যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৭

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৭
মুন্নি আক্তার প্রিয়া

শুনশান নিরবতা যেন ভর করেছে চৌধুরীর বাড়ির আঙিনায়। চতুর্দিকে মেহমান, আত্মীয়স্বজনের এতটুকুও কমতি নেই; তবুও রয়েছে নিরবতার সঙ্গ। হুট করেই বর এবং হাসিব, আহিল ওরা উধাও। কোথায় গেছে না গেছে কাউকেই কিছু জানানো হয়নি। এদিকে হলুদের অনুষ্ঠানের শুরু হলে বলে। চারপাশে চাপা গুঞ্জন।

‘বর কি তবে আবার পালাল নাকি?’
এমন গুঞ্জনে জহির চৌধুরীর মেজাজ চড়ে যায়। চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। তার ছেলেকে নিয়ে এমন বিরূপ মন্তব্য সহ্য করা তার ধাতে অন্তত নেই। তথাপি প্রশ্ন তবুও রয়েই যায়, দুই ভাই আর বন্ধু মিলে গেল কোথায়? তিনি লাগাতার আহনাফের ফোনে কল করে যাচ্ছেন। রেসপন্স না পেয়ে আহিল এবং হাসিবকেও কল করলেন। তবে লাভের লাভ কিছুই হলো না। এবার দুশ্চিন্তায় তিনি রীতিমতো ঘামছেন। ছেলেগুলো গেল কোথায়?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুনসহ বাকি মেয়েরা নিস্তব্ধ, নির্বাক চাউনিতে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। লামিয়া দু’গালে হাত রেখে বলে,
“হায়ে! তোকে কী সুন্দর লাগছে রে অর্ষা! আজ তো দুলাভাই একদম পাগল হয়েই যাবে।”
মুন বলল,
“উঁহু! আজ নয়। কাল। দুলাভাই আজ দেখবে কী করে?”

“কীভাবে আবার! ভিডিয়ো কলে। এত সুন্দর হলুদকন্যাকে যদি দুলাভাই আজ দেখতে না পারে তাহলে তার হলুদ সন্ধ্যাটাই বৃথা যাবে বুঝলে?” বলল রেশমি।
জুঁই ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল,
“ঠিক কথা। নে ভাইয়াকে একটা কল কর তাহলে।”

অর্ষা বাঁধা দিতে গিয়েও দিল না। উহ্য রইল, পারল না। সে আগের চেয়ে স্বাভাবিক হলেও পুরোদমে হতে পারেনি। ঠিকমতো কথা বলতে পারে না। তার কণ্ঠস্বরের গতি শ্লথ হয়ে আসে। চিনচিনে ব্যথাটা বুকে এখনও হয়। তার দরুণ সে এবারও চুপ করে রইল। রেশমি বার দুয়েক চেষ্টা করেও আহনাফকে কলে পেল না। শেষে বিরক্ত হয়ে বলল,
“কিরে তোর জামাই কি হলুদের নিচে পড়ছে নাকি?”
অর্ষা ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,

“কীসব কথা বলিস!”
“তাহলে আর কী বলব? এতগুলো কল দিলাম। একটাও ধরছে না।”
লামিয়া বলে,
“আহিল ওদের দিয়ে দেখ। দুলাভাই হয়তো ফোন সাথে রাখেনি।”
আহিলকে ফোন করার পূর্বেই সকাল রুমে এসে উপস্থিত হলো। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আপুকে স্টেজে নিয়ে যেতে বলেছে।”

পূণরায় আর কাউকেই ফোন করা হলো না। স্টেজে গিয়ে না হয় পরে ট্রাই করা যাবে ফের। সবাই এখন সাবধানে অর্ষাকে নিয়ে যাচ্ছে। গায়ে হলুদের স্টেজ বাড়ির উঠানেই বানানো হয়েছে। ওদের পক্ষের মেহমানের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। তবুও বিশাল আকৃতির উঠান মানুষে মানুষে এখন গিজগিজ করছে। বাড়ির চতুর্দিকে ঝাড়বাতির ঝিকিমিকি আলো। স্টেজে ফুলের বাহার।

অর্ষার রুম থেকে বেরোনোর প্রয়োজন হয়নি বলে সে এত সুন্দর করে সাজানো নিজের বাড়িটা লক্ষ্যই করেনি। তবে এতটুকু সে শুনেছিল, রুহুল নিজে লোক সাথে নিয়ে পুরো বাড়ি সাজিয়েছে। ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসার জানান দিতে গিয়ে তার চোখ ছলকে পানি বের হতে চাইছে। পুরনো ক্ষত, বাজে অতীত এবং সেদিনের দুর্ঘটনা ছাপিয়ে গেছে এখন রুহুলের ভালোবাসা। সে সমস্ত খারাপ ঘটনা ভুলে গেছে এক সেকেন্ডেই।

মনের ভেতর অনুভব করছে এবার অন্য ক্লেশের উপস্থিতি। আগামীকাল বিয়েটা হয়ে গেলেই সে হয়ে যাবে অন্য বাড়ির বউ। চিরপরিচিত তার এই বাড়িটাকে, বাড়ির মানুষগুলোকে ছেড়ে যেতে হবে। অর্ষা নিজেকে আর সামলে রাখতে পারল না। তার কাজল কালো সুন্দর আঁখিদ্বয় থেকে দু’ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার কোমল, পেলব গাল পেয়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরে সে কান্না আটকানোর চেষ্টা করল। স্টেজে তার দুইপাশে বান্ধবীরা বসে আছে।

অর্ষা একবার চোখ তুলে সামনে তাকাল। এত মানুষের উপস্থিতিতে কিছুটা অস্বস্তিবোধও করছে সে। ক্যামেরাম্যান এসে উপস্থিত হয় তখন। জানতে পারে এদেরকে রুহুলই এনেছে। তারা এখন অর্ষাকে দিয়ে নানানরকম পোজ দেওয়াচ্ছে আর ছবি তুলছে। এর মাঝেই সে বান্ধবীদের সঙ্গে উদ্ভট ছবির পোজ দিতে গিয়ে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে শব্দ করে হেসেও ফেলে। ওমর রহমান,সেলিনা বেগম দূর থেকে দেখে চোখের পানি ফেলেন। আহা, সময়! রাত পোহালেই আগামীকাল মেয়েটা তাদের ছেড়ে যাবে। বুকে পাথর বাঁধতে চেয়েও তারা বারংবার দুর্বল হয়ে পড়ছেন। চোখের পানি যেন বাঁধ-ই মানতে চাইছে না কোনো। আচ্ছা মন এত দুর্বোধ্য বেহায়া এবং অবাধ্য কেন? কেন চাইলেও মন নামক বস্তুটাকে কোনোভাবেই মানানো যায় না!

মুন, লামিয়া, জুঁই, রেশমি আর সকাল একসাথে মিলে নাচবে। গায়ে হলুদের আগের দিন রাতেই রাত জেগে সবাই ড্যান্স প্র্যাকটিস করেছিল। “তেরে লিয়ে সাজনা ইয়ে চুড়ি কাঙ্গনা” গানেই ড্যান্স কভার করবে ওরা। মাঝখানে এজন্য সুন্দর করে সাজিয়েছে রুহুল। পাঁচজনের নাচ শেষ হলেই হাত-তালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো বাড়ি। ওরা ক্লান্ত হয়ে অর্ষার পাশে এসে বসে। রুহুল পানির বোতল এনে দিল। রুদ্ধশ্বাসে সবাই পানি শেষ করে হাফ ছেড়ে বসতে না বসতেই হঠাৎ করে বাড়িতে শোরগোল শুরু হয়ে যায়।

অর্ষাসহ বাকিরা সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনা কী! রুহুল নিজে বাইরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখনই আহনাফ, আহিল, আশিক, দিদার আর আদিবকে দেখতে পায় সবাই। আহনাফ হাসিহাসি মুখ করে অর্ষার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার এদিকের বাকিরাও জোরে চিৎকার করছে আর শিষ বাজাচ্ছে। অর্ষা তাকিয়ে রয়েছে ভূত দেখার মতো। এতটা সারপ্রাইজড হয়েছে যে, সেটা সে রিয়াকশন দিয়েও প্রকাশ করতে পারছে না।

আনন্দে চোখের কোণে ফের জমা হয়,দু’ফোটা অশ্রু। সে পারিপ্বার্শিক দিক এবং সমস্তটা বেমালুম ভুলে গিয়ে বসা থেকে উঠে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে। আহনাফ হেসে ফেলে। অর্ষাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৬

“আয় হায়! আমার প্রজাপতিটা কি আমায় এতটাই ভালোবাসে যে বাবা-মা, ভাই-বোন, ফ্রেন্ডস এমনকি এত মানুষ থাকা সত্ত্বেও সমস্ত কিছুর পরোয়া না করেই আমায় জড়িয়ে ধরেছে?”
অর্ষা কিছুই বলল না প্রত্যুত্তরে। শুধু চুপচাপ পড়ে রইল আহনাফের বুকের মাঝখানে।

যেদিন তুমি এসেছিলে সিজন ২ পর্ব ৩৮