসো আরাবী।আগে চলো দু-রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নেই।’
আরাবী জায়ানের কথা শুনে মাথা দোলালো।ভারি লেগেঙা হওয়ায় আরাবীর উঠে দাঁড়াতে সমস্যা হচ্ছিলো। জায়ান এসে সাহায্য করলো আরাবীকে। ফ্রেস হওয়ার আগে এই গহনা গাটি খুলতে হবে।

তাই আরাবী সোজা হেটে চলে গেলো ড্রেসিংটেবিলের সামনে।সেখানের টুলে বসে পরলো আরাবী।পাশের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে নিলো।তারপর মাথায় ওড়না খুলে নিলো।খোপাতে কতোগুলো গোলাপ গাথা।এইগুলো ও খুলতে পারবে না।আরাবী তাকালো জায়ানের দিকে।জায়ান আরাবীকেই দেখছিলো।আরাবী মাথা নিচু করে বলে,

-‘ শুনুন।’
-‘ হু?’
-‘ আমায় একটু সাহায্য করবেন?’
জায়ান বিনাবাক্যে আরাবীর কাছে এসে দাঁড়ালো।প্রশ্ন করলো,
-‘ কি সাহায্য বলো।’
আরাবী হালকা আওয়াজে বলে,

-‘ এইযে আমার খোপাতে কতোগুলো ফুল।এইগুলা একটু ছুটিয়ে দিননা। আমি নাগাল পাচ্ছি না।’
জায়ান মৃদ্যু হেসে আরাবীর খোপায় হাত লাগালো।একে একে ফুলগুলো খোপা থেকে তুলে ফেলছে জায়ান।আরাবীও ওর গহনাগাটি খুলছে একে একে।জায়ান ফুল ছুটাতে ছুটাতেই বলে,
-‘ তুমি চুল বাধার সময় হেয়ার সেটিং স্প্রে করো নি?’

আরাবী আয়নায় জায়ানকে একবার দেখে নিয়ে আবারও কানের দুল খোলায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।বললো,
-‘ নাহ, এইগুলা দিলে চুল ন’ষ্ট হয়ে যায়।এমনিতেই আমার এইটুকুনি চুল।শুধু বলেছি বেবি ক্লিপগুলো দিয়ে আটকে দিতে।’
-‘ বেশ ভালো করেছো।’
পরমুহূর্তে আবার বিরবির করে বললো,
-‘ নাহলে দেখা যেতো এই চুল খুলতে খুলতেই আমার বাসর রাত শেষ হয়ে পানি পানি হয়ে যেতো।’
-‘ কিছু বললেন?’

আরাবী আবছা শুনতে পেয়েছে জায়ান কিছু বলেছে।জায়ান মাথা দুলিয়ে কিছু না বুঝালো।সব গহনা খোলা শেষ। আরাবী উঠে দাঁড়ালো।জায়ান গিয়ে আলমারি থেকে একটা প্যাকেট বের করে আরাবীকে দিলো।বললো,
-‘ যাও এটা পরে আসো।এখানে প্র‍য়োজনীয় সব আছে।’

আরাবী মাথা দুলিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।আরাবী প্যাকেটটা খুলে দেখলো সুন্দর একটা সাদা জামদানী শাড়ি।আরাবী হাসলো তারপর দ্রুত ফ্রেস হয়ে শাড়িটা পরে ওযু করে বের হয়ে আসলো।জায়ান আরাবীকে দেখেই বিমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো।মেয়েটাকে এতো সুন্দর লাগে। জায়ান বড় বড় ধাপ ফেলে এগিয়ে গেলো আরাবীর কাছে।আরাবীর অতি নিকটে এসে দাঁড়িয়ে নিষ্প্রভ কণ্ঠে বলে,

-‘ একদম সদ্য ফুটে ওঠা শুভ্রতায় মোড়ানো স্নিগ্ধ কাঠগোলাপ লাগছে।এই রূপে দেখে বিমোহিত হয়ে আমি ম’র’তে রাজি শতোবার, বারবার।’
আরাবীর জায়ানের এইসব আবেগঘন কথা শুনলেই ভালোলাগায় হৃদয়টা রঙিন হয়ে যায়।আরাবী মাথা নিচু করে লজ্জামাখা হাসি দিলো।জায়ানও হালকা হেসে বলে,

-‘ যাও আলমারি জায়নামাজ আছে তা বের করে বিছিয়ে নেও।আমি ওযু করে আসছি।’
আরাবী মাথা দুলিয়ে সায় দিতেই জায়ান মুচঁকি হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো।আরাবীও এই ফাঁকে জায়ানের কথা মতো কাজ করে নিলো।জায়ান ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে সোজা আলমারি খুললো তারপর একটা নামাজের হিজাব দিলো আরাবীকে।আরাবী মুচঁকি হেসে সেটা নিয়ে পরে নিলো।তারপর দুজন একসাথে নামাজের মাধ্যমে তাদের নতুন জীবনের পথচলা শুরু করলো।নামাজ শেষে জায়ান আরাবীকে নিয়ে বিছানায় বসালো।

তারপর আবার চলে গেলো।আরাবী দেখছে জায়ানকে। জায়ান এগিয়ে গেলো আলমারির কাছে। আলমারি থেকে দুটো প্যাকেট হাতে নিয়ে আবার আসলো আরাবীর কাছে।প্যাকেট দুটো নিজের পাশে রেখে।এইবার একটু কাছে আসলো আরাবীর।আরাবী হকচকিয়ে গিয়ে একটু পিছিয়ে গেলো। আরাবীকে অবাক করে দিয়ে জায়ান আরাবীর কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে নিলো।তারপর বিরবির করে কি যেন পড়তে লাগলো।আরাবী অবাক চোখে জায়ানকেই দেখছে।খানিকক্ষণ বাদে জায়ান বিরবির করা থামিয়ে দিয়ে চোখ খুলে তাকালো।তারপর আলতো হেসে আরাবীর মাথায় ফু দিয়ে দিলো।জায়ান এইসব কি করছে বুঝতে না পেরে আরাবী না চাইতেও প্রশ্ন করেই ফেললো,

-‘ এটা কি করলেন আপনি?’
জায়ান আলতো হেসে বলে,
-‘ আমি আল্লাহ্’র বিধান সবটা মেনেই আমাদের নতুন জীবনের পথচলা শুরু করবো ভেবেছি আরাবী।আর এইটাও সেই বিধানের মাঝে একটা।স্বামি তার স্ত্রীর কপালে হাত ধরে একটা দোয়া পাঠ করে তারপর তার কপালে ফু দেয়।’
আরাবী জায়ানের প্রতিটা কাজে বার বার অবাক হয়।এই লোকটা তাকে আর কতো অবাক করবে?এতো ভালো কেন জায়ান? আরাবী মনে হয় ও জায়ানকে পেয়ে যেন পৃথিবীর সব পেয়ে গেছে।জায়ান এইবার পাশে রাখা প্যাকেট দুটো নিয়ে আরাবীকে দিলো।আরাবী জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই জায়ান বলে,

-‘ একটায় তোমার মোহরানা আর একটায় তোমার বাসর রাতের উপহার।’
মোহরানার কথা শুনে আরাবী বলে,
-‘ মোহরানার এতোগুলা টাকা দিয়ে আমি কি করবো?’
-‘ তা তুমি জানো।এটা তোমার হক,তোমার প্রাপ্য।এটা পরিশোধ আমাকে করতেই হবে।আমি তাই করলাম।এখন এই টাকা দিয়ে তুমি কি করবে তা তুমি জানো।’

জায়ানের কথা শুনে আরাবী আর কিছু বললো না।আরাবী মোহরানার প্যাকেটটা পাশে রেখে দিলো।তারপর জায়ানের দেওয়া উপহার খুলে দেখলো।সেখানে একটা কোরআন শরীফ,একটা তবজী, আর একটা জায়নামাজ আছে।আরাবী ভীষণ খুশি হলো।হাসি মুখে বললো,
-‘ অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
জায়ান বলে,

-‘ দেখি হাতটা দেও।’
আরাবী ভ্রু-কুচকে বলে,
-‘ কেন?’
-‘ দেও নাহ।’
আরাবী হাত দিলো।জায়ান সুন্দর একটা ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে দিলো আরাবীকে।অতঃপর বলে,
-‘ পছন্দ হয়েছে?’
-‘ ভীষণ।’
জায়ান হালকা হেসে এইবার উঠে দাঁড়ালো।বললো,
-‘ ওগুলো দেও। রেখে আসি।’

আরাবী মোহরানা গুলো আর উপহার গুলো জায়ানকে দিলো।জায়ান গিয়ে সেগুলো রেখে আসলো। তারপর আরাবীর পাশে আবার বসে পরলো। এতোক্ষণ ঠিক থাকলেও এখন আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না আরাবী।সব তো শেষ নিয়ম। এইবার? এইবার কি করবে জায়ান?

অস্থির আরাবীর গালে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো জায়ান।শীতল হাতের ওই ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠলো আরাবী।জায়ান আরেক হাত আরাবীর কোমড়ে রেখে ওকে একেবারে টেনে নিজের কাছে টেনে আনলো।তারপর কোন কিছু না ভেবেই আরাবীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে। আরাবীর কি হলো কে জানে?ও নিজেও জায়ানকে আঁকড়ে ধরলো।জায়ান আরাবীর চুলের ভাজে চুমু খেলো দীর্ঘ সময় নিয়ে। তারপর কোমল স্বরে বলে উঠে,

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১১

-‘ তুমি আমার অনেক সাধনার আরাবী।আমার একান্ত সবচেয়ে প্রিয় শুভ্রময়ী এক কাঠগোলাপ।’
আরাবী কিছু বললো না। শুধু নিবিড়ভাবে মুখ লুকালো জায়ানের বুকে।এ যেন এক পরম শান্তির স্থান আরাবীর জন্যে।সবচেয়ে নিরাপদ, ভরসাযোগ্য স্থান।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১৩