হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১১

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১১
সাদিয়া জাহান উম্মি

আরাবী আর জায়ানকে মুখোমুখি করে বসানো হয়েছে।তাদের সামনে লাল রঙের ওড়না দিয়ে দেওয়া।যাতে একে-অপরকে দেখতে না পারে।কিন্তু ওড়নাটা পাতলা জায়ান এতে আরাবীকে দেখতে পারছে।কিন্তু সমস্যা একটাই আরাবী ওর সেই সোনালী রঙের ওড়না দিয়ে ইয়া বড় ঘোমটা টেনে বসে।তাই আরাবীর চেহারা দেখতে পারছে না ও।

জায়ান বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ করলো।অবশেষে কাজি সাহেব নিজের কাজ শেষ করে জায়ানের উদ্দেশ্যে কবুল বলতে বলবেন।জায়ান একপলক আরাবীর দিকে তাকিয়ে ফটাফট তিন কবুল বলে ফেললো।এইবার আরাবীর পালা তাকে কবুল বলতে বললো কাজি। কিন্তু আরাবী নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ওর কেন জানি মনে হচ্ছে ও কবুল বললেই ও আর ওর বাবা মায়ের থাকবে না।চিরতরের জন্যে বাবা, মায়ের থেকে আলাদা হয়ে যাবে।আরাবী ক’লিজাটা বোধহয় কেউ চেপে ধরে রেখেছে।বুক ফেটে কান্না আসছে ওর।কিছুতেই মুখ থেকে কবুল শব্দটা বের হচ্ছে না।ভীষণ কষ্ট লাগছে তার।বিশেষ করে ওর বাবা আর ভাইয়ের জন্যে।কাজি সাহেব আবারও কবুল বলতে বললেই।আরাবী ঝরঝর করে কেঁদে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,

-‘ আব্বু, ভাইয়া।আমি কবুল বলবো না।আমি বিয়ে করবো না। আমি তোমাদের ছেড়ে যাবো না।যাবো না।কবুল বলবো না।’
জিহাদ সাহেব মেয়ের কান্না দেখে তিনিও কেঁদে দিলেন।তাড়াতাড়ি মেয়েকে বুকে আগলে নিলেন।ফাহিমেরও চোখজোড়া লাল হয়ে এসেছে।সে চাইলেও কাঁদতে পারছে না।ও কাঁদলে তো হবে না।ওর বাবা আর বোনকে তো ওকেই সামলাতে হবে।আরাবী বাবার বুকে মুখ গুজে চিৎকার করে কাঁদছে।সে কিছুতেই কাঁদছে।ওর একটাই কথা কবুল বললেই নাকি ও চিরজীবনের জন্যে ওর পরিবার থেকে দূরে সরে যাবে। ফাহিম এসে আরাবীর পাশে বসলো।আরাবীর মাথায় রাখতেই আরাবী জিহাদ সাহেবের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তাকালো।ফাহিম দেখেই আবারও ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।

-‘ ভাইয়া,আমি যাবো না ভাইয়া।যাবো না।আমি বিয়ে করবো না।কবুল বলবো না।’
ফাহিম আরাবীকে বুকে জড়িয়ে নিলো।আরাবীর মাথা য় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,
-‘ আচ্ছা আচ্ছা।তুই আগে শান্ত হো দেখি।যাস না তুই।এখানেই থাকিস।ঠিক আছে?আমি যেতে দিবো না।কিন্তু বিয়ে তো করতে হবে তাই নাহ বোন? সবাই নাহলে আমাদের বলবে দেখো দেখো বিয়ের আসরে মেয়ে বিয়ে না করেই চলে গেছে।তখন আমাদের কতোটা খারাপ লাগবে ভাব।জায়ানেরও তো মন খারাপ হবে।’

আরাবী কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।জায়ান শুধু শান্ত চোখে তাকিয়ে আরাবীর দিকে।মেয়েটা কেঁদেকেটে বাবার আর ভাইয়ের বুক ভাসিয়ে দিচ্ছে।অবশেষে প্রায় আধাঘন্টা যাবত জিহাদ সাহেব আর ফাহিম আরাবী বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলো।কিন্তু আরাবীর কান্নার রেশ কমলো না।আরাবী হেঁচকি তুলতে তুলতে কবুল বলে দিলো।সবাই ‘ আলহামদুলিল্লাহ!’ বললো।

তারপর কাবিননামায় জায়ানের স্বাক্ষর নিয়ে তারপর আরাবীর স্বাক্ষর নেওয়া হলো।আজ থেকে জায়ান আরাবী জুড়ে গেলো একে-অপরের সাথে সারাজীবনের জন্যে।স্বামি স্ত্রীর মতো পবিত্র বন্ধনে বাধা পরলো দুজন।আজ থেকে তাদের চিরজীবনের জন্যে একে-অপরের হাত রেখে সকল বিপদ-আপদের মোকাবেলা এগিয়ে যাওয়ার পথ পারি দেওয়া শুরু হলো।

আজ থেকে তারা একে-অপরের পরিপূরক। অবশেষে সকল নিয়ম-রিতি শেষ করে বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেলো।আরাবী ওর বাবা আর ভাইকে খামছে ধরে আছে।সে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না যাওয়ার জন্যে।কান্না করতে করতে একটা কথাই বলছে,
-‘ আমি যাবো না।যাবো না আমি।আব্বু,ভাইয়া তোমরা তো বললে আমায় যেতে দিবে না।তাহলে এমন কেন করছো?যাবো না আমি।’

জিহাদ সাহেবও কাঁদছেন।তিনি আরাবীর হাত জায়ানের হাতে তুলে দিয়ে।কান্নারত গলায় বলেন,
-‘ আজ থেকে আমার মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিলাম বাবা।আমার মেয়ের খেয়াল রেখো।কখনো ওকে কষ্ট দিও না। সহ্য করতে পারবো না।’
জায়ান আরাবীর হাতটা শক্ত করে ধরলো।দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
-‘ এইযে ধরলাম আর ছাড়ছি না।সারাজীবন ওকে আগলে রাখবো।কথা দিলাম আব্বু।’
জিহাদ সাহেব কান্নায় পুরোপুরি ভেঙে পড়লেন।নিহান সাহেব বলেন,

-‘ জিহাদ সাহেব কাঁদবেন না।ইনশাআল্লাহ আপনার মেয়েকে আমি আমার মেয়ে করেই রাখবো।আমার নূর যেভাবে থাকে আরাবী মাও সেইভাবেই থাকবে।কাঁদবেন নাহ।’
জিহাদ সাহেবকে লিপি বেগম ধরে রাখলেন।ফিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। তার বেশ ভালোই লাগছে।আরাবীকে একটা মুসিবত মনে হয় ওর।ভালোই হবে ও বিদায় হলে।ভাবলো ফিহা।

এদিকে আরাবী জায়ানের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ফাহিমের কাছে গিয়ে ওকে ঝাপ্টে ধরে।শক্ত করে ধরে রেখেছে।আদরের বোনকে এইভাবে কাঁদতে দেখে নিজেকে আর শক্ত রাখতে পারলো না ফাহিম।ওর চোখ দিয়েও গড়িয়ে পরলো একরাশ কষ্টের অশ্রু। আরাবী বলছে,
-‘ ভাইয়া আমি যাবো না।তোমরা আমাকে পাঠিয়ে দিও না ভাইয়া।আমি থাকতে পারবো না ভাইয়া।এমন করো না আমার সাথে।’

ফাহিম আরাবীকে বুকে নিয়েই আগাচ্ছে।ওর আরাবীকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছে,
-‘ আজ একটু যা আরাবী।এইতো কালই আমরা আসছি। তোকে কালই নিয়ে যাবো।ভাব তুই বেড়াতে যাচ্ছিস।একটা রাতই তো।’
-‘ নাহ, যাবো না। যাবো না আমি।’

ফাহিম ইশারা করলো জায়ানকে। জায়ান ইশারা বুঝতে পেরে আরাবীকে টেনে ফাহিম থেকে সরিয়ে আনলো আরাবীকে কোলে তুলে নিলো একঝটকায়।আরাবী ওর হুশে নেই। সে এককথাই বলছে। ও যাবে না।জায়ান কোলে নেওয়ায় জায়ানকে খামছি,কিল,ঘুষি সব দিচ্ছে।একসময় আরাবী ক্লান্ত হয়ে নেতিয়ে পরলো জায়ানের বুকে।তবুও ওর চোখ থেকে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে।ফাহিমের কষ্ট বুক ফেটে যাচ্ছে।জায়ান ফাহিমকে আশ্বাসবাণী দিলো,

-‘ কান্না করো না।ইনশাআল্লাহ তোমার বোনকে রানি বানিয়ে রাখবো।কোন কষ্টকে তাকে ছুতে দিবো না।’
ফাহিম মাথা দুলাতেই জায়ান আরাবীকে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।নূর এইবার এসে ফাহিমের সামনে দাড়ালো।নূরও কাঁদছে এটা ভেবে এভাবে তো ওকেও একদিন চলে যেতে হবে ওর পরিবারকে ছেড়ে।তাই আরাবীকে দেখে নিজেও আর কান্না থামাতে পারেনি।নূর কান্নারত স্বরে ফাহিমকে বললো,

-‘ আপনি কাঁদবেন না।আমি ভাবির খেয়াল রাখবো।কোন চিন্তা নেই।ভাবির যখন মন চাইবে ভাবিকে এখানে নিয়ে আসবো।ভাইয়া নিয়ে না আসলেও আমি নিয়ে আসবো।আর আপনার যখন মন চাইবে আপনিও আমাদের বাড়ি এসে যাবেন।কাঁদবেন না।আপনি কাঁদলে আংকেলকে কে সামলাবে।’

নূর চলে গেলো।ফাহিম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নূরের যাওয়ার পাণে।মেয়েটা কি সুন্দরভাবে তাকে বুঝ দিয়ে গেলো।একটু আগেও না কিভাবে বাচ্চাদের মতো লাফালাফি করছিলো।আর এখন কেঁদেকেটে অস্থির।জায়ানদের গাড়ি চলতে শুরু করলো।ফাহিম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।মনেপ্রাণে দোয়া করলো যাতে তার বোনটা সুখে থাকে আজীবন।

মাইক্রোবাস নিয়েছে জায়ান’রা। ড্রাইভারের সাথে জায়ানের এক কাজিন বসেছে।তারপর বসেছে জায়ান আর আরাবী।তার পিছনে নূর আর ইফতি আর তাদের আরও একটা কাজিন।জায়ান আরাবীকে বুকে নিয়ে বসে আছে।অতিরিক্ত কান্নার কারনে মাথা ব্যাথায় ঝটফট করছে আরাবী।তাও ওর কান্না থামছে না।এখনো জায়ানের বুকে নিস্তেজ হয়ে আছে।জায়ান এইবার আরাবীর গালে হাত রেখে উদ্বিগ্ন গলায় বলে,

-‘ হয়েছে তো।আর কাঁদেনা।কালই তো নিয়ে আসবো তোমাদের বাসায়।’
আরাবী জায়ানের বুকের কাছটায় খামছে ধরলো।জায়ান পকেট থেকে রুমাল বের করে আরাবীর চোখের জলগুলো মুছে দিলো।কিন্তু লাভ কি আবারও গড়িয়ে পরছে তা আপনগতিতে।জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো।মেয়েটার চোখের এক একফোটা পানি তার কলিজায় ছু’রির ন্যায় আঘাত করছে।কিন্তু করার কিছু নেই। এইটাই প্রকৃতির নিয়ম।আদি যুগ থেকে এটাই হয়ে আসছে। জায়ান এইবার হাতের সাহায্যে আরাবী চোখের পানি মুছে দিলো।মাথাটা নিচু করে আরাবীর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

-‘ কাঁদে না তো আর।তুমি যখন চাইবে আমি তখনই তোমায় তোমাদের বাড়ি নিয়ে আসবো। এতো কান্না করলে অসুস্থ হয়ে পরবে আরাবী।এইভাবে চোখের জলগুলো ফেলে আমার বুকের দহন বাড়িয়ে দিও না।’
আরাবী জায়ানের বুকের কাছে যেই হাতটা দিয়ে খামছে ধরেছিলো সেই হাতের উপর হাত রাখলো জায়ান।একইভাবে আবার বলে,

-‘ কাঠগোলাপের অশ্রুসিক্ত চোখজোড়া আমার হৃদয়ের পীড়া যে বাড়িয়ে দেয় তা কি সে জানে নাহ?এইভাবে কাঁদলে তো বুকের ভীতরটা ঝাঝ’ড়া হয়ে যায়। কাঠগোলাপের চোখে অশ্রু না।তার ঠোঁটে মুক্তজোড়া অমায়িক হাসিই বেশি সুন্দর লাগে।’

আরাবী কান্না থেমে গেলো জায়ানের এতো আবেগঘন কথা শুনে।বুকের ভীতরটা শীতলতায় ছেঁয়ে গেলো।হৃদস্পন্দন বেরে গেলো।মিইয়ে গেলো আরো জায়ানের বুকের মাঝে।জায়ান হাসলো তা দেখে।তারপর আরাবীর ঘোমটার উপরেই চুমু খেয়ে বিরবির করলো,
-‘ অবশেষে আমার অপেক্ষা শেষ হলো।তুমি আমার।শুধুই আমার। আমার কাঠগোলাপ।আমার বউ।’

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১০

ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন কেমন হয়েছে জানবেন।মাইগ্রেনের ব্যা’থা কমার নাম নিচ্ছে না। অসহ্য ব্যা’থা।লিখলাম তাও।ছোট হয়েছে বলে আমাকে লজ্জা দিবেন না।আমি অসুস্থ্য এটুকু বুঝবেন আশা করি।

হৃদয়াসিক্ত কাঠগোলাপ পর্ব ১২